বৈশাখী আকাশ
অভিষিক্তা দে (দোলা)
আকাশ আর বৈশাখীর ফেসবুকে আলাপ হয়। বৈশাখী খুব মিষ্টি দেখতে, কিন্ত আকাশ দেখতে শুনতে তেমন নয়।
বৈশাখী একদিন ফেসবুক গ্রুপে আকাশের কবিতা পাঠ শোনে। কবিতার কথা আর আবৃতির শৈলী এমন অন্তরভেদি ছিল যে প্রথম দেখাতেই তার আকাশকে ভালো লেগে যায়। সে আকাশকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, আর এভাবেই তাদের পরিচয় হয়।
বৈশাখীর বয়স চব্বিশ বছর, গ্রাজুয়েট। কোনো রকমে পাশ করেছে, পড়াশোনায় মন ছিলনা তার। সে ভাবে চাকরি করে অনেক কিছু করবে, কিন্তু চাকরি খোঁজার মানসিকতা খুব একটা দেখা যায় না। সে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, বাবা নেই, মা আছে, আর ওর দাদা ছোটখাটো একটা চাকরি করে। কিছু জমানো টাকা রয়েছে তার ইন্টারেস্ট আর বাড়ি ভাড়ার টাকায় ওদের সংসার চলে। কিন্তু ওর চোখে অনেক স্বপ্ন।
এদিকে আকাশের বছর সাতাশ বয়স। সে খুব সংবেদনশীল, শিল্প মনস্ক মানুষ। কবিতা লেখে, ছবি আঁকে আর একটা ভালো চাকরি করে। তার বাড়িতে বাবা-মা দাদা বৌদি, ছোট একটা ভাইঝি আর ঠাকুমা আছেন। ওদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। সেটা ওর বাবা আর দাদা দেখাশোনা করে, কিছু পৈত্রিক সম্পত্তিও রয়েছে, খুব সচ্ছল পরিবার, উচ্চ মধ্যবিত্ত বললে ভুল হবে না।
এদিকে বৈশাখী ও আকাশ আলাপের পর মসেঞ্জারে কথা বলে ভালো লাগায় তারা ফোনে কথা বলা শুরু করে। আস্তে আস্তে আকাশের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে জেনে বৈশাখীর তার প্রাতি একটা ভালো লাগা তৈরী হয়। সে খুব পরোপকারী, মিশুকে হাসিখুশি ধরনের। অনেক বন্ধু থাকা সত্ত্বেও বছর তিনেক আগে প্রেমে গভীর আঘাত পাওয়ার পরে সে আর দ্বিতীয় বার কারোর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়। তবু তার বৈশাখীর প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়েছে।
বৈশাখীর আকাশের প্রতি আকর্ষণ এতটাই বেড়ে উঠেছে যে সে নিজে থেকে আকাশকে ফোন করে, তার খেয়াল রাখে, দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করে। কতদিন গল্প করতে করতে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। এসব আকাশের খুব ভালো লাগছে, সে বৈশাখীর অনুভূতি বুঝতে পারে, কিন্তু তার মনের কথা জানাতে সাহস পায় না। আকাশের মনভাব বৈশাখীরও বুঝতে অসুবিধা হয়না, তার ইচ্ছা করে তাদের মাঝখানে যে না বলা অনুভূতি আছে তার আবরণ তুলে দিতে। তবে বৈশাখীর নিজেকে এতটা তুচ্ছ করে তুলতে ইচ্ছা হয়না। এদিকে আকাশের অতীত অভিজ্ঞতার ভয় থাকা সত্ত্বেও, বৈশাখীর কথা, আচরণ, ভাব ভঙ্গি তার উপর এমনই প্রভাব ফেলে যে তার আবেগের বাঁধ ভেঙে যায়। তাদের অনুভূতি এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়।
এভাবেই আনন্দ আর হাসি মজায় বছর খানেক কাটার পর তাদের সম্পর্ক বেশ আগে এগিয়ে যায়। দুই বাড়ি থেকে তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন করনার কারনে লকডাউনের পরিস্থিতি শুরু হয় তখন সবকিছু বদলে যায়। অনেকের মত আকাশের চাকরিটাও চলে যায়। তার ঠাকুমা আর বাবা করনায় অসুস্থ হয়ে মারা যায়, তাদের কাপড়ের ব্যবসাটাও বেশ মন্দায় চলতে থাকে। এই অবস্থায় তার বাড়ির সকলে ভেঙে পড়ে, তারা কিভাবে সবকিছু সামাল দেবে তা বুঝতে পারে না। তাই দুই তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আকাশ আর বৈশাখীর বিয়েটা কিছুদিনের জন্য স্তগিত রাখা হবে। আকাশ খুব মন মরা উদাসীন হয়ে পড়ে। সে তার লেখা, ছবি আঁকা নিয়ে লক ডাউনের কঠিন সময়টা কাটায়।
এদিকে বৈশাখীর হয়ে যায় ভীষণ চিন্তা। কারণ এতদিন আকাশ তাকে বেশ দামী দামী উপহার দিত, প্রয়োজন হলেই অনলাইনে টাকা পাঠাতো। কিন্তু এই বিপদকালীন পরিস্থিতিতে সেই সমস্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈশাখী মনঃক্ষুণ্ণ হয়। আস্তে আস্তে বৈশাখী আকাশের সাথে যোগাযোগ রাখা কমিয়ে দেয়। আকাশ খেয়াল করে না যে বৈশাখী আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ সরল সাদাসিধে, জটিলতা বোঝে না, তাই সে ভাবে এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির কারণে বৈশাখীরও মন ভালো নেই। তাই দুজনেরই দুজনকে একটু ভাবার সময় দেয়া দরকার।
তবে সে দু-একবার বৈশাখীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু সে বিষয়টা এড়িয়ে যায়।
তবে কদিন ধরে আকাশ বারবার বৈশাখীকে ফোন করে, ব্যস্ত দেখতে পায়। তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, আমার স্কুলের পুরনো বন্ধুরা মিলে একটা গ্রুপ খুলেছে এবং তারা এই লকডাউনে সময় কাটাবার জন্য কনফারেন্সে কথা বলে আড্ডা দেয়। আকাশ বৈশাখীর কথা বিশ্বাস করে নেয়। তবে এই ঘটনার এক দু মাস গড়াতে না গড়াতেই বৈশাখী ভীষণভাবে আকাশকে উপেক্ষা করতে শুরু করে। আকাশ এতে ভীষণভাবে কষ্ট পায়, সে বারবার বৈশাখীর সাথে কথা বলে সমস্ত কিছু জানতে চায়। কিন্তু লকডাউন চলায় সে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে পারে না। এখন বৈশাখী আর তার সাথে ভালোভাবে কথাও বলে না, সবসময় রাগ দেখায়, কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব তার, কেমন যেন বদলে গেছে সে।
এরপর বৈশাখী প্রথমে দুদিন তিনদিন ছাড়া ছাড়া, তারপর এক সপ্তাহ বাদ দিয়ে সে আকাশের সাথে কথা বলে। এটা আকাশ বিশেষ ভালো লাগে না, সে অশনি সংকেতের অভাষ পায়। সে ভাবে, আমার কোন ভুল ত্রুটি হলো না তো! সে বারবারই ম্যাসেজ করে, ফোনে জিজ্ঞাসা করে- কিন্তু কোনো সদত্তর পায় না। হঠাৎ একদিন বৈশাখী আকাশকে বলে যে- আমার কিছু জরুরী কথা বলার আছে তোমাকে। আকাশ উদ্বিগ্ন হয়। বৈশাখী বলে - আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলেটা একটা ব্যাংকে বড় পোস্টে চাকরি করে, ভালো মাইনে তার। পারিবারিক অবস্থাও খুব ভালো।
এসব কথা শুনে আকাশের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে।
সে জানতে চায়, তুমি কি নিজে থেকেই এই বিয়ে ঠিক করেছ, নাকি বাড়ি থেকে ঠিক করেছে? বৈশাখী বলে- আমি নিজেই ঠিক করেছি। এই কথা শুনে আকাশ মনে মনে ছটফট করে ওঠে, কথা হারিয়ে যায়, কাপা গলায় সে জিজ্ঞাসা করে, বৈশাখী তুমি এমন কি করে করতে পারলে? কেন করলে তুমি? তাতে বৈশাখী উত্তর দেয়, ছাড়ো, সে বিষয়ে তুমি না জানলেই ভালো। তুমি আমাদের সম্পর্ক ভাঙ্গার বিষয়টাকে যত সহজে মেনে নেবে ততই তোমার আর আমার দুজনের জন্যই মঙ্গল। কিন্তু আকাশের পক্ষে কিছুতেই ব্যাপারটা এত সহজে মেনে নেয়া সম্ভব হয় না, কারণ সে সত্যিই বৈশাখীকে ভীষণ ভালোবাসে ছিল, আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়ে ছিল । তাই বৈশাখীর এই সিদ্ধান্তে সে দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে। তার মনের ভিতর যেন এক তুফান এসে তার স্বপ্নের ঘর ভেঙে চুরমার করে দিল বৈশাখীর একটা সিদ্ধান্ত।
সময় এক শিশুর মত কেঁদে উঠলো সে বৈশাখীকে বলল, আমায় ছেড়ে যেও না, তোমায় বড্ড ভালোবাসি। তুমি ছাড়া এই কঠিন সময়ে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। যদি কোন ভুল ত্রুটি করে থাকি তুমি আমাকে ধরিয়ে দাও, আমি তা শুধরে নেব কিন্তু আমায় ছেড়ে যেও না। তোমার জীবনে আমায় একটু জায়গা দাও আমায় এভাবে একা করে দিও না, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবনা।
কিন্তু বৈশাখী তাকে জানিয়ে দেয়, আমার পক্ষে কোনভাবেই এই সিদ্ধান্ত বদলানো সম্ভব নয়। আকাশ বারবারই তার কাছে কাকুতি মিনতি করে, বৈশাখীর এভাবে তাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ বলার জন্য। কিন্তু প্রথম অবস্থায় বৈশাখী তা বলতে চায় না। তবে আকাশের এই নাছোড়বান্দা অবস্থা দেখে বৈশাখী সময়কে বলে, দেখো তোমাকে যদি আমি সত্যি কারণটা বলি, তাহলে তোমার হয়তো খারাপ লাগবে, কষ্ট হবে। আমি তোমাকে আর বেশি কষ্ট দিতে চাই না।
আকাশ বলে, আমি বুঝে গেছি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু তুমি যদি আমাকে এভাবে না বলে চলে যাও তাতে যে আমি আরো কষ্ট পাব। এই প্রশ্ন আমাকে সারা জীবন কুড়ে কুড়ে খাবে। আর তুমি যদি সত্যি একদিনের জন্যও আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাকে কারণটা বলে যাও।
তখন বৈশাখী তার মুখের উপর উত্তর দেয়, দেখো আকাশ, আমি ভেবেছিলাম তুমি একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে কিন্তু এখন তো তোমাদের পরিবারের অবস্থা আর আগের মতো নেই, আর আমি ভীষণ উচ্ছাকাঙ্খী, ছোট থেকেই অনেক কিছু আমি পাইনি, তাই আমি তোমার কাছ থেকে আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন পূরণের আশা করেছিলাম। তবে আমার মনে হয় না যে তুমি আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। তাই আমি সেই মানুষটাকেই বেছে নিয়েছি যে আমার সমস্ত স্বপ্নপূরণ করতে পারবে।
আকাশ কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও। আমি সব পাল্টে ফেলতে পারি তোমার জন্য, অনেক টাকা রোজগার করবো। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করব।
বৈশাখী বলে, আমি মনস্থির করে ফেলেছি আকাশ। তোমার আর আমার রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু তুমি শুধু বোঝোনি, বড্ড বোকা তুমি।
এভাবে আকাশের মন আর বিশ্বাস ভাঙতে একটুও বাঁধলো না বৈশাখীর, কারণ আবেগ দিয়ে নয় হিসাব দিয়েই ভালোবাসাকে মাপে সে। যাবার আগে সে ব্যাঙ্গর ছলে আকাশকে বলে যায়, পুরনো মানুষ জীবন থেকে না গেলে নতুন মানুষ আসে না। আমি হয়তো তোমার যোগ্য ছিলাম না। তুমি খুব ভালো মানুষ আর আমার থেকে অনেক ভালো কোন মেয়েকে তুমি তোমার জীবনে পাওয়ার যোগ্য। তাই আমি তোমার জীবন থেকে বিদায় নিয়ে সেই জায়গা ফাঁকা করে দিলাম। ভালো থেকো, আমায় ভুলে যেও।
আকাশ ফোনের ওপার থেকে আর কিছু বলার আগেই বৈশাখী এই শেষ কথাতে তার ফোনটা কেটে দেয়। আকাশ এরপর যতবারই ফোন করে ফোনটা ব্যস্ত বলে। সে বুঝতে পারে বৈশাখী তাকে শুধু তার জীবন আর মন থেকেই নয় তার ফোন থেকেও তাকে ব্লক করে দিয়েছে। আর এভাবেই কালবৈশাখী ঝড়ের ভীষণ তাণ্ডবের মত বৈশাখী আকাশের মনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বপ্নের ঘর এক নিমিষে চুরমার করে দিয়ে চলে যায় নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে, নিজের স্বপ্নের অট্টালিকা বানাতে।
----------------------------------
45, নিবেদিতা সরণী,
পোস্ট - দুর্গাপুর (বালী)
পি.স - নিশ্চিন্দা (বালী)
জেলা - হাওড়া