ইতি তোমার .....
জয়শ্রী ব্যানার্জি
ঋতুরাজ্ঞী চক্রবর্তী
বর্ধমান
২২/১২/২০২৩
৫ ই পৌষ ,১৪৩০
দুপুর ৩ টে
প্রিয়,
অরণ্য দেব ,
ধরো ...
তুমি কোথাও এমন কোনো হেমন্তে...
এমন শিরশিরে হিমেল হাওয়ার সুর ...
যেমন পাগলা রাজা ঘোড়া ছোটায় দূর অচিন পুরে..
তেমন করে তুমিও পাড়ি দিয়েছ কোনো নির্জনে , স্বেচ্ছা নির্বাসনে ... পশ্চিম বঙ্গে র মধ্যেই ধরো ..বা তার কোনো সীমান্তে কিন্তু অনেকের অজানা সেটা আবিষ্কার সেই ভাবে হয়নি ।তুমিই করলে ধরো সেই আবিষ্কার .. লাগোয়া জঙ্গল , অযুত বুনো ফুলের গন্ধ আসে ভেসে । রাতে নীল জোছনায় স্নান করে অরণ্য। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তোমার ঘর , দেরাজে বই ,খাতা । দেওয়ালে ক্যালেন্ডার , ঘড়ি । বিছানায় বই রাখা একটা দুটো । তোমার শার্ট এর একটা বোতাম মেঝেয় পড়ে...
লাগোয়া বাথরুম , বারান্দা ।সেখানে টেবিলে তোমার খাতা, কলম টুকটাক এটা ওটা জিনিস । খুবই কম মোবাইল ব্যবহার করছো তখন ,সেটা একদিকে কিছুটা অবহেলায় রাখা যেন! ফুলদানিতে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া জারুল ফুল কিছু । ছোট একটু কিচেন । গ্যাসের ব্যবস্থা আছে। বিদ্যুৎ ও আছে মাঝে মাঝেই লোড শেডিং তখন তেলের লণ্ঠন কি হারিকেন কি মোমবাতি ভরসা। আর টিউবয়েলের জল । স্বচ্ছ জল । এসি নেই কিন্তু অজস্র হাওয়া চারদিক থেকে আসে । সেই হাওয়ায় শীত করে !
আর একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয় তোমার ওখানে । পাশ দিয়ে বয়ে চলে ঝিরি ঝিরি নদী ..ধরো নাম তার আয়না ..মিনিট ৫/১০ হাঁটা পথে স্থানীয় বাজার ।
সেই দিকে বেশ কিছু বাড়ি আছে ।কিন্তু একটু ছাড়া ছাড়া নিরিবিলি পরিবেশ। বাজারে রোজকার কাগজ আসে । ডাক্তারও আসেন । তিনিও ধরো বেশ পাগলা টাইপের ।টাকা পয়সার দিকে ঝোঁক নেই রোগীর খবরেই ব্যস্ত থাকেন । তোমার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে ! ওনার কাছে বহু তথ্য পাও । ওখানে টুকটাক অসুখে প্রবলেম নেই । বড়ো অসুখে শহরে যেতে হয় । ..বাজার থেকে ধরো আরো ৫/১০ মিনিট গেলে একটা ছোট স্টেশন । সকাল আর বিকালে মাত্র দুবার ট্রেন থামে । শেষ ট্রেন ওই সন্ধ্যে নামার আগে ।
সেই দিকে একটা পুরোনো শিব কি কালী মন্দির ।লোক পরম্পরায় কোনো একটা দিন বিশেষ পুজো হয় মেলা বসে । মন্দিরের পাশে সাদা রঙিন চেনা অচেনা ফুলের বাহার । আকাশমনি, ঝিন্টি ফুলের গাছ এদিক ওদিক । আছে তমাল পিয়াল গাছ । তাদের ঘন ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায় ।
অন্য রুটে বাস রাস্তা আছে । এক ঘন্টা অন্তর ধরো ।
বাস স্টপে খড়ের ছাউনি দেওয়া চায়ের দোকান । দু একটা মিষ্টির দোকান । একটা বট গাছ । অজস্র বটফল পড়ে ! লাগোয়া খেলার মাঠ । ফুটবল খেলে সাঁওতালি কিছু ছেলে .. মাঝে মাঝে সাঁওতালি পরবে মাদলের সুর ভেসে আসে । দ্রিমি দ্রিমি...তুমিও আমন্ত্রিত হও।
বেশ চা খাচ্ছো আর লিখছো তুমি ,তোমার রান্না করে দিয়ে চলে যায় কোনো একটি চটপটে ছেলে ।সে তোমার সঙ্গীও সেখানে .! টুকটাক ফরমাশ খাটে এটা ওটা। আর অবাক হয়ে তোমার ক্যামেরাও দ্যাখে সেই ছেলেটি ... ধরো নাম তার ঝুমরু কি কহন!
বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে তোমার চোখে পড়ে আয়না নদীর উজান বেলা .. পাখির ঝাঁকের নীড়ে ফেরার তাগিদ ! কানে আসে বিকালের ট্রেনের চলে যাবার শব্দ । নদীর চারদিকের বিষণ্ণ বালিয়াড়ি। অজস্র ঝরা পাতা জঙ্গলময়। অচেনা পাখির ডাক । তোমার বারন্দায় একপাশে একটা দেব কাঞ্চন গাছ তার ঝরা পাতা তোমার ওই ছিমছাম সাজানো ছোট বাড়ির কাঠের সিঁড়ি তে পড়ে থাকে , রাজ অশোকের ফুল গুলো লাল রঙে রঙিন হয়ে লাজুক হাসে । হাওয়ায় দোলে তোমার লাগানো ছাতিম চারা। তোমার নিজের হাতে লাগানো এটা ওটা গাছের সারি তে জল দাও ।
আকাশে কমলা রং ছড়িয়ে সূর্য তার সেদিনের কাজ শেষে ছুটি নেবার কথা জানিয়ে দিচ্ছে , এমন কোনো দিনে ধরো ..আমি সত্যিই গেলাম সেদিনের বিকালের ট্রেনে ... খুশি হবে বলো সত্যি করে ?
আমার লেখা বই দেবো সেদিন । ! কোনো অবসরে যেদিন থাকবো না সেদিন পড়ো। আর তোমায় যত্ন করে এঁকে নিয়ে যাবো সেদিন । আর তুমি মিষ্টি ভালোবাসো যেসব ...! তবে বর্ষা নিয়ে যেতে পারবো না তখন , হেমন্তই দেবো । আর ধরো কোনো এক সুন্দর জিনিস ...সেটা আপাতত সারপ্রাইজ থাক ! কি বলবে অবাক হয়ে ? ঋতু তুমি? আমি তো ভাবতেই পারছিনা তুমি সত্যি আসবে খুঁজে! তাও একা ! রেগে যাবে না জানি ! তুমি জানো ,যে দু তিনজন তোমার এখনকার আর এখানকার ঠিকানা জানে তার একজন আমি ।
ধরো এমন কোনো অসুখ আমার হয়েছে হয়তো খুব জোর একমাস কি দুমাস থাকবো ।তার আগে আমি শেষ ইচ্ছা গুলো একটু একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছি । চলে যাবো বলে আর বাধা দেয়নি কেউ । বৃষ্টি নেই ধরো সেদিন ।ওই পড়ন্ত বিকালে ওই চালা ঘরের দোকানে চা খাবে আমার সাথে ? মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে শেষ ট্রেনটা শব্দ তুলে ফিরে যাবে ...!চা খেতে খেতে ওই প্রান্তিক জায়গার ,মানুষ দের গল্প শোনাবে?
না বৃষ্টি বিন্দু থাকবে না হয়তো সেদিন তোমার চোখে মুখে .. সন্ধ্যে নামার আগের আলোর কুচি গুলো তোমার চোখে মুখে ! আমার রুমালে মোছাতে পারবো না তোমার মুখের সেই বৃষ্টি বিন্দু গুলো ।তবে সেই আলোর একটু মাখিয়ে নেবো রুমালে । হিমেল হাওয়াই নীল ফুল শার্ট তোমার । হাফ সোয়েটার। আমার কালো হালকা শাল, নীল শাড়ি। ছোট কালো টিপ । কাজল পড়ি আমি । নীল পাথরের দুল ।
আমার একটা খুব সুন্দর রাধা কৃষ্ণের ছবি রঙিন সুতোর কাজ করা ভারী চমৎকার শান্তিনিকেতনী ব্যাগ আছে ।সেদিন সেটাই নেবো । একদিন ধরো দুজনেই অতিথি হয়ে গেলাম কোনো সাঁওতালি পরবে। ওই ঝুমরু দের পাড়ায়।
ধরো, একদিন আমি সব রান্না করে তোমায় আর ঝুমরু কি কহন নামের ছেলেটিকে খাওয়ালাম .. এটা আমার ভীষণ ইচ্ছা একদম মন থেকে ,চা করে খাওয়াবো ।রান্না করে খাওয়াবো একদিন , আমি নিজে খুব ঝাল খেলেও রান্নায় দেবো না সেদিন একদম অল্প দেবো । জানি তো তুমি ঝাল খেতে পারোনা। প্রচন্ড ঝাল খেলেও আমি কিন্তু বাঙাল না, একদম পিওর ঘটি।
ধরো, তোমায় বলিনি কিছুই সেই অসুখের কথা । খুব তিন চারদিন কি এক সপ্তাহ অরণ্য নদী তোলপাড় করে তোমার সাথে দিন রাত্তিরের মুহূর্ত গুলো স্মৃতি করে ফিরে যাবার পর কিছু দিন পর হঠাৎ কোনো এক অবেলায় একটা ফোন এলো তোমার কাছে , শুনলে আমার বলে যাওয়া কোনো বন্ধু কি আত্মীয়র কাছ হতে যে, ,আমি কোনো এক আলোকবর্ষ দূরের গ্রহে চলে গেছি । বলো মন খারাপ করবে সত্যি ? জল আসবে তোমার চোখে আমার জন্য ? মনে পড়বে সেই শেষ ট্রেনে তুলে দেবার কথা ? ছেড়ে চলে আসার মুহূর্তে ওই আকুল ভাবে আমার তোমায় জড়িয়ে ধরার কথা ? ওই জঙ্গল নদী তে দুই পাগলের বেড়ানোর কথা ! ওই আলতো আদরের কথা ? ঐ ছুঁতে পারা আর না পারা দের কথা ? রাশি রাশি ঝরা পাতার মতো কথা দের কে তোমার মনে থাকবে? ।
ঠিক ওই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এর 'যাও পাখি ' গল্পের মধুমিতার মতো হাসতে হাসতে চলে গেলাম ধরো! দারুন হবে! ..কেউ জানবে না বুঝবে না .. তাই না অরণ্য? আমার অরণ্য দেব !
মনে থাকবে এই পাগলী টাকে? মনে রাখবে?
ইতি
ইয়োরস
ঋতুরাজ্ঞী(ঋতু)
তোমার পাগলী
অরণ্য চ্যাটার্জি
বালিগঞ্জ প্লেস,
২৪/বি সেকেন্ড অ্যাভিনিউ
বালিগঞ্জ
কলকাতা ৭০০০১৯
=====================================
জয়শ্রী ব্যানার্জি
পাল্লারোড, পূর্ব বর্ধমান