লাগ ভেল্কি লাগ
প্রদীপ কুমার দে
লাগ ভেল্কি লাগ,
লাগ,লাগ,লাগ, লাগ...
সফিকুল পা দিয়ে মাটিকে কামড়ে ধরে, দঁড়ি টেনে ধরে রাখে একপ্রান্তে, অন্যপ্রান্তে তার দশ বছরের পুত্র আব্দুল, হাতে ডুগডুগি বাজায় বাপ, ছেলে আব্দুলের ঠোঁটের চাপে কলকলিয়ে ওঠে প্লাস্টিকের বাঁশি, উত্তেজিত দর্শকদের লাগামহীন কৌতূহলোদ্দীপক চাউনির মাঝেই একহাতে ধরে রাখা একটা বাঁশে পা দিয়ে, লকলকে রোগাটে শরীরে উঠতে চায়, রঙচটা সিল্কের হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা শাড়ি টেনেটুনে তুলে দুধারে দুটি লম্বাকৃতির স্তনের মাঝামাঝি পেঁচিয়ে নিয়ে তা আবারও পিছন ঘুরে কোমড় কামড়ে, যুবতী রামিতা তরতর করে ভল্ট খেয়ে ঝুলন্ত দঁড়িকে পা দিয়ে মারায়, দুপায়ে লাফিয়ে ওঠে আবার নামে, দঁড়ি ধরে এগোয়, ততোক্ষণে স্বামী পুত্রের দঁড়ি দুদিকের দুই খুঁটি ধরে ফেলেছে, ছেলের বাঁশি ওই যুবতীর মুখে বসে যায় আর এক হাতে কঞ্চি উঠে আসে, সোয়ামীর দেওয়া মাটির কলস শিরে চড়ে আর অন্য হাতে তারই সেই ডুগডুগি বাজে, প্রগাঢ় নিশ্চয়তায় লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে চলে রামিতা, রজ্জুর এপ্রান্ত ছেড়ে অন্যপ্রান্তে।
হাততালি আর শিসে ভরে ওঠে ভাঙামাঠ, টুং টাং শব্দে জাগে এলুমিনিয়ামের পুরোনো থালা, পকেট হাতরিয়ে অনেকে খোঁজে কমের কয়েন, আর বেশিরভাগই দারুণ, অসাধারণ বলে চটজলদি ভীড় ভাঙে, খেলা শেষের আগেই শেষ করে দেয় বুদ্ধিমানেরাই, কেটে পড়ে ভেগে পড়ে বাঘমামা নিজেই সব কিছু জান্তে।
খেলা তখন অনেক বাকি। শুরুতেই মার দিয়া কেল্লার মত ভল্টবাজি ছাড়াও ট্রপিজের অনেক খেলা সব্বাইকে কাত করে মাত করে দিয়েছে বটে কিন্তু চালাক সচেতন দর্শক অধিকাংশ শুন্যে হারিয়ে গেছে। খেলা চলে তাও। অনেক সার্কাসের খেলা, লিকলিকে শরীরকে ভেঙে মুছড়ে চৌচির করে দেয় রামিতা। রোগা অপরিচ্ছন্নতায় তার কর্কশ দেহও লাফায়, মুখ আর বুকের সৌন্দর্য্য ফুঁটে ওঠে, রঙমরা শাড়িতে তার দেহ যখন পাল্টি খায়, তার শৈল্পিক সৃষ্টি যত দৃষ্টিনন্দনই না হোক তার অনাবৃত শরীরের শোভা প্রকটিত হয় অনেক বেশী করে সবার চোখে।
রামিতার কর্কশ অবয়ব ক্লান্তিহীন। লড়তে জানে। গায়ে মাংস নেই ঠিকই কিন্তু শক্তির আধার। নারী শক্তির প্রকাশ তার কর্মে। লড়তে জানে প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে। জীবনে কোন জিনিস তার আয়াসসাধ্য ছিল না। অভাবে পেট ভরেনি, লেখাপড়া তো বহুদূর। গো মাংস সস্তায় তার শরীরে শক্তি জুগিয়েছে যা তাকে তার শরীরের বিনিময়ে তার জাত ভাইদের নিত্যদিনের কামোদ ক্ষুধা মেটানোর জন্য তাকে ভোগের সাথী হতে হয়েছে। দাওয়াই নিতে হয়েছে অনেক। রোজগারের নিমিত্ত বাড়িতেই দেহ বিক্রি করতে হয়েছে। এ তাদের পরিবারের এক রীতি। এই বংশে কুমারী মেয়ে ঋতুমতী হলেই তাকে তার পরিবারের গুরুজনেরাই প্রথম ভোগ করে, পরবর্তীতে ঐ নারীই ভোগের প্রসাদ হয়ে অন্যের সুখের তরে দোকান লাগায় আর তার আয়ের গুড় গুরুজনেরাই পিঁপড়ে হয়ে খায়।
সফিকুল নিয়মিত বারোমাসের খরিদ্দার ছিল। মন ভাল। শরীরের চাহিদামতো রামিতাকে খাদ্য বানাতো পয়সা দিয়েই। অসাবধানতাবশত পেটে সফিকুলের বাচ্চা এসে যায়। রামিতা সফিকুলকে খুশির শেষ জানায়,
-- তোর কারণে আমার পেট ভরলো যে রে?
সফিকুল লাফিয়ে ওঠে,
-- এ কেমন কথা?
-- সত্যি বলছি। তুই প্রোটেকশন না নেওয়ার ফল।
সফিকুল নারাজ,
-- ভাল করে দেখ এটা অন্য কার?
-- অন্য সবাই প্রোটেকশন নেয়। দেখার কি আছে, আমি কি বুঝি না এ কার ওরস।
-- আমি পয়সা দিই। প্রোটেকশন কেন নেবো?
-- ভালো তো এবার বিদেয় হ। আমি যে পয়সা নিয়েছি এবার তাই দিয়ে খালাস করি।
সফিকুল আশংকায় দুশ্চিন্তা গিলে খেয়ে নেওয়ার অবস্থায়, উগরাতে পারে না। সে ভালই জানে পয়সা দিয়ে বেশ্যাভাড়া করে তার কর্মের ফল নেওয়ার দায়িত্ব তার উপর বর্তায় না। কিন্তু মানুষ হিসাবে সফিকুল ভালো, হয়তো সে নিত্য রামিতার কাছে গিয়ে সুখ খুঁজতো তদাপি বেশ্যা রামিতার প্রতি তার একটা দুর্ব্বলতা ছিল। ঠিক বেশ্যালয়ের খরিদ্দার হিসাবেই সফিকুল রামিতাকে ব্যবহার করতো না, ব্যবহার করতো একান্ত নিজের কেউ ভেবেই। রামিতাকে সফিকুল নিজের বউ ভাবতো আর তাকে যে অর্থ প্রদান করতো তা তার জীবিকা নির্ধারণের জন্যই।
দুদিন পর সফিকুল ফিরে আসে রামিতার কাছে। মাথা পরিস্কার। পরিস্থিতিতে সে নিজেই নিজের বিচারক,
-- রামিতা এদিকে আয় তোর সাথে কথা আছে,
মুখ বেঁকিয়ে হাসে, হাড় লিকলিকে রামিতা। শরীরের মধ্যে তলপেট সামান্য উঁচুতে। পেটে কাপড় টেনে মুখ খোলে,
-- কথা? তুই তো কাজের?
-- আজ কাজ করতে আসা নয় ....
-- বেশ্যার কাছে সবাই কাজ করতেই আসে
-- আমি বেশ্যার কাছে আসিনি, তুই ঠিক সে জাতের বেশ্যাও নয়। তোর গুরুজনই তোকে দিয়ে তাদের খিদা মেটায়। হ্যাঁ আমিও খিদে মেটাতেই এসেছিলাম, মিটয়েওছি, কিন্তু কেন জানিনা তোকে খুব ভালো লেগে গেছে নেশাগ্রস্ত আমি তোর জন্য। যখন জানলাম তোর পেটে আমারই বাচ্চা, তখন ফিরে এলাম ....
-- ভালো করেছিস নাগর আমার। আমারও পয়সা লাগবে এটাকে নষ্ট করতে।
-- থাম তুই হারামজাদী। নষ্টের কথা মুখেও আনবি না। আমি তোকে শাদি করে নেব। তোর বাচ্চার বাপ হবো আমিই।
-- মাল খেয়ে এসেছিস? আমাকে নিয়ে শুয়ে ঠান্ডা হয়ে নে ঘোর কেটে যাবে...
-- বাজে বকিস না, ফকিরের কাছে চল নিকাহ করে নেব।
রামিতা হেসে ফেলে, ব্যঙ্গাত্মক চাউনি,
-- কবে?
-- আজই, এখনই।
রামিতার দুচোখে স্বপ্নজাল। চোখেমুখে হঠাৎই এক ঝিলিক রঙমশালের বিচ্ছুরিত উচ্ছ্বাস।
সফিকুল সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, রামিতাকে বুকে টেনে নেয়, কপালে চুমা দেয়। রামিতা সফিকুলকে টেনে চৌকিতে নিতে চায়, সফিকুল রামিতাকে কোলে তুলে ওর পেটে মাথা ঘোষে,
-- ওরে বাপ আমার!
রামিতা পাল্টায়। সেও যেন নেশাগ্রস্ত। অন্ধকার গলি থেকে রাজপথ একটা সরু আলোর সুতো সে দেখে। নিমেষে হারিয়ে যায়। বুকের ভিতর কি যেন তোলপাড় করে, সফিকুলের হাত ধরে, সেই এখন তার এটাই একমাত্র ভরসা।
সে রাতেই সফিকুল রামিতাকে নিয়ে ফকিরের কাছে গিয়ে শাদি করে, রামিতা কোন বাঁধা দেয়নি,,সে যে তার গুরুজনদের তার শরীর আর কামাইয়ের অর্থ থেকে বঞ্চিত করে প্রথম ভেল্কি দেখিয়ে দিল, বড় খুশী হয় সে।
সফিকুল আর রামিতার পুত্র সন্তান সাদরে পৃথিবীর মুখ দেখলো। রামিতা কোনদিনই ভাবেনি যে সে তার জন্মগত অধিকার থেকে শুধুই লাঞ্ছনা পেয়ে যাবে আর যে ছিল তার শরীরের পয়সা ফেলা খরিদ্দার সে তাকে এতবড় মর্যাদা দেবে।
ছেলে চারবছর হলে রামিতা বায়না ধরে,
-- আমি তোর সাথে খেলা দেখাবো।
-- কেন?
-- আমি তোকে সাহায্য করবো আমার ইচ্ছে।
-- তুই আমার ঘরের লক্সিমি, বাইরে কেনে যাবি?
-- তুই আমায় কি ভাবিস?
-- তোকে আজও ভালোবাসি।
-- এত বছর পরেও? তোর আমায় ঘেন্না হয় না?
-- না তুই আমার বিবি। তুই আর আব্দুল আমার জান।
রামিতা কেঁদে ফেলে। তার পরিবারের কথা মনে আসে আর সফিকুলকে দেখে। কত ফারাক! মানুষে মানুষে ! কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল আমূল পরিবর্তন এসে গেল তার জীবনে। নিজের ভালোবাসার সংসার পেয়ে গেল সে। আল্লাহর অশেষ মহব্বত।
কিন্তু বিপদ অন্য বিষয়, তা বলে কয়ে আসে না। আগে সফিকুল বাঁদর নিয়ে খেলা দেখাতো। একদিন পথধারে খেলা দেখানোর পর ঘোছগাছ শেষের সময় একটি প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা দেয় তাকে। বাঁদর দুইটি মারা যায় , সফিকুল প্রানে বাঁচে তবে একটি পা হাঁটুর নিচে থেকে বাদ যায়।
অকাল অভাব ফিরে আসে। ঘরে ছেলে আর স্বামী তার যে বড় আপনজন! কি করবে সে? ভেবে কুলকিনারা হারায়। সে কি তবে ফিরে যাবে তার জানা দেহ ব্যবসায়?
হার মানে তার দুশ্চিন্তা এগিয়ে আসে ধাক্কা দেওয়া সে গাড়ির মালিক, প্রতিবেশীদের দাবিতেই। সফিকুলের নকল পা জুড়ে যায়। অতো সহজে নয়, অনেক কষ্টের। সেই সময় অনেক সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে তাদের বাঁচাতে। ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হতেই রামিতা সফিকুলের সহযোগী বন্ধুর সাহায্যে সেই ট্রপিজের খেলা আয়ত্তে আনে, স্বল্পকালে অনায়াসাদ্যে, শুধুমাত্র তার রোগাটে চেহারার খাতিরেই।
বছর খানেক বাদেই ফের মাঠে নামে তারা তিনজন। ট্রপিজের নানান খেলায় ততদিনে রামিতা পারদর্শিনী হয়ে উঠেছে। সফিকুল নকল পায়ে ডুগডুগি বাজিয়ে দঁড়ি টেনে রাখে ওপারে থাকে তার প্রান আর দঁড়ির মাথায় চড়ে মাচে তার জান! আল্লাহর মেহেরবানি দুধারে দুই শক্ত মানুষের হাতে ধরা রজ্জুর উপর নিশ্চিত ভরসা করে রামিতা মাথায় কলস চড়িয়ে, একহাতে লাঠি অন্য হাতে ডুগডুগি বাজিয়ে হেঁটে চলে আবার দর্শকদের খুশি করতে সব নাবিয়ে ডিগবাজি খায়, আর ততোধিক আনন্দে ডুগডুগি বাজায় সফিকুল প্লাস্টিকের বাঁশীতে আওয়াজ তোলে তাদের বেটা আব্দুল আর ততোধিক আনন্দে সফিকুল মুখে আওয়াজ তোলে,
-- লাগ ভেল্কি লাগ, লাগ,লাগ, লাগ!
-------
PRADIP KUMAR DEY
Birati Housing Estate
LIG - 9
M.B.ROAD.
NIMTA
KOLKATA - 700 049
West Bengal
INDIA