অণুগল্প ।। বেদনার বালুচরে ।। দীনেশ সরকার
দীনেশ সরকার
বৃদ্ধাশ্রমের বিছানায় শুয়ে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় বিন্দুবাসিনী। এই তো সেদিনের কথা, ক্লাস নাইন অব্দি পড়া ঘোমটা দেওয়া লাল টুক্টুকে আলতা পায়ে মিত্র বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলো বিন্দু । পড়তে চেয়েছিলো বিন্দু, কিন্তু অভাবী বাবা পড়াতে পারে নি । মেয়ে বেশী লেখাপড়া শিখলে অভাবী বাবা মেয়ের যোগ্য পাত্র যোগাড় করতে পারবে না । তাই একটা যেমন তেমন স্কুল মাস্টার পাত্র পেয়েই তার গলায় মেয়েকে ঝুলিয়ে দিলো । হোক না পাত্রের বয়স বেশী, স্কুলের মাস্টার তো বটে । মেয়ের বিয়ে দিতে যেটুকু ধানের জমি ছিল সেটুকুও বেচতে হয়েছিল অভাবী বাবার । বিয়ের পরে বিন্দু জানতে পারে তার স্বামী অমলকান্তি মিত্র মাস্টার হলেও মাইনে পায় না । কারণ, স্কুলটা তখনো সরকারী অনুমোদন পায় নি । অমলকান্তি সকাল –সন্ধ্যায় বাড়িতে টিউশন পড়াত । মিত্র বাড়িতে প্রবেশ করে বিন্দু দেখলো সংসারের বেহাল দশা । বড় সংসার, অক্ষম শ্বশুর-শাশুড়ি আর তিনটে নাবালক দেবর । সাত জনের সংসার, উপায় বলতে স্বামীর টিউশনের ওই কটা টাকা । অভাবকে সাথী করেই বড় হয়েছে বিন্দু । গরিবের মেয়ে বিন্দু, তাই হাল ছাড়তে শেখে নি । দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছে ।
নাবালক দেবরদের সাথে নিয়ে বিন্দু দোকানে দোকানে ঘুরেছে, ঠোঙার অর্ডার নিয়েছে । পুরোনো খবরের কাগজ কিনে এনে বাড়িতে বসে ঠোঙা বানিয়েছে । তারপর সেই ঠোঙা দোকানে দোকানে পৌঁছে দিয়েছে । বিনিময়ে কিছু পয়সা পেয়েছে । এইভাবে সংসারের হাল ফেরানোর চেষ্টা করেছে । তার দেবররাও অবসরে বৌদির সাথে ঠোঙা তৈরিতে হাত লাগিয়েছে । বিন্দুর তখন একটাই লক্ষ্য সংসারের হাল ফেরানো আর দেবরদের উচ্চ শিক্ষিত করে নিজের পায়ে দাঁড় করানো । নিজে না খেয়ে দেবরদের খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে ।
এইভাবে লড়াই করতে করতে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে । বড় দেবর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাইরে যাবে । এডমিশন ফি, সেমেস্টার ফি, হোস্টেল চার্জ বিপুল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন । অমলকান্তির স্কুল সরকারী অনুমোদন পেয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনোও মাইনে পত্তর পাওয়া শুরু হয় নি । চোখে অন্ধকার দেখে বিন্দু । শেষে যে সব দোকানে ঠোঙা সাপ্লাই দিত তাদের কাছ থেকে কিছু অগ্রিম নিয়ে আর নিজের বিয়ের যে দু-একখানা গয়না ছিল সেগুলো বিক্রি করে বড় দেবরের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিল ।
অমলকান্তির মাইনে পাওয়া শুরু হতেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল বিন্দু । অমলকান্তি বলেছিল, ' আর ঠোঙা তৈরীর দরকার নেই । আমি সংসার সামলে নেবো ।' কিন্তু বিন্দু শোনে নি সে কথা । তার তিনটে দেবরকেই উচ্চ শিক্ষিত করতে হবে । সামনে অনেক খরচ । তার উপর তাদের কোল আলো করে বাবাই সোনা এসেছে তার ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হবে । আরও বেশী করে ঠোঙা তৈরীতে মন দেয় বিন্দু । দেবরদের পড়ার চাপ তারা সময় দিতে পারে না । তাই তার সহকারী হিসাবে পাড়ারই একটা ছেলেকে কাজে লাগায় ।
শুয়ে শুয়ে ভাবে বিন্দুবাসিনী । দিনগুলো যেন ঝড়ের গতিতে চলে গেল । সবই তো চোখের সামনে ভাসছে । মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা । অথচ, কত বছর কেটে গেছে । শ্বশুর-শাশুড়ি গত হলেন । তার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের ফলস্বরূপ দুই দেবর ইঞ্জিনিয়ার আর এক দেবর অধ্যাপক হ'ল । ধুমধাম করে তাদের একে একে বিয়ে হ'ল । তারপর যে যার সংসার গুছিয়ে নিজের নিজের গন্তব্যে ফিরে গেল । দাদা-বৌদির খোঁজ রাখার আর তাদের সময় নেই । ভালোবাসার সুতোগুলো এভাবেই আলগা হয়ে গেল । এটাই বোধহয় জগতের নিয়ম ।
বিন্দুবাসিনীর চোখের সামনে থেকে একে একে পর্দা সরতে থাকে । অমলকান্তি শিক্ষকতা থেকে যখন অবসর নিল তখন বাবাই M Sc. পড়ে । অমলকান্তির বড় সাধ ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে Ph. D. করাবে । কিন্তু তার জন্য তো বিপুল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন । অবসর নেওয়ার কালে যে টাকা-পয়সা পেয়েছে তাতে তো বাবাইকে বিদেশে পাঠানো যাবে না । অমলকান্তি আবার দিন-রাত টিউশন পড়াতে শুরু করলো । ভগ্ন শরীর অতটা ধকল নিতে পারলো না । কয়েক মাসের মধ্যেই অমলকান্তি শয্যা নিলো । সেই শয্যা থেকে অমলকান্তি আর উঠলো না ।
চোখে অন্ধকার দেখলো বিন্দু । অমলকান্তির সাধ কিভাবে পূরণ করবে বিন্দু ? বাবাইয়ের বিদেশের খরচ কিভাবে সামলাবে বিন্দু ! একবার ভেবেছিল, যে দেবরদের ছোট থেকে আদর-ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে সেই দেবরদের সামনে হাত পেতে দাঁড়াবে । কিন্তু দেবররা যে তার খবরই নেয় না । তাই অভিমানী বিন্দু বাবাইয়ের জন্য দেবরদের কাছে হাত পাততে পারে নি । বিন্দু আরও বেশী বেশী করে ঠোঙা তৈরী করতে লাগলো । দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করতে লাগলো । অমলকান্তির সহশিক্ষকদের বদান্যতায় বিন্দুর Family Pension পেতে খুব একটা বিলম্ব হয় নি । তাতে বিন্দুর অনেকটা সুরাহা হ'লো ।
অমলকান্তি আর বিন্দুর সঞ্চয় এককরে আর শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ধার করে বিন্দু বাবাইকে ক্যালিফোর্নিয়া পাঠাল Ph. D. করতে । দিন গড়িয়ে চললো । বাবাইয়ের Ph. D. শেষ হ'লো কিন্তু বাবাই আর দেশে ফিরলো না । মায়ের সঙ্গে যোগাযোগও তলানিতে ঠেকলো ।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে বিন্দুর শরীর দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে । আর আগের মতো কাজ করতে পারে না । তারউপর প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে বাজার ছেয়ে গেছে । কাগজের ঠোঙার চাহিদা দিন দিন কমছে । বিন্দু ঠোঙা তৈরী বন্ধই করে দিল । বাবাইয়ের পথ চেয়ে বসে থাকে বিন্দু । স্বপ্ন দেখে বাবাই এসে মা বলে ডেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছে । একাকীত্ব বিন্দুকে গ্রাস করে ।
শরীর-মন দুটোই ভাঙতে থাকে বিন্দুর । বেঁচে থাকার আর কোনো মানেই খুঁজে পায় না । শেষে এক শুভানুধ্যায়ীর বদান্যতায় ফ্যামিলি পেনশনকে সম্বল করে এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে । বিন্দুবাসিনী আজও তার বাবাইয়ের পথ চেয়ে বসে আছে । তার বাবাই এসে 'মা' বলে ডেকে তাকে জড়িয়ে ধরবে । তার অন্তর জুড়িয়ে যাবে । কবে আসবে সেই দিন ?
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ---- ৭২১৩০৬