Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। বসন্ত রঙ ।। সুদামকৃষ্ণ মন্ডল


বসন্ত রঙ

সুদামকৃষ্ণ মন্ডল


তাকে দেখেই আমার খুব দুঃখ হয়।  কেন জানিনা সে আমাকে বুঝেনি । আজও বুঝেছে কিনা তাও বলতে পারব না । কতদিন মসজিদের পাশে একা একা পেয়েছি । বুঝতাম  ও হয়তো মনের কথা চাহুনীর মধ্যে ধরে নেবে । আমি তো এও বলেছি, মেলায় যাবো একসাথে । কেন চলে যায় মা -বাবার সঙ্গে । হয়তো বাবা-মায়ের সাবধানতা । অথবা ওর সাহস হয়নি । প্রেম করতে সাহসও লাগে । লোক দেখামাত্র মুচকি হাসবে । কেউ কোনও মন্তব্য করলেও করতে পারে হয়তো তাই কোন উচ্চবাচ্য করে না ।
      অম্বিকা , আমার থেকে দু 'মাসের ছোটো।  ও আমাকে বাপনদা বলে ডাকে । স্কুলে একসঙ্গে পড়ি।  স্কুলে যেতে  আসতে কতদিন সাইকেলের পিছনে নিয়েছি । ও যখন সাইকেল চালাতে পারল তবুও আমার পাশে পিছনে এক সঙ্গে যেতাম । স্নানের সময় সাঁতরে যেতাম পুকুরের ওপারে।  ডুবে তুলতাম শালুক ফুল । কচুরিপানার নীলচে  সাদা ফুল মাথায়  দিতাম গুঁজে । ওকে রানী বলে ক্ষেপাতাম।  জলের মধ্যে কত দিন জাপটে ধরেছি । দু'হাতের বাঁধন ছেড়ে নিজেকে সরিয়েছে।  হয়তো এক পাড়ায় বাড়ি । রথের মেলায় গেলে দেখা হয় জিলেপীর দোকানে । পুতুল কিনে দিতাম পছন্দ করে । পয়সা ওর পছন্দ আমার । সকাল হলে সুধীর মাঝি নৌকা নিয়ে শ্মশান ঘাটে আসত।  নৌকায় থাকত মাছ।  তার বউ খালুই  ঝুড়িতে  মাছ নামিয়ে দিল সেখানেও আমি ওর পছন্দের মাছ বেছে দিতাম । ও সবই আমার কাছে ব্যক্ত করত । কেবল  মনের মধ্যে ঘর বাঁধার কথা চেপে যেত । শ্যামলদের স্নানের ঘাটে  ছিপ ফেলত শ্যামলের দিদি ।  ছিপ ফেলে তুলত আকাশ  ট্যাংরা - তেলাবিরা  - ফলুই মাছ ইত্যাদি । কত রকম মাছ দেখার জন্য দৌড়ে যেতাম। অম্বিকা বলত , আমি ট্যাংরা খাই না । আমি বলতাম, খাবি না খাবি তোকে কি কেউ জিজ্ঞেস করেছে , তাহলে তুই বলবি কেন ?  ও জোর করে  তাদের পুকুরের ফলুই মাছ নিত ভাজা খাবে বলে । মনে মনে বলি , পরের পুকুরের মাছের প্রতি জব্বর দখল করে পরের হৃদয় আগলাতে পারে না।
     যেখানে যাবার ইচ্ছে হয় , ও আমাকে সঙ্গে নেবেই।  গতকাল বিকালে আমাকে তেঁতুল তলার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল , চল না ধনেপাতা কিনে আনি ?  কথাটা শুনে হাসলাম । ও বলল,  হাসছিস কেন ? --- এমনি । চল্ । মনের কথা বলতে গিয়ে বলল,  তুই  নিশ্চয়ই আমাকে কি ভাবিস বল তো ? ----- কেন?  ---- ভালোবাসিস ?  ---- হুম । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম । ----- ভালোবাসতে জানিস  ?  --- মানে !  ভালবাসতে আবার জানার কি আছে ? ---- বাঃ রে জানতে হয় না বুঝি ? ----- সারা জীবন একসঙ্গে এক ঘরে থাকাটা মিলেমিশে এটাই ভালোবাসা , এ ছাড়া আর কি ? ---- না । ভালোবাসলে ত্যাগ করতে হয়।  কে কতখানি ত্যাগ করবে । ধরো, মীরা -পদ্মাবতী- বিষ্ণুপ্রিয়া-?   রামকৃষ্ণ -বিবেকানন্দ- নেতাজী- বিদ্যাসাগর  ত্যাগী সকলে ।
----- আমরা তো মহাপুরুষ হবো না , সংসারী মানুষ । ----- ছাড় তো ।  ভৌতিক কথা । মানুষের হয়ে মানুষ   কিছু ত্যাগ করলে ভালো মানুষ হওয়া যায় ।  ঠাকুমাই কালকে রাতে গল্প করতে  করতে বলেছিল ।
ধনেপাতা নিয়ে ও চলে গেল । মনের মধ্যে চিন্তার বিষগুলো কিলবিল করছে। সেই কবেকার কথা ।  আমিও চলে যাই সাইকেল গ্যারেজে কাজ নিয়ে । পেটে  ভাতে খাই কোনও বেতন নেই ।  স্কুল ছুট নয় কিন্তু পড়াতে পারবে না বলে বাবা কাজের সন্ধান দিয়ে নিরিবিলিতে থাকল ।
" ফিটিংস সাইকেল মার্ট " হয়ে গেল স্থায়ী  ঠিকানা ।   খাই দাই নোংরা জামা কাপড়ে  ঘুমিয়ে অবশ হয়ে যাই।  আমার কাজ শেখা শেষের পথে । আমার মালিক পড়ল করোনার প্রকোপে । সে সবেমাত্র বিয়ে করেছে।  দু' বছর গেলেও কোনো সন্তান নেয়নি।  ইচ্ছাকৃত কিনা বলতে পারব না। " ফিটিংস সাইকেল মার্ট'' -র কর্ণধার অকালে প্রয়াত হলে  দিশেহারা শুভ্রা বউদি নিরুপায় সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ে । দোকানের দায় ভার আমাকে নিতে হলো । শুভ্রা বৌদি বিধবার বেশে কিছুদিন দোকানে বসে  পয়সা নিত।  তারপর হঠাৎ সে বেপাত্তা।  কোথায় গেল কাকে নিয়ে গেল তাও জানিনা। দোকানটা চালু রাখলাম । লোকে যা নয় তাই বলল । আমি কোনো কান করি না । দেখি আমার বাবা আমাকে নিয়ে ইতিমধ্যে রঙিন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে । আমি নাকি দোকানের মালিক । কিন্তু স্বত্ত্ব বদলাইনি ।  প্রোপাইটারের  স্থলে যেই নাম সেই থাকল।  অবশেষে কেউ কেউ বলে  আমি নাকি চিটিংবাজী করে দোকানের মালিক হয়েছি । এ কথা কেউ ভালো করে বলেনি । বলেছে অম্বিকার বাবা-মা । আমার বাবা শৈশবের মেলামেশার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গেলে অম্বিকা নিজেই বলেছে , একজন মেয়েকে অসহায় করেছে তার স্বামীকে মেরে  । তারপর তাকেও ফাঁকি দিয়ে সরিয়েছে  আমাকে কি আর বিয়ে দেবার জায়গা নেই  ? বাবা শুনে এসে বললে, মিত্তিরদের মেয়ে আছে কালকে যাব দেখতে। হ্যাঁ,  সেই মেয়েকে বিয়ে করলাম ।   শঙ্করী  সত্যি নামের স্বার্থকতা আছে।  কর্মঠ - তৎপর সংসার সম্বন্ধে বুঝে । সে-ই আমাকে একদিন বলল , যেহেতু তোমার দোকান নয় শুধু বেতন হিসেব করে নেবে । বাদ বাকি ওই দোকানে ক্যাশে থাকবে ।  আমি তো শুনে অবাক।  সত্যি তো করা যায় । যদি কোনওদিন শুভ্রা বৌদি ফিরে আসে তার পাওনা গন্ডা বুঝে নিতে চায় । সকলের ধারণা বদল করে দেওয়া যাবে । কারো না হলেও অম্বিকাকে  তো নীরবে জবাব দেওয়া যাবে ।
     শঙ্করী দেবী প্রতিমার মতো দেখতে । সুশ্রী সুন্দরী কিন্তু এ নিয়েও তার অহংকার দেখি না । আমার দৈনন্দিন পেশাকে সে ঘৃণাও করে না । কত আপন ভাবে সেও বুঝি । ঘর আলো করেছে তার আচরণ ব্যবহারে । বাবা-মার প্রিয় বৌমা।  সকলকে মিষ্টি ব্যবহারে বশ করেছে । আমিও সুখে আছি ।
    সেদিন ছিল বসন্তকালের মিষ্টি সুবাস প্রেমোষ্ণ  দিন।  পলাশ -শিমুল - আম - মহুয়ার বনে  ধুম পড়েছে । আমের বনে মুকুলের ছয়ালাপ ।  বদ্যিদের ঘাটে হাঁসেরা সাঁতার কাটছে । তাদের বড় বউ ভাতে  কুঁড়ো দিয়ে মিশিয়ে 'চৈ চৈ ' - করে ডাকছে ।  সুন্দর সাঁতরে  কাছে এসে ব্যালা বাটিতে চঞ্চু  দিয়ে আনন্দে খাচ্ছে ।  হোলির দিনে কিশোর- কিশোরী জড়ো হয়েছে  রঙ খেলতে । আমি আর শঙ্করী হাত ধরে আসছিলাম পুকুর পাড় বরাবর । ওপারে লজ্জাবতী লতায় ফুল দেখে আমায় বলল,  ফুল সব সময় সুন্দরই লাগে  । হঠাৎ অম্বিকার মুখোমুখি।  সে বিধবা তাও জানতাম না । ওরা দৌড়ে গিয়ে গায়ে আবির রঙ সহ গাঢ়  জল রঙ ফিচকিরি দিয়ে  দিতে গেলে বাধা দিল । তবুও যেই না গায়ে ও সাদা শাড়িতে রঙ পড়েছে , মুখ ভারী করে বলল, অসভ্য ইতর । না বললাম । ওরা জানত না আগের দিন হিন্দু সনাতন ধর্ম সংস্কার মতে ক্ষৌরকর্ম  ঘাটক্রিয়া  হয়েছে , শ্রাদ্ধ শান্তি না সমাপ্ত হওয়া অবধি সাদা থান পরণে রাখতে হয় । আর  হোলির দিনই ওর স্বামীর উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ ।
     ওর বর ঘরজামাই ছিল । ঠকবাজ স্বামীকে পাওনাদার রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফেরার পথে খুন করেছে । শ্বশুর বাড়িতে থেকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল।  তা আর হলো না ।
       অম্বিকা আমাকে দেখে কেমন ঘাবড়ে  কিছু যেন  বলতে চাইলেও বলতে পারল না । কারণ আমিও তো  ব্যথিত ছিলাম ।

 ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
========================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.