ক্ষেত্রপাল অনার্য কৃষি দেবতা
বারিদ বরন গুপ্ত
"ডাকিছে ডগর বাদ্য ভৌরবী সুরে
সদর্পে তালে তালে ক্ষেত্রপাল তলে--"
এখনো বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে আদিম সংস্কৃতির নিদর্শন চোখে পড়ে, শুধু নিদর্শন বলবো না, প্রাচীন সংস্কৃতির সুর তাল ছন্দ সবই খুঁজে পাওয়া যায়, হারিয়ে যায়নি, হারাবার নয়, শুধু চোখ কান খোলা রাখলেই তার অস্তিত্ব চোখে পড়ে! বর্তমানে ভোগবাদী সভ্যতায় ব্যাপকভাবে সংস্কৃতির বিলম্বন ঘটেছে বা ঘটেছে। বস্তুগত সংস্কৃতি অবস্তুগত সংস্কৃতিকে পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলেছে! ফলে প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির সুরতাল ছন্দ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, তবুও তার মধ্যে যদি একটু আধটু উঁকি মারে, প্রাচীন সংস্কৃতির ঝলক একটু চোখে পড়ে, তখন নিজেদের ঐতিহ্যকে একটু খুঁজে পাওয়া যায়। আজকেই সেই ঐতিহ্য খুঁজে পেলাম পূর্ব বর্ধমানের ফুল গ্রামের ক্ষেত্রপাল তলায়।
গ্রামটা একসময় গড়ে উঠেছিল নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে! সেই হিসেবেই গ্রামটা যে কতদিনের পুড়ানো তা বলা খুবই দুঃসাধ্য! তবে সমতীরবর্তী বড়বেলুন, নাসিক গ্রাম , ইন্দ্রপুর, বাঘাসন, চন্দ্রপুর, হোসেনপুর প্রভূতি গ্রামগুলির দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে এবং পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এর ভিত্তিতে মনে করে যেতে পারে যে এই গ্রাম প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন! পশুপালক সভ্যতা থেকে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উত্তরণের বিভিন্ন পর্যায় পড়ে রয়েছে এই গ্রামে, তা ভৌগোলিক অবস্থানেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে! এই গ্রামে এখনো প্রাচীন কিছু সংস্কৃতি চোখে পড়ে। রাস্তাঘাট বাড়িঘর দেখলে এখনো পুরনো গ্রাম বাংলাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আমি আমার দীর্ঘ ক্ষেত্র গবেষণার লক্ষ্য করেছি দামোদর বা খড়িননীর প্রাচীন খাতের বেশিরভাগ গ্রাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে ফুলগ্রাম অন্যতম! শুধু ফুলগ্ৰাম নয় অন্যান্য গ্ৰামগুলোর অবস্থান এবং বর্ণনা আমার গ্রন্থে স্থান পাবে! এইসব গ্ৰামগুলির জাতি বিন্যাস থেকে পরিষ্কার যে সভ্যতার পরবর্তীকাল থেকে প্রাক-বিটিশ পর্ব পর্যন্ত এই গ্ৰামগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজ হিসেবে দ্রুত গড়ে উঠেছিল! হয়তো কেন্দ্রীয় স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছিল নিশ্চয়ই। তা অবশ্যই নদীকে কেন্দ্র করে! যাই হোক পরে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে!
প্রাচীন রাঢ় যে একসময় পুরোপুরি অনার্যদের দখলে ছিল তা এই গ্ৰাম টি দেখে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে! প্রাচীন রাঢ় বিশেষ করে বর্ধমানের দামোদর অজয় খড়িনদীর উপত্যকা অঞ্চল গুলো বহুকাল পর্যন্ত অনার্য জাতিগুলো আপন সংস্কৃতির মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছিল! এসব অঞ্চলগুলোর সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে! রাঢে আর্যীকরণ ঘটেছে অনেক পরে! বলা যায় মৌর্য যুগের শেষ পর্ব থেকে, তাও ধাপে ধাপে অনেক খড় কাঠ পুড়িয়ে! এই গ্ৰামের লৌকিক দেবতা ক্ষেত্রপালের আরাধনা দেখলে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে! আমার মনে হয় এই গ্রামটি পাল যুগ পর্যন্ত বর্গ ক্ষত্রিয় রুইদাস প্রভৃতি আদি অস্ত্রাল গোষ্ঠীর দখলে ছিল! জমিদারি সূত্রে পরে উগ্র ক্ষত্রিয়দের আগমন ঘটে! তার পরে ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য জাতিগুলো নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আবর্তে জড়িয়ে পড়ে! এই ক্ষেত্রফল যে একসময় অনার্য কৃষি সম্প্রদায়ের হাতে ছিল তা পূজার বিধি বন্দোবস্ত দেখলে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়!
ক্ষেত্রপাল অনার্য কৃষি দেবতা! ক্ষেত্রের রক্ষক! নদী নালা ভয়ঙ্কর প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ কৃষি জীবনের জন্য ক্ষেত্রপালের আবির্ভাব ঘটে! এখানে একটা প্রাচীন অশ্বথ বৃক্ষের তলে এর স্থান! যদিও তার আদিগুড়ি বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই, কালের প্রবাহে সলিল সমাধি ঘটেছে! খড়ি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ধর্মের অর্থাৎ ধর্মরাজ এর উপাসনা একসময় প্রবলভাবে প্রবাহিত হয়েছিল, এখনো হচ্ছে, তা বেশিরভাগ ডোম বাগদি হাড়ি গোপ প্রভূতি জাতির দখলে! ক্ষেত্রপাল এবং ধর্মের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়! আসলে ধর্ম ঠাকুরের আভরণ দেবতা হলো ক্ষেত্রপাল, বটুকনাথ, দীননাথ, ঘন্টা ভৈরব ইত্যাদি! যাই হোক অনার্য আদি অস্ত্রাল গোষ্ঠীর টোটেম প্রথার অঙ্গ হিসেবে এই ফুলগ্ৰামে ক্ষেত্রপালের আবির্ভাব ঘটে! ক্ষেত্রপালের স্থানটি গ্রামের উত্তর-পূর্ব কোণে, গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে! শুধু এই গ্রামে নয় আমি বেশ কয়েকটি গ্রাম কভার করে দেখেছি, যেমন কাটোয়া মহকুমার সিঙ্গি গ্রামে, ভাতার ব্লকের মুরুলিয়া এবং ছাতনি গ্রামে ক্ষেত্রপালের প্রতিষ্ঠান গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে, মুরুলিয়া গ্রামে তো দেখলাম একদম মাঝ মাঠেই ক্ষেত্রপালের অধিষ্ঠান, তাহলে বোঝা যায় ক্ষেত্রকে রক্ষা করার জন্য, আপদ বিপদের হাত থেকে ক্ষেত্রকে বাঁচানোর জন্য এই ক্ষেত্র দেবতার আবির্ভাব ঘটেছিল! উল্লেখ করা যায় যে ধর্মরাজের মতো দীর্ঘদিন এই দেবতা সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের দখলে ছিল, তারাই ছিল এই দেবতার সেবাইত! তার প্রমাণ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার সিঙ্গি গ্রামের ক্ষেত্রপাল, আজও নিম্ন শ্রেণীর দখলে, সেই প্রাচীনকাল থেকে এই দেবতার সেবাইতের দায়িত্ব পালন করছেন গ্রামের সাহা সম্প্রদায়। তাহলে বোঝা যায় যে একসময় এই ক্ষেত্রদেবতার দায়িত্ব কাদের হাতে ছিল! বাংলার মহাভারত প্রনেতা কাশীরাম দাসের গ্রাম এই সিঙ্গি, এই গ্রামটাও যেমন প্রাচীন তেমনি ক্ষেত্রপাল ও যথেষ্ট প্রাচীন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য যে সেই আদি কবি, বাংলায় মহাভারত প্রনেতা তার কাব্যে এই ক্ষেত্রপালের কথা উল্লেখ করেছেন-'ঊনকোটি দানা নিয়ে আসে ক্ষেত্রপাল'! আরো উল্লেখ করা যায় যে আর্যীকরণ সূত্রে পরবর্তীকালে আপস মীমাংসার মাধ্যমে এই ক্ষেত্র দেবতা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে এসে যায় এবং হয়তো ধর্মের রুদ্ররূপী ভৈরবের অঙ্গীভূত হিসেবে! পরবর্তীকাল এর পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভৈরব মূর্তি, ক্ষেত্রপালকে জটাজুধারি রুদ্ররূপী শিবের ভূমিকায় অনার একটা প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়!এরপর অন্যান্য গোষ্ঠীর আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটে! তবে বঙ্গে সামন্ত প্রথার সূত্রপাতের পরেই এই আধিপত্যের শুরু, তা যে শুধু ক্ষেত্রপালের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়, ধর্ম মনসার চন্ডী চামুন্ডা প্রভৃতি অনার্য দেব দেবী গুলো এই সূত্র ধরেই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে এসে যায়। সতীপীঠ ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
আজকে ক্ষেত্র সমীক্ষায় ফুলগ্রামে আসার মুখে দেখলাম পূব পাড়ার বর্গ ক্ষত্রিয়রা, পশ্চিম পাড়ার রুইদাসরা দস্তুর মতো লাঠি উঁচিয়ে ডগর বাদ্যে নৃত্যের তালে তালে শোভাযাত্রা সহকারে সদর্পে ক্ষেত্রপাল তলার দিকে এগিয়ে চলেছে! অনার্য সংস্কৃতির ঝলক চোখের সামনে উঠে এলো! এদের উৎসাহ উন্মাদনা প্রমাণ করে হারিয়ে যাওয়া অতীত ঐতিহ্যকে! শুধু তাই নয় কয়েকশো বলি, গোটা ক্ষেত্রপাল স্থান জুড়ে, যত্রতত্র বলি, যা অনার্য সংস্কৃতির একটা অন্যতম রুপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জামালপুরের বুড়ো রাজে যেমন শত শত গোপ, বর্গক্ষত্রিয়রা লাঠি বল্লম উঁচিয়ে সদর্পে এগিয়ে চলে, এখানেও ঠিক তাই! প্রাচীন সংস্কৃতির ঝলক মাঝে মাঝে উঠে আসে, ঠিক তখনই অতীত ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়!
বর্ধমান জেলায় বেশ কিছু প্রাচীন ক্ষেত্রপাল এর অধিষ্ঠান রয়েছে, বেশিরভাগই মাঠের মাঝে খোলা আকাশের নীচে প্রাচীন বট অশ্বথ তেতুল প্রভৃতি প্রাচীন বৃক্ষের তলায়! এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পানাগড়ের ক্ষেত্রপাল, পূর্বে ২২ টি গ্রামের মাঝে একটা প্রাচীন তেঁতুল গাছের তলায় এর অধিষ্ঠান ছিল, ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ অর্ধে অর্থাৎ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিরক্ষা দপ্তর এই গ্রামগুলো অধিগ্রহণ করে, কিন্তু জনগণের চাপে ক্ষেত্রপাল মিলিটারি ক্যাম্পের ভেতরেই থেকে যায় প্রায় দু বিঘে জায়গা জুড়ে, বর্তমানে সেখানে ক্ষেত্রপাল এর বিশাল মন্দির তৈরি হয়েছে, এবং প্রস্তর মূর্তিতে ক্ষেত্রপালের পূজা হয়। তবে সবটাই প্রতিরক্ষা দপ্তরের করা নিরাপত্তার মাধ্যমে এখানে ভক্তরা ক্ষেত্রপালের দর্শন পায়! সিঙ্গি গ্রামের ক্ষেত্রপাল গ্রামের উত্তর পূর্ব প্রান্তে এক প্রাচীন বৃক্ষের তলায়, তাছাড়া ভাতার ব্লকের মুরুলিয়া ছাতনি, পূর্বস্থলী ব্লকের ঘুনী, প্রভূতি গ্রামের ক্ষেত্রপাল ও খুবই প্রাচীন!
যাই হোক এক সময় অনার্য কৃষিজীবী সম্প্রদায় কৃষি ক্ষেত্রের আপদ বিপদ উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে টোটেম প্রথায় এই ক্ষেত্র দেবতার আরাধনা করেছিল, পরবর্তীকালে এক আপস মীমাংসা সূত্রে আর্যীকরনের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় জটাজুধারী রুদ্ররূপী ভৈরবের রূপ পরিগ্রহ লাভ করেছে।
============================
লেখক পরিচিতি::বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক লেখালেখির সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন!
=================================