শেষ ইচ্ছা
মহা রফিক শেখ
সেদিন ছিল ২৭শে সেপ্টেম্বর। ২০১৮।রাত্রি ৯ টা। সবে অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেছি।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। দেখি বাড়ির ফোন। ভাই করছে। ফোন টা ধরা মাত্রই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল-"তুই পারলে বাড়ি চলে আয়।বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। তোকে দেখতে চাইছে একবার। তোর সাথে কিছু কথা বলবে।"শুধু হ্যাঁ বলেই ফোন টা কেটে দিলাম।কিছুক্ষণ পরে আবারও ফোন। বাড়ির থেকে এবার বোন করছে। তারও সেই কাতর কন্ঠে ভেসে এলো সে ই একই কথা।
হঠাৎ মনটা যেন কেমন করে উঠল। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লাম —বাড়ির দিকে —মুর্শিদাবাদের একপ্রান্তে। প্রচন্ড ভীড়ে ঠাসা রাতের শেষ ট্রেন টা ধরলাম। বসার তো প্রশ্নই উঠে না - দাঁড়াবার জায়গা নেই।
ট্রেনে চলতে চলতেই কতো কথায় না মনের ভিতর তোলপাড় করতে লাগল।
এই তো সেদিন ১০ই সেপ্টেম্বর —মা গুরুতর অসুস্থ হলো। তাকে দেখার জন্যও সময় হলো না।
তারপর ১৬ই সেপ্টেম্বর দাদুও প্রচন্ড শ্বাসকষ্টজনিত রোগে হাস্ পাতালে ভরতি হলেন।অক্সিজেন চললো। না—এবারও আমার সময় হলো না। দাদুকেও দেখতে গেলাম না।
এরপর এবার বাবা ১৯শে সেপ্টেম্বর হঠাত শরীর খারাপ হওয়াই কান্দি মহকুমা হাস্ পাতালে ভর্তি হলেন। ওখানে তিন দিন থাকার পর ডাক্তাররা বাবাকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করলেন। ৫দিন ধরে এখানেই চিকিৎসিত হচ্ছিলেন। অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তবুও তাকে দেখার মতো সময় পেলাম না। এবারেও যাওয়া হলো না।
এই রকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই চোখের পাতা বুজে আসছিল। হঠাত একটা ঝাকুনিতে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। সেটা ঘুম না হওয়ার না অব্যক্ত ব্যথা বেদনার —তা বুঝলাম না। কালো ঘন অন্ধকারকে ভেদ করে ট্রেনটা প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলছে। ভাবলাম আমাকে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌছে দেওয়ার গুরু দায়িত্ব যেন ট্রেনটা নিয়েছে। এই ভাবেই অন্ধকার যত বাড়তে লাগল ট্রেনটার গতিবেগও ততই বাড়তে লাগল।
অনেক ঘন্টা হয়ে গেলো। মোবাইলের দিকে তাকালাম। তিন্ টে বাজে।দেখি ভোর হয়ে আসছে। মন টা আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল।
হর্ন বাজিয়ে ট্রেন টা সবে পলাশি ঢুকছে....... এমন সময় ফোন টা বেজে উঠল। ফোনে হ্যালো বলতেই ভেসে এলো কান্নার রোল। আর্তনাদ।"বাবা আর নেই। মারা গেলো। তোকে দেখার ও কিছু বলার জন্য ছটফট করছিল।"
হঠাৎ ব্রেক কষায় ফোন টা হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়। কানেকশন কেটে গেলো। মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সারা শরীর যেন ঝিম ধরে আসছিল। শরীরের শক্তি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে লাগল। চোখ বুজে আসছে।
ভোর হয়ে আসা সেই রাত আবার ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উঠল। আরও গভীর... আরও কালো গাঢ় অন্ধকার!! সেই অন্ধকারে বসে দেখি..বাবা যেন বলছে "তুই কি একবার আসতে পারবি?
========================
ঠিকানা - মহিসার, খড়গ্রাম,মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ।