প্রহ্লাদ কি এসেছেন ?
অনিন্দ্য পাল
সবাই নাচছে। উত্তাল উদ্দাম। ডিজে মিউজিকের সঙ্গে প্রচন্ড ঝোড়ো আনন্দ বয়ে যাচ্ছে আকাশ বাতাস সর্বত্র। কেঁপে কেঁপে উঠছে কংক্রিট কলামের ব্লক। কেঁপে উঠছে রাতের নিশ্চুপ সবুজ। চমকে চমকে উঠছে পুকুরের জলের সমতল পিঠ। আনন্দ ছাড়া কোথাও কিছু নেই। নাঃ। সদ্য আসা কেউ বুঝতেই পারবে না, এখন এই নাচটা কেন? উপলক্ষ্যটা কী?
এমনকি যারা নাচছে তাদের অনেকেই জানে না ঠিক কেন শুরু হল এই উথাল পাতাল আনন্দ। পথচলতি যারা দেখছে বা শুনছে তারা কেউ বিরক্ত হচ্ছে, কেউ আনন্দিত হচ্ছে - তবে একটা ব্যপারে তারা সবাই একমত, এই উন্মাদ আনন্দের কারণ তারা কেউ জানে না। পরস্পরের কাছে এটাই তাদের প্রশ্ন। এবং অত্যন্ত সংগত আর স্বাভাবিক ভাবেই কেউই কাউকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন নিয়েই সবাই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরস্পর সমান্তরাল এবং বিপরীত দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যারা তারা জানেনা কোথায় শেষ এই আনন্দের। আদৌ কি শেষ আছে?
শেষ কিসের আছে? মৃত্যু মানেই কি শেষ? অথবা শেষ হয়ে যাওয়া মানেই কি মৃত্যু? খুঁজতে খুঁজতে চল্লিশের পাড়ায়। নাক চেপে ধরে দুর্গন্ধ আটকানোর চেষ্টা করছি যত, ততই চারদিক থেকে মৃতশরীরের গন্ধ ঘিরে ধরছে। কোথা থেকে এলো এত মৃতশরীর? এই সমস্তই কি জীবনের মৃতদেহ -- না তা নাও হতে পারে। জীবনের বসতি তো সমাজের পেটে। সমাজ মরে গেলে জীবন বাঁচে কেমন করে? সমাজের পেটটা এখন পচে গেছে। দোষটা পেটের নয়, কৃমি এবং পরজীবী সংক্রমণের। সমাজের মাথা এদেরকে প্রতিপালন করছে, কারণ ওই মাথার ভিতরেও আসলে একটা নরকের কীট বাস করে। কীটের বর্তমান ঠিকানা নরক নয় যদিও, শহর, নগর, বন্দর, মহানগর এবং অবশ্যই ক্ষমতাগ্রহের সর্বোচ্চ অট্টালিকায়। সেই অট্টালিকার পাশে সুসজ্জিত রাজপথ। রাজপথের পাশে হাতপেতে মাথানত করে হাঁটুগেড়ে বসে আছে মৃতশরীরের দল। এরা কি জীবন পেয়েছিল কখনও? পেলেও সেই ঝোপঝাড়ের জীবন এগিয়ে আসতে আসতে এখন এই রাস্তার ধারে এসে পড়েছে। অথচ রাস্তাটা পেরোলেই যে নর্দমা তার বাঁধানো পাড় বরাবর এখনও শুয়ে আছে কান্নার দেহ। গত একবছরে এই নর্দমার জলে ভেসে গেছে কত দেহ, তাদের কোন নাম ঠিকানা কেউ লিখে রাখেনি। ওরা চলে গেছে, এক একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে, আর কেউ কি কখনো পড়বে ওই সব অদ্ভুত শব্দে লেখা একান্ত ব্যক্তিগত গদ্য? কেউ কখনও আটকাতে পারবে সৃষ্টিগহ্বরের রক্তের ধারা? অথবা আলো জ্বালাতে কি পারবে সেই ধ্বংসগুহায় যেখানে গতজন্মের অভিশাপের মত আজো টুকরো টুকরো হয়ে যায় সতীচ্ছদ এবং বালিশে বা শ্বাপদের হাতের উল্টোপিঠে চাপা পড়ে যায় মরণ আর্তনাদ? খুঁজছি, এখনও। যত খুঁজছি তত পুড়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব। পুড়ছে কোশ, পুড়ছে ডিএনএ, পুড়ছে মন। নিজেকে মনে হচ্ছে চরম দুর্বল, বোবা-কালা হাত-পা বিহীন থলথলে জেলিফিশ। চটচটে রাতের চৌখুপীতে ঘুমোতে গিয়ে নিজেই নিজের উপর যাচ্ছি ক্ষেপে, দিনের আলোয় রাস্তায় বের হলে নিজেকেই ঘেন্না করতে ইচ্ছা করছে। এত অ-সভ্যতার মাঝে, এত আর্তনাদের ভিতরে, এত দুর্গন্ধের ভিতরেও আমরা কেমন করে বয়ে চলেছি -- ভাবলেও ধুয়ে মুছে যেতে চায় সব বিশ্বাস আর আত্মসম্মান।
তবু, তবুও আমাদের ধ্বংসস্তুপের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে ঘাপটি মেরে আছে আশা, হঠাৎ ঝড়ের মত কখনও ছড়িয়ে পড়ছে বিপদ সঙ্কেত, আর ধুনি জ্বেলে নরমাংস ভক্ষণের ভয়ংকর উৎসবে বেজে চলেছে, সভ্যতার দৈত্য ডিজে। প্রহ্লাদ কি এসেছেন?
========================
Address
Anindya Paul
C/O Biswanath Paul
Vill-- Jafarpur
PO-- Champahati
PIN-- 743330
PS--Sonarpur
DIST--south 24 Parganas
west Bengal, India