বাঁশি
প্রতীক মিত্র
ট্রেনটার আর যেন যাওয়ার ইচ্ছে নেই। থেমেই আছে। একে তো এত লেট তার ওপরে তেড়ে ভীড়। এত মানুষ অথচ একে অন্যের সাথে কথা কম লোকেই বলছে। যে যার মোবাইল অথবা ঢুলুনিতে ব্যস্ত। সেখানে আমাদের মূল চরিত্রও আছে।আর পাঁচ জনের মতনই অনোযোগী, ব্যস্ত তবে ভীষণ ক্লান্ত। সে তার খারাপ লাগাগুলো আর ভাগ করে নিতে চায় না। চুপচাপই থাকে। দশটা-পাঁচটার এই আত্মা-ভক্ষক চাকরিকেই সে বেশ বীরত্বের সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। দিন যাপনের বিস্বাদটা যদি একটু কমে।বাড়িতে যদি কিছু সেরকম ঘটে?দুর্ঘটনা বলছে না।ঝগড়াও যদি…পাড়ার উঠতি যে সব নেতা তাদের দ্বারা অপমানিত হওয়ার মধ্যেও বেশ অনেকটা নাটকীয়তা আছে।কিন্তু ও জানে এসব হবে না।একে তো ও এতো সাধারণ যে নেতারা ওকে পাত্তাই দেবে না। তাছাড়া, ও নিজেও যা সতর্ক আর লাজুক এবং ভীতু ও কাদা-পাঁক-আবর্জনা-মহিলা এবং ঝামেলা এড়িয়েই যাবে। আচ্ছা ট্রেনে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে।এটা সম্ভব। সন্ধ্যের মুখে বিদ্যুৎ গেলে বেশ ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকার হয়ে যাবে।লোকজনের মধ্যে বিরক্তি আর ভয় বেশ চেপে বসবে। দুরে দিগন্তের কাছে নারকেল গাছের সিলিউট টপকে যে লাল আলো সেইটা তখন কোনো দানবের চোখ হয়ে যাবে। কিম্বা ট্রেনের মধ্যেই ছিল অবসরপ্রাপ্ত কোনো গুপ্তঘাতক।সে হয়তো রক্তের টাটকা স্বাদ নেওয়ার জন্য নতুন করে অনুপ্রেরণা পাবে। মূল চরিত্রের মাথায় এমন উষ্টুম-ধুষ্টুম ভাবনা চলতেই থাকতো ওই বাঁশিটা বাজার আগে অবদি। বাঁশিওয়ালার বাউলের মতন বাবরি চুল। গায়ে বহুরঙের জোব্বা। সে বাঁশি বাজাচ্ছে বটে কিন্তু বিনিময়ে পয়সা নেওয়ার কোনো চেষ্টাই নেই। বাজানোর আনন্দটুকু নিয়েই যেন সে বেশি খুশি।অধিকাংশের ওপর সেই বাঁশির মিঠে সুর প্রথমে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে না পারলেও মূল চরিত্রের ওপর তার প্রভাব পড়েছে ব্যাপক।ও ভাবে এই বাঁশিওয়ালা অ্যাদ্দিন কোথায় ছিল?এই ভালোলাগা থেকে অ্যাদ্দিন বেচারাকে তাহলে বঞ্চিত হতে হত না। ক্রমে ও এদিক ওদিক তাকাতে নজরে এলো অন্যরাও একটু একটু করে মনোযোগ ঘোরাচ্ছে ওই বাঁশির সুরে। মূল চরিত্রের মতন তাদেরও মাথার চিন্তা-দুশ্চিন্তা একটু হলেও কমে যাচ্ছে কি?তারাও মুগ্ধ হচ্ছে সেই বাঁশির সুরে। সেই বাঁশি তাদেরও মনে মনে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনোখানে মেঘের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে। বাঁশিওয়ালার অতশত খেয়াল নেই।সে মনের আনন্দে বাঁশি বাজিয়েই চলেছে। ক্রমে ট্রেনের ওই কামরায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো পাখি। দমকা হাওয়ায় কামরায় ঢুকে এলো শুকনো পাতা, রঙীন বাহারী ফুল। তাদের সুরভিতে কেউ কেউ গুনগুন করে গেয়ে উঠলো কয়েক কলি গানও।তারপর কামরার ছাদে কখনো নীল আকাশ কখনো বা নরম অন্ধকার যে অন্ধকার আরো যেন ভালোবাসার উপযোগী হয়ে উঠলো অগুন্তি তারার মিটমিটানিতে। যখন এই ক্ষণ, এইসব মুহুর্তগুলো মনে হচ্ছিল অনিঃশেষ তখনই ট্রেনটা বেশ ধাক্কা খেয়ে নড়েচড়ে চলতে শুরু করলো।না ওই বাঁশিওয়ালাকে আর পাওয়া যায়নি।কিন্তু যারা যখনই নিজেদের গন্তব্যে নেমেছে মাথায় তাদের গুনগুন করছিলো ওই সুর।
=======================
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর-712235, পশ্চিমবঙ্গ