হারিয়ে যাওয়া শৈশব
মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
"আরে কে কোথায় গেলি রে। শিগ্গির এসে আগে শোবার ঘরের জানালা গুলো বন্ধ কর।বিছানাটা পুরো ভিজে গেলো।আমি কি একা হাতে সব সামলাতে পারি। সরলা,বলি এই সরলা। কানে কি ঠুলি পড়েছিস নাকি, এতো করে ডেকে চলেছি কানেই যাচ্ছেনা?"
" তখন থেকে শুধু সরলা আর সরলা করে চিৎকার করলে হবে? ছাদে যে এক গামলা জামা কাপড় কেঁচে মেলে দিয়ে এলাম, বলি সেগুলোর কি হবে? দোতলায় দৌড়ে উঠে সবকটা জামা কাপড় একসাথে তুলে আনা কি মুখের কথা? দেখোতো ঠিকমতো দম নিতে পারছিনা। পুরো ভিজে একেবারে স্নান করে গেলাম। আর তুমি বিছানা ভিজে যাওয়ার কথা বলছো? এখন বৃষ্টির জলে ভিজে যদি আমার জ্বর আসে তবে আমার সেবাটা কে করবে শুনি?কামাই করলেই তো বলবে যে ইচ্ছে করে ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। সকালেই তোমাকে পইপই করে বললুম যে বৌদি'গো, আজকে আর জামা কাপড় ভিজিও না। বর্ষাকাল, সকাল থেকেই তো বোঝা যাচ্ছিল চুটিয়ে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু শুনলে তো সে কথা। ছুটির দিন, তোমাকে তো একরাশ কাপড় জামা কেঁচে পরিস্কার করার জন্যে ভেজাতেই হবে। আর আমাকেও পেয়েছো একখানা কলুর বলদ। জানো মুখে গজগজ করলেও তোমার কথা ফেলতে পারবো না। এখন এই এত্তো গুলো ভিজে জামা কাপড় নিংড়ে কোথায় মেলি বলোতো?"
"আরে দেখছিসই তো বাড়িতে কেউ নেই। থাকার মধ্যে এই মুহুর্তে শুধু আমি আর তুই। কে কোন দিকে দৌড়াই বল?ছেলেটাকে বারবার করে বললাম যে, আজকে স্কুল ছুটি আছে, আর ঘন্টা খানেক নাহয় একটু বেশিই পড়াশোনা করলি। ক্লাস নাইনে উঠেছে। লেখাপড়ার কম চাপ?কিন্তু কে শুনবে কার কথা। শুনলে তো বাবা-মা'দেরকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আর ভাবতেই হতোনা।"
"আচ্ছা বৌদি তুমি নিজের বুকে হাত দিয়ে একটা সত্যি কথা বলোতো যে, টুকাই বাবুর বয়সে দিনে তুমি ক'ঘন্টা পড়াশুনা করতে? সবেতো চোদ্দো পেরিয়ে পনেরো। গত মাসেই চোদ্দোটা মোমবাতি নিভিয়ে কেক কেটে জন্মদিন পালন হলো। তো এই বয়সে একটু ছেলেমানুষী করবেনা, চঞ্চলতা করবেনা? সারাদিন মুখে বই গুঁজে ঘরে বসে থাকবে?"
"তুই থামতো। মায়ের থেকে দেখছি মাসির দরদ বেশি উথলে উঠছে। লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট না করলে তারপরে তো সারাজীবন পরের গোলামী করতে হবে। সেটা কি বেশি সুখের? আমাদের মেয়েদের কথা ছাড়, বিয়ের বয়স হলে ঠিক একটা না একটা বর জুটে যাবে। রোজগার তো আর করতে হচ্ছেনা। আর পুরুষ মানুষকে শুধু নিজের পেটই নয় উল্টে সংসার পাতলে স্ত্রী-সন্তান সবারই খাওয়া-পড়ার দায়িত্ব নিতে হবে। তো রোজগার করতে গেলে পেটে কিছু বিদ্যা-বুদ্ধি থাকাটা তো দরকার,নাকি?"
"সেটা আসলে তোমরা ঐভাবেই ভেবে অভ্যস্থ,তাই। আমাদের 'শ্যামার' বাবা'তো বড়জোর কেলাস ফাইভ পাশ। কিন্তু কোন কাজটা পারেনা বলো? জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব জানে। কিন্তু কাজের বড়ই অভাব। তাই যখন যেটা পায় সেটাই করে। দৈনিক কাজ পেলে কি আমাকে এইভাবে লোকের বাড়িতে গতর খাটিয়ে রোজগার করতে হতো বলোতো।"
"আরে সেই জায়গাটাইতো তোকে তখন থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে সবজান্তা না হয়ে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। আর তার জন্যে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। ছোটবেলায় পনেরো বছর কষ্ট করে একটু ঠিকমতো পড়াশোনাটা করে নে, তারপরে বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে আয়েস কর। নে, অনেক হয়েছে। এখন এসব নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করলে আর দুপুরের খাওয়া জুটবেনা। সবেমাত্র ভাত আর ডাল হয়েছে। কতো রান্না এখনো বাকি। চল চল চটপট করে সবজি গুলো কুটে দে। ভিজে জামা কাপড় গুলো নিয়ে পরে ভাবা যাবে। বৃষ্টি তো আর গোটা দিন ধরে হবেনা।এদিকে বৃষ্টিও তো থামবার নামই নিচ্ছেনা। ছেলেটা যে কোথায় গেলো। এরপরে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে এসে জ্বর,সর্দি বাধাবে আর তোর দাদার কাছে বকা খেতে হবে আমাকে। আমার হয়েছে যত জ্বালা। আমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে ছেলেটা নাকি দিনকে দিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছে। আমি কি এমনি এমনি এতো কথা বলি? মনের দুঃখ থেকেই বলি। আর তুই ভাবিস বৌদি বেশি কথা বলে।"
****** ******
"আরে টুকাই'দা, বলটা এদিকে পাশ কর।"
"আরে করবো কি করে। বলতো এগোচ্ছেই না, জলে আটকে যাচ্ছে।"
"একটু আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তুলে নিয়ে শর্ট মার।"
"আরে সেটাই তো তখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু যা পেছল ঠিকমতো সোজা হয়ে দাড়াতেই তো পারছিনা, বল মারা তো দূরের কথা।"
"ঠিকই বলেছিস। তবে বৃষ্টিটা কিন্তু হেব্বি হচ্ছে বল?দৌড়াচ্ছি, পরে যাচ্ছি কিন্তু ছিটেফোটা ঘাম হচ্ছে না।"
"আর পরে গেলে ব্যাথাও লাগছে না। কেটে ছড়ে যাওয়াতো দূরের কথা।"
"যা বলেছিস, উপরে জল নিচে জল আর মাঝখানে আমাদের পায়ে বল। বাড়ি থেকে আসার সময় অপুটাকে কতো করে ডাকলাম। "না রে, কালকে স্কুলে অঙ্ক স্যার ক্লাস টেস্ট নেবে। না পারলে গার্জেন কল হয়ে যাবো"; ন্যাকা!! পড়িস তো ঐ সেভেনে, তাতেই এই !!এইসব ছেলে-পুলে জীবনে বেশি দূর এগোতে পারবেনা, মিলিয়ে নিস।"
"সবই তো ঠিক আছে কিন্তু ভেবে দেখ, আমাদের মায়েরা যদি আমাদেরকে এইভাবে কাঁদা মাখা অবস্থায় ভিজে দাঁড়কাকের মতো দেখতে পেতো তাহলে নির্ঘাৎ হার্টফেল করতো। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে দশ মিনিটের যায়গায় এগারো মিনিট হয়ে গেলেই চেল্লামেল্লি শুরু। শিগ্গির বেরিয়ে আয়, ঠান্ডা লেগে যাবে। বুকে কফ বসে নিমোনিয়া হয়ে যাবে। আরও কতো কি।"
"সত্যি, যা বলেছিস!!একমাত্র মায়েরাই এমনটা পারে। পান থেকে চুন খসলেই চিৎকারের চোটে বাড়ি মাথায় করে ফেলবে।আর আমার দিদি তো একেবারে ওৎ পেতে বসে থাকে। মা যতো না বলবে দিদি তার থেকে দশ গুন বেশি। মায়ের মাথাটাকে একেবারে চিবিয়ে খেয়ে নেবে। "দেখেছো তো, ভাই বলে আজকে কিছু বললে না। ভাইয়ের জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে পিঠে দু-ঘা পড়ে যেতো।"এমনিতেই উদম বকা খাচ্ছি, তার উপরে গরম তেলে ফোড়ন ছিটোচ্ছে, ভাব একবার। কাঁহাতক সহ্য করা যায়? দে দুমাদুম কষিয়ে কটা কিল চড়,ঘুসি। আর তারপরে যা হবার তাই, বাড়ির সবারই দুপুরের খাওয়ার চোদ্দটা।"
"তোর দিদি তোর থেকে বয়সে দু-বছরের বড়, না? আমার একটা দিদি থাকলে কি ভালো হতো বলতো। মাঝে মধ্যে সবকিছুর উপরেই খুব রাগ হয়। কোনকিছু স্বাধীন ভাবে ভাববার উপায় নেই !!যা বলি সবই নাকি ভুল। আমার বুদ্ধি নাকি এখনো পাকেনি, তাই বড়দের মুখে মুখে তর্ক না করে বড়রা যা বলছেন সব কান খুলে মন দিয়ে শোনো। রাগ হলে সেই রাগটা যে তোর মতো কাউকে দু-ঘা দিয়ে মনের জ্বালা মিটিয়ে নেবো, তার উপায় নেই। তোর কি ভালো বল। রাগ হলো, ব্যাস, দিদিকে দু-চারটে দিয়ে মনের জ্বালা মিটিয়ে নিলি।"
"নারে টুকাই'দা। তুই যেভাবে ভাবছিস ব্যাপারটা ঠিক সেটাও নয়। মার খেয়ে দিদি যখন হাপুস নয়নে কাঁদে, দেখে খুব কষ্ট হয় রে। আসলে হঠাৎ করে রেগে গেলে তখন মাথার ঠিক থাকেনা। পরে মনে হয় এতো জোরে না মারলেই পারতাম। নিশ্চই খুব ব্যাথা পেয়েছে। দিদির পিঠে গিয়ে হাত বুলিয়ে দি। দিদি খুশি হয়। কান্না বন্ধ করে শুধু বলে, "তোর শরীরে একটুও মায়া দয়া নেই? এতো জোরে নিজের দিদিকে কেউ মারে? আমার ব্যাথা লাগেনা বুঝি?" আমি উত্তরে বলি, "তুইই-বা মায়ের সাথে জুড়ে পাল্লা দিস কেন? দেখছিস তো মা ভীষন রেগে গেছে। তার উপরে কেউ যদি মাকে আরও উত্তেজিত করে দেয় তাহলে তো মা আমাকেই ধরে উত্তম মধ্যম দেওয়া শুরু করবে। তাহলে তুই কি চাস যে, মায়ের হাতে আমি উঠতে বসতে মার খাই?" দিদি এরপরে চুপ করে যায়, আর কিছু বলেনা।"
"কিন্তু এবার বাড়ি ফিরতে হবে রে। মনে হচ্ছে বেলা ভালোই হয়েছে, মেঘলা বলে সঠিক সময়টা বোঝা যাচ্ছনা।"
"ঠিকই বলেছিস। কিন্তু এইভাবে কাঁদা মাটি মেখে বাড়িতে ফিরলে তো বাড়িতে ঢুকতেই দেবেনা।"
"বাড়িতে ঢুকতে দেবে, কিন্তু তারপরে গরম জলে চুবিয়ে সাবান সোডা দিয়ে মা, যা ঘষবে মনে হবে দশদিনের পুরোনো রান্না করে ফেলে রাখা না ধোওয়া বাসনের গা থেকে পোঁড়া দাগ তুলছে। শরীরের ছাল-চামড়ার দফারফা। মা মনে করে মাঠের জল কাঁদা গায়ে লাগা মানেই চামড়ায় নির্ঘাৎ খোস পাঁচড়া বের হবে।"
"চল টুকাই'দা, মণিষ জ্যাঠুদের পুকুরে চারটে ডুব দিয়ে গায়ের কাঁদা গুলোকে ধুয়ে সাফ করে ফেলি। এই সুযোগে বার দুয়েক একটু এপার ওপার সাঁতার কম্পিটিশনটাও করে নেওয়া যাবে। তোর সাথে আমি অবশ্য পারবো না। কিন্তু লড়ে দেখতে ক্ষতি কি?"
"বেড়ে বলেছিস তো। পড়িস তো ক্লাস এইট-এ, এতো বুদ্ধি আসে কোথা থেকে? সাথে থেকে থেকে তোরও দেখছি আমার হাওয়া লেগে গেছে।"
"আরে কার শিষ্য দেখতে হবে তো। দ্য গ্রেট টুকাই দাদা। হিপ্ হিপ্ হুড়রে !!"
----×××××----
ঠিকানাঃ
MRINAL BANDYOPADHYAY,
KAMPA PURBAPARA,
VILL. AND P.O. KAMPA,
DIST. 24 PGS (NORTH),