পরিণতির মুখে
প্রতীক মিত্র
ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম। ফোন দেখেও যে সময় কাটাবে তারও জো নেই।টাওয়ারই মেলে না। অথচ এই প্ল্যাটফর্ম থেকে পনের-বিশ কিলোমিটার গেলেই বেশ ঘন বসতি।এখানে চট করে কোনো ট্রেনও থামে না।সিগন্যালে গলতি-টলতি হলে সেটা আলাদা বিষয়। তেমনই একটা কিছু হয়ে থাকবে। ওর ইচ্ছে ছিল না। একদমই ছিল না।
কিন্তু তনিমার শেষ ওয়াট্সঅ্যাপ মেসেজে এই জায়গাটার কথাই বলা ছিল। অগত্যা ও এখানে। তনিমার সাথে ফোনাফুনি ইত্যাদির তাও মাস ছয়েক হল। প্রথম প্রথম ও এইসব জিনিস একদম গায়ে মাখতো না। তারপর উদাসীনতা, বিরক্তি, প্রতিহিংসা, একাকিত্ব, বিষাদ সমস্ত পর্ব একে একে মিটে গেলে ও বুঝতে পারে তনিমার ব্যাপারটা আর ওর হাতে নেই। ও জড়িয়ে গেছে সেখানে না চাইতেও। প্রথম প্রথম এটা ও বুঝেই ফোন ধরতো যে কেউ চেনা এইসব ফাজলামি করছে।তারপর ধীরে ধীরে কোন কালে যে এই তনিমা(নামটাই নকল কিনা কে জানে?)র প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেল। ও বুঝতে পারতো দুর্বলতাটা আসলে ওরই নিজের। এটাও বুঝতে পারতো তনিমা নিজেও সেটা ক্রমেই ধরে ফেলছে। অবশ্য তনিমার বিনয়ী শান্ত স্বভাবের জন্য ও আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ছিল ওর সাথে। তানিয়ার ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজ হোক কিম্বা ভিডিও হোক সবেতেই একটা শান্ত স্নিগ্ধতার ছাপ ছিল। অবশ্য ওর সেটাতেও সন্দেহ ছিল যে যে ছবি বা ভিডিও তনিমা ওকে ওর বলে পাঠাতো সেটা আদৌ হয়তো ওর না। যাজ্ঞে ওর শেষমেশ অতি মাত্রায় গুঁইগাঁই করার ফলে তনিমা শেষমেশ ওর সাথে সশরীরে দেখা করতে রাজী হয়।এই সাক্ষাৎকার এর আগেও হওয়ার কথা ছিল। হয়নি।তনিমাই কাঁচি করে দিয়েছে। এবারেরটা কলকাতা থেকে এতদুরে উত্তরবঙ্গে এইসব জংলী জায়গায় হওয়ার কারণ তনিমার নাকি এখানে আত্মীয়ের বাড়ি। ও জানতো এটাও মিথ্যে কথা কিন্তু তবু গিলে নিতে বাধ্য হয়েছিল এই ভেবে যে গোটা বিষয়টা একটা যদি পরিণতি পায়। নয় নয় করে ওর বয়সও তিনের কোঠায় ঢুকে পড়েছিল চুপিচুপি। কাজ ব্যস্ততা সামাজিকতা সব কিছু সামলে বিয়ের বিষয়ে একটু বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল। তারপরই কোন ফাঁকে যে এই তনিমা চলে এলো। সশরীরে এলো বলা ভুল এল এই রকম একটা মায়া , একটা দুর্বলতা, মুদ্রাদোষ, উন্মাদনা, অসঙ্গতি হয়ে। কতগুলো বিনিদ্র রাত যে কেটেছে ওর তনিমাকে একা একা কামনা করে! আজ সেই সমস্ত প্রতীক্ষার, দ্বিধার, ধোঁয়াশার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। এই স্টেশনে নাকি ছোটোবেলায় তনিমা সাইকেল করে এসেছে ওর মামাদের সাথে।ওর নাকি ওই স্টেশন ভালো লাগবে। জঙ্গল, পাহাড় সব মিলে প্রাকৃতিক সম্ভারে মন ভরে যাওয়ার কথা। ওর আর এইসব ভালো লাগে না। এবারেও যে ও ঠকবে এবং ঠকছে সেটা মেনে নিতে মোটেও পারছে না।ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ কিছু করার নেই অপেক্ষা ছাড়া।কিন্তু কতক্ষণ? কালেভদ্রে একটা-আধটা গাড়ির আওয়াজে দৃষ্টি ওর এদিক-সেদিক হয় বটে কিন্তু পরক্ষণেই বিরক্তির পানায় ডুবে যায় সমস্ত মনোযোগ, বোধ। ও বসে থাকে।অস্থিরতা ক্রমে শিথিল হয়ে আসে।শুকনো পাতা আশপাশে ওর জড়ো হতে থাকে।ওর ঢুলুনি আসতে থাকে। ও দেখতে পায় একটি মেয়ের অবয়ব। অন্তরঙ্গ একটি পুরুষের সাথে।পুরুষটি কি ও নিজে?তারপর কে যেন বলে ওঠে 'তোমার নামও আসলে সংবর্ত নয়?তুমিও শেষমেশ মিথ্যে বললে? কিন্তু এই যে আমি এলাম।এইতো দেখছো!তবুও কি তোমার এত অবিশ্বাস?' ওর ঘুমটা ভেঙে যায়। স্টেশনে গাছেদের সারিতে অসময়ে অন্ধকার নেমে আসে।ঠান্ডাও লাগতে থাকে।কোথায় কেউ?তনিমা?ওর সঙ্গী হিসেবে থেকে যায় ওরই একাকিত্ব।
=======================
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর-712235, পশ্চিমবঙ্গ