এক প্রেমিকের চিঠি
তপন মাইতি
প্রিয় তরী,
কেমন আছ?হঠাৎ করে চিঠিটা লিখে ফেললাম। আমি সেকেলের মত এখনও আপডেট হতে পারিনি। এই ফোনাফুনি যুগে যদিওবা চিঠির চল্ দেখাই যায় না।তবুও জীবনে যদি কাউকে প্রথম চিঠি লিখি সেটা তোমাকেই তরী।সেই নীল কালী সেই বানান ভুল সেই কাটাকুটি। কী করে ভুলি তখন সবেমাত্র নবম শ্রেণি।স্কুলের সেরা ক্রাশ ছিলে তুমি।আমার তোমাকে খুব ভালো লাগল। কেন জানি না পলকহীন চোখে যেমন পৃথিবীর দিকে সূর্য চেয়ে থাকে।সেদিন আগোছলো এলোমেলো কথাবার্তার উত্তরে বলেছিলে কি আগডুম বাগডুম লিখেছ শুধু?চড়াগলা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই আপনজনের জন্য প্রথম ভয়ে বুক কেঁপে ওঠা।তুমি বলেছিলে এই রোদ্দুরে কোদাল মাটি কোপাতে পার?মনে মনে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। আজ সরস্বতী পুজো ভ্যালেন্টাইন ডে ভারতীয়দের কাছে ব্ল্যাক ডে মিলেমিশে একাকার। লাল হলুদ সাদা কত রকম শাড়ি। পায়ে আলতা।হাতে মেহেন্দি। ছোটো করে লভ্ চিহ্নের মাঝে 'T' অক্ষরটি লেখা।হয়তো তোমার মত ভয়ে ভয়ে নামে আদ্যক্ষর প্রথম লিখেছে হাতে।টোকো কুল পেড়ে খেতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম মণ্ডলদের বুড়ির হাতে।সাইকেলের সামনে বসে কথা বলতে বলতে ঠাকুরাণীর পাড় ধরে যাচ্ছিলাম।তুমি বললে এই নিরালায় একটু বসব।দুটো কথা বলব।হাঁটু ব্যাথা করছে খুব। তোমার সৌন্দর্য রীতিমত নিস্তব্ধ হয়ে কান পেতে শুনছিল আমাদের সংলাপ পাশের ম্যানগ্রোভ অরণ্য।ভেতর ভেতর শীত জড়িয়ে ধরছে শরীরে সন্ধ্যে নামার অজুহাতে।বিকেলের শেষ আলোয় গোলাপী হয়ে উঠল তোমার মুখ। ততক্ষণে নদীর ঢেউএ ঢেউএ ভেঙে যাচ্ছে নদীর পাড়।তোমার গা গোলানো ভাবে কোলে মাথা দিয়েছিলে। সেই প্রথম কেউ বিশ্বাস ভরসা রেখেছিল কোলে।সেই এক না ভোলার মত অনুভূতি।সেই নিরালা সন্ধ্যায় হাতের মুঠোয় কি অনুপম মায়া। ঘন নিবিড়ের মুগ্ধতা। কেউ মনে রাখুক আর না রাখুক। আমার ছবির মত মনে পড়ে।তোমার চুলের সুবাস। এলিয়ে পড়া মুখে আগলে রেখেছিল গোলাপের সৌন্দর্য ও সম্মান। বুকে করে রেখেছিল রক্ত গোলাপ। তুমি বলেছিলে অন্ধকার নেমে আসলে পাখিগুলো উড়ে যাবে বাসায়।আমায় ভয় করছে।দেরি করে গেলে মা বকাবকি করবে।তুমি সেদিন শখ করে পান খেয়ে গাল পুড়িয়েছিলে। ঠোঁট দুটো রক্তজবার মত লাল আর পিরিচ মুছে ছিলে আমার সাদা রুমালের গায়ে।সেই রুমালের বিউটি স্পটের মত লেগে আছে কলিজায়।তোমার গলায় মানাতো গীতবিতানের রবীন্দ্রনাথ। গুনগুন করলে পাগল হয়ে উঠত মন।যেন পৃথিবীতে এই প্রথম কোন প্রেমিক সর্বপ্রথম প্রেমিকার কথায় মুগ্ধ ও বিভোর হল। আর সব কথাগুলো না হয় আজ অপ্রকাশিত থাক মনের মণিকোঠায়।সেই থেকে ভাবি মানুষেরা কেন প্রেমে পড়ে। ভালোবাসায় মানুষ বড় প্রত্যাশী।তার কাংক্ষিত মানুষের আয়নায় শুধু তার প্রতিবিম্বটি দেখতে অভ্যস্ত। মনে পড়ে তোমার সেই উত্তরের কথা?প্রিয়তম, খুব ভালবাসি। তীব্র থেকে তীব্রতম।একটা লতানো উদ্ভিদ যেভাবে একটি শক্ত দণ্ড জড়িয়ে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে।সেভাবেই বলতে অস্বীকার করব না।তোমার প্রতি আমার শুধুমাত্র প্রেম বা ভালোবাসা রয়েছে।রয়েছে আরো অন্য কিছু।হয়তো তোমার চেয়ে ও বেশি।জীবনে প্রথম তুমি নিজে এই গোলাপ এনেছিল আমার অজান্তেই। যা আজীবন স্মরণ থাকবে।প্রতিদিন গোলাপটা খুলে দেখি।কতটা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে আসে শুকিয়ে যায়।আর তার গন্ধ কেমন বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। ভাল্লাগে ভীষণ তোমাকে জড়িয়ে আঁকড়ে বাঁচতে।মন চায় নিজের করে পেতে। তোমার স্পর্শ আমাকে ব্যাকুল করে তোলে কিন্তু অন্ধকারের যাত্রী আমি।যা ভাবনার অবকাশ বা পরিষর আমাকে পূর্ণতা পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় হয়।ভয় হয়।তুমি ভুল বুঝে দূরে গেলে।ফিরো এসো।এ জ্বালা সামলাতে পারব না একা।আমার যা কিছু সঁপে দিয়েছি তোমার কিন্তু ভয় শুধু পরিণতির।তবে পরিণতির চেয়ে বেশি দরকার তোমার শান্ত গলায় দুটো কথা শোনার। খুব একা বড় হয়েছি মনের কথা শোনবার জন্য কেবল তুমিই আছ।পাশে থাকবে,কাছে থাকবে, নিজের হয়ে বেঁচে থাকবে।খুব যত্নে রাখব। তুমি ছাড়া আমার এজীবন অন্ধকার রাত অসম্পূর্ণ থেকেই যায়।তীব্র স্পষ্ট ছোঁয়া আমি আগে কখনও পাইনি।মান অভিমান বেশিদিন জিরিয়ে রেখো না।দারুণ ভালবাসি।আর প্রকাশ করে ভালবাসি এটা হয়তো তোমাকে কোনোদিন বোঝাতে পারব কিনা জানি না।অভাবের সংসার বোতাম ফোন সেকেণ্ড হ্যাণ্ড ও ছিল না।তোমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম তুমি চলে যেতে স্কুলে।দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে যেতাম বাজার পর্যন্ত। তুমি ফিরে ফিরে তাকাতে।শরীর খারাপ হলে বুঝে যেতাম পাশে থাকার ইঙ্গিত করছ।তবুর মধ্যে তবুও একটা দূরত্ব থাকত। একটা অনুভব করতাম। খেতে না।কষ্ট হত।পড়তে না।রাগ হত।কথা বলতে না।মন খারাপ করত।আনচান করত মনটা।দিনে অত্যন্ত একবার আমাদের দেখা হত।মনে পড়ছে স্মৃতিগুলো। বলেছিলে তুমি বেশিদূর পড়তে চাও। উচ্চশিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। চাকরি করবে।আপিস যাবে।তারপর বিয়ে করবে।বিকেল যত গড়াবে মন তত খারাপ করে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে।হঠাৎ হঠাৎ মনটা উথাল পাথাল করে।যখন তখন অভিমানের চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করে ফেলে। তুমি ফোন নম্বরটা চেঞ্জ করলে কিন্তু নম্বরটাও দিলে না।যোগাযোগ বন্ধ। আর নিতে পারছি না।শুনেছি ভাল কোম্পানির জব সেন্টারের কাজ।ভাল মাইনে কড়ি।কিন্তু অন্য কাউকে চাইলে বিয়ে করে দিতে পার।বয়স তো অনেক হল।বেশি বয়সে অনেক অসুবিধা আসে প্রত্যেকের। আজকাল শরীর শিহরিত হয় জ্বলে পুড়ে খাক হয়। মন জ্বলে কষ্ট হয়।দুঃখে চোখে জল আসে।খুব সহজে আর নিয়ন্ত্রণ হারাই না।তুমি বলেছিলে মনে আছে সুন্দরী মেয়েদের জীবনে কি কি প্রবলেম ফেস করতে হয় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তুমি বুঝবে না।তুমি সম্বোধন করে বলেছিলে...
নাথ,
তোমার অনিন্দ্য সুন্দর হৃদয় সম্পর্কে আমার পৃথিবীতে এক আলোড়নের হিল্লোল তোলে।তুমুল ভাবে সঙ্গ চায়।মন চায় এই মধ্যবিত্ত ঘরে তোমার সাথে থাকতে।চাই না আমার এই নাগরিক জীবনের জটিলতা।আমার অভিমানের অলস চোখ খুলে দেখ একান্তে রাখা আছে তোমার ছবি।আজ এই ভরদুপুরে সে অন্য এক উপলব্ধির শিকার।ফাগুনের প্রথম চাঁদ ছুঁয়ে যাচ্ছে শিমুল পলাশ বনের শরীর।কোকিল কণ্ঠস্বর গেয়ে যাচ্ছে একটানা মধুর গান। প্রিয় পার না?তোমার হৃদয় অন্তরীপে আমায় একটু ঠাঁই দিতে?একটু যত্ন করে বসে দুজনে শীতলপাটির উপর বসে অনুভব করতাম নিজেদের জীবন। নিঙড়ে দেখলে দেখতে পেতে উসুক ভালবাসা।তোমার সাথে অগম দূরত্বের নদী পেরোতে চাই একই নৌকায়। তুমি হাল ধরবে। আমি বেয়ে যাব দাঁড়। পৌঁছে যাব জীবন-দ্বীপ মোহনায়।একান্ত মনের দায়ে লিখে ফেললাম চিঠি।আবেগঘন কিছু নিবিড় মুহুর্ত
বিনীত
ইতি দিয়ে শেষ করতে নেই
তোর তপু
========================
নামঃ তপন মাইতি
গ্রামঃ পশ্চিম দেবীপুর; পোঃ দেবীপুর; থানাঃ মৈপীঠ কোস্টাল;
জেলাঃ দঃ২৪পরগণা; পশ্চিমবঙ্গ। ভারত।