গল্প ।। রতন একটি অবোধ বালিকার নাম ।। গোবিন্দ মোদক
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
রতন একটি অবোধ বালিকার নাম
গোবিন্দ মোদক
দিন চারেক হইল পোস্টমাস্টার তাহার কাজে জবাব দিয়া কলিকাতা ফিরিয়া গিয়াছেন। বলিয়া গিয়াছেন আর আসিবেন না। কিন্তু রতনের কাছে ইহা একটি প্রবল মিথ্যার মতো প্রতিভাত হয়। সে কেবলই পোস্টঅফিসের চারিপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহার বিশ্বাস তাহার পোস্টমাস্টার দাদাবাবু আবার ফিরিয়া আসিবেন, আবার পোস্টঅফিসের কাজ করিবেন, রতনের সঙ্গে আবার সেই পুরাতন সখ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে — অবকাশের সময় তিনি রতনের সহিত তাহার কলিকাতার বাড়ির গল্প করিবেন, সময়ান্তরে তিনি রতনকে যুক্তাক্ষর পরবর্তী পড়া পড়াইবেন, আর মন-মেজাজ তেমন ভালো না থাকিলে হুকুম করিবেন — রতন, একটু তামাক সাজিয়া আন দেখি!
কিন্তু বাস্তবে তেমনটি আর হয় না, পোস্টমাস্টার আর ফিরিয়া আসেন না, ভগ্নহৃদয়ে ব্যর্থ-মনস্কাম রতন কেবলই পোস্টঅফিসের চারিপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকে।
অবশেষে তাহার মনের মধ্যে নানাপ্রকার সম্ভাবনার কথা উদয় হয়, কিন্তু কোনও সম্ভাবনাই চূড়ান্ত পরিণতি পায় না। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া সে তাহার অপটু হস্তে তাহার পোস্টমাস্টার দাদাবাবুকে একখানি চিঠি লিখিয়া ফেলে — "দাদাবাবু, আমি খুব মনোকষ্টে আছি। তুমি ফিরিয়া আইসো!" চিঠিখানি লিখিয়া সে পোস্টঅফিসের ডাকবাক্সে পোস্ট করিয়া দেয়। তাহার পর এক প্রবল বিশ্বাসবশতঃ পোস্টঅফিসের চারিপাশে সর্বদা ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকে। বর্তমান পোস্টমাস্টারকে কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে থাকে — মাস্টারবাবু, আমার নামে কি কোনও চিঠি আসিয়াছে? মাস্টারবাবু দুইদিকে ঘাড় নাড়েন। বেচারী রতন! অবোধ বালিকা! সে কি প্রকারে বুঝিবে ঠিকানা ব্যতীত কোনও চিঠি কোথাও পৌঁছে না! কাজেই উত্তর আসিবে কি প্রকারে?
অবশেষে পোস্টমাস্টার দাদাবাবুর কাছ হইতে চিঠির উত্তর পাওয়ার আশা একপ্রকার ছাড়িয়ে দেয় রতন। সে ভিন্নতর কোনও পন্থা খুঁজিতে থাকে। ইতোমধ্যে প্রকৃতি জুড়িয়া শারদীয়ার আগমন ঘোষিত হইতে থাকে। সে দেখিতে পায় বর্ষণক্লান্ত মেঘ বিদায় লইয়া আকাশ সুনীল হইয়াছে, তাহাতে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ সতত সঞ্চরণশীল, নদীর তীরে কাশের সমারোহ, খালে-বিলে দুই-একটি শাপলা-শালুক উঁকি দিতেছে, শিউলি গাছের শাখা-প্রশাখা জুড়িয়া ভরিয়া আসিয়াছে কুঁড়ি। রতন মনস্থির করিয়া ফেলে — তাহাকে কলিকাতা যাইতে হইবে, দাদাবাবুর সন্ধান করিতে হইবে, দাদাবাবুকে ছাড়া সে বাঁচিতে পারিবে না! রতনের চক্ষে জল ভরিয়া আসে।
আশেপাশের দুই-একটি গৃহস্থবাড়িতে কাজকর্ম করিয়া রতন সামান্য পয়সা-কড়ি যাহা পাইয়াছিল তাহা লইয়াই সে পাড়ি দিল কলিকাতার উদ্দেশে। কিছুটা হাঁটিয়া, কিছুটা নৌকায়, কিছুটা ট্রেনে যাইয়া সে যখন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছিল তখন লোকজন গাড়ি ঘোড়া দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। এতো বড় শহর! এখানে দাদাবাবুকে খুঁজিবে কি প্রকারে!
যাহাই হউক, বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে একটি পোস্টঅফিসে আসিয়া হাজির হইল অনেক কষ্টে। পুরাতন সাইনবোর্ডে লেখা আছে বউবাজার পোস্টঅফিস। অফিসটিতে অনেক লোকজন। রতন চাহিয়া দেখিল তাহার দাদাবাবু বসিয়া কাজ করিতেছেন। রতন ভাবিল কষ্ট করিয়া তাহার আসা সার্থক হইয়াছে। তাহার চক্ষে জল ভরিয়া আসিল। সে দ্রুতপদে কাছে গিয়ে ডাকিল- দাদাবাবু!
— তুমি কি কাহাকেও খুঁজিতেছ, বোন?
অশ্রু সংবরণ করিয়া রতন দেখিল- দাদাবাবু নহেন, দাদাবাবুর মতোই একজন সেখানে কাজ করিতেছেন। প্রবল হতাশায় রতনের চক্ষে পুনরায় জল আসিল।
রতনের কাছে সমস্ত শুনিয়া সেই সহৃদয় ভদ্রলোক বলিলেন - রতন, তুমি তোমার দাদাবাবুর নাম বলো দেখি! রতন তাহার দাদাবাবুর নাম কিছুতেই বলিতে পারিল না, কারণ সে তাহার দাদাবাবুকে "দাদাবাবু" বলিয়াই জানিত, তাহার যে একটি নাম আছে সেটি জিজ্ঞাসা করিবার কোনওদিন দরকার হয় নাই।
ভদ্রলোক বলিলেন - এই কলিকাতায় প্রায় একশত পোস্টঅফিস আছে, সুতরাং কোন পোস্টঅফিসে তিনি কাজ করেন তাহা নাম না জানা থাকিলে বলা সম্ভবপর নহে। ভদ্রলোকের কথা শুনিয়া রতনের মুখ ব্লটিং পেপারের মতো ফ্যাকাসে হইয়া গেল। তাহার সমস্ত আশা এক ফুৎকারে যেন নিভিয়া গিয়াছে। রতন তাহার চক্ষের জল সংবরণ করিয়া ধীরে ধীরে পথে নামিল। তাহার নজর এখন রাস্তার অপরপ্রান্তে।
ঠিক এমনই মুহূর্তে তাহার সামনে দিয়া ধর্মতলাগামী একটি ডাবলডেকার বাস চলিয়া যাইতেছিল। তাহার ভিতরে আমাদের সেই উলা গ্রামের ভূত-পূর্ব পোস্টমাস্টার বসিয়া ছিলেন। তিনি এক ঝলক রতনকে দেখিলেন। মুহূর্তে তাহাকে চিনিতে পারিলেন। ভাবিলেন এক ছুটিয়া বাস হইতে নামিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাহার মনে হইল সেই সুদূর উলা গ্রামের রতন, নিতান্ত এক অবোধ বালিকা, সে কী প্রকারে কলিকাতা শহরে আসিয়া পড়িবে! নাঃ, ইহা অন্য কেউ বটে!
কাজেই ধর্মতলাগামী বাস ছুটিয়া চলিল আপন গন্তব্যে আর রতন তাহার পরবর্তী গন্তব্যের জন্য পা রাখিল অপরিচিত শহরের রাস্তায়।
=============================
স্বরচিত মৌলিক গল্প।
(রবীন্দ্রনাথের "পোস্টমাস্টার" শীর্ষক ছোটগল্পের "রতন" নামক চতুর্দশবর্ষিয়া বালিকা চরিত্রটিকে কেন্দ্র করিয়া এই কাল্পনিক গল্পটি রচিত হইয়াছে)
রচনা: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ।