শঙ্খ ঘোষের জীবনদৃষ্টি
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ- জীবনানন্দ পরবর্তী অন্যতম বলিষ্ঠ কবি হলেন কবি শঙ্খ ঘোষ ।তিনি প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিজীবী;যিনি অনেক শোনেন, অনেক ভাবেন, বক্তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করেন এবং বিশ্লেষণ করেন। তার পাঁজরের হাড়ের মধ্যে ছিল একটা নরম মন, যা অন্যায় আঘাতে রক্তাক্ত হত।কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতেন সেই সব বেদনার কথা।
সব বুদ্ধিজীবীদের দুটো সত্তা থাকে;একটা অন্তর্মুখী আর একটা বহির্মুখী ।অন্তর্মুখী সত্তায় তিনি সব সময় চান নিজের সাথে সময় কাটাতে ,গভীরে চিন্তাভাবনা করতে, অনেক পড়াশোনা করতে- এই সত্তায় তিনি তাঁর মনের ঘরে ফিরতে চান, একা থাকতে চান। এই একা পথ চলা তাঁকে সৃষ্টির নন্দন কাননে পৌঁছে দেয়। আর তাঁর বহির্মুখী সত্তা তাকে নিয়ে যায় নানান সাহিত্য সভায়,নানা আলোচনায়, যেখানে তিনি তাঁর সতীর্থদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করেন ।তবুও কবির মনে হয়,
"ভাবি আমার মুখ দেখাবো
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।"
বুদ্ধিজীবীদের এই দুই সত্তার টানা পোড়েন চলতে থাকে -
"ঘরে ফিরে মনে হয় বড় বেশি কথা বলা
হল? চতুরতা ক্লান্ত লাগে খুব। "
মননের এই গভীরতা থেকেই কবি অনায়াসে বলতে পারেন -
"সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।"
কবির প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মনিন্দ্র কুমার ঘোষ এবং মাতা অমলা ঘোষ। বাংলাদেশের জন্ম ও বড় হওয়া এবং দেশভাগের পর কলকাতায় চলে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা ।আজীবন তিনি ছিলেন শিক্ষক ।কেন্দ্রীয় সরকারের 'নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল' এর বিরুদ্ধে বারবার কলম ধরেন ।এই প্রতিবাদ তিনি 'মাটি' নামক কবিতায় জানিয়েছেন;
"গোধূলিরঙিন মাচা ,ও-পাড়ায় উঠেছে
আজান
এ দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান এখনো পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ।
এই মাটি আমারও মাটি সে কথা সবার সামনে কিভাবে প্রমাণ করবো আজ।"
প্রেমিক শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন জীবনে প্রেমই শেষ সত্য।
"ঘুরে ঘুরে এই প্রকৃতি কি কথা কয় ?
সে বলে যায় প্রেমের মতন আর কিছু নয়।"
বারবার তিনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন এমএ পাস করেন তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন -
"লিখতে যদি চাও, পার্টি মেম্বারশিপ নেবার কথা কখনোই ভেবো না। পার্টির কাজ যদি করতে চাও, তাহলে বাইরে থেকে করো। বাইরে থেকেই অনেক ভালোভাবে কাজ করতে পারবে।....পার্টির কাজে সাহায্য করার কথা ভুলো না কখনো। আর মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না।"
খ১৯৭৬ সালে বাবরের প্রার্থনা প্রকাশিত হবার পর তার কবিতার অভিমুখ পাল্টে যায়।পিতার আর্তনাদ ফুটে ওঠে তাঁর নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য।
" ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।"
বাম শাসনের মধ্য গগনে তিনি প্রতিবাদী কবি ছিলেন ।ক্রমশ চাপা দীর্ঘশ্বাসে তার কবিতা ভরে যায় এবং ২০০৭ এ প্রকাশিত হয় " সমস্ত ক্ষতের মুখে বালি "।
ওই বছর নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে তিনি লেখেন "স- বিনয় নিবেদন "।কামদুনির নৃশংস ঘটনার পর তিনি পথে নামেন এবং লেখেন :
"'কি খুঁজছেন?'
মিহি স্বরে বললেন তিনি:
'মেরুদন্ড খানা' "।
তাঁর দীপ্ত লেখনি আজও প্রবল আঘাত হানে ক্ষয়িষ্ঞু সমাজে ।
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে।
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে ।"
এরপর সরকার বদলে গেছে। কবির কলমে জন্ম নিয়েছে 'মাওবাদী' র মত কবিতা। প্রান্তিক মানুষদের অত্যাচার নিয়ে লেখা কবিতা অমেরুদন্ডী বাঙালি সমাজে স্বতন্ত্রতা দান করেছে।
তাঁর লেখায় শব্দের একটা আলাদা ভার ছিল ,আলাদা ঢং ছিল ।'জলছবি 'কবিতায় শব্দ রা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
"রাতের বেড়াল গুলি বড় বেশি দ্রুত
লাল সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল ।
আমিও কুয়াশামাখা চোখে
ধরতে গিয়েছি একে ওকে-
ফিরে দেখি সেও নেই ,
রোমে ভরে আছে শুধু
একদিন যেখানে সে শুত।"
তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তাঁর রচিত 'ওকাম্প ও রবীন্দ্রনাথ" এর মাধ্যমে রবীন্দ্র ভাবনা আজ শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্র পুরস্কার ,সাহিত্য একাডেমী, জ্ঞানপীঠ, সরস্বতী সম্মান এবং পদ্মভূষণ সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। সরস্বতী সম্মানের সম্পূর্ণ অর্থ ( ৫ লক্ষ টাকা) তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে দান করে যান ।
৯০ বছর বয়সে কোভিডের থাবা কেড়ে নিয়েছে কবিকে। কবি শব্দহীন হলেন। কিন্তু তাঁর শব্দগুলো আমাদের পাঁজরে আজও দাঁড় টেনে যায় ।মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য হলেও তোপধ্বনী হয়নি। তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর রচনা সম্ভারের মধ্যে যে তোপধ্বনী কবি করে গেছেন ,তার কাছে আমাদের তোপধ্বনী নিতান্তই ম্লান। কবির কাছে জীবনের অর্থ -
"জীবন মানেই হল আত্মবোধে নিজেকে সাজানো। নিজের সত্তার কাছে সত্য হতে চাওয়াই জীবন।"
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
===================
225 Rifle Club Road
1E Rifle Tower
Bansdroni
Kolkata