ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
সম্পূর্ণা
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
মম মজুমদার
কয়েকদিন ধরে একেবারে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সমরকে বলেও লাভ হয়নি। সে সবসময় মায়ের দ্বারা চালিত স্কুল আর টিউশন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বৌয়ের কথা শোনার মত সময় তার নেই। বিয়ের পর থেকেই অশান্তি সম্পূর্ণার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। যখন সম্পূর্ণা চাকরি পায়নি তখন এই বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে গিয়েছিল যেইমাত্র স্কুলে চাকরি পেল আবার এই সম্বন্ধটা ঘুরে আসে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতীতের কথা গুলো মনে পড়ছিল।
সমরের বাবা-মা বার বার সম্পূর্ণা মায়ের হাত ধরে বলেছিল তারা সম্পূর্ণা কে ঘরের লক্ষী করে রাখবে ছোটবেলায় বাবা হারানোর কষ্ট সব ভুলিয়ে দেবে। সম্পূর্ণ যে স্কুলে চাকরি পেয়েছিল প্রায় সব দিদিমণি মাস্টারমশাই বিবাহিত তাদের স্বামী বা স্ত্রী সকলেই সরকারি স্কুলের টিচার সম্পূর্ণা ভেবেছিল সে নিজে চাকরি করছে স্কুলে এবং স্কুলের মাস্টারের সাথে বিয়ে হচ্ছে ফলে সামাজিক স্ট্যাটাস অনেক উপরে থাকবে সংসারে কুটো নাড়তে হবে না কাজের লোক এসব করে দেবে। তার এই ভাবনা কত বড় ভুল ছিল আজ বিছানায় শুয়ে বুঝতে পারছে যেদিন থেকে অসুস্থ হয়েছে স্বামী তাকে বাপের বাড়ি তুলে দিয়ে গেছে বুড়িমা আর দিদি যে নিজের সংসার ফেলে পড়ে আছে সম্পূর্ণা চিকিৎসার জন্য।
মনে পড়ছে ছোটবেলার দুই বোন কিভাবে বাবার মায়ের সাথে সময় কাটাতে। সম্পূর্ণা বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিল। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্গত নামী মহিলা কলেজ থেকে ইতিহাসের বিএ পাস করে ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার ডিগ্রী লাভের পর দামি কলেজ থেকে বি এড ও পাস করে। দুবারের চেষ্টা হয় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়
যখন দশম শ্রেণীতে পড়তো সেই সময় বাবাকে হারায় মা মোটা টাকা পেনশন পেতেন হলে অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল না ডানলপের মতন জায়গায় বড় বাড়ি মাথায় ছাদের অভাব নেই। শান্ত স্বভাবের সম্পূর্ণা র বন্ধুবান্ধব ছিল না ভেবেছিল স্বামী ভালো বন্ধু হবে কিন্তু হায় কপাল বন্ধু তো হলোই না দিনে দিনে যেন শত্রু হয়ে উঠ ল। দিনের পর দিন অবহেলায় সম্পূর্ণা কেবল গুটিয়ে যেতে লাগলো একমাত্র আশ্রয় ছিল ছোট্ট মেয়েটা, সেও আয়ার কাছে মানুষ শাশুড়ি ও যত্ন নিত না। নিজের স্কুল করে আর এনার্জি পেত না প্রথম প্রথম রান্নাঘরে ঢুকে ভালো-মন্দ খাবার তৈরি করে দিলে ও শশুর ছাড়া আর কেউই প্রশংসা করত না বিবাহিত ননদ ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেনি। শ্বশুরবাড়িতে অবহেলিত হওয়ার মাকে জানিয়েছিল বারবার। এবং বাপের বাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মায়ের ভয় ছিল মেয়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে অনেক গঞ্জনা পেতে হবে। সে তো চাকরি করে না। আর আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী কি বলবে এই চিন্তায় মেয়েকে আবার ওই শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তার বক্তব্য ছিল একটা বাচ্চা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন সম্পূর্ণা বুঝতে পেরেছিল সে কতটা অসহায় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়েও সরকারি স্কুলে মোটা টাকা মাইনে সবটাই সমরের হাতে তুলে দিত আয়া আর কাজের লোকের মাইনে তাকেই দিতে হতো। তাতেও তার শান্তি ছিল না ।
তবে সম্পূর্ণা একটা দোষ ছিল সে সংসারের কাজে কোনদিনই পটু নয় পাড়ার কোন মহিলার সাথে মিশতো না পুজো কমিটিতেও যেত না অন্যান্য মহিলাদের মতন।
স্কুলেও ছাত্র-ছাত্রী বলতে তেমন প্রিয় ছিল না সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখত । বিয়ের পর প্রথম প্রথম সব অনুষ্ঠানে সেজেগুজে আসতো ইদানিং ক্লাস ঠিকমত ক্লাস না নেওয়ার অভিযোগ হেডমাস্টার মশাই বারবার করতো একদিকে স্কুলে অশান্তি অপরদিকে সংসারে অশান্তি বাপের বাড়িতে মায়ের সহযোগিতা না পাওয়াতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আজ সম্পূর্ণা মৃত্যু শয্যায় ডাক্তার জবাব দিয়ে গিয়েছে মা এবং দিদি চোখের জল ফেলছে। ছোট্ট মেয়েটা বিছানায় চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমর মাঝে মধ্যে একটা দুটো ফল নিয়ে দেখতে।
যেদিন প্রথম অসুস্থ হলো নার্সিংহোম থেকে সোজা বৃদ্ধা মায়ের কাছে তুলে দিয়ে যায় সম র।
সম্পূর্ণা র প্রায় ছয় মাস হল কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সব বুঝতে পারে কিছুই বলতে পারে না কেবল চোখে কোনা দিয়ে জল পড়ে যায় অবিরত। একসময় স্কুলে যারা খুব কাছের ছিল বিয়ের কিছুদিন পর তারা অনেক দূরে চলে যায় আজকে তারা দেখতে এসেছিল। স্কুলের একজন দিদিমণি কে যে পার্ট টাইম চাকরি করে কিন্তু খুবই পরিশ্রমই একাই এই পৃথিবীতে লড়াই করছে তাকে খুব আশা করেছিল কিন্তু সে আসতে পারেনি যারা দেখতে এসেছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন বলল সে এক
জন লাইফ পার্টনার পেয়ে গেছে। সম্পূর্ণা ভাবতে থাকে একটি মেয়ে যার কেউ নেই সামান্য চাকরি করে সে কি করে এত মানসিক শক্তি পায়। যার কথা শুনে মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায় সম্পূর্ণা ভাবে যখন সেই পৃথিবীতে আসবে তার মত শক্তি নিয়ে চলার চেষ্টা করবে কোন কিছুতে ভয় পাবে না।
বাবার কথা বারবার মনে পড়ছিল। সব অপমানেরহাত থেকে বাবাই তাকে বাঁচাতে পারতো এই সমাজের উজানে বইতে বাবাই হয়তো সাহায্য করতে পারতো। এ জীবনে তার সম্ভব নয় সব অবহেলা মাথায় নিয়ে তাকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী থেকে। আজ নবমীর শেষ রাত দশমী আগত সম্পূর্ণ সব ছেড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে শেষ হলো সম্পূর্ণা উপন্যাস। আধুনিক এইপৃথিবীর কোনায় কোনায় প্রতিমুহূর্তে আজও অনেক সম্পূর্ণা উপন্যাস রচিত হচ্ছে কে তার খবর রাখে!!
----------------------
কলমে : মম মজুমদার