প্রবন্ধ ।। বাংলা নববর্ষের হাল-হালৎ ।। শংকর ব্রহ্ম
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
বাংলা নববর্ষের হাল-হালৎ
শংকর ব্রহ্ম
পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই তাদের নিজ নিজ বছরের প্রথম দিনটিকে বরণ করে নেয়। প্রাচীনকাল থেকে এরূপ বর্ষবরণের প্রথা চলে আসছে। পৃথিবীর এক এক জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এ নববর্ষ বা বছরের প্রথম দিনটিকে বরণ করে নেওয়ার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী মিসরীয়, ফিনিশীয় ও ইরানিরা যেমন বহুকাল আগে থেকে তাদের নববর্ষ পালন করে আসছে তেমনি তাদেরও আগে গ্রিক ও রোমকরা যীশুখ্রিস্টের জন্মের পঞ্চম শতাব্দী আগে থেকে এরূপ উৎসব পালন করতো বলে জানা যায়। প্রাচীন আরবীয়রা 'ওকাজ' মেলা, ইরানীয়রা 'নওরোজ' উৎসব ও প্রাচীন ভারতীয়রা 'দোল' পূর্ণিমার দিনে নববর্ষ উদযাপন করতো।
কানাডার বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অফ আলবার্টা অন্যান্য সংগঠনের সাথে বর্ণাঢ্যভাবে তার ঐতিহ্য উৎসব (বাংলা নববর্ষ) উদযাপন করে। ক্যালগারির বাঙালিরা ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক এবং বাঙালি সংস্কৃতির সাথে দিনটি উদযাপন করে। অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল সিডনি অলিম্পিক পার্কে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে।
পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতির মধ্যে নববর্ষ উদযাপনের সময়ের বিভিন্নতা ও রকমফের যতই থাকুক না কেন এ বিশেষ দিনটি যে আনন্দের সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। পুরাতনকে ধুয়ে মুছে মানুষ যে চিরকাল নতুনের স্বপ্ন রচনা করে চলছে এ তাৎপর্যটি নববর্ষ উদ্যাপনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাই নববর্ষের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন-
"এসো হে বৈশাখ
এসো, এসো,"
কবি মহাদেব সাহা বলেন -
"এবারও তেমনি শেষ চৈত্রের খর নিঃশ্বাসে
নতুন বছর আসবে হয়তো;
কিন্তু তুমি কি জানো এদেশে?"
কবি শংকর ব্রহ্ম বলেন -
"আসছে বলেই নতুন বছর লাফাচ্ছ খুব মনে,
ভাবছ না তো থাকবে যে কে থাকবে না কোন জনে।
আসছে বলেই নতুন বছর ফুরিয়ে যাচ্ছে জীবন
এই কথাটা ভাবার সুযোগ দিচ্ছে নাকি মন?"
বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ বাংলা সনের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রকাশ করেছেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মণিপুর, নেপাল ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হতো।
অন্যদিকে আবার বহু ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার পরিমার্জনের মাধ্যমে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থাকে একটি সুষ্ঠু রূপ দেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর সৌর পঞ্জিকা এবং হিজরি সনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন।
বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন হয় ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট আকবরের সময়। তখন বাংলাদেশ ছিল মোগল সম্রাটের করদ (খাজনা দাতা) রাজ্য। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বছরের প্রথম দিনটিতে অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিনে জমিদাররা খাজনা আদায় করত। জমিদারদের সভাঘরে বসত 'পুণ্যাহ'।
আবার বহু ঐতিহাসিক এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে হিন্দু ঐতিহ্যের দিনপঞ্জীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন।
কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন।
একথা সত্য যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আকবরের শাসনকালের বহু আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জিকা এবং নববর্ষ উদযাপনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেজন্য আকবরকে বাংলা বর্ষপঞ্জির উদ্ভাবক বলে ধরে নেওয়া যুক্তিসম্মত বলে মনে করেন না তারা। আধুনিক গবেষণার ফলে মনে করা হয় গুপ্তযুগীয় বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়।
বঙ্গাব্দ শব্দটি (বাংলা বছর) আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বে দুটো শিব মন্দিরেও পাওয়া গেছে, যা বলছে বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের পূর্বেও ছিল। আবার এও অস্পষ্ট যে আকবর বা হুসেন শাহ এর দ্বারা এটি গৃহীত হয়েছিল কিনা। বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহারের রীতি আকবরের পূর্বে হুসেন শাহ এর দ্বারাই হয়ে থাকতে পারে।
পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত হয়।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে চিহ্নিত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।
বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনকে স্বাভাবিক আপাতদৃষ্টিতে অগণিত উৎসবের একটি সুষ্ঠু সমাহার বলে মনে হলেও বাঙালীর জীবনে নববর্ষ উদযাপনের সার্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্র একটি বছর ধরে মানুষের জীবনে যে মানসিক ক্লান্তি, গ্লানি ও হতাশা জন্ম নেয় সেগুলি থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণেই উৎসবের সার্থকতা। বাঙালীর নববর্ষ উদযাপন এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়।
বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে বাঙালীরা পুরনো বছরের সকল ক্লেদ, গ্লানি এবং জীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃতপক্ষে নতুন জীবনের আশ্বাসকেই বরণ করে নেয়। তাছাড়া নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে সকল বাঙালীর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অপূর্ব স্বাজাত্যবোধ, বেঁচে থাকে বাঙালীয়ানা। বিভিন্ন উৎসবের পালনের মধ্যে দিয়ে বাংলার অগণিত মূল্যবান লোকসংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। পৃথিবীজুড়ে সকল বাঙ্গালীর মধ্যে ঐক্যগত মেলবন্ধনের সেতু রচিত হয়।
এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল "শুভ নববর্ষ"। নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলাদেশে নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
বর্তমান যুগে বাইরে থেকে আমদানিকৃত বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যজনিত বাড়াবাড়িতে বাংলা নিজস্ব সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। বাঙালীর জাতীয় সত্তার এই সংকটকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে আজকাল বিভিন্ন স্থানে বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনের মধ্যেও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়।
এই অপসংস্কৃতি থেকে বাঙালীর স্বাজাত্যবোধ এবং নিজস্ব জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অনতিবিলম্বে আত্মসংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া ভীষণ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান নগরজীবনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দ্বারা আয়োজিত সাংস্কৃতিক উৎসব, মিলন মেলা, গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা প্রভৃতি উদ্যোগের সার্থকতার কথা উল্লেখ করতেই হয়।
নববর্ষ প্রতিটি বাঙালীর জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটিতে বাঙালী পৃথিবীর যে কোনেই থাকুক সে তার জাতীয় ঐতিহ্য উদযাপন করতে মেতে ওঠে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন এই দিনে বাঙালী পুরুষেরা সাধারনত পাঞ্জাবী ও ধুতি পরে এবং মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়িতে সেজে ওঠে।
তাছাড়া এই দিনে বাঙালী ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ বিভিন্ন রকমের ভাজা খাওয়ারও প্রথা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে মহা-আনন্দ সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। চারিদিকে পরম আনন্দের পরিবেশে বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে বাঙালী জাতির মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালী জাতির কাছে এই দিনটি নিজেদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।
বাংলা নববর্ষের কথা বলতেই সর্বপ্রথম যে দিনটির কথা আমাদের মনে আসে তা হল পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালী জাতি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠেন। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ তো বটেই তার সাথে ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের কিছু অংশেও বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধাম সাথে পালন করা হয়।
সাধারণভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। বাঙালি এই সময়ে মেতে ওঠে নানা প্রকার উৎসবে। হালখাতা, বিভিন্ন শোভাযাত্রা, নানা ধরণের মেলা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়। একে অপরকে 'শুভ নববর্ষ' অভিবাদন জানিয়ে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে বাঙালীরা বছর শুরু করে।
(বৈশাখী মেলা)
বাংলা লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বাংলার বিভিন্ন উৎসব। সেই সকল উৎসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা অন্যতম একটি উৎসব। বাংলাদেশের নগরায়নের পরিবেশেও এখনও এই মেলা আয়োজিত হয়।
বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক শিল্পকে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য এই মেলায় নিয়ে আসেন। বাংলার গ্রামীণ পটচিত্র, তথা বিভিন্ন লোকগান, লোকনৃত্য ইত্যাদি এই মেলাতে স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে। নববর্ষের আনন্দ উদযাপনের মাধ্যমে বাংলার হারিয়ে যেতে বসা আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে মর্যাদা দান এবং পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস এই মেলার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়।
(বউমেলা)
ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে যার নাম বউমেলা, এটি স্থানীয়ভাবে "বটতলার মেলা" নামেও পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে।
(ঘোড়ামেলা)
এছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তার স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।
(হালখাতা)
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আলোচনায় বাঙালীর হালখাতা পালনের কথাও উল্লেখ করা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। নববর্ষের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালীর উন্মাদনা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটির তাৎপর্য হলো বর্ষবরণ-এর শুরুতে ব্যবসায়িক হিসাবগত খাতার হাল-হকিকত যাচাই করে নেওয়া। তবে এই উৎসবটি সকল ব্যবসায়ী মহলেই পরম রসনার সঙ্গে পালন করা হয়। সকল আমন্ত্রিত ক্রেতাকে করানো হয় মিষ্টিমুখ। ক্রেতারাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের ধার বাকি মিটিয়ে পরস্পর এক শুভ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। যদিও গ্রাম বাংলার চরিত্র মূলত দুই বাংলাতেই একরকম, তবে উৎসবগুলির চরিত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে থাকে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চড়কের মেলা, লোকগানের আসর, বাউল মেলা ইত্যাদি। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান কলকাতায় নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের আগে থেকেই বাজারে চলতে থাকে চৈত্র সেল।
(আদিবাসীদের নববর্ষ)
সাধারণ বাঙালিদের পাশাপাশি উভয় বাংলা সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যেও বাংলা নববর্ষ পালনের প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই সকল আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকে।
প্রান্তিক অঞ্চলের এই সকল নৃগোষ্ঠী গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর, পুরুলিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি গুলির নববর্ষ উদযাপনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলা নববর্ষ হল বাঙালির বাঙালীত্বকে উদযাপন করার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মধ্যে যাতে কোনোভাবেই অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি স্তরে সকল বাঙালিকে সচেতন হতে হবে।
নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর বাঙালীত্ব বিশ্বায়িত হোক, বাঙালী সংস্কৃতি মর্যাদা পাক বিশ্বের দরবারে, আধুনিক ভোগবিলাসমূলক জীবন দর্শন ত্যাগ করে আপন আত্মা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দিকে বাঙালী যত্নবান হয়ে উঠুক এটুকু আশা করা যায় নিশ্চয়ই। নববর্ষে বাঙালীত্ব এবং বাঙালী সংস্কৃতির পবিত্র উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জীবনের সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে নতুন জীবনের আশার আলোয় নতুন বছর ভরে উঠুক।
"অসতো মা সৎ গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়,
ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।।"
----------------------------------------------------------------------------
নাম - ঠিকানা - ফোন নম্বর
----------------------------------------------------------------------------
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
----------------------------------------------------------------------------