ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
দুর্নীতিমুক্ত বাজার
মিঠুন মুখার্জী
নদীয়ার নবদ্বীপের কাছের ছোট্ট একটি গ্ৰাম। গ্ৰামের কাছেই একটি বাজার। প্রতি বুধবার ও শনিবার সেখানে বড় হাট বসে। গ্ৰামে ইলেকট্রিক না থাকলেও বাজারে আছে। বাজারে স্থায়ী দোকান আছে প্রায় পঁচিশটি। তার মধ্যে চারটি মুদিখানা, তিনটি চালের দোকান, একটি তেলের মিল, পাঁচটি সব্জীর দোকান, দুটি ডাক্তারখানা , একটি রেশন দোকান, দুটি জামাকাপড়ের দোকান, পাঁচটি মাছের দোকান ও দুটি মাংসের দোকান। হাটবারে আরো কুড়িটির মতো অস্থায়ী দোকান পেতে বসে। এমনি দিনের তুলনায় হাটবারে হাটবারে বাজারে লোকের ভিড় অনেক বেশি থাকে। আশেপাশের গ্ৰামের মানুষেরাও ওই দুটি দিন এই বাজারে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য আসেন। সাড়া সপ্তাহের সওদা কেউ কেউ হাটবারে কিনে রাখেন।
বাজারটির একদা খুবই নাম ছিল। কিন্তু বর্তমানে দোকানদারদের জালিয়াতির কারনে ক্রেতা সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। প্রতিটি দিন কোনো না কোনো দোকানদারের খরিদ্দারকে ওজন কম দেওয়া নিয়ে কিংম্বা মালের দাম বেশি নেওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজার সমিতি থাকলেও তাদের কোনো হেলদোল নেই। কারন এই সমিতির বেশিরভাগ সদস্যই এই বাজারের দোকানদার। তারাও কোনো না কোনো ভাবে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। শম্ভু নামের একজন মাছ বিক্রেতা ওজনে কম দিয়ে ও দাম বেশি নিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গে দাদাগিরি করেন। কিন্তু তাকে কিছু বলার সাহস পায় না ক্রেতারা। পাশের গ্ৰাম থেকে একজন স্কুলমাস্টার একদিন ওই বাজারে মাছ কিনতে এসেছিলেন। খুবই শান্ত প্রকৃতির মানুষ তিনি, কিন্তু অন্যায় একেবারে সহ্য করতে পারেন না। তাকে এক মাছ বিক্রেতা ওজনে প্রায় এক কিলোতে দুশো গ্ৰাম মাছ কম দেন। মাস্টারমশাইয়ের সন্দেহ হওয়ায় তিনি অন্য দোকানে মাছটা মাপেন। দেখেন দুশো গ্ৰাম মাছ কম। তিনি তখন সেই মাছ নিয়ে গিয়ে তাকে বলেন --- "এই মাছওয়ালা আমায় তুই দুশো গ্ৰাম মাছ কম দিয়েছিস কেন? কবে থেকে এরকম ব্যবসা শুরু করেছিস? আমি তোর কাছ থেকে মাছ নেব না। আমার পয়সা ফিরিয়ে দে ।" মাছ ব্যবসায়ী তাকে বলেন--- " আপনি রাগ করবেন না। যাওয়ার সময় হয়তো দুশোগ্ৰাম মতো মাছ আপনার ব্যাগ থেকে পড়ে গেছে, আপনি বুঝতে পারেন নি। আর পয়সা ফেরত দেওয়া হয় না। আপনি চাইলে অন্য মাছ নিতে পারেন।" অন্যান্য দোকানদাররা ওই মাছ ব্যবসায়ীকে সমর্থন করেন। মাস্টারমশাই বুঝতে পারেন এভাবে এদের শিক্ষা দেওয়া যাবে না। একটু ভেবে এদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। তিনি এরপর কিছু না বলে মাছটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
বাড়িতে এসে ছেলে রজতকে সমস্ত বিষয়টি বলেন তিনি। রজতের প্রচন্ড রাশভারী। তিনি পনেরো বছর ভারতীয় আর্মিতে চাকরি করে পুনরায় ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছেন। খুবই রাগি প্রকৃতির মানুষ। তবে প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। পরদিন ছিল রবিবার। বাবার বদলে তিনি ব্যাগ নিয়ে বাজারে যান। সব্জী থেকে মুদিখানা, মাছ থেকে চাল সবই একাহাতে ক্রয় করেন। এরপর বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে মাল মাপার একটি তুলাদন্ড ছিল তাদের। তিনি সমস্ত মালগুলো কয়েকবার মেপে বুঝতে পারেন ওই বাজারের সমস্ত ব্যবসায়িরাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেকের মালে কিলোতে এক থেকে দুশোগ্ৰাম কম। তিনি তখন সেই মালগুলো একটা ব্যাগে নিয়ে পাশ্ববর্তী থানায় যান এবং ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরে ফোন করেন। তারা সব শুনে তাকে তাদের দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ জানাতে বলেন। তাদের কথামত রজত অনলাইনে একটি লিখিত অভিযোগ পাঠান। তারপর তিনি একসপ্তাহ চুপচাপ থাকেন। ওদিকে একসপ্তাহ পর একদিন সকাল নটা নাগাদ হঠাৎ বাজারে একগাড়ি পুলিশ নিয়ে ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের সাতজন অফিসার ঢোকেন। তখন পুরোদমে বাজার বসেছে। পুলিশ দেখে বাজারের মানুষেরা ভয় পেয়ে যায়। পুলিশ ও ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের অফিসাররা মাছ বাজার থেকে মুদিখানা ও সব্জীর দোকান থেকে চালের দোকান, রেশন দোকান সকল জায়গায় গিয়ে তুলাদন্ড ও বাটকারা চেক করেন। সকলের তুলাদন্ড ও বাটকারাতে তারা কমবেশি অসঙ্গতি দেখতে পান। ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরাও এই প্রবঞ্চকদের মধ্যে ছিলেন। কোনো কথা না বলে পনেরো জন দোকানদারকে গ্ৰেপ্তার করেন পুলিশ। ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের একজন অফিসার বলেন --- " এই অসাধু ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ দিনের প্রতারনার কারনে আজ এদেরকে গ্ৰপ্তার করা হচ্ছে। আমরা ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর থেকে এসেছি। দীর্ঘ একবছর যাবত এই বাজারের ব্যবসায়ীদের অসাধু ব্যবসার বিষয়ে আমাদের দপ্তরে অনেক অভিযোগ পড়েছে। অনেকেই বারংবার এদের সাবধান করেছেন কিন্তু এরা শুধরায় নি। বরং দাম বেশি নেওয়ার কথা বললে কিংবা ওজনে কম দেওয়া নিয়ে এদেরকে বলতে এলে এই অসাধু ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে সেই সকল ক্রেতাদের ভয় দেখাতেন। যার পরিণতি এদের আজ থেকে ভুগতে হবে। ক্রেতাদের অধিকার আছে কোনো জিনিস কেনার সময় ওজন দেখে নেওয়া ও সঠিক মূল্য নিচ্ছেন কিনা তা পরখ করে নেওয়া। আপনাদের সঙ্গে যদি কোন অসাধু ব্যবসায়ী খারাপ আচরন করেন বা আপনাদের ঠকায়, তাহলে আপনি অবশ্যই ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করে অভিযোগ করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর। ভয় পাবেন না। ভয়কে জয় করতে শিখুন। তবেই অপরাধী ও অপরাধের সমূলে উৎপাটন সম্ভব।" ব্যবসায়ী সমিতির সাতজন গভর্নিংমেম্বারও এই অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন। সাতজনের সকলেই খুব লজ্জিত হন। দুর্নীতিগ্ৰস্থ সকল ব্যবসায়ীকেই কোমড়ে দড়ি পড়িয়ে নিয়ে যান পুলিশ। তাদের সকলের জরিমানাসহ স্বল্প মেয়াদী জেল হয়ে যায়।
এদিকে রজতের বাবা কয়েকদিন পর ওই বাজারে পুনরায় বাজার করতে যান। তিনি দেখেন বাজারে কয়েকটিমাত্র দোকান খোলা। তবে বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। তিনি একটু অবাক হয়ে একজন মাছ ব্যবসায়ীকে বাজারের এই দশার কথা জানার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সেই দোকানী তাকে পুরো ঘটনাটি তার সামনে তুলে ধরেন। তিনি বুঝতে পারেন এই ঘটনা ঘটানোর পিছনে তার ছেলে রজতের হাত আছে। তিনি মনে মনে হাসেন। তারপর ওই মাছ ব্যবসায়ীকে তিনি বলেন --- " যা হয়েছে তা তো হবারই ছিল। অসৎ লোকেদের সঙ্গে এমনই হয়। কথায় বলে না 'চোরের সাতদিন গৃহস্থের একদিন ', কথাটি ঠিক। আমার মতো অসংখ্য ক্রেতা এই বাজারে বছরের পর বছর ঠকে আসছে, তাছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটে বাজারের ক্রেতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। দেখ এবার কেমন লাগে। এ হল ভগবানের মার।" যে কটি দোকান খোলা ছিল তাদের পরীক্ষা করার জন্য তিনি এরপর বুদ্ধিকরে প্রত্যেকটি থেকে কিছু না কিছু কেনেন। বাড়ি গিয়ে ওজন করে দেখেন সব জিনিসপত্রের ওজন ঠিক ঠিক আছে। তখন তিনি বুঝতে পারলেন ঠেলায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের বাজারে এখন শুধু সৎ ব্যবসায়ীরাই আছেন। এই ঘটনার পর কেউই আর ওজন কম দেওয়ার বা দামে বেশি নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
পরদিন সকালে চা খাওয়ার টেবিলে রজত বাবুকে তার বাবা বলেন--- " তোর বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হবে রজত। যা এতদিন কেউ করার সাহস দেখায় নি তা অতি অল্প সময়ের মধ্যে তুই করে দেখালি। তোর জন্য আমার গর্ব হচ্ছে। মানুষ চাইলেই সব পারে। তোর মতো সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষেরা সচেতন থাকলে ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে অন্যায়কারীরা অন্যায় কাজ করার আগে দুবার ভাববে। দুর্নীতিমুক্ত হবে এই সমাজ। পুলিশরাও চাইলে অন্যায়ের আঁতুড়ঘরকে যখন তখন ভেঙে দিতে পারে। তাদের ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার সমাজকে দূষণমুক্ত করতে পারে। সকলের মনে রাখা উচিত ----- অন্যায়কারী ও অন্যায় সহ্যকারী মানুষ ঈশ্বরের কাছে সমান অপরাধী।" বাবার কথা শুনে রজত মুচকি হেসে বলেন--- "মানুষ আজ অত্যন্ত স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। তাই এদের ভালো হবার নয়। আমরা যতই ভালো কিছু করার চেষ্টা করি না কেন, এরা শুধরোবে না।"
=======================================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা