বাঙালি চেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারি ।। পাভেল আমন।
বাঙালির চেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারি
পাভেল আমন
আবারো একুশে ফেব্রুয়ারি সমাগত আপামর বাঙালি মানসে। বাঙালি জাগরণের বিকাশের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের সৃষ্টিশীলতার দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি। সত্যি কথা বলতে বাঙালি আবেগ ভালোলাগা ভালোবাসা চরমভাবে বিজড়িত এই দিনকে ঘিরে। কাঁটাতারির বেড়া টুপিয়ে মুহূর্তেই যেন দুই বাংলা ভাষার টানে বাঙালি জাতিতে একাকার হয়ে যায়। বাঙালি জাতিসত্তার চরম বার্তাবাহক একুশে ফেব্রুয়ারি। ২১ তারিখে যেন নিজেকে বেশি বাঙালি বলে মনে হয়। কত স্মৃতি ঘাত প্রতিঘাত লড়াই সংগ্রাম ঘিরে আছি ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখের আগমনের নেপথ্যে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'—৭২ বছর আগে পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণের ভাষা জীবন যাপনের ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম বাংলা ভাষা রক্ষার্থে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এই অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। পূর্ব বাংলার মানুষ এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আপামর বাঙালি মননে একটি চেতনা জাগরণ বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে জায়গা দিতে হবে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত অবস্থায় তারা জীবনকে বাজি রেখে গর্জে উঠেছিল পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে। সেদিন আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। বুক চিতিয়ে লড়াই করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। আমরা সবাই অবগত ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আমাদের ভাষাশহীদ দিবস; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এই দিন বাঙালির জন্য বিশেষভাবে আবেগময়। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভাষার জন্য বাংলার সন্তানদের এই বিরল আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে দেশে পালন করা হয়। শুধু বাংলা নয়, বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে আরো যেসব ভাষার মানুষ আছে, তাদেরও নিজ নিজ মাতৃভাষার বিকাশের উদ্যোগ বেগবান করার তাগিদ দেয় এই দিবস। আজকে চারিদিকে যখন ভাষা দিবস নিয়ে এত আলোচনা অনুষ্ঠান তখন সত্যিই মননে একরাশ প্রশান্তি জেগে ওঠে বাঙালি চেতনার জাগরণে। বাংলা ভাষা এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতিতে কৃষ্টিতে ঐতিহ্য ঘরানার ধারাবাহিকতা বয়ে দিয়ে যাবে প্রবাহমান নদীর মতো। কিন্তু দিনকে দিন বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালিদের এক চরম উদাসীনতা তারা ভুলতে বসেছে বাঙালি সংস্কৃতি পাল পার্বণ ঐতিহ্য। ইন্টারনেট মোবাইল প্রযুক্তির দৌলাতে ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সবাই যেন ছুটছে সেই ভাষার আকর্ষণে। এ কথা অনুস্বীকার্য ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা আমাদের জাতিসত্তাকে বিস্মৃতি প্রায় করে তুলছি। চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তরুণ প্রজন্ম বাঙালি সংস্কৃতি চিন্তাভাবনা ভুলে পাশ্চাত্য ধারণায় আক্রান্ত। এভাবে দিনকে দিন আমরা বাংলার শেকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের মাতৃভাষা ভাব প্রকাশের ভাষা চেতনার ভাষা সৃষ্টিশীলতার ভাষা বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে অঙ্গীকার করি বাংলা ভাষা প্রসার ও ব্যবহারে আমরা আরো বেশি দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হয়ে উঠি। দরিদ্র বস্তিবাসী ও শ্রমজীবী পরিবারের ছেলে মেয়েরাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করছে। বিশ্বকবির ভাষায় "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম"। অথচ প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের মাতৃভাষার সঙ্গে এক প্রকার দ্বিচারিতা ও বিশ্বাস ঘাতকতা করে চলেছি। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অবশ্যই ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু তাই বলে মাতৃভাষাকে কোনভাবেই অবহেলা করে নয়। যে জাতির মাতৃভাষা যত সমৃদ্ধ ঐতিহ্যপূর্ণ প্রসারিত সেই জাতি প্রগতির অভিমুখে এগিয়ে যাবে। বর্তমানে ইংরেজি পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি ভাষার প্রতি বাঙালিরা ঝুকতে বসেছে। সময় এসেছে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাঙালি চেতনা ভাবনা সর্বোপরি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলা ভাষাকে আমাদের অবশ্যই যত্ন ভরে শিখতে হবে। শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের মধ্যে দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না বাংলা ভাষাকে প্রসারিত উপতিষ্ঠিত করতে তরুন প্রজন্মকে অবশ্যই বাংলা ভাষা চর্চা ও গভীরভাবে অনুশীলন করতে হবে। আমরা যদি আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি এখনো বিমুখ উন্নাসিক থাকি তাহলে আগামীতে বাংলা ভাষা তার জৌলুস ও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে ফলস্বরূপ বাংলা ভাষা সংকটের মুখে আচ্ছন্ন হবে ।
=========================রচনা -পাভেল আমান -হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ