দত্তবণিক ভিলা রহস্য
সুদীপ্ত পারিয়াল
আমাদের গ্রামের স্কুলে নতুন মাস্টারমশাই এসেছে অনেকদিন হল। সেদিন হঠাৎ সকাল সকাল আমাদের বাড়ি এসে হাজির। সেই কাপালিক কান্ডের পর দিকে দিকে যেভাবে রণদার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে একপ্রকার ওর অসুবিধাই হয়ে গেছিল। চারদিক থেকে ওর ডাক আসছে, কেউ সম্বর্ধনা দিতে চায়, কেউ বা ওর বীরতত্বের গল্প শুনতে চায়।এসব কিন্তু ও একদম পছন্দ করে না। সম্বর্ধনা বিষয়টা ওর কাছে হাস্যকর। ও বলে, যেটা আমার কর্তব্য সেটা করলে সম্বর্ধনা দেওয়া হলে, আমাকে অপমান করা হয়। আর ওর বীরত্বের গল্প শুনলে অনেকেই বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে সেসব কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেছে।
বৈরাগীতলার সাধুবাবার হত্যার তদন্ত ও মাত্র একদিনের মধ্যে করে দিয়েছিল। খুনি আসলে থানারই এস. আই। এই ঘটনার পর ওর ছবি কলকাতার বেশ কয়েকটা কাগজের ছাপা হয়েছে। তা দেখেই আমাদের নতুন মাস্টারমশাই সুদর্শন দত্তবণিক ওকে দেখে বললেন, তোমার সাথে একটু জরুরী দরকার আছে, একদিন যাব তোমার বাড়ি।
সেই সূত্র ধরেই আজ ওঁর আসা। আমি দরজা খুলে ওকে বসালাম। গুরুজি কলকাতায় গেছে স্কুলের কিছু বইপত্র কিনতে। রণদা বলল, বলুন স্যার আমার সাথে কি কথা আছে?
-কথাটা যে কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। তুমি আমার ছাত্র, তুমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা...
-দেখুন আপনার মনে হয়েছে বলেই তো আপনি এসেছেন। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন।
-কথাটা যদি তোমার হাস্যকর লাগে আমায় পাগল ভেবো না।
-একদমই না। আপনি বলুন।
মাস্টারমশাই এবার বলতে শুরু করলেন, আমি একপাশে বসে আছি, রণদা সামনে।
-হাওড়ার আমতায় আমাদের একটা একশ বছরের পুরনো বাড়ি আছে। যদিও মা আমি ও আমার জ্যাঠতুতো দাদা সপরিবারে কলকাতায় থাকে। সে বাড়িতে আমার বড়জেঠু, বড়জেঠি আর আমার ঠাকুরদা থাকেন। ওনার বয়স প্রায় নব্বই। আর আছে আমাদের কুলদেবী এক কালী মূর্তি। সেখানে রোজ পুজো হয়, নিত্য সেবা দিতে আমাদেরই গ্রামের এক পুরোহিত আসেন রোজ। সমস্যা হল আমরা কেউই ওখানে গিয়ে রাত কাটাতে পারি না।
-কেন? প্রশ্ন করল রণদা।
-সেই কেনর উত্তরই তো নেই রণবাবু! লোকমুখে প্রচলিত সেখানে নাকি ভূত আছে।
-বটে!
-তাই তো শোনা যায়। যদিও এই সব কথা মানা যায়, কিন্তু গত বছর মার্চ মাসে আমাদের বাড়ির কালী মূর্তির বহুমূল্য মুকুটটি চুরি হয়ে যায়। থানা-পুলিশ সব হয়ে গেছে, গোটা বাড়ি, এলাকার সমস্ত পুকুর, সমস্ত স্যাকরার দোকান চিরুনি তল্লাশি করেও মুকুট আর পাওয়া যায়নি। আমার অনুরোধ, তুমি যদি একবার চেষ্টা করে দেখো!
-চেষ্টা তো করতেই হবে স্যার। তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
-নিশ্চয়ই, বল রণবাবু।
প্রথম প্রশ্ন, ধরুন আমি যদি আমার মতন তদন্ত করি, বা মুকুট চোরকে খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে কিন্তু সন্দেহের খাতা থেকে কেউই বাদ যাবে না। আপনিও না। আপত্তি নেই তো?
-না না একদমই না। আমি যদি নিয়েই থাকতাম, আমি কি আর তোমার কাছে আসতাম? আমি কথা দিচ্ছি, সবরকম সাহায্য আমরা করব।
- দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই যে ভূতের মিথ-টা এটা কিভাবে তৈরি হল? মানে আপনারা কখন বুঝতে পারলেন? ও বাড়িতে রাত কাটানো সম্ভব হচ্ছে না?
-মিথ নয় রণবাবু, সত্যি ওই বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ কার জন্য ছায়া দেখা যায়। অদ্ভূত সমস্ত আওয়াজ হয়, আবার অনেকে দেখেছে ও বাড়ির ছাদের আলসে বেয়ে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।
-বেশ। তৃতীয় এবং আপাতত শেষ প্রশ্ন, আপনি তো চাইলেই কোন নামকরা গোয়েন্দাকে ডাকতে পারতেন, আমাকে ডাকা কেন? -এটারও একটা ইন্টারেস্টিং কারণ আছে, আমার ঠাকুরদা কাগজে তোমার খবর পড়ে, আমাকে অনেকদিন ধরেই বলছিল, মুকুট চুরির ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। আর কি রকম কোনইন্সিডেন্স ভাবো, আমি সেই রণবীর গাঙ্গুলির গ্রামে তারই স্কুলে তারই মাস্টার হয়ে এলাম। তারপরও বেশ কয়েকদিন কিন্তু কিন্তু লাগছিল, কিন্তু বৈরাগীতলার সেই সাধু হত্যার কিনারা তুমি যেভাবে করলে, তা নিজের চোখে দেখে আর না এসে থাকতে পারলাম না।
-আগামী রবিবার আমি আর আমার ভাই যাব আপনার বাড়ি। ও, সরি আরও একজন যেতে পারে, সুজন মাঝি। আমার বন্ধু।
-বেশ তো বেশ। আমি ব্যবস্থা করছি।
-তবে একটা শর্ত আছে।
-কি?
-পরিবারের সবাইকে কিন্তু সেদিন বাড়িতে থাকতে হবে। আপনি কথা বলে দেখুন, সবার ওইদিন সময় হয় কি না! নইলে আমরা অন্যদিন যাব।
-আচ্ছা রণবাবু, আমি তোমায় জানিয়ে দেব।
মাস্টারমশাই যাওয়ার পরেই, রণদা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। ও একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, মাস্টারমশাই কিন্তু আমাদের বিনা পরিশ্রমে কাজ করাবেন না। উনি রণদাকে বলেছেন, তোমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো। আমি অগ্রিম দু-হাজার দিয়ে যাচ্ছি, শোনো রণবাবু, পারিশ্রমিক না নিলে তোমার কাজের কোনও কদর থাকবে না।
রণদা টাকাটা নিয়ে বলে, বেশ তবে এক হাজার নিলাম, বাকি টাকাটা আপনি বাবাকে দেবেন। স্কুলের বইপত্র ও মিড-ডে মিলের খরচ সরকার যা দেয় তা তো দেবেই, তবে এটা আপনার তরফ থেকে একটা ছোট ডোনেশন আপনি দেবেন। আরেকটা কথা, আমি চাই না এই হাজার টাকার কথা আর কেউ জানুক।
মাস্টারমশাই বললেন, দাদু ঠিকই বলেছিল, ভুল মানুষের কাছে আমি আসিনি।
রণদা যাওয়ার আগে আমায় বলে গেল, আমি যেন সুজনদাদাকে সব কথা জানিয়ে রাখি, তারও তো দিন আনি-দিন খাই সংসার। হুট করে সে কি আদৌ যেতে পারবে!
তবে সুজন মাঝি সব শুনে বেশ উৎসাহী। সে বলল, তোমার দাদা যেসব টাকা পেয়েছিল সব অনুষ্ঠানের থেকে তার অনেকটাই তো আমায় দিয়েছে, কটা দিন বাবা ওই নিয়ে চালিয়ে দেবে।
বুঝলাম, সম্বর্ধনাস্বরূপ রণদা যে পারিতোষিক পেয়েছিল, তার অনেকটাই সেই সুজনদাদাকে দিয়েছিল, এটা অবশ্য আমরা জানতাম না। সে আরও বলল, আমতায় নাকি অনেক সুন্দর সুন্দর গ্রাম আছে।
তবে আমরা জানি না, তদন্তের কাজে গিয়ে কতগুলো গ্রাম আমরা পরিদর্শন করতে পারব!
২
এই কিছুক্ষণ আগে আমরা দত্ত বনিক ভিলা এসে পৌঁছেছি। যেমনটা কল্পনা করেছিলাম ততটা অজপাড়া গাঁ নয়,বরং এই অঞ্চলকে মফস্বল বলা চলে। আমরা বাসে করে এসেছি। সবার আগে বলা দরকার এই বাড়ির বর্তমান প্রধান দেবকান্ত দত্তবণিকের কথা। ভদ্রলোককে দেখে বোঝাই যায় না তাঁর বয়স নব্বই। ঠাম্মির চেয়েও বড়। তবে মস্ত বড় বাড়ি, পেল্লায় ঠাকুরদালান, বড় বড় ঘর। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, এই বাড়ি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। রণদা সেদিনের পর থেকে কথা কম বলছে, সর্বক্ষণ একটা খাতায় কি যেন আঁকি-বুকি কাটছে। প্রথমে আসি দেবকান্তবাবুর কথায়। আমরা টোটো করে পৌঁছতে, উনি স্বয়ং আমাদের আপ্যায়ন করতে এলেন। রণদা যে কেন ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো, বুঝলাম না। ওদিকে উনি কিন্তু বিনয়ে গদগদ। প্রথমেই বাড়ির কুলদেবীর মন্দিরে নিয়ে গেলেন। মুকুটহীন মূর্তিটাকে সত্যিই কেমন যেন অসহায় লাগছে।
উনি বললেন, এই হল দক্ষিণা কালী মা। লোকে বলে দত্তবণিক কালী। আমার ঠাকুরদাদার বাবা ঈশ্বর মানিকান্ত দত্তবণিক এই মায়ের স্বপ্নাদেশ পান, তারপর দিনেই গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে সত্যিই এক কষ্টিপাথর জলে ভেসে ওঠে। তিনি সেই কষ্টিপাথর তুলে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। বলে রাখা ভালো, এই বাড়িও কিন্তু ওনার তৈরি। পরে খোদাই করে তিনি সেই পাথরটিকে মৃন্ময়ী রূপ দেন। এসব গয়নাগাটি যা দেখছ, সব ভক্তদের দান। মুকুটখানা দিয়েছিল স্বয়ং রানী রাসমণি, অবশ্য ওসব গল্পকথা কিনা আমি জানি না। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠা দিবসে যখন গয়নাগাটি পালিশ করা হয়, তখন সার্টিফিকেট পাই, তাতেই উল্লেখ আছে, মুকুটে হিরে ছাড়াও, চুন্নি, পান্না, পোখরাজ ইত্যাদী আরও অনেক বহুমূল্য রত্ন আছে।
রণদা বলল, এত বহুমূল্য গয়নাগুলো বাড়িতে রাখেন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল নিশ্চয়ই।
-আগেকার যুগে সেপাইরা ছিল, তারপর আমি ছোটবেলাতেও দেখেছি লেঠেল ছিল। এখন সব গিয়ে ওই সিভিক ভলেন্টিয়ারে ঠেকেছে। ওরা আর কি করবে? নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো ছাড়া! ওদের নাকের ডগা দিয়ে মুকুট চুরি হয়েছে! চুরির পরদিনই ওদের আমি দূর করে দিয়েছি! আমি নিশাচর, দিনে ঘুমাই, রাত্রেবেলা এখন মন্দির পাহারা দিই।
-আচ্ছা আপনি যখন নিশাচর, তখন ভূতের ব্যাপারটা একটু বলবেন!
-ওই বস্তুটি চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ওসব ভয়ও আমার নেই। আমার ছেলেরা ভয় পায়। আমার বিশ্বাস, যে বাড়িতে স্বয়ং মা কালী বিরাজ করছেন, সেখানে ভূতের চোদ্দপুরুষও আসবে না।
-না আসলেই ভালো। আপনি বললেন, আপনি রাত জাগেন। মানে দুপুরে বা দিনের বেলা ঘুমান।
-হ্যাঁ, তাও বেশিক্ষণ না। ঘন্টা তিনেক।
- চুরিটা রাতে হয়েছে?
-হ্যাঁ।
-টের পাননি কিছু?
-না ভাই, পেলে কি আর সবাইকে ফেলে তোমায় ডাকি! পরদিনই সেবাইত এসে দেখে মুকুট নেই। ভয় পেয়ে সে আমায় খবর করে। আর আমার বড়ছেলে আর বড়বৌমা ছাড়া এ বাড়িতে তো আর কেউ থাকে না।তবু গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়, এমনকি সেবাইতকে আটক করে ওর বাড়িতেও আতিপাতি করে খোঁজা হয়েছিল, মূর্তি আর ফেরত এল না। এবার তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। ... দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন দেবকান্তবাবু... বাকিদের সঙ্গে পরে আলাপ হবে, সুদর্শন ওদের ঘরে নিয়ে যাওয়া বাবা...
রনদা বলল, বিশ্রাম নিতে আমরা আসিনি দাদু, স্যার একটা সাইকেল পাওয়া যাবে?
-হ্যাঁ, কিন্তু জলখাবারটা...
-কুনাল আর সুজনদাদা খেয়ে নাও। আমি পরে খাব।
-রণ তুমি একা যাবে নাকি?
-চিন্তা নেই স্যার, আমার কিচ্ছু হবে না।
রণদা যে কি করে না! আমরা এখন এই অচেনা বাড়িতে কি যে করব? মাস্টারমশাই বললেন, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাদের জলখাবার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জলখাবার খেয়ে আমরা বাড়িটা ঘুরে বেড়াচ্ছি, ছাদে গিয়ে দেখি আমার বয়সী একটা ছেলে আলসেতে দাঁড়িয়ে। সুজনদাদা বলল, কুনালভাই, এই সেই ভূত নয় তো!
-ধুর! দিনের বেলা আবার ভূত বেরোয় নাকি?
-কিন্তু ও যেভাবে...
ছেলেটা আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে, সে নেমে এল। দেখি বোঝা যায় শহুরে ছেলে। আমাদের দেখে একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ভয় নেই। আমি ভূত নই। আমি তোমাদের মাস্টারমশায়ের ভাইপো! হাই! মাই সেল্ফ় ঋষি।
বলে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য।
ওকে আমার ভালো লাগল।হ্যান্ডশেক করলাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ভাব হয়ে গেল। আমরা গল্প করছি, স্কুলের গল্প, সিনেমার গল্প, আরও কত কি!
ঋষি গল্পের বই পড়ে না। ও বলল, ধুর! স্মার্টফোনের যুগে কেউ বই পড়ে নাকি?
-তা বলে ফেলুদা পড়বে না?
-আমি শুনি, রোজ রাতে ঘুমানোর আগে সানডে সাসপেন্স শুনি।
ওটা রেডিওর একটা জনপ্রিয় প্রোগ্রাম। আমরাও কয়েকবার শুনেছি। আমাদের বেশ ভালোও লেগেছে। তবে বই পড়ার মজা কি আর শুনে পাওয়া যায়!
সুজনদাদার মাস্ল দেখে ছেলেটা বলল, তুমি কদিন ধরে জিম করছো?
সুজনদাদা বাইরের লোক দেখলে কেন যে এমন চুপসে যায় কে জানে! আমাকেই বলতে হল যে ও জিম করে না, ওর পেশাটাই ওকে পেশিবহুল ও সুঠাম করে তুলেছে।
ঋষি বলল, আমাকে ওরকম বডি বানাতে হবে।
-ভালো, তা তুমি ছাদের আলসেতে উঠেছিলে কেন?
-ভালো লাগে। আমার উঁচুতে উঠতে ভালো লাগে। আমার এক্রোফোবিয়া নেই।
কথাটার মানে আমি পরে রণদার থেকে জেনে নিয়েছিলাম। উঁচুতে ভয় করাকে এক্রোফোবিয়া বলে।
ঋষি বলল, আসলে কি জানো এটা একটা অংক। অংকটা ঠিকঠাক মতন জানলেই আর কোন ভয় থাকে না। ছোট থেকে এনসিসি করছি। আমার ইচ্ছা আমি মিলিটারিতে যাব, সেজন্যই তো আমাকে জিম করতে হবে।
-ভালো, আচ্ছা তুমি কি প্রায়ই পাঁচিলে হাঁটো?
-যখন মুড হয়। তোমাদের আরেকজনকে তো দেখছি না। সেই বিখ্যাত রণবীর গাঙ্গুলী? -রণভাই একটু বেরোল। বলল সুজনদাদা।
আমি একটু মজা করে বললাম, তোমার মতন একজন বীরপুরুষ থাকতে, মুকুটটা চুরি হলো কি করে?
-তখন তো আমি ছিলাম না। থাকলে কি আর চোরকে ছেড়ে দিতাম, ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতাম।
এমন সময় একটা চিৎকারে আমাদের গল্প ভেঙে গেল। কোন ভাষা বোঝা যাচ্ছে না। জড়িয়ে-মরিয়ে কথা বললে যেরকম শোনা যায়, এটাও খানিকটা তাই। শুধু একটা কথা বুঝতে পারলাম, 'বদ বণিক দূর হটো'!
ঋষি বলল, বড়দাদু, জানো বড়দাদু এখন পুরো উন্মাদ! কখন যে কি বলে?
আমি বললাম, বদ বণিকটা কে?
-বড়বাবু ,দেবকান্তকে উনি বদ বণিক বলেন।
-তা বাবার উপর ওনার এত রাগ কেন?
-কে জানে!
রণদা ফিরল তিনটে নাগাদ। আমরা খেয়ে নিয়েছি, ওই ফোন করে আমাদের খেয়ে নিতে বলল। বাবার একটা পুরনো ফোন ও আজকাল ব্যবহার করে, আসলে ওর যা কাজ, তাতে একখানা ক্যামেরাওয়ালা ফোন খুব দরকার। যদিও অযথা ব্যবহার ও কখনোই করে না। একটাও গেম নেই ওর ফোনে। মাঝেমধ্যে আমাকে একটু ইউটিউব দেখতে দেয়, এই যা! ও এসে বলল বাইরে খেয়ে নিয়েছে, এখন ও জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
ঋষির বাবা-মা, মাস্টারমশাইয়ের বড়জেঠি, মাস্টারমশাইয়ের মা এই কজনই পরিবারের সদস্য। দেবকান্তবাবুর বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই সে থাকবে না। তার মেজোছেলে ও বৌমা, অর্থাৎ ঋষির ঠাকুরদা-ঠাকুমা অনেককাল আগেই মারা গেছেন। এমনকি মাস্টারমশাইয়ের বাবাও জীবিত নেই।
যাই হোক, জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল-
প্রথমে বড়জেঠি। রণদার কথামতো, গল্পের এই অংশটা আমি একটু নাটকের মতন করে লিখছি, তোমাদের পড়তেও সুবিধা হবে আর মজাও পাবে।
রণ- আপনার নাম?
বড়জেঠি- সুপ্রভা দত্তবণিক।
রণ- আপনার স্বামীর ঠিক কি হয়েছে? কবে থেকে হয়েছে?
সুপ্রভা- বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে এক ধরনের রোগ আছে, এরা নিজেদের আপন লোককেই সহ্য করতে পারে না।
রণ- চুরির রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
সুপ্রভা- আমি তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এই কান্ড।
রণ- তার মানে রাতের বেলা আপনার স্বামী কি করছিল আপনি জানেন না।
সুপ্রভা- উনি তো ওষুধ খেয়ে সেই বিকেলের ঘুমিয়ে পড়েন। তাছাড়া ওর ঘরে তালা বন্ধ থাকে। আমি নিজের হাতে তালা বন্ধ করি।
রণ- ভূতের ব্যাপারটা আপনি চোখে দেখেছেন?
সুপ্রভা- আমি তো সবচেয়ে বেশি দেখেছি। গভীর রাতে ছাদের মধ্যে আওয়াজ, তারপর আলসে দিয়ে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে! আমার ছোটদেওর মানে তোমাদের মাস্টারের বাবার মতন যেন।
রণ- কিন্তু আপনি তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমান। কি করে শব্দ পেলেন!
সুপ্রভা- রোজ পাই না, মাঝে মাঝে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে।
রণ- বেশ, ধন্যবাদ।
মাস্টারমশায়ের মা অলকাদেবী
অলকা- আমি তো আজ প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল, এখানে থাকি না। উনি মারা যাওয়ার পরই, আমার বাপের বাড়ি কলকাতার বরানগরে চলে যাই, তখন তোমাদের মাস্টারমশাই অনেক ছোট ছিল। তারপর যতবার এসেছি, এক দু দিনের বেশি থাকিনি। তবে কেন জানি না, প্রচন্ড ভয় করত, বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে কাউকে যেন আপন মনে হতো না। সবকিছুর মধ্যে যেন একটা রহস্য!
রণ- আপনার স্বামী মৃত্যু ঠিক কিভাবে হয়েছিল বলতে পারবেন?
অলকা- তার সাথে মুকুট চুরির কি সম্পর্ক!
রণ- সম্পর্ক কিছুই নেই। আবার হতেও তো পারে অনেক সম্পর্ক আছে।
অলকা-আমি যদি বলতে বাধ্য না হই!
রণ- ঠিক আছে, আপনাকে আমরা জোর করব না। বুঝতেই পারছি আপনার খুব ইমোশনাল জায়গা ওটা। তবে অপঘাতে মৃত্যু অনেকসময় খুনও হয় সেটা নিশ্চয়ই জানেন। মুকুর চুরির ব্যাপারে আপনি কাউকে সন্দেহ করেন কি?
অলকা- না, এ বাড়ির কোন ব্যাপারেই আমার কোন উৎসাহ নেই। যতদিন আমার শ্বশুর বেঁচে আছেন, ততদিনই আমার এই বাড়ির সাথে সম্পর্ক। তারপর আমি আর এ বাড়িতে আসতে চাই না।
আমার কেন জানি না মনে হল, অনেক কিছু জানেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু কোন এক কারণে আমাদের কাছে কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন। রণদা কিছু বলছে না দেখে আমরাও আর কিছু বললাম না।
ঋষির বাবার নাম অজয়।
অজয়- আমি তো কলকাতায় থাকি, আমার স্কুলিং-কলেজ-বর্তমানে চাকরি সবই কলকাতায়। তবে মাঝেমধ্যে কোম্পানির কাজ এখানে আসতে হয়। তখন নাইট স্টে করি।
রণ- আপনার সাথে ঋষিও আসে।
অজয়- হ্যাঁ, এই গণ্ডগ্রামে ও কি যে মজা পায় জানি না। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমার জেঠিমার, একসময় গয়নার প্রতি সাংঘাতিক আসক্তি ছিল, তা বলে বাড়ির কুলদেবীর গয়না থেকে চুরি করবেন, এটা যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না।
রণ- আর ভূতের ব্যাপারটা!
অজয়-ভোগাস! ওসব আমার কোন বিশ্বাস নেই, তবে একটা কথা তোমায় বলতে পারি। মুকুটটা বাড়ির কেউই নিয়েছে! নইলে এলাকার লোক দাদুকে যেভাবে সমীহ করে, তাদের মধ্যে কারো সাহস হবে না বাড়িতে ঢুকে এই কাজটা করার।
রণ-আপনার বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেনএকইদিনে। এটা আপনার কাছে রহস্য মনে হয় না?
অজয়- না, বাবার হার্টের সমস্যা ছিল ছোট থেকেই। আর মায়ের এজমার সমস্যা। তাই এটা কাকতালীয় ব্যাপার। তবে এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিওনি। ওরা মারা যাবার পরই দাদু আমায় কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়।
রণ- অনেক ধন্যবাদ।
ঋষির মা লীনা বললেন, দেখো বাবু, আমি হাতে গুণে পাঁচ-ছ বার এ বাড়িতে এসেছি। তাছাড়া আমি নিজে চাকরি করি, ইচ্ছা করলে ওরকম মুকুট আমি দশটা বানাতে পারি।
রণ- তা পারেন বৈকি! কিন্তু এটা তো মানতেই হবে ওটা আপনার শ্বশুরবাড়ির একটা পারিবারিক আমানত।
লীনা- অত জানি না, তবে এ বাড়িতে থাকতে আমার কোনদিনই ভালো লাগত না। ভূতের জন্য নয়, এত নির্জন পরিবেশে থাকতে আমি অভ্যস্ত নই।
সবশেষে এল ঋষি।
রণ- শুনলাম তুমি মিলিটারিতে যেতে চাও, ছাদের আলসেতে উঠে প্র্যাকটিস করো! এক্রোফোবিয়া না থাকুক, কোনরকম প্রটেকশন ছাড়া এভাবে হেঁটে বেড়ানোটা তো রিস্ক, তাও রাতের বেলা!
ঋষি- রাতে না করলে ওরা তো করতে দেয় না। আজ বিকেলে ভাবলাম প্র্যাকটিস করব, কুনাল আর সুজয়দাদা চলে এল, ওদের বললাম আমি করছি তোমরা দেখো, আমি অংক ঠিকঠাক জানি কোন ভুল হবে না।ওরা কিছুতেই করতে দিল না।
রণ- কিন্তু এর জন্য যে তোমার সবাই ভূত ভাবছে!
ঋষি- কিন্তু এই সমস্যা তো আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই।
রণ- আচ্ছা তুমি জানো, মুকুটটা কে নিয়েছে?
ঋষি- না, তবে যে নিয়েছে, সে নিশ্চয়ই এতদিনে সেটাকে জল করে ফেলেছে।
রণদা বলে উঠল, ভেরি গুড!
ঋষিও হাসল।
দেবকান্ত বাবুকে রণদা বলল, কেস প্রায় সলভ। শুধু একবার আপনার বড় ছেলের সাথে কাল দেখা করতে চাই।
-বেশ, ছটায় ওর ঘুম ভাঙে।
-মাস্টারমশাই কাল সব মিটে গেলে কালকেই আমরা ফিরে যাব।
আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম কাল রাত্রে কি হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু গরম গরম মাংসের ঝোল, ভাত খেয়ে বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে উঠে সুজনদাদার মুখে শুনেছি, কাল সারারাত নাকি রণদা আর ও ঘুমায়নি। বেরিয়ে গিয়েছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরে এসেছে। আমি বললাম, কি হয়েছিল? কোন শব্দ পেলে?
-এক বিকট হাসির শব্দ। এখনও মনে পড়লে গা শিউরে উঠছে।
-হাসি! এই হাসির কথা তো কেউ বলেনি?
-সেইটাই তো, মানুষের হাসি এমন ভয়ানক হয় না গো!
-আমায় ডাকলে না কেন?
-ভয়ে তখন আমার মাথা কাজ করল না। রণভাই হুট করে বেরিয়ে গেল, আমি সেই যে কাঠ হয়ে তোমার পাশে শুলাম, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, ও ব্যায়াম করছে, তারপর এই মাত্র দেবকান্তবাবুর বড়ছেলের সাথে দেখা করতে গেল।
আমি বুঝতে পারছি না রণদা কোন আত্মবিশ্বাসে এমনভাবে এগোচ্ছে! আমি তো এর কুল কিনারা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ধরে নিলাম এটা কোন মানুষেরই কাজ। আমাদের ভয় দেখানোর জন্য সে এরকম করছে। কিন্তু একটা বছর পনেরোর কিশোরের কি ক্ষমতা আছে কার সাথে লড়ার ? বুদ্ধিতে ও শক্তিতে সে নিশ্চয়ই অনেক চতুর। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
৩
কথা মতন রনদা দেবকান্তবাবুর বড় ছেলে সূর্যককান্ত দত্ত বণিকের(নামটা পরে জেনেছি)সাথে কথা বলে ঘরে এসে বলল, তোমরা চলো, কেস সলভ, আটটায় পুলিশ আসবে।
-পুলিশ! আবার পুলিশ কেন?
-সেটা যথা সময় টের পাবি।
আটটার সময় দত্তবণিক ভিলার বৈঠকখানায় সবাই হাজির। এমনকি আজ সূর্যকান্ত বাবু আছেন, ঘন ঘন জল খাচ্ছেন, হাত-পা অসম্ভব রকম কাঁপছে। বুঝলাম নার্ভের সাংঘাতিক রকম রোগ ভদ্রলোকের। ঋষিকে দেখতে পাচ্ছি না। স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর মিস্টার দাশগুপ্ত ও দুজন কনস্টেবল এবং একজন লেডি কনস্টেবল আছেন।
রণদা ওর গুরু ফেলুদার কায়দায় এবার বলতে শুরু করল।
-প্রথমেই বলি এই বাড়িতে এসেই দেবকান্তবাবুর মুখ দেখে আমার অত্যন্ত চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি ওনাকে। অবশ্য দেখার কোনও সম্ভাবনাও নেই। তারপর উনি যখন ওনার পূর্বপুরুষ মণিকান্ত দত্ত বণিকের কথা বললেন তখন বুঝলাম ঐ মণিকান্তবাবু আসলে ছিলেন একজন কঠোর তন্ত্রসাধক। তবে আন্দাজে ঢিল আমি ছুঁড়ি না। সাইকেল নিয়ে প্রথমে গেলাম এলাকার লোকাল লাইব্রেরীতে,সেখানে 'বিংশ শতাব্দীর তন্ত্র সাধনা' বইটা নিয়ে চোখ বোলাতেই মণিকান্তবাবুর একটা প্রবন্ধ পেলাম। বলে রাখি নামটা আমি শুনেছিলাম, আমাদের গ্রামের বৈরাগীতলার সাধুবাবা অবনীকান্ত মুখোপাধ্যায়ের মুখে। ওনার কাছে বহু তন্ত্রসাধকের ছবি আছে, তাদের মধ্যে মণিকান্ত দত্তবণিক অন্যতম। বলে রাখা ভালো এই মনিকান্তবাবু এককালে কুখ্যাত ডাকাত ছিলেন, সেই ইতিহাসটা অবশ্য আপনি গোপন করে গেছেন দেবকান্তবাবু। আরও একটা কথা সেই পূর্বপুরুষের সঙ্গে কিন্তু আপনার মুখের অসম্ভব মিল।
দেবকান্তবাবু ম্লান মুখে বললেন, বুঝতে পারছি। কিন্তু মুকুট চুরির সঙ্গে সেই ইতিহাসের কি যোগাযোগ আছে?
-আসছি, সেই প্রসঙ্গেই আসছি। স্যার আপনি যখন আমার বাড়িতে গিয়ে অগ্রিম দিয়ে এসেছিলেন, সেদিনই আপনি চলে যাওয়ার পর আমি বীরপুর থানার এস.আই সমরবাবুর কাছ থেকে এই মুকুট চুরি কেসটার ডিটেলস জানতে চাই। উনি সেদিনই আমায় মিস্টার দাশগুপ্তর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দাসগুপ্তবাবু সেদিন আমি আরও অনেক তথ্য দেন।
দেবকান্ত বাবু কেন ঘামছেন বুঝতে পারলাম না। আমি লক্ষ্য করলাম, মাস্টারমশের মায়ের মুখও কেমন শুকনো হয়ে গেছে। আর সূর্যকান্তবাবুর অস্থিরতা ক্রমশই যেন কমে আসছে। তিনি মন দিয়ে শুনছেন।
-স্যার কাল সবার জিজ্ঞাসাবাদ হলেও আপনারটা বাকি রয়ে গিয়েছিল, আপনাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবো না, শুধু এতটুকু বলুন আপনার বাবার মৃত্যুটা কিভাবে হয়েছিল? আপনার মা তো সে বিষয়ে আমাদের সাহায্য করেননি। অথচ আপনি কথা দিয়েছিলেন আপনি সমস্ত ভাবে আমাদের সাহায্য করবেন।
-আসলে তখন আমি খুবই ছোট। তবে মৃত্যুটা যে অপঘাতে সেটাই জানি শুধু।
-দেবকান্তবাবু, আপনি একটু বিষয়টা পরিষ্কার করে দেবেন কি!
-আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকেই আমার বড়ছেলে সূর্যর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তার ফল তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছো।
-মিস্টার দাশগুপ্ত-এর রিপোর্ট বলছে এই ঘটনার আরও বেশ কয়েক বছর পর অজয়বাবুর বাবা-মা একই দিনে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
-হ্যাঁ, ওরা যে কেন এমন করেছিল, জানি না!
-সূর্যবাবু আপনি কিছু বলবেন?
-না তো।
-আচ্ছা এই প্রসঙ্গে পরে আসছি, ঋষি...
রণদা ডাকতেই ঋষি ঘরের ভেতরের একটা দরজা দিয়ে হাতে একখানা মুকুট নিয়ে ঢুকল। সবাই এবার নড়ে চড়ে বসেছে। দেবকান্তবাবু বললেন, এটা কোথায় পেলে ভাই?
ঋষি বলে, দুষ্টু লোকটার ঘরের খাটের তলায়।
-আপনার বড়ছেলে যে সাংঘাতিক অভিনেতা সে তো বোঝবার সৌভাগ্য আমার হয়নি।ভাগ্যিস হয়নি। নইলে মাথাটা এভাবে খেলানো যেত না।
-মানে?
-কাল এখানকার একটা ডাক্তারখানায় গিয়ে ওনার প্রেসক্রিপশনের ছবিগুলো দেখাই। অবশ্য ওগুলো পেতে স্যার আমার সাহায্য করেন। স্যারকে ফোন করে ওগুলোর ছবি চাই, ওখানকার ডাক্তাররা বলেন, ওই নামে কোন ডাক্তার এই ভারতবর্ষে নেই। এবং এই ধরনের পেশেন্ট কখনও বন্দী অবস্থায় থাকেন না। তারা সবার সাথে মেলামেশা করেন, শুধু নিজের আপন লোক ছাড়া।এদিকে আপনার বড় ছেলের দেখাশোনা আপনার পুত্রবধূই করেন। আর এখানেই আমার আসল সন্দেহ!
-কি বলছ আবোল তাবোল? বললেন সুপ্রভাদেবী।
-আজ সকালে ওনার ঘরে গিয়ে, ওনার একটা ওষুধ পাইনি। এবং উনি বললেন আপনার সঙ্গে ওনার কোন কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া কোনদিন হয়নি। তাহলে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ তো ওর মধ্যে নেই। তার পরে আমি আপনার ঘরেও সার্চ করি, এখানেও আপনার স্বামীর কোন ওষুধ খুঁজে পাইনি। আপনার কোন ঘুমের ওষুধও ছিল না।
সুপ্রভাদেবী প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ধরে নিলাম ও পাগল নয়, তার মানে মুকুটখানা ও চুরি করেছে তার প্রমাণ কি?
-প্রমাণ, রণদা একবার হেসে মিস্টার দাশগুপ্তর দিকে তাকালেন, দাশগুপ্তবাবু একটি কনস্টেবলকে ইশারা করতেই কনস্টেবল বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেক মূর্তিকে ঘরে হাজির করলেন। যাকে দেখে সূর্যকান্ত বাবুর চোখ বিস্ফারিত।
রণদা নতুন ভদ্রলোকটিকে বলল, তো মিস্টার সিভিক ভলেন্টিয়ার, আপনার পেশাকে আমি সম্মান করি, কিন্তু ঘুষ নেওয়াটা নয়। কত ঘুষ নিয়েছিলেন আপনি?
-আজ্ঞে দশ হাজার! আমার ছেলেটার বড় অসুখ ছিল স্যার।
দেবকান্তবাবু বললেন, বেঈমান!
-দাঁড়ান, আগে ভালো করে আপনার মুকুটটা পরখ করে দেখুন!
ঋষির হাত থেকে মুকুটটা নিতেই দেবকান্তবাবুর চোখ লাল হয়ে গেল।
-একি! এটা তো টিনের!
রণদা হেসে বলল, ওটার জন্য আমার পকেট থেকে দুশো টাকা খরচ হয়েছে, এটা না বানালে সত্যিগুলো সূর্যবাবু ও তার স্ত্রীর থেকে জানা যেত না। নকশা এক রেখে এটা বানানো হয়েছে। মাস্টারমশাই আমায় মুকুটের ছবিটা আগেই দেখিয়েছিলেন।
মাস্টারমশাই বললেন, চিন্তা করো না আমি তোমার...
- স্যার, এখনও একটা কেস বাকি।
রনদা বুক পকেট থেকে একটা রিসিট মতন কি যেন বার করে দেবকান্তবাবুকে দিয়ে বলল, কাল আমার সেকেন্ড গন্তব্য ছিল, সূর্যকান্ত দত্তবণিকের স্যালারি-একাউন্ট ব্যাংক। মাস্টারমশাই আমাকে বলেছিলেন, উনি এক সময় একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন, এবং ওনার ব্যাংক একাউন্টও রয়েছে। অবশ্য মিস্টার দাশগুপ্তের সাহায্য ছাড়া সেখানে কিছুই কাজ হতো না। তো সেখানে গিয়ে জানতে পারি আপনার সেই মুকুট সূর্যবাবুর ব্যাংক লকারে সুরক্ষিত রয়েছে। এটা তারই সার্টিফিকেট।
সূর্যকান্তর সব পাগলামি উড়ে মুখে চোখে এখন তীব্র আতঙ্ক।সুপ্রভাদেবীরও মুখ নিচু।
-কাল ঋষির মুখে শুনলাম, সে আপনাদের ছাদের আলসেতে হেঁটে বেড়াতে পছন্দ করে, এটা অনেকেরই আছে, যাদের উঁচুতে কোন ভয় নেই। বা এক্রোফোবিয়া নেই। তবে এই গুণটা সে বংশগতভাবে লাভ করেছে। সূর্যবাবু, কাল রাতে আপনার বোকামিটা না ঘটলে শেষ কেসটা সত্যিই জটিল হয়ে যেত, কাল রাতে আপনারা সকলেই, ওনার বিকট হাসি শুনেছেন, আমরা নতুন মানুষ স্বভাবতই ভয় পেয়ে গেছিলাম, কিন্তু আমি সে রাতেই ছাদে গিয়ে, চাক্ষুষ দেখেছি বাইপোলার ডিসঅডার-এর একজন রোগী কিভাবে ছাদের আলসে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তার ভিডিও ফুটেছে আমার ফোনে আছে, সেটা দাশগুপ্ত বাবুকেও দিয়ে দিয়েছি।
সূর্যবাবু গর্জে বললেন, হ্যাঁ আমার এক্রোফোবিয়া নেই। তার মানে এই নয় যে আমি অশেষকে খুন করেছি। সুদর্শন-এর বাবা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল। আমাদের দুজনেই উঁচুতে উঠতে ভালো লাগত, ছোটবেলাতে কি আমরা উচু জায়গা দেখলেই উঠে পড়তাম। কিন্তু একটা কথা জানো কি, অংক ঠিক মতন না জানলে টিকটিকিও দেয়াল থেকে খসে পড়ে, ওর মৃত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট।
-বেশ, কিন্তু অজয় বাবুর বাবা আপনার মেজভাই সুপর্ণকান্ত ও তার স্ত্রী বিদিশা দেবীর মৃত্যু! একসাথে দুজনের গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা! সেটাও কি কাকতালীয়।
সুপ্রভা দেবী এবার উঁচু গলায় বললেন, তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে ছোকরা?
-আমি তো আগেই বলেছি, আন্দাজে আমি ঢিল মারি না। ওনাদের নকল রিপোর্ট আপনারা সকলকে দেখিয়েছেন। কিন্তু আসল পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলছে গলায় ফাঁস লেগে মৃত্যু হয়নি, হয়েছে বিষক্রিয়ায়। আপনারা খুব ভালো করেই জানতেন সুপর্ণবাবুর হাটের রোগ, এবং তার স্ত্রীর অ্যাজমার সমস্যা! তারপরে বিষ খাইয়ে সে দেহ দুটো ঝুলিয়ে দিতে এই নির্জন বাড়িতে খুব একটা অসুবিধা হয় কি! আর আপনাকে বিষের যোগান দিয়েছিল, আপনাদেরই অতি বিশ্বস্ত সেবাইত রঘুনাথ চ্যাটার্জি। ওনার বয়ানে আপনাদের কথাই পাচ্ছি। ওনাকে আমার কোনদিক থেকেই সন্দেহ হয়নি, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের ঠেলায় উনি ভয় পেয়েই সত্যিটা বলে ফেলেছেন। উনি এখন দাশগুপ্তবাবুর জিম্মায়। আমি শুধু এটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি, একজন নিঃসন্তান দম্পতির এত কিসের লোভ!
সূর্যকান্ত ও সুপ্রভার দু'পাশে একজন কনস্টেবল ও একজন লেডি কনস্টেবল চলে গেছে।
দেবকান্তবাবু অসহায়ের মতন কেঁদে উঠলেন, আমার আর কিচ্ছু রইলো না! আমি বড় নিঃস্ব হয়ে গেলাম! আমারই বাড়িতে আমার বড়ছেলে এত বছর ধরে এত কুকীর্তি করে গেছে, আর আমি কিছুই ধরতে পারিনি।
রণদা বলল, দাদুভাই, আপনি এত ভেঙে পড়বেন না। আপনাকে এমনটা মানায় না। আপনি তো তিন নাতিকে পেলেন। আমি, কুনাল আর সুজনদাদা! তাছাড়া আপনার এমন বীরপুরুষ পুতি আছে! আপনার চিন্তা কি!
ঋষি বলল, আমি আর কোনদিন উঁচুতে উঠবো না রণদা! অংক ভুল হলেই তো জীবন শেষ। জীবন থাকলে অনেক অংক কষা যাবে।
==============
সুদীপ্ত পারিয়াল।
ধাড়সা ব্রাহ্মণ পাড়া (পল্লী মঙ্গল সমিতি),
জি.আই.পি কলোনী, হাওড়া।