গল্প ।। মার্জার কাহিনি ।। শংকর ব্রহ্ম
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
মার্জার কাহিনি
শংকর ব্রহ্ম
জনপ্রিয় একজন বিখ্যাত লেখকের বাড়িতে অপূর্ব সুন্দর একটি বিড়াল ছিল। গায়ের রঙ ফুটফুটে সাদা, লেজটি মোটা রোমশ, কিশোরীর বেণির মতো। চোখদুটি মায়াবী নীল, নাম তার মেনি। লেখক তাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যখন লিখত বসতেন, বিড়ালটি তখন তার পায়ের কাছে এসে বসত।
বিড়ালটিকে তিনি কোলে তুলে নিয়ে লেখার টেবিলে রাখা বাতির নীচে এনে বসাতেন। বাতির আলো বিড়ালকে যখন বেশ তুষ্ট করত, বিড়ালটি তখন তুষ্ট মনে প্রশান্ত হৃদয়ে শান্ত ও স্থির হয়ে বসে থাকত, তার সে প্রশান্তি লেখককে দিত অনুধাবন ক্ষমতা। বিড়ালের এই প্রশান্তি তাকে ধীরে ধীরে আবেশিত করত, লেখক তখন ফিরে পেত আত্ননিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং সৃষ্টি করার প্রেরণা। লেখক শুধু সে সময় বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে থাকত। লেখার মনোযোগের উপর বিড়ালের প্রভাব চমকপ্রদ, এবং রহস্যময় মনে করতেন তিনি।
এইভাবে লেখকের ভালই কাটছিল দিন। তার লেখনী দিয়ে ভাল ভাল লেখা বের হচ্ছিল। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। বাড়ছিল তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনপ্রিয়তা। কথায় বলে, খ্যাতি প্রতিপত্তি বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কিভাবে যে কী হয়ে যায় ! লেখকের ভাগ্যেও ঘটল সে রকম ঘটনা। সেই কথাতেই আসছি এবার।
অদূরেই এক মহিলা সঙ্গীত শিল্পী থাকতেন। তার বাড়িতেও আর একটি বিড়াল ছিল। তার গায়ের রঙ বাদামী, চোখদুটি কটা কটা, নাকের দু'পাশে গোঁফ আছে। খুবই আদরের ছিল সে তার, তার নাম ছিল পুশি। গায়িকা ভোরবেলা উঠে যখন রেওয়াজ (গানের অনুশীলন) শুরু করতেন, তার আগে একবাটি দুধ দিয়ে বিড়ালটিকে সামনে বসিয়ে দিতেন। বিড়ালটি যখন ধীরে ধীরে দুধ পান করতে করতে শিল্পীর মুখের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতেন, তখন গায়িকা বুঝতেন রেওয়াজ করা তার ভাল হচ্ছে। আর বিড়ালটি যদি দুধ পান করা বন্ধ করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত, তখন সে বুঝত রেওয়াজ ঠিক মতো হচ্ছে না তার। এইভাবে তার সঙ্গীত চর্চাও সাফল্যের দিকে এগোচ্ছিল।
একদিন দুপুরবেলা বিড়াল দু'টির দেখা হল ছিমছাম এক মনোরম পার্কে। গাছে গাছে তখন ফুল ফুটেছে, সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে চারপাশের পরিবেশ। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের সোনালি আলো এসে পড়ে, মোহময় আলো-ছায়ার কারুময় জাফরি সৃষ্টি করছে পার্কে। সেই মায়াবী মুহূর্তে পুশির চোখ গিয়ে পড়ল মেনির চোখের উপর। তাকে দেখে ভাল লেগে গেল পুশির। মেনিরও চোখ পড়ল পুশির দিকে।
মেনি কিছুদিন ধরেই ভাবছিল, তার একজন
সঙ্গী দরকার। পুশিকে তার সঙ্গী করে নিতে ইচ্ছে হল।
মেনি পায়ে পায়ে পুশির দিকে এগিয়ে গেল। পুশি তা দেখে খুব খুশি হল। মিনি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে, লাজুকভঙ্গীতে মিউ মিউ স্বরে বলল, তুমি আমার বন্ধু হবে?
পুশি যখন জানতে পারল সে তার বন্ধু হতে চায়, পুশি খুশি মনে রাজী হয়ে গেল তার কথায়। বলল, অবশ্যই আমি তোমার বন্ধু হব।
তারপর তারা দু'জনে একসঙ্গে পার্কে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, কিছুটা খুনসুটি করল একে অপরের সঙ্গে। তারপর, যে যার বাড়ি ফিরে গেল। পুশি বাড়ি ফিরে গিয়ে, গায়িকার কাছে তার মনের কথা খুলে বলল। বলল, এ'বাড়িতে সে মেনিকে নিয়ে আসতে চায়।
গায়িকা তার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন। মোটেও রাজী হলেন না পুশির কথায়। পুশিকে সামনে থেকে দূর দূর করে তাড়ালেন।
অবশেষে তারা দু'জনেই এক চাঁদনীরাতে বাড়ি থেকে পালাল। তারপর তারা সারারাত নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াল তারা। সারারাত মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াবার পর,
উজ্জ্বল সকালে এসে একটা সুন্দর পার্কে উপস্থিত হল। পার্কটা তখন সূর্য়ের সোনালি আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তা দেখে তাদের মনে হল, এ যেন মায়াকানন।
তখন কোথা থেকে একটা কুকুর এসে পার্কে ঢুকে তাদের তাড়া করল। মেনি তখন ঝটপট গাছে চড়ে বসল। আর পুশি গড়গড় আওয়াজ তুলে দাঁত খিঁচিয়ে মেনিকে বাঁচাবার জন্য পথ রুখে দাঁড়াল। ভাগ্যক্রমে তখন একজন ড্রাইভার পার্কে একটু বসার জন্য এসে হাজির হয়েছিল। সে তখন একটা ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে কুকুরটির দিকে ছুঁড়ে মেরে তাকে তাড়িয়ে দিল। তারপর পুশিকে কোলে তুলে নিয়ে, গাড়িতে বসা তার মালকিনের কাছে নিয়ে গেল। তার মালকিন একজন পশুপ্রেমিক ছিলেন। তিনি বিড়ালটিকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খুব আদর যত্ন করলেন তার।
কিন্তু পুশির মন পড়ে রইল মেনির কাছে। দিন দিন সে শুকিয়ে যেতে লাগল।
দুধ মাছ দিলে, কিছুই সে খেতে চায় না। তা দেখে, পশুপ্রেমিক মহিলা একদিন তার কাছে এর কারণ জানতে চাইল। পুশি তাকে সব খুলে বলল।
মহিলা তারপরের দিন গাড়িতে করে পুশিকে নিয়ে সেই পার্কে গেল। গিয়ে দেখল, সেখানে মেনি নেই। পুশির মন খারাপ হয়ে গেল। তারা বাড়ি ফিরে এল।
এদিকে মেনি আবার সেদিনই কুকুরটা চলে যাবার পর, গাছ থেকে নেমে, সব জায়গায় খুঁজে, পুশিকে না পেয়ে, একা একা বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়েও তার মন টিকল না বাড়িতে। আবার পুনরায় একদিন সেই পার্কটাতে ফিরে এলো মেনি । পুশিও সেদিন সৌভাগ্যক্রমে মহিলার সঙ্গে গাড়িতে চড়ে পার্কে বেড়াতে এসেছিল। মেনিকে দেখে সে চিনতে পারল। গাড়ির জানলা দিয়ে একলাফে নেমে তার কাছে ছুটে গিয়ে, তার গায়ে গা ঘষতে লাগল। গা চাটতে লাগল। মহিলা তা দেখে বুঝতে পারলেন, এ-ই পুশির প্রেমিকা।
তিনি তখন তাদের দু'জনকে গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন। এখন তারা সেই মহিলার বাড়িতেই একসঙ্গে থাকে। তাদের থাকার জন্য আলাদা ঘর, বিছানা করে দেওয়া হয়েছে। এখানে তারা আনন্দে একসঙ্গে সুখে শান্তিতে আছে। সম্প্রতি তাদের ফুটফুটে তিনটি বাচ্চা হয়েছে।
তাদের কি কি নাম রাখা যায় ভেবে এখন মহিলা তাদের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাংলা ভাষার অভিধান থেকে।
আর এদিকে জনপ্রিয় বিখ্যাত লেখকের লেখা আপাতত বন্ধ হয়ে আছে মিনির অভাবে। আর সঙ্গীত শিল্পী মহিলা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার পুশিকে।
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
----------------------------------------------------------------------------