গল্প ।। ব্যতিক্রমী চরিত্র ।। দীপক পাল
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
ব্যতিক্রমী চরিত্র
দীপক পাল
- আরে মোজা, শিক্ষা তো দেখছি বেশ ভালো ভাবেই হয়েছে তোমার।'
- কিসে বুঝলে সেটা?' মোজাম্বেল বলে।
- এইযে সদর দরজাটা ঘ্যাঁচ করে শব্দ করে বন্ধ হলো। এই শব্দটা রাত দশটার পরে আজ বোধহয় প্রথম শুনলাম। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।'
- আরে ভাই কি বলবো তোরা কমন রুম থেকে আটটা পাখা চুরি করেছিস ঠিক আছে, তাই বলে জানালায় মেলা আমার নতুন টাওয়েলটাতে তেলকালি মাখা হাতগুলো মুছে, ফেলে না দিয়ে আবার সেটা আগের মত সুন্দর করে জানলায় মেলে দিলি। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি কালো তেলচিটে একটা টাওয়েল ঝুলছে।
- আমি কতো বার রাতে তোমাকে বলেছি দরজা বন্ধ না করলে একদিন ঠিক চুরি হবে। তুমি তখন বলেছিলে যে তবেই আমার শিক্ষা হবে। এটা একটা অদ্ভুত যুক্তি। তুমি ধরেই নিয়েছিলে কোনোদিন চুরি হবে না। বোঝো আটখানা পাখা চুরি হয়ে গেলো। অবশ্য তোমার এই শিক্ষাটা দরকার ছিল।
- ঠিক বলেছো।'
এর নাম মোজাম্বেল। বেশ মোটা শ্যাম বর্ণ। ভীষণ কুঁড়ে কিন্তু বেশ জ্ঞানী ও রসিক। রাতে দরজা সেই পর্যন্তই দিত যেখানে দরজাটা আটকে যায়। মাথার দিকের জানলাটা অর্থাৎ দরজা বরাবর যে জানলাটা আছে সেটা পুরোটা খোলা থাকতো আর সেই বরাবর খাটটাকে রেখেছিল যাতে বাইরের হাওয়াটা সোজাসুজি ও পায়। মশারিটা ছাতার মত ওপরে গোটানো থাকতো ক্বচিৎ খোলার প্রয়োজন পড়ত। একদিন নাকি মশার কামড় খেয়ে ওই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মশারীটা ফেলেছিল। কিন্তু মশারির ভিতর নাকি এত মশা ঢুকে গিয়েছিল যে মশার কামড়ে ঘুমোতে পারছিল না। তখন সে মশারির একপ্রান্ত তুলে একটা খবরের কাগজ দিয়ে জোরে জোরে হাওয়া করে ঘরের সব মশা মশারির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে মশারী ফেলে দিয়ে তার বাইরে আরাম করে ঘুমিয়েছে। এটা ওর মুখে শোনা। অত রাতের কথা কেইবা দেখেছে। যাই হোক ও দরজাটার ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাত না। খালি অফিসে গেলে বা কোথাও বাইরে গেলে দরজাটা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে বেরত। তালা সব সময় দরজার কড়ায় ঝোলান থাকতো। আমি একদিন বললাম, 'দরজাটা না হয় হাওয়া পাস করার জন্য খোলা থাকলো কিন্তু সারারাত লাইট কেনো জ্বালিয়ে রাখো? ভয়ে নাকি?' মোজা উত্তর দিলো,
- আরে বাবা ভয় টয় কিছুনা। আসলে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। তাই লাইট নিভানো হয়না।
- ' এই দিকেও তো একটা জানলা আছে নাকি। তার পাশেই তো সুইচ বোর্ড। আমি তো গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুম এসে গেলে মশারির ভিতর থেকেই হাত উঁচু করে লাইট নিভিয়ে দিই। আমার তো লাইট জ্বালা থাকলে ঘুমই হবে না। এই উইংয়ে সবাই খাট এই সুবিধাটুকুর জন্যই এদিকে রেখে ঘুমায়।'
- ' সে আবার খাটটাকে ওদিকে টেনে নিয়ে যাও তারপর ঘুম পেলে কাঁধ উঁচু করে মাথাটা ওপরে তুলে হাত উঠিয়ে মশারির ভিতর থেকে সুইচ অফ করা এ ভয়ানক ঝামেলা। এর থেকে এখানেই ঠিক আছি। বাইরের হাওয়াটা পাই ঠিক ঠাক।'
একদিন একটা ছোট রেডিও কিনে এনে প্লাগ লাগিয়ে খবর শুনতে লাগলো। রাতের ডিনার সেরে রেডিও খুলে কিছু একটা পড়তে পড়তে গান শুনত বা খবর শুনত শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। কোনো সুইচই সে অফ করতো না। আবার সকাল হতেই রেডিও প্রোগ্রাম শুরুর আগে যে মিউজিকটা শুরু হয় সেটা শুনে তার ঘুম ভাঙত। যদি জিজ্ঞেস করতাম রেডিও অফ কেনো করেনা? সে তখন একটা অদ্ভুত যুক্তি শোনায়। আলাদা করে বন্ধ করার কি প্রয়োজন। প্রোগ্রাম শেষ হলে তো এমনি বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন আবার নিজের থেকেই প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়। শুয়ে শুয়ে প্রোগ্রাম শোনা যায় আবার। আমারও হ্যাপা সইতে হয়না।
মোজাম্বেলের অফিসে যাওয়াটাও মজার ব্যাপার ছিল। ঘরের মাঝ বরাবর একটা দড়ি টাঙনো থাকতো। ওই দড়িতে জামাটা এমন ভাবে ঝুলিয়ে রাখতো যে সহজেই দুটো হাত গলিয়ে পড়া যায়।ফুলপ্যান্টটা চটির ওপর গুটিয়ে এমন ভাবে রাখতো যে ঘুম থেকে উঠে খাট থেকেই দুটো পা একেবারে চটির মধ্যে ঢুকিয়ে প্যান্টটা একটানে কোমর অবধি তুলে দিয়ে দড়িতে ঝোলান জামায় দুটো হাত গলিয়ে নিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে পকেট থেকে চাবি বার করে কড়াতে ঝোলানো তালা খুলে এবং দিতে ওর পাঁচ ছ মিনিট সময় লাগতো। এত কথা বলছি যে কারণে সেটা হলো ওর এক বন্ধু নিকটস্থ এক কোয়ার্টারে থাকতো সে মোটরসাইকেল নিয়ে হোস্টেল ক্যাম্পাসে ঢুকে এ উইংয়ে দু নাম্বার ঘরের কাছে এসে বাইক থেকে। না নেমে ডাকতো
' মোজামবেল এই মোজামবেল '। ঘুমন্ত মোজা লাফ দিয়ে উঠে যে কাজটির কথা বললাম সেটি করে বন্ধুর বাইকের পেছনে বসে বলত ' চল '।টেকনিক্যাল স্টাফদের ডিউটি ছিল সকাল ৭টা থেকে ১২টা আবার ২টো থেকে ৫টা।
এরপর আমরা কোয়ার্টারে চলে যাবার পর মোজাম্বেল মোটর সাইকেল কিনলো। শেখাবার ভার নিল পলাশ। সে থাকত পাশের কোয়ার্টারে। আমাদের কয়েকজনের কোয়ার্টার পাশাপাশি ও সামনা সামনি। আমাদের দশটা কোয়ার্টারের মাঝখান দিয়ে পীচের রাস্তাটা পাক দিয়ে ঘুরে পরের রাস্তায় পড়েছে। তাই এইটুকু জায়গা শেখার জন্য যথার্থ। মোজাকে পলাশ এইখানে মটর সাইকেল শেখাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে মোজাম্বেল একাই বেশ চালাতে লাগলো মনের খুশীতে। পলাশ কিছুটা সময় দাঁড়িয়েছিল। ভিতর থেকে চায়ের ডাক আসতেই ও ভিতরে ঢুকে সেদিনের খবরের কাগজ পড়তে লাগলো চা খেতে খেতে। হঠাৎ করে পেটের তলদেশে চাপ পড়তেই টয়লেটে ঢুঁকে পড়লো। ভুলে গেলো মোজাম্বেলের কথা। আর ঠিক সেই সময় মটর সাইকেল থেকে নামার জন্য পলাশের বাড়ির দরজার কাছে এসে ' পলাশ, এই পলাশ ' বলে ডেকে বেরিয়ে গেলো। আবার গাড়িটাকে ঘুরিয়ে এনে এপাশের দরজার কাছ দিয়ে যাবার সময় 'এই পলাশ, এই পলাশ ' বলে ডেকে গেলো। কোয়ার্টার গুলোর একতলায় বাইরে বেরোনোর বা ঢোকার জন্য দুদিকেই দরজা ছিল। আসলে মোজা স্টার্টটা শিখেই চালাতে শুরু করেছিল, কি করে থামতে হয় সেটা না শিখেই। এদিকে পলাশ সদ্য টয়লেটে গেছে তাই সেও চট করে বেরোতে পারছিল না। ওদিকে মোজা পাক খেয়েই যাচ্ছে। পলাশের কোয়ার্টারের দুদিকের দরজা দিয়ে যেতে যেতে হাঁক পারতে পারতে, ' এই পলাশ, পলাশ '। পলাশ টয়লেট থেকে বেরিয়েই হাঁক পারলো, ' কোথায় মোজা দা ?' দরজাদিয়ে বেরিয়ে শুনলো, 'এই যে আমি এখানে '।
পলাশ দেখলো মোজাম্মেল উল্টো দিকের দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলো। ও ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কারণ মোজা ওখানেই ঘুরে আসবে। এবং মজাম্বেল কাছে আসতেই পলাশ বাইকের সাথে সাথে দৌড়তে দৌড়তে নির্দেশ দিতে লাগলো। কিছু দূরে যেতেই বাইকটা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো।।
এর কিছুদিন পরে আমি আর এক বন্ধু রবিন অফিস থাকে বেরিয়ে দেখি আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। ঝড় ওঠার বাকি নেই। তাই দুজনে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলাম। ঠিক এই সময় মোজাম্বেল তার বাইকটা আমার পাশে ঘ্যাঁচ করে দাঁড় করালো। বললো, ' চটপট দুজনে বাইকের পেছনে উঠে পড়। ভয়ানক জোরে বৃষ্টি আসছে।'
আমি আর রবিন পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। মনে মনে ভাবলাম আরে এ বলে কি এই কদিন হলো মাত্র বাইক চালানো শিখল আর এখনই বাইকের পেছনে দুজনকে বসিয়ে এই অতি ব্যস্ত রাস্তার ওপর দিয়ে রাইড করতে চায়। এখান থেকে টাউনশিপটা তো কম দুর না। তার ওপর মুচিপাড়ার ওপর জিটি রোডের মোড়টা পেরোনো যে এক কঠিন ব্যাপার কারণ মোড়ের বাঁকটা একটু বেশ গোলমেলে। ঘাবড়ে গিয়ে রবিন বললো,
- ' মোজা, তার কোনো দরকার নেই। গেটটা পেরোলেই রাস্তার ওপারে বাস স্ট্যান্ড। আমরা বাসে করে ফিরছি। তুমি এগোও ওখানে দেখা হবে।'
- ' আরে যা বলছি শোন, আকাশের অবস্থা দেখছ তো। বাস কি তোমার কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে? দু আড়াই ঘণ্টার আগে ঘরে পৌঁছতে পারবে না। নাও উঠে পড় তাড়াতাড়ি। এখনই জোরে নামবে বৃষ্টি।'
সত্যি হঠাৎ জোরে হাওয়া বইতে শুরু হল।আমরা ভগবানের নাম করে বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। রাস্তার কিছুটা পর্শন জিটি রোডের ওপর দিয়ে গিয়ে ডান দিকে ফরেস্ট অফিসের ভিতরদিয়ে টাউনশিপের রাস্তায় পরেছে। ফরেস্টের এই ছোট্ট রাস্তাটা কাঁচা এবং সরু। মোটর গাড়ি যায় না। এইটুকু রাস্তা পেরোলে টু ওয়ে রাস্তা টাউনশিপ বরাবর গেছে। কিন্তু এই টু ওয়ে রাস্তা শুরুর মুখে একটা কালভার্ট পরে। সেটা আবার কাঁচা রাস্তার নাক বরাবর। গেট পেরোতেই বৃষ্টি শুরু হলো। জিটি রোড পড়তেই মুষল ধারায় বৃষ্টি নামলো। দৃশ্যমান আবছা হয়ে গেলো। মোজাম্মেল বোধহয় সেইসময় নার্ভাস বোধ করছিল। গাড়ি সেই সময় কম থাকায় জিটি রোড পেরিয়ে ফরেস্ট অফিসের রাস্তায় গিয়ে পড়লো বাইকটা। সরু কাঁচা রাস্তার ওপরে মনে হচ্ছিল কোনো গাছে গিয়ে লাগতে পারে। সেটা কোনো রকমে পেরোতেই একেবারে সামনে সেই কালভার্ট। প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টির ছাট চোখে মুখে এসে লাগছে, মোজাম্মেল হেলমেট পরেনি। বাইকটা সোজা কালভার্টের সাথে সংঘর্ষ হবেই। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সংঘর্ষের অপেক্ষা। কিন্তু গাড়ি চলতে লাগলো। চোখ খুলে দেখি কালভার্ট পেরিয়ে গেছে। আমি জোরে চেঁচিয়ে বললাম,
- ' রবিন বেঁচে গেছি আমরা। মোজা দারুন ভাবে শেষ মুহূর্তে কাটিয়েছে কালভার্টটাকে।'
- ' সেইতোরে, মোজা জিন্দাবাদ।' আমি বললাম,
- ' আচ্ছা মোজা তুমিতো দারুন বাইক চালাও। কি করে শেষ মুহূর্তে কাটিয়ে ফেললে?'
- ' জানি না।' হাসি হাসি মুখে ছোট্ট উত্তর।
- ' এই বলোনা, সত্যি ইয়ার্কি করো না।'
- ' আরে আমি সত্যি বলছি। আমি তো চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। কি করে কি হলো আমি বলতে পারবো না।'
রহস্যজনক ব্যাপার। অনেক বার মোজাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কিন্তু এক কথাই বলেছে।এর পরেও বাইকের লেগ গার্ড ভেঙ্গে যাওয়ায় সেটা সারাতে সারাতে মোজার পনের দিন লেগেছিল। সকালে ভাবে টিফিন টাইমে করে নেবে। আবার টিফিনের সময় ভাবে ছুটির পর সরিয়ে নেবে। কিন্তু ছুটি হয়ে গেলে ভাবতো আজ থাক কাল করে নেব। দুটো গ্যারেজ অফিসে যাওয়ার পথেই পড়ে কিন্তু।
-০-০-০-০-০-০-০-০-
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.