আরতি মিত্র
" মুনিয়া , তুমি জলের কাছে ঐভাবে ঝুঁকে বসে আছো কেন?"
মুনিয়া কি করে বোঝাবে মাকে, তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে! ওর ঠাম্মিকে যখন বাড়ি থেকে অন্য জায়গাতে বাবা,মা মিলে রেখে এসেছে ,তখন থেকেই ওর কিছুই ভালো লাগছে না।
বৃদ্ধাশ্রম কি সে জানে না।
আজ সবাই মিলে এখানে এসেছে, যে ঠাম্মিকে ও এতো ভালোবাসে, আশ্চর্য তার মুখটার দিকে তাকালেই ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে! সে মনে মনে ভাবছে," এর নাম বৃদ্ধাশ্রম, এটা তো একটা বিশাল বাড়ি, ওদের ফ্ল্যাট বাড়ির মতো নয়, অনেক অনেক গাছপালা, ঘাট বাঁধানো পুকুর, খুব সুন্দর ।
মুনিয়ার মতো ঠাম্মির মনেও আনন্দ নেই, হয়তো ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটাই ভালো কারণ ওখানে মুনিয়া আছে যে ,তারপর থেকেই মুনিয়ার মনেও খুবই কষ্ট হচ্ছে, অথচ বাবা,মা বললো, এতো ছোট ঘরে ঠাকুমা হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারছে না, তাই অন্য একটা ভালো বাড়িতে ঠাকুমাকে রাখা হবে, সব মিথ্যে কথা,
মাগো, বড়রাও তাহলে মিথ্যে কথা বলে, ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা।"
অনেকবার ডাকাডাকির পর মুনিয়া মুখ নীচু করে ঘরে ঢুকলো, সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মাত্র ছুট্টে এসে ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
ঠাম্মি মুনিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, " ও মুনিয়া, মুনিয়া তোর কি হলো রে , এতো কাঁদছিস কেন?
আমি তো তোর কাছেই আছি।"
" তোমাকে তো বাড়িতে পাই না, আমার খুব কষ্ট হয় গো। তুমি আর এখানে থাকবে না, আমার সঙ্গে বাড়ি চলো ।"
" ওরে , তোদের ফ্ল্যাটটা বড্ড ছোট তো, আমার ওখানে থাকতে খুবই কষ্ট হয় রে। তোর যখন আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে, এখানে চলে আসবি, ঠিক আছে?"
" না না, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না।" ইতিমধ্যে মুনিয়ার ঠাম্মি ফিরে গিয়েছেন তার অতীতের জীবনে।
ঠাকুমার আনমনা মনের আয়নায় কত শত ছবি জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগলো।
সে যখন মুনিয়ার মতো ছিল, কতো আনন্দময় জীবন ছিল তাদের,
সে যুগ আর এ যুগ --কত তফাত-- যৌথ পরিবার - চারপাশে আপনজনের ভালোবাসা,আদর --অবশ্য দুষ্টুমি করলে গুরুজনদের শাসন ছিল বৈকি; কিন্ত সেই স্মৃতি পরম যত্ন করে মনের কোণে এখনও সাজিয়ে রেখেছে মুনিয়ার ঠাকুমা।
বড়দের চোখ এড়িয়ে বাগানে ঘুরে বেড়ানো, গাছের কাঁচা পাকা ফল লুকিয়ে খাওয়া - ঠাকুমা
আপন মনে বলে উঠলো "ওঃ, কি মজাটাই না করতাম।
সকালের পড়া শেষ করার ফাঁকেই মায়ের হাঁকডাক , ' রমা ও রমা , জলখাবারটা খেয়ে যা,'
আমি যেন বাঁচলাম, এবার গোগ্রাসে দুটো রুটি তরকারি খেয়েই দে ছুট,
একছুটেই এক্কেবারে মাঠে, উঃ, মুক্তির আনন্দ।
বন্ধুরাও ততক্ষণে এসে গেছে কত্তরকমের খেলা, গোল্লাছুট, চু কিত্ কিত্, কানামাছি,এক্কা দোক্কা আরও কত কি --"
হঠাৎই ভাবনার মধ্যে ছেদ পড়লো,
মুনিয়া বলে উঠলো ,
" কেন , সমুতো ( মামার ছেলে ) দিদার সঙ্গেই থাকে ,
ওদের ঘরও তো ছোট ,
তাহলে?"
ঠাকুমার মনে হলো ,"তিনিও তো ছোটবেলায় ঠাকুমা দাদুর সান্নিধ্য পেয়েছেন,
রামায়ণ,মহাভারতের গল্প শুনে শুনে বড়ো হয়েছেন,
শক্তিশেল বাণে আহত লক্ষণকে রক্ষা করতে হনুমানের গন্ধমাদন পর্বতকে নিয়ে আসা,
রাবণের সীতাহরণ,
বানরসেনাদের সেতুবন্ধন,
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-- আরও কত কি।
এসব তো মুনিয়াকে শোনানো হয়ে নি।
ঠাকুমার মানসিক দ্বন্দ্বে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলেন।"
সেই যে নাতনী গলা জাপটে ধরেছিল এখনও ছাড়েনি।
মুনিয়া তখন ঠাম্মির উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখল, ঠাম্মির মতো একজন মনমরা হয়ে বসে আছেন।
ঠাম্মির এখানে এসে সে দেখেছিলো তার ঠাম্মির মতো আরও অনেকেই রয়েছে,
ঠাম্মির ঘরের পাশে অন্য এক ঠাম্মির কাছে তখন ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" তোমাদের ঘরটাও কি ছোট,
তাই তোমাকে এখানে রেখে দিয়ে গেছে?"
একথা শুনে সেই ঠাম্মির দুচোখ জলে ভরে গেলো,
মুনিয়া বুঝতেই পারলো না কেন উনি কাঁদছেন?
সে কি কোন অন্যায় করেছে?"
ছুটে গিয়ে বললো, " ও ঠাম্মি তুমি কাঁদছো কেন গো?
আমার কথায় কি তুমি দুঃখ পেলে ?"
কি হয়েছে ঠাম্মি তোমার ,আমাকে বলো না গো"
তিনি চোখ তুলে মুনিয়াকে দেখলেন।
তারপর বললেন," তুমি কে মা?"
মুনিয়া আঙুল তুলে তার ঠাম্মিকে দেখিয়ে বলল, "আমার ঠাম্মি হয়।
- তুমি কাঁদছো কেন?"
- "আমার ছেলেটা আমাকে এখানে দু'মাস হল, রেখে গেছে। তারপর একবারও দেখতে আসেনি।"
শুনে মুনিয়ার খুব কান্না পেল। সে এক ছুটে ঠাম্মির কাছে ফিরে এসে
ঠাম্মির গলা জড়িয়ে ধরে বলল," আমি তোমাকে ছেড়ে এখান থেকে যাব না। আমি তোমার সঙ্গে এখানেই থাকব।"
মুনিয়ার মা ভিতরে ভিতরে খুব রেগে গেল। শেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে, মুখে বলল, "কি জেদ তোমার মেয়ের।"
মুনিয়ার বাবা বলল, "একদম আমার মায়ের মতো হয়েছে। আমার মায়েরও খুব জেদ ছিল। কি আর করা যাবে, চলো মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাই।"
মুনিয়ার মা তাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, "তোমার যা ইচ্ছে কর। "বলে সে নিজে বাইরে বেরিয়ে গেল।
-----------------------------------
Arati Mitra.
267/3 Nayabad. Garia.
Kol. 700094