চাবি আর তিন লাখ টাকা হাতে দিয়ে বলল, তালা চাবি তরে দিইই , দাদন টিঁয়া যা লাগিব পরদি লইবিদে আরি । আঁর বেস্সা আঁয় চায়ুম । বুঝাই দিবি, আঁই কেঅরে নঅ চিন্যম । বুইঝ্যনি ?
সঞ্জয়কে তার ধীবর মালিক প্রাণতোষ দাস বুঝিয়ে দিল । পাশে তারই ছোট ভাই মহিতোষ দাঁড়িয়ে দেখছে । বৃদ্ধা বিধবা মা চেয়ারে বসে। ঠাকুরমা পাশে থেকে বললেন , ইবা গটির পুয়া ন্য ? এতগিন টিঁয়া লই যার সাবধান ! য্যঁরত্যে চুঅখ ন্য যায় ।
---- কিয়া ইতে তো আছে। ইতে ন্য যাইব কি ? মহিতোষকে দেখিয়ে বলল । মহীতোষও বলল , ওমা! ন্য যাউম কি ! ব্যস্সা চ্যঅন ন্য পরিব ? সঞ্জয়দা টিঁয়া লইয়ারে যাওগৈ । আঁই তো পত্তেক দিন যায়ুম।
----- রোজের হিসাব রোজ লঅন পরিব ।
সঞ্জয়কে দু'ভাই ব্যবসার টাকাকড়ি বুঝিয়ে দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি । মহীতোষ সবসময় সঞ্জয়কে অনুসরণ করত। পাছে টাকা আত্মসাৎ না করে । সঞ্জয় সজ্জ্বন ব্যক্তি । দীর্ঘদিন ব্যবসা পরিচালনা করেছে। পরিচিতিও আছে । ওদের ব্যবসায় প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হলো । মাছের আড়তে সঞ্জয় তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করেছে । তাই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হয় পরিকল্পিতভাবে সঞ্জয়কে ঠিক করেছে । তার নামে কোনও বদনাম নেই ।
এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে । হালখাতা পয়লা বৈশাখে। কারণ আড়তে মাছের পাইকারিরা লক্ষ লক্ষ টাকা বাকি নেয়। আর হালখাতার দিনে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ করে আবার কেউ কেউ করেও না। অনেক টাকা মার খায় ।
গত বছর চৈত্রের শেষ দিনে নতুন আড়তে ব্যবসার জন্য টাকা দিয়েছিল প্রাণতোষ পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করার জন্য । শুরুও হয়েছিল । গত পয়লা বৈশাখ থেকে আজ অবধি পয়লা বৈশাখের ব্যবসার মুনাফা সবই বাকি। হালখাতার দিনে অনেক আশা থাকে পরহস্ত ধনম নিজ হাতে আসার জন্য ।
সকাল থেকে আড়তে সাজো সাজো রব। ফুলে ফুলে সাজিয়েছে সঞ্জয়। মিষ্টির অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সবকিছুই প্রাণতোষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আড়ৎ চালানো বাবদ তিন লাখ টাকা বাদেও প্রায় এক কোটি টাকা দাদনী দিয়েছে তাও প্রাণতোষ জানে। স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষর করে ওরই সাক্ষাতে দিয়েছে তাই অনাদায়ী টাকা হস্তগত হবে কিনা চিন্তিত । কিন্তু সঞ্জয় বারবার আস্বস্ত করেছে বকেয়া বাকী উদ্ধার হবে এবং দাদনী টাকা কিছু হলেও উদ্ধার হবে । দাদনী টাকা বছরের পাওনা কোনওদিন বছরের মধ্যে শোধ হয় না। বকেয়া থেকে যায় আর সঙ্গে নতুনভাবে আবারও দাদন দিতে হয় । কারণ দাদন টাকায় জাল- নৌকা- মাঝি -ভাগীদের দিলে তবেই মাছ আড়তে দেবে । ওরাও জানে সবকিছু । তা সত্বেও বাড়তি কথা বলে সঞ্জয়কে বেশি চিন্তিত করে ।
সেদিন পয়লা বৈশাখে সকাল থেকে নারায়ণ পূজা। লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি পোড়ামাটির বলে দামী আনা হয়েছে । নতুন ক্যালেন্ডার খাতা পেনসহ প্রয়োজনীয় সব এনেছে । ব্রাহ্মণ এসে পূজা করছে। আড়তের কর্মচারীরা সহযোগিতা করছে । মহীতোষ সংকল্প মন্ত্র পাঠ করছে । এমন সময় সঞ্জয়কে মুঠোফোনে ফোন করল। --- তুই কডে ?
---- কেন দাদা আমি তো আড়তে । কিছু বলবেন ? ---- যা খাতায় বাকী পইরজ্যে ব্যাগ্গিন আদায় করিবি ন্য দিলে সঁইয়ার ব্যস্সায় লাভ কি ?
---- যত যাই বলেন সব টাকা আদায় হবে না দাদা । যতটা হয় চেষ্টা তো করব আদায়ের জন্য ।
----.কডে কি করিবি আঁই ন্য বুঝি ।
সঞ্জয় খুব মানসিক চিন্তায় পড়ল । কারণ অসম্ভবের বার্তা । এটা তাকে হুমকি দেওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো বুঝতে পারল না । হালখাতায় অধিকাংশ পাইকারি টাকা দিয়েছে । তবে সম্পূর্ণ টাকা দেয়নি । কিছু পাইকারি আসেনি। রাত ন'টা বেজে গেছে । পরিস্থিতি বুঝে মহীতোষকে বলল , টিঁয়া সব বান্ডিল কর । যা উইঠ্যে লই আয়। সঞ্জয়কে আড়ালে বলল, টাকা লইয়ারে গারিৎ করি মহীতোষেরে লই আইতি । সঞ্জয় আরো বেশি চিন্তিত শুনে ।
মহীতোষকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণতোষের বাড়ি গেল । গেটের মুখে এসে মহীতোষ বলল, গাড়ি তো ভিতরে যাচ্ছে । তোমাকে আর ভিতরে যেতে হবে না । ততক্ষণে সে নেমে গেল । নেমে মহীতোষকে বলল, মিষ্টির প্যাকেট পনের- কুড়িটা আছে সবাইকে ভাগ করে দিও। পরের দিন মহীতোষ তার পরিচিতজনকে দিয়েছে । এবং প্রাণতোষকে না জানিয়ে ।
পরের দিন ফোনে ডেকে বলল , টিয়া কারে দিঅস ? অথচ ছোট ভাই তাকে টাকা দিয়েছে সে অস্বীকার করল।
----- কেন ! কেন ছোটবাবু তো নিয়ে এলো ।
----- তরে বুঝাই দিই বেগ্গিন আঁই , তোর তুন চাবি টিঁয়া চাইর। ইতারে দিঅস কিঅর লাই ?
---- ছোটবাবু বলল, তোমাকে যেতে হবে না আমি নিজে হাতে টাকা বুঝিয়ে দেবো। তাহলে কি---
----- মিষ্টি ঠুঙ্গা কারে দিঅস ?
----- সবই তো ছোটবাবু নিয়ে গেল ।
---- কালিয়া তুন আরতের চাবি দি ফেলিবি । তরে লইয়ারে আর ন্য ব্যস্সা কইরজ্যুম।
সঞ্জয় কথা শোনার পর স্তম্ভিত। ভাবতে পারেনি এক বছরের মধ্যে তাকে ছাড়িয়ে ব্যবসার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলবে। আড়ৎ ব্যবসায় কেন , কোনও ব্যবসায় বাকিধার হালখাতায় সমূহ আদায় করা যায় না । প্রাণতোষকে কেউ কেউ কু-পরামর্শ দিয়েছে নিশ্চয়ই মনে হয় । যারা তার কাছাকাছি থাকে । অনভিজ্ঞতা কিন্তু তারাও যে অনভিজ্ঞ এ কথা কি করে বোঝানো যায়।
শুরু হলো সম্পত্তি নিয়ে গৃহযুদ্ধ । ভাই ভাইকে কি করে ফাঁকি দেওয়া যায় । প্রাণতোষও চেয়েছিল এই অজুহাতে ভাইকে কি করে ফাঁকি দেওয়া যায় । তাই হলো।
সঞ্জয়কে দায়ী করল এসবের জন্য । তাকে ডেকে অসভ্য অশ্রাব্য গালিগালাজসহ মা- মাসি তুলে অপমানিত করল। জঘন্য কথাবার্তা বলে লোকজন জড়ো করে হেনস্থা করল। সঞ্জয় খুব দুঃখ পেয়ে কাজটা ছেড়ে দিতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, সারা বছর কাজ করেছি বেতন কি দিবেন দেন আমি চলে যাবো ।
নিয়োগের সময় প্রাণতোষ বলেছিল, কাজ করো আমি তোমার ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ দেবো আরো বিয়েতে খরচ দেব । কিন্তু সে থাকবে না বলে দিতেই তাকে সম্বৎসরের কোনও বেতন দিল না । ফলে বিনা পারিশ্রমিকে ধীবর পরিতোষ খাটিয়ে নিল । উদ্দেশ্য ছিল আড়ৎ চালু হলে তাকে সরিয়ে দেবে ; ছোট ভাইকেও ফাঁকি দেওয়া যাবে এবং তার বড়ো ছেলেকে ওখানে বসিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করবে ।
=======================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা ।