ভ্রমণকাহিনি ।। ট্রেকিংয়ে আশঙ্কার দিক ।। দীপক পাল
ট্রেকিংয়ে আশঙ্কার দিক
দীপক পাল
সুন্দরী লিডার নদীর পাশ দিয়ে একসাথে অনেক ঘোড়া লাইন করে চলতে শুরু করল।পাহাড় ঘেরা চারিদিকের এই নদীর সাথে সাথে আমরাও চলতে লাগলাম। দুপুর একটার আগেই চন্দনবাড়ী পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা মাত্র দোকান আছে সেখানে। আর সব দোকান টোকান বন্ধ করে চলে গেছে নিচে। সেই মওকায় এই দোকানে দাম নিচ্ছে প্রায় তিনগুণ। মুশকিল হল আমরা ঘন ঘন চা পান করি। আর এখানে হয়েছিল আমাদের ভুল। আমরা যদি পহেলগাও থেকে গুঁড়ো দুধ, চা পাতা ও একটা স্টোভ ভাড়া করে আনতাম তাহলে কোনো অসুবিধা হতো না।
দোকানটায় এখন খুব ভীড়। দোকানের দু জন এখন খুব ব্যস্ত পর্যটকদের খাবারের অর্ডার মেটাতে। আমি দুটো গ্লাসে চা আর বিস্কুট নিয়ে সমরদার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা পান করতে লাগলাম। একজন বেশ হেলদি কাশ্মীরি লোককে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে রাতে এখানে থাকার কিছু ব্যবস্থা আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। সে বলে একজন ভিআইপি আসার কথা আছে, তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি যদি না আসেন তবে আমরা ডাকবাংলোটা পেতে পারি। তবে আরো আধ ঘণ্টা আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বুঝতে পারলাম যে সে ওই বাংলোর কেয়ার টেকার। আমরা কিছুটা শেষনাগের দিকের রাস্তায় এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে দেখি লিডার নদী রাস্তার তলা দিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে দেখে বুঝলাম আসলে এটা একটা হিমবাহের মতো। একটা রাস্তার রূপ নিয়েছে। এর ওপরে ধূলোর আস্তরণ পড়ায় মনে হয় এটা একটা সাধারণ রাস্তা। একটু এদিক ওদিক করে আবার ফিরে এলাম দোকানের কাছে। এসে দেখি পর্যটকরা সব চলে গেছে। আমাদের ঘোড়ার সহিসরা ওই কেয়ার টেকারের সাথে কথা বলছে। কাছে যেতেই ইশারায় কেয়ার টেকার ওর পেছনে পেছনে যেতে বললো। আমরা সহিসদের পুরো টাকা মিটিয়ে দিলাম। ওরা চলে যেতে কেয়ারটেকারের পিছন ধরলাম।
ডাকবাংলা দেখে চক্ষুস্থির। উঁচু উঁচু পাহাড় চারিদিকে আর তার মাঝখান দিয়ে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নূপুরের ছন্দ তুলে বয়ে চলেছে লিডার নদী বাংলোকে পাশ কাটিয়ে কোন অচিন দেশে। মনে হলো এটাই যেন স্বর্গ অপ্সরাদের দেশ। মুগ্ধ হলাম। কেয়ারটেকার বাংলোর তালা খুলতেই ভেতরে ঢুকে হঠাৎ ' তুষার তীর্থ অমরনাথ ' সিনেমাটার কথা মনে পড়লো। অমরনাথ যাত্রীর নায়ক নায়িকারা এই বাংলোয় রাত্রি যাপন করেছিল। কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাংলোটা সত্যি সুন্দর। বাইরে বারান্দায় এসে বসলাম। ভারী সুন্দর লাগল এই ঝকঝকে বিকেলটা। ঘন নীল আকাশ আর তার নিচে দিয়ে চলেছে দুধ সাদা মেঘেদের দল। সূর্যের কিরণ তার ফাঁকে ফাঁকে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। কেয়ার টেকার এসে বসলো এক ধাপ সিঁড়ির নিচে। সে আমাদের বললো অমরনাথ দর্শন করার ইচ্ছে আছে নাকি। আপনারা দেখছি ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দিলেন। এই শীতেও গায়ের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমরা বললাম সেটা কি সম্ভব। সে বলে কেন সম্ভব নয়। রাত চারটেতে ঘোড়ায় চেপে যাত্রা শুরু করলে সন্ধ্যার পরে রাত আটটার মধ্যে অমরনাথ দর্শন করে ফিরে আসা যায়। আমি আর সমরদা নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে জিজ্ঞেস করলাম কত লাগতে পারে। উত্তর শুনে বুঝলাম এটাও নিচ্ছে তিনগুণ।
অর্থাৎ এই জার্নিটা করলে আমাদের আর কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তাতেও আমরা কেয়ারটেকার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। মনে কিন্তু ধন্দ থেকে গেলো এটাকি আমাদের পক্ষে সম্ভব টানা বার ঘন্টা ট্রেক করে অমরনাথ দর্শন করা? কথাটা একবার কেয়ার টেকার কে বলতেই ও বলে, 'কিউ নেহি সকেঙ্গে সাব, জরুর সকেঙ্গে। তবতো এক কাহিনী শুনিয়ে।' বলে সে যে একটা কাহিনী আমাদের শোনালো সেটা হচ্ছে এই,
-মাত্র দিন দশেক আগে এক ভিআইপি তার স্ত্রীকে নিয়ে গাড়ি করে এই বাংলোয় উঠেছিল। আমি তাদের ঐ ঘোড়ায় করে ঠিক এইভাবে অমরনাথ দর্শনের কথা বলেছিলেন। ভিআইপি ভদ্রলোক রাজী হলেও তার স্ত্রী রাজী তো হয়নি উল্টো তার স্বামীকেও যেতে দেবে না। তখন ভদ্রলোককে অনেক অনুনয়ের পর শেষনাগ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসার অনুমতি দিলেন। সেই মতো টাট্টু সমেত এক সহিসকে নিয়ে হাজির করলো শেষ রাতে কেয়ার টেকার। টাট্টুতে উঠে তিনি স্ত্রীকে বললেন চারটের মধ্যে ফিরে আসবেন। কিন্তু চারটেতো দূরের কথা ছটা বাজার পরেও তিনি এসে না পৌঁছানোয় ওনার স্ত্রী অতি আশঙ্কায় কাঁদতে শুরু করলেন। তারপর কেয়ার টেকারকে খোঁজ নিতে বললেন। ড্রাইভারকেও এগিয়ে দেখতে বললেন। কিন্তু তারা সব কিছু অবগত থাকায় চুপ করে ওখান থেকে সরে গেলেন। সাতটা বেজে গেল যখন তখন তিনি নিজেই বেরিয়ে পড়লেন। তিনি বেরিয়ে দেখেন তাদের গাড়ির ড্রাইভার ও কেয়ারটেকার চায়ের দোকানে বসে ওদের সাথে গল্প করছে। রেগে গিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে ওই দুজনকে ভীষণ বকাবকি করতে লাগলেন। দোকান থেকে একজন তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলে বলে,
' ম্যাডামজি, আপ রো না মত, সাহেব কুছ দের তক আ জায়েঙ্গে অমরনাথ মন্দির দর্শন করকে দেখিয়েগা। আপ এক কাপ গরম চায় পিকে বাংলো যাকে আরাম কিজিয়ে।'
উনি কোনো কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন বাংলোতে। রাত সাড়ে আটটা বেজে যাবার পর ভিআইপি ভদ্রলোক এসে স্ত্রীকে বললেন, ' অমরনাথ মন্দির দেখে এলাম।'
সেই কথা শুনে তিনি নাকি আরো বেশি কাঁদতে শুরু করলেন আর বলতে লাগলেন আমিযে পাপী তাই আমার এর দেখা হলনা।
তাকিয়ে দেখি কেয়ার টেকার এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি এত গভীর নীল আকাশ কলকাতায় কখনো দেখা যায় না। কিন্তু সে এক এমন কথা বললো যাতে করে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। সে বলে,
- ' বাবু, আজ রাতমে বারিষ হোগা সাব, কাল যানা ঠিক নেহি সাব। পরশো যানা ঠিক হ্যায়। ওহী দিন তিন ঘোড়ে লে চলেঙ্গে । হামভি আপ লোগো সাথে চলেঙ্গে সাব।' আমি সমরদাকে বললাম,
- 'এতো সুন্দর আকাশ ঘোর নীল, সাদা মেঘ, স্বচ্ছ সূর্য কিরণ, কি করে বৃষ্টি হয়?'
- ' তুমি কি জানো? এরা পাহাড়বাসি তাই আগে ভাগেই বুঝতে পারে।'
- ' বাবু হাম চলতে, হাফ চন্দনবাড়ী যানা হ্যায়।'
বলে সে উঠে পড়ল। আমরাও ঘরে তালা লাগিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ও বাম দিকের রাস্তা ধরলো। আমরা দু গ্লাস চা বিস্কুট নিয়ে বসলাম বেঞ্চে। দোকাদারদের সাথে কথা বলে রাতের খাবারের একটা হিল্লে হল। আমাদের সন্ধ্যে ৭টায় আসতে বললো কারণ সাড়ে সাতটায় দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করা হবে। বড়ো বড়ো দুটো মোমবাতি ও দেশলাই কেনা হলো। চা খেয়ে বাংলোয় ফিরলাম। আগে টেবিলে মোমবাতি দুটো জ্বালালাম তারপর বেডিং খুলে বিছানা করা হলো। কম্বলের তলায় বসে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে নিলাম। তারপর ঠিক সাড়ে ছ়টায় বাংলোয় তালা লাগিয়ে বেরোলাম। দোকানে যাবার রাস্তা ধরলাম। ডান দিকে দুটো পাশাপাশি টেন্ট দেখলাম। বিকালবেলা দেখছিলাম কিছু লোককে টেন্ট খাটাতে ব্যস্ত। এখন দেখছি কিছু লোক গল্প গুজব করছে আর কিছু লোক রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। বড়ো বড়ো চাপাটি বানানো চলছে আর একদিকে তরকারির মতো কিছু একটা বানানো হচ্ছে আর তারই গন্ধ বেরোচ্ছে। যারা বসে গল্প করছে তারা কাঠ জ্বালিয়ে সেটাকে ঘিরে বসেছে। সমরদা বললো, ' সাতটা বাজতে এখনও দেরী, চলো ওদের পাশে বসে খবর নিই।' আমরা কাছে গিয়ে ওদের সাথে আলাপ করলাম। ওরা সরে বসে আমাদের বসতে দিল। বসা মানে উবু হয়ে বসা। এত প্রচন্ড শীতে একটু যেন আরাম বোধ করলাম। জানতে পারলাম ওরা সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার লোক। তাঁবু আর যন্ত্রপাতি নিয়ে হিমালয় সার্ভে করে বেড়ায়। আজ ওরা শেষনাগ থেকে এসেছে। ওখানে ওরা মাসখানকের ওপর ছিল। তার আগে ছিল পনতচরনী পর্বতে। আমাদের বাংলোর সামনে যে বিশাল উঁচু পর্বতটা দেখা যায় সেটা শেষনাগ পর্বত আর ডান দিকেরটা পনতচরণী। সামনের সপ্তাহে সবাই পহেলগাও নেমে যাবে। তাঁবু সহ সব যন্ত্রপাতি অফিসে জমা দিয়ে ছুটিতে চলে যাবে যার যার নিজেদের দেশে। কারো দেশ দেরাদুন, কারও দেশ লছমনঝুলা আবার কারো দেশ পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন জেলায়। সার্ভের লোকেরাও আমাদের সম্বন্ধে জানতে চাইলো। আমরা কোথা থেকে এসেছি, এখানে কোথায় আছি আর কোথায় বা যাবো আমরা ইত্যাদি। আমরা আমাদের পরশুদিনের প্ল্যানের কথা বললাম, কেয়ার টেকারের কথা বললাম। সব কথা শুনে ওদের খুব চিন্তিত দেখলাম। সেটা লক্ষ্য করে ওদের জিজ্ঞেস করে যা শুনলাম তাতে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
ওরা ওদের বহুদিনের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। প্রথমেই বললো আমাদের পক্ষে কোনো মতেই ঘোড়ায় চড়ে একদিনে অমরনাথ দর্শন করে ফিরে আসা সম্ভব নয়। কোনো চক্রান্তে আমরা যেন পা না দিই। কারণ সারা সিজনে এই ঘোড়াগুলো প্রচন্ড সার্ভিস দিয়ে এখন তারা কাহিল। এদের দিয়ে সামনের গোটা সিজন চালানো সম্ভব নয়। তাদের ব্যবসা বসে যাবে। তাই তারা আমাদের মতো পর্যটক পেলে অমরনাথ দেখিয়ে আনার লোভ দেখায়। আর ওই ঘোড়া খাদে পড়ে গেলে ওদের কপাল খুলে যাবে। ওরা সোজা পাহেলগাওয়ের টুরিস্ট অফিসে ঘোড়া খাদে পড়ে যাওয়ার খবরটি পেশ করবে। ইন্সপেকশন হবে এবং ঘোড়া পিছু ৩/৪ হাজার করে পাবে। পাশে যে লোকটি মরে পরে আছে সরকারের কাছে তার কোনো দাম নেই। আর ঘোড়ার মালিক ক্ষতিপূরণ পেয়ে নতুন টাট্টু কিনে নতুন সিজনটা বেশ ভালই চালাবে। এদিকে ঠিক এই সময় ট্রেকিংও ভীষন কঠিন কাজ তাঁবু ও স্টোভ না থাকলে। বাংলোগুলো পাওয়া যাবে না। শেল্টার শেডের মাথায় ছাউনি, পিছনটাও বন্ধ কিন্তু সামনে ও দুপাশে ফুট চারেক বাদ দিয়ে বাকিটা বিলকুল খোলা। প্রবেশ পথটা পুরোটাই খোলা। তাই একটা রাতও আমাদের পক্ষে খুব বিপদজনক আর সেখানে ৪/৫ রাত কাটাতেই হবে। এদিকে সাতটা বেজে যাওয়ায় আমরা ওদের কাছে বিদায় জানিয়ে দোকানে গিয়ে উঠলাম। দোকানের দুজন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাদের বসিয়ে চারটে থালায় ভাত বাড়লো। সঙ্গে দেড় হাতা কুদরির তরকারী। কুদ্রি এর আগে আমি কোনো দিন খাইনি তাই কোনোমতে খেয়ে উঠে পড়লাম। খেতে খেতেই শুনছিলাম ওদের মধ্যে একজন গান গাইতে পারে। তাই একটা কাশ্মীরি ফোক সঙ্গীত গাইতে বললাম। সেই একজন উচ্চ স্বরে লোকসঙ্গীত গেয়ে উঠলো। আর একজন একটা থালা বাজাতে লাগলো। সেই প্রচন্ড শীতে অতি নির্জন পরিবেশে তার গান যেন পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হতে থাকলো। একটা যেন অন্য জগতে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই রাতে।
খেয়ে দেয়ে বাংলোয় ফিরলাম। আসার সময় দেখলাম সার্ভে করতে আসা লোকেরা চাপাটি খাচ্ছে কিছু একটা দিয়ে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। দুজনে দুটো পুজো সংখ্যা নিয়ে শুলাম। সমরদা খুব গম্ভীর। আমার মতো ভীতুর ডিমের পরিবর্তে ওর মতো সাহসী কেউ যদি থাকত তাহলে মনে হয় সে একবার চেষ্টা করতো অমরনাথ যাওয়ার। একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম কাল খুব ভোরে উঠে টেকিং করে শেষনাগ ঘুরে আসা যায় কিনা। সে খালি বললো, ' দেখা যাক।' আমি বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়। রাত কত কে জানে একটু ঘুম ভাঙতেই দেখি সমরদা তখনো গল্পের বই পড়ছে। আমি তাকে এবার ঘুমোতে বলে নিজেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন হতে হতে কানে এলো একটা কথা ' আমার ঘুম আসছে না।' পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে দেখি সমরদা বিছানায় নেই তার সাথে কম্বলটাও নেই। তাকে আমি চেনার জন্য বিচলিত হলাম না। শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাউন্টয়েরিং এর সদস্য সে তাই ফিরে যেতে মন চাইছে না আরকি। বেশ খানিক পরে কম্বল গায়েই ঢুকলো ঘরে। বললাম,
' সমরদা কোথায় গিয়ে ছিলেন?' বললো, ' খুব রাগ হচ্ছিল জানো। তাই সাড়ে চারটেতে ঘুম ভাঙতেই কম্বল গায়ে বেরিয়ে পড়লাম। নদীর দিকে থাকলাম কিছুক্ষণ চেয়ে একমনে কিছুক্ষণ শুনলাম তার সঙ্গীত। তারপর চলে গেলাম পনতচরণীর পদ প্রান্তে। কিছুটা উঠলাম ওপরে। খুব অন্ধকার। তাই নেমে এলাম। মনে হয় মনে একটু শান্তি পেলাম। যাকগে, চল এবার সব গুছিয়ে টুছিয়ে নিয়ে ফিরে যাই।' আমি অবাক হলাম। ' সেকি শেষনাগের দিকে যাবেন না? আর কেয়ার টাকার হই চই করবে না?'
- ' আমরা তার আগেই বেরিয়ে পড়ব। এখানে থেকে লাভ নেই, এককাপ চায়ের দামই কত, আর শেষনাগ গিয়ে লাভ নেই।'
- ' কিন্তু ঘোড়া ছাড়া এই বেডিং কি ভাবে নিয়ে যাব? ভীষন ভারী যে।'
- ' তুমি এই বেডিংটা আমার পিঠে ওঠাতে সাহায্য কর। আগে তো বেরোই তারপর রাস্তায় দেখা যাবে।'
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সমরদার নির্দেশে কেয়ারটেকারের ঘরের দরজার তলা দিয়ে কিছু টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা টেনে দিলাম। রাস্তায় পৌঁছে হাঁটতে শুরু করলাম। চা এর দোকান এখনও খুলতে দেরি আছে। গল্প করতে করতে চলেছি দেখি রাস্তায় এক শেডের নিচে ভিখারি মত একটি লোক হাত বাড়িয়ে কিছু চাইলো। ওর পাশে একটা কেটলি আর স্টোভ দেখতে পেলাম। সমরদা তাকে জিজ্ঞেস করলো সে চা খাওয়াতে পারবে কিনা। সে বলে, সে লাল চা খাওয়াতে পারবে। সমরদা শেডের তলায় ঢুকে পিঠ থেকে বেডিংটা নামিয়ে তাতে বসে আমাকে ডাকলো এবং বসতে বললো। বসলাম। চা খেলাম ও কিছু টাকা দিলাম ভিখারি লোকটাকে।
এবার আমি বেডিংটা নিতে চাইলে সমরদা বলে,
- ' না আমি যখন একদম পারবো না তখন নিও।'
আবার পথ চলা শুরু হলো আমাদের। পথে কেয়ার টেকারের সাথে দেখা হলো। সে প্রথমে অবাক এবং পরে রাগ দেখাতে শুরু করলো। ও নাকি তিনটে ঘোড়া ওয়ালকে কথা দিয়েছে কালকে ওদের অমরনাথে দুজনকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা ওকে কোনো পাত্তা দিলাম না। যে রকম হাঁটছিলাম সেরকম হাঁটতে থাকলাম। আমি শুধু পিছন ফিরে বললাম, কিছু টাকা ও ঘরের দরজা খুললে পাবে। আরও কিছুদূর গিয়ে দুটো ছেলের সাথে আলাপ হলো। তারা আবার এক দেড় কিলোমিটার বেডিংটা বয়ে দিলো কিছু টাকার বিনিময়ে। এরপর দেড় দু কিলোমিটার বাকি থাকতে সমরদা বললো এবার তুমি নাও পিঠে। তখন সমতলে পৌঁছে গেছি। তবুও ওই বাকি সমতল রাস্তাটুকু পেরোতে আমার যা কষ্ট হয়েছিল যে কি বলবো। পিঠ্টা যেনো ভেঙ্গে গিয়ে ছিল। অবস্থা বুঝে শহরে ঢুকে প্রথম রেষ্টুরেন্টেই ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার হাত পা কাঁপছিল তখন। ভাবছিলাম বাকি প্রায় বার কিলোমিটার পথ সমরদা একা কি করে বয়ে আনতে পারলো তাও আবার আট হাজার ফুট ওপর থেকে। তারপরেও সে বেশ স্বাভাবিক। ধন্য সমরদা, ধন্য তুমি।
-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B
Diamond Harbour Road