ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
বাংলার রেনেসাঁ ও মেঘনাদবধ কাব্য
ভুবনেশ্বর মন্ডল
ঊনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় নবজাগরণ। এই নব জাগরণ বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলে। নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য গুলি হল যুক্তিবাদ ,মানবতাবাদ ,বিজ্ঞানমনস্কতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, জাগতিকতা, মানবকল্যাণ ,আত্মবিশ্বাস ,দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। নবজাগরণের এইসব বৈশিষ্ট্য গুলি আত্মস্থ করে আসে সমাজ সংস্কার, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূরীকরণ ,মহান পুরনো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন , নারী মুক্তি আন্দোলন ইত্যাদি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশব চন্দ্র সেন প্রভৃতি সমাজ সংস্কারকদের সংস্কার আন্দোলন যেমন সমাজ জীবনকে প্রভাবিত করে তেমনি প্রভাবিত করে সমকালীন সাহিত্য জগতকেও। ঠিক এই পটভূমিকায় আমরা পর্যালোচনা করব মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যটিকে।
মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকৃতপক্ষে রেনেসাঁর ফসল। এই সাহিত্যিক মহাকাব্যটি ধারণ করে আছে রেনেসাঁর বিবিধ বৈশিষ্ট্য। একটি মহাকাব্যে প্রতিফলিত হয় একটি বিশেষ যুগের বা সমগ্র জাতির বিচিত্র ভাব তরঙ্গ। মেঘনাদবধ কাব্যও ধারণ করে আছে ঊনিশ শতকের বাংলার বিচিত্র ভাব রাশিকে। এর কাহিনী যদিও রামায়ণের কিন্তু এই কাহিনীকে পুষ্ট করেছে ঊনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁ। যুগন্ধর মধুসূদন ঊনিশ শতকের বাঙালির প্রতিনিধি হয়ে বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে গেঁথে দিয়েছেন এই কাব্যে। তাই বস্তুতপক্ষে এই কাব্য রেনেসাঁর ফসল। নয়টি সর্গে গঠিত এই কাব্যের বিষয় রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে নেওয়া হলেও মধুসূদনের মৌলিক সৃজনশীলতায় অভিনব। মধুসূদন এখানে রামায়ণকে যেন বিনির্মাণ করেছেন। এমন বিনির্মাণ দেখি বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্রে, রবীন্দ্রনাথের কর্ণ কুন্তী সংবাদে, চিত্রাঙ্গদায়, গজেন্দ্র মিত্রের পাঞ্চজন্যে, দীপকচন্দ্রের বিভিন্ন পুরান আশ্রিত রচনায়। এ কথা বলা যেতে পারে এই ধারাটি মধুসূদনের উত্তরাধিকার থেকেই এসেছে।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধুসূদন বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদের নিরিখে মেঘনাদবধ কাব্যে চরিত্র চিত্রনে প্রথাগত ভাবনাকে ভেঙে দিয়েছেন। প্রচলিত রামায়ণে আছে ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়। সেখানে রামচন্দ্র ভগবান, ধর্মের মূর্ত বিগ্রহ, নানা গুণে গুণান্বিত, আদর্শ মহামানব। অধর্মকে ধ্বংস করে তার জায়গায় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতেই তাঁর আবির্ভাব। অন্যদিকে রাবণ এ কাব্যের খলনায়ক। তাঁকে দেখানো হয়েছে মহাপাপী, অধার্মিক, অসংস্কৃত, পরস্ত্রী হরণকারী, হৃদয়হীন দানব রূপে। যুক্তিবাদী মধুসূদনের এখানেই আপত্তি। তাঁর মনে হয়েছে কোন মানুষই এরকম একরঙা দোষের আকর হতে পারেননা। মূল রামায়ণের এই যে রাবণ চরিত্র তা অসম্পূর্ণ, পক্ষপাত দুষ্ট ভাবনার ফসল। মানুষ যেমন পূর্ণ গুণসম্পন্ন হতে পারেন না। তেমনি পূর্ণ দোষ সম্পন্নও হতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ দোষে গুণে ভরা। এটাই স্বাভাবিক এবং বাস্তব। রাবণ চরিত্রের মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময় মানবিক দিক ছিল যেটাকে মূল রামায়ণকারেরা বিকশিত করেননি বা করতে চাননি। তাই মধুসূদনের মনে হয়েছে রাবণ যেন 'কাব্যের উপেক্ষিতা'। তাই চরিত্রটির সম্ভাবনাময় দিক গুলিকে তিনি মেঘনাদবধ কাব্যে আপন সৃজন কল্পনা দিয়ে বিকশিত করেছেন। যুক্তিবাদী মধুসূদনের কাছে রাবণ হলেন রক্তমাংসের মানুষ। তার সমাজ আছে, সংসার আছে, দাম্পত্য প্রেম আছে, সন্তানস্নেহ আছে, ভ্রাতৃস্নেহ আছে, দেশপ্রেম আছে, প্রজাপ্রেম আছে, ন্যায়পরায়ণতা আছে, বীরত্ব আছে, উদারতা আছে, আছে দুঃখ, শোক, যন্ত্রণা ও হাহাকার। আসলে রামায়ণ মহাকাব্য তো আর্য অনার্যের সংগ্রামের কাহিনী। রাম আর্য জাতির প্রতিনিধি। আর রাবণ অনার্য জাতির প্রতিনিধি। এই সংগ্রামের কাহিনীটি যিনি লিখলেন তিনিও আর্য জাতির মানুষ। ফলে ইচ্ছে করেই অনার্য জাতিকে ছোট করে, হেয় করে, কিংবদন্তি রুপে প্রচলিত কাহিনী সংকলন করে মহাকাব্যের রূপ দিলেন। অনেক সময় ক্ষমতাবানেরা নিজেদের মতো ইতিহাস তৈরি করেন।এক্ষেত্রেও তেমনটা হওয়াই সম্ভব। আর এখানেই মধুসূদন আঘাতটা হানলেন। এতদিন যারা ছিল উপেক্ষিত অবহেলিত ,অপমানিত ,ঘৃণিত তাদেরকেই মানবতা ও নবচেতনার আলোয় আলোকিত করে তুললেন। ফলে মেঘনাদবধ কাব্যে নায়ক চরিত্রে পরিবর্তন এলো। রাবণ হলেন নায়ক। আর সে নায়ক পেলেন মধুসূদনের হৃদয়ের উজাড় করা ভালোবাসা। তাই তিনি হয়ে উঠলেন 'গ্রান্ড ফেলো', আর ইন্দ্রজিৎ হয়ে উঠলেন 'ফেভারিট ইন্দ্রজিৎ।'এইযে অবহেলিত ঘৃণিত বঞ্চিত মানুষদের থেকে নায়ক সন্ধান এটা পরবর্তীকালের সাহিত্য গ্রহণ করেছে। এখানে রয়েছে সাব অল্টার্ন ভাবনার প্রতিফলন। তাই আমরা তারাশঙ্কর ,মানিক ,বিভূতিভূষণ সতীনাথ ভাদুড়ী প্রভৃতি কথাসাহিত্যিকদের রচনায় পেয়েছি চিরকালের পিছিয়ে পড়া নিচু তলার মানুষের সামনের সারিতে এসে দাঁড়ানোর কথা। এই কাজের সূচনা হয়তো মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণকে দিয়েই। যদিও রাবণ রাজা ছিলেন তবুও আর্য মানসিকতায় তিনি ঘৃণিত, অবহেলিত ,অসংস্কৃত , নিচু তলারই মানুষ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক 'উপন্যাসের সাঁওতাল রাজা দোবরুপান্নার কথা। মধুসূদন নায়ক চরিত্রের এই যে পরিবর্তন আনলেন তার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি। এর মধ্যে রেনেসাঁর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
রেনেসাঁর আর এক বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র। অর্থাৎ ব্যক্তির অধিকার স্বাধীনতা ,আত্ম বিকাশ, আত্মমুক্তি ইত্যাদি গুরুত্ব পায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে। মধ্য যুগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র উপেক্ষিত হয়েছে, অবদমিত হয়েছে সামাজিক চাপে। কিন্তু উনিশ শতকের বাংলায় রামমোহন বিদ্যাসাগর রেনেসাঁর প্রভাবে যে সমাজ সংস্কারের জোয়ার আনলেন সেখানে গুরুত্ব পেল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র।। তাই আমরা পেলাম নারী মুক্তি আন্দোলন। নিষিদ্ধ হল সতীদাহ প্রথা, আইনসিদ্ধ হলো বিধবা বিবাহ ইত্যাদি। এই যে নারী মুক্তি তার সাথে জড়িয়ে আছে নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র রক্ষার অধিকার ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা পদক্ষেপ। এখন আর নারী শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয়, পুরুষের সেবাদাসী নয়, সে অবলা, কোমলা, অসহায়া কিম্বা পুরুষের ছায়াসঙ্গিনী নয়। তার একটা কায়া আছে, আছে নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা, বোধ ,চেতনা, ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। মধুসূদন তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে নারী ব্যক্তিত্বের এই জায়গাগুলি প্রস্ফুটিত করেছেন প্রমিলা চরিত্র এবং চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের মধ্য দিয়ে। প্রমিলা যখন সখিকে বলেন তিনি পর্বত থেকে নেমে আসা নদী ,তার গতিকে আটকাবার কারো ক্ষমতা নেই। তখন এক বীরাঙ্গনা নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়। তাই তিনি বলেন "আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে ?"প্রমিলা চরিত্রের মধ্যে আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্য নারীর বীরাঙ্গনা রূপ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র।
চরিত্রটির মধ্যে মধুসূদন ভারত ইতিহাসের সুলতানা রিজিয়া, রানী লক্ষ্মীবাঈ প্রভৃতি নারীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকেও হয়তো জ্ঞাতে অজ্ঞাতে সঞ্চারিত করেছেন। রাবণের আরেক স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা তিনি যখন সন্তান বীরবাহুর মৃত্যু শোকে প্রায় পাগলিনী হয়ে স্বামী রাবণের রাজসভায় এসে তাঁকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করেন তখন চিত্রাঙ্গদার বীরাঙ্গনা মূর্তিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিত্রাঙ্গদা যেন এক প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী নারী। মধুসূদনের 'বীরাঙ্গনাকাব্যে'র নারী চরিত্রগুলিও রেনেসাঁর ফসল। ভারতীয় পুরাণের ১১ জন নারী এখানে পত্র লিখেছেন তাঁদের স্বামী বা প্রেমিককে। তাঁরা অসি যুদ্ধ করেননি কিন্তু করেছেন মসি যুদ্ধ। মন ,মানসিকতা, মুক্ত দৃষ্টি, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বা প্রখর ব্যক্তিত্বে এঁরা সকলেই উজ্জ্বল। সকলেই বীরাঙ্গনা। কাব্যটি মধুসূদন উৎসর্গ করেছেন নারী মুক্তির রূপকার বিদ্যাসাগরকে। মধুসূদনের এই নারী মুক্তির চিন্তা পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্য গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র হয়ে একাল পর্যন্ত বয়ে চলেছে সেই নারী মুক্তির নদী যুগ জীবনের সঙ্গে অন্বিত হয়ে।
রেনেসাঁর আর এক বৈশিষ্ট্য হলো জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম। মেঘনাদবধেও আমরা দেখি রাবণের দেশ লঙ্কা বিদেশি শত্রু রামচন্দ্র দ্বারা আক্রান্ত। আর রাবণ দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছেন প্রাণপণ। আসলে রাবণ চরিত্রের সঙ্গে মধুসূদন একাত্ম হয়ে গেছেন। রাবণের দেশ লঙ্কা আর মধুসূদনের সমকালীন পরাধীন ভারতবর্ষ মিলেমিশে একাকার। রাবণের জীবনে যে হাহাকার, ব্যর্থতা ,যন্ত্রণা ,নিয়তির চক্রান্ত সে সবের সঙ্গে মিশে গেছে মধুসূদনের জীবন। তাই রাবণ হয়ে উঠেছে মধুসূদনের আত্মা। রাবণের দুঃখ যন্ত্রণা হাহাকার যেন মধুসূদনেরই আত্মবিলাপ। এভাবেই রাবণের দেশপ্রেম কে সম্পৃক্ত করেছেন মধুসূদন নিজের দেশপ্রেমের সঙ্গে।
রেনেসাঁর আর এক বৈশিষ্ট্য মহান প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন। মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গে অশোক কাননে সীতা সরমার কথোপকথনে সীতা চরিত্রের বা সরমা চরিত্রের যে দিকগুলি পরিস্ফুট হয়েছে তাতে আদর্শ ভারতীয় নারীর রূপটি পরিস্ফুট হয়েছে। সীতা সহনশীলতা,ত্যাগ, ধৈর্য্য, শান্ত , সৌম্য, স্নিগ্ধ মূর্তিতে বিরাজিতা। মধুসূদন যেমন প্রমিলার বীরাঙ্গনা মূর্তিকে চিত্রিত করেন তেমনি চিত্রিত করেন সীতার শাশ্বত ভারতীয় নারীত্বকে। প্রমিলার বীরাঙ্গনা মূর্তিই শুধু নয় তাঁর মধ্যে ভারতীয় নারীর স্বামীপ্রেম, একনিষ্ঠতা ও আত্মসমর্পণকে অপূর্ব করে তুলে ধরেছেন। আবার সরমার উপমা দিতে গিয়ে বলেন তুলসীর মূলে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। এসব কিছুই মধুসূদনের রেনেসাঁ সঞ্জাত ভাবনার ফসল বলেই মনে হয়।
মধুসূদন ঐহিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই রাবণের আত্মশক্তির উপর তার এত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। রামচন্দ্রের দৈবশক্তি ,দৈব সাহায্য তাঁর কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। মধুসূদন রাবণের পুরুষাকারে বিশ্বাসী, ইন্দ্রজিতের প্রকৃত বীরত্বে বিশ্বাসী। এ কাব্যে নরকের কথা আছে তবে তা নিছকই প্রথাগত কাব্যবিষয়টিকে বজায় রাখার জন্য। কৃত্তিবাসের রাম ভক্ত বৎসল ভগবান। দৈবশক্তিতে বলিয়ান। কিন্তু মধুসূদন রামচন্দ্র কে একজন সাধারন মানুষ হিসাবে দেখেছেন রেনেসাঁর আলোয়। তিনি দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। কোন ভাগবতী সত্ত্বা নয় মধুসূদন মানবিক সত্তাকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন মেঘনাদবধ কাব্যে। তাই সব মিলিয়ে বলতে হয় মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকৃত অর্থেই ঊনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁর ফসল।
________________________________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবু বাগান
পোস্ট -সাঁইথিয়া
জেলা -বীরভূম