এপ্রিল মাস শেষ হতে চলল । সাড়া রাজ্য তথা দেশ জুড়ে চলছে ভয়ঙ্কর তাপপ্রবাহ ।এ পর্যন্ত বৃষ্টির কোন দেখাই নেই। তাই মানুষেরও আপাতত স্বস্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অফিস থেকে পৌনে ছ'টায় বেরিয়ে একটু দূর থেকে একটি এসি বাস আপন গাম্ভীর্য নিয়ে বিলম্বিত লয়ে আসতে দেখে প্রতীক হাত নাড়ে। বাসটা শ্লো হয়। পূর্ব রেলের হেড অফিসের কাছাকাছি জায়গা থেকে প্রতীক বাসে উঠে পড়ে। উঠেই গোটা বাসটার ভেতরে ভাল করে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নেয় যদি কোন বসার সিট পাওয়া যায়। দেখল বাসের ডানদিক বরাবর মাঝ খানের অঞ্চলে যে তিনটে সিট থাকে তাঁর একটি সিট শুধু ফাকা বাকি দুটোতে দুজন বসে আছে। আশ্চর্যজনক ভাবে নজরে পড়ল একজন পরিচিত ভদ্রমহিলাকে, মহিলা না বলে বোধহয় মেয়ে বললেই ভাল শোনায়। বয়সে মধ্য ত্রিশের বলেই মনে হয় অর্থাৎ বয়সে প্রতীকের থেকে সে অনেকটাই ছোট। প্রতীক মাঝে মধ্যে মেয়েটিকে জিপিও'র কাছে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।বাসটিতে একটিমাত্র সিটই খালি ছিল এবং সেটি ছিল মেয়েটির একদম পাশের সিটটি । হয়ত মুখ চেনা বা ভদ্রতার খাতিরে মেয়েটি প্রতীককে উদ্দেশ্য করে বলে এখানেই বসে যান আর কোন সিট তো খালি নেই। মেয়েটিরও প্রতীকের মুখ চেনা । প্রতীক ওর পাশেই বসে পড়ল। মেয়েটিকে বলল - থ্যাঙ্ক ইউ। প্রতীক চরিত্রগত ভাবে একজন সদালাপী । মানুষের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে দ্বিধা কাটাতে খুব বেশি সময় লাগে না। একই রুটের বাসযাত্রী হলেও এই প্রথম মেয়েটির সাথে ওর কথা হল। একটু ইতস্তত লাগলেও প্রতীক ওর পাশে বসেই বলতে শুরু করে – গরমটা কি পড়েছে বলুন তো, একেবারেই অস্বাভাবিক । অফিসের এক বন্ধু আজ মজা করে বলছিল - জানিস তো এগিয়ে বাংলা, আমি বললাম কিসে - ও বলে তাপমাত্রায় আমরা মরুভূমি রাজস্থানকেও ছাপিয়ে গেছি। মেয়েটি শুনে হাসলো। তারপর মেয়েটি প্রতীককে জিজ্ঞেস করে আপনাকে মাঝে মাঝে মিনি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ।
প্রতীক মাথা নাড়ে বলে - হ্যা আমি ও আপনাকে কখনও কখনও দেখেছি, আপনি সম্ভবত বাগুইআটিতে থাকেন, তাই তো?
মেয়েটি বলে- হ্যা । প্রতীক বলে আমি তাঁর আগের স্টপেজেই থাকি । এসি বাসটা পেয়ে গেলে আর কোন বাসে যেতে মন চায় না। একটু হেসে বলে - তবে ভাল জিনিষ বলেই এরা সংখ্যায় খুবই কম। গরম কালে এ বাসে সিট পাওয়াতো অনেকটা লটারি পাওয়ার মত। বাসটা সংখ্যায় আরও কিছু বাড়ালে ভাল হয়।
মেয়েটি মাথা নাড়ে- ঠিকই বলেছেন। ধর্মতলা থেকেই বাসটা ভরতি হয়ে আসে । মাঝপথে সিট পাওয়া তাই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
প্রতীক বিবাহিত, সাংসারিক জীবনের বয়স হয়ে গেল প্রায় বারো বছর। ওর ন'বছরের এক ছেলে সন্তানের জনকও বটে। তবে ওর অল্প বয়সের অভ্যেস আজও যায়নি। প্রতীক মানুষের সাথে কথা বলতে ভালোবাসে, সে সমাজের যেকোন স্তরের মানুষই হোক না কেন। ওটা ওর জন্মগত স্বভাব । বাস ট্যাক্সি ট্রেন বা কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হোক মানুষের সাথে সেধে ও গল্প জুড়ে দেয় । এমনকি রিক্সা অটোতে উঠলেও চালককে নানান প্রশ্ন করে "তুমি কোথায় থাক? ছেলেপুলে কজন? ওরা কি করে? সারাদিনে কত রোজগার হয় এরকম বহু প্রশ্ন" । সবাই যে এতে খুশি হয় এমনটা নয়। অনেকে হয়ত হয়। হয়ত ভাবে এই লোকটা আমাকে নিজের মনে করেই আমার সম্বন্ধে এতসব জানতে চায়। আজকের দিনে কজনই বা আর অন্য মানুষের জীবন কাহিনীর গল্প শুনতে চায়! প্রতীকের এই স্বভাবের জন্য ওর স্ত্রী মাঝে মাঝে ওর উপর খুব বিরক্ত হয়, কখনও রেগে গিয়ে বলে - "কি এত সারাক্ষণ বকর বকর কর, মুখটা একটু বন্ধ রাখতে পারো না, ওদের সম্বন্ধে এতসব জেনে তোমার লাভ কি?" প্রতীক মুখ খোলে না। সংসার অভিজ্ঞতায় এতদিনে ও বেশ বুঝেছে - পুরুষ তুমি যত বড়ই বিজ্ঞ পন্ডিত বা তার্কিক হও, মহিলাদের সাথে অন্তত তর্ক করার থেকে দূরে থাকো, কোন অবস্থাতেই ওদের সাথে বিতর্ক জড়িও না। ওদের কিছু বোঝানো যায় না, কোন যুক্তির ধার ধারে না, ওরা কারো কোন কথা শুনবেও না। নিজেরা যা বুঝবে সেটাই ঠিক। তাই ওদের সামনে মানে মানে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। একবার তো প্রতীক এক বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল ।
সেদিন সিঁথির মোড়ে শাটল ট্যাক্সির জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর যদিবা একটি পেল কিন্তু টাক্সির গেটের মুখে অন্তত দশ জন প্যাসেঞ্জার হুড়মুড়িয়ে সবাই একসাথে ওঠার চেষ্টা করল। পিছন থেকে বড় সর চেহারার একটি মেয়ে এসে এমন ধাক্কা মারল যে ও ট্যাক্সিতে তো উঠতে পারলই না বরং ছিটকে গিয়ে পড়ল চার হাত দূরে। অদূরে জনতা তাকিয়ে দেখল বটে কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। উল্টে যখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল কেন এভাবে ঠেললেন। মহিলা উল্টে ব্যস্ত রাস্তায় মোড়ে ভয়ঙ্কর চিৎকার জুড়ে দিল বলল - "ইউ সাট আপ, আমি মোটেও না আপনি আমাকে ঠেলেছেন" অনেক যুক্তিতর্ক করার সুযোগ থাকলেও প্রতীক আর কথা বাড়ায় নি । সামনে ট্রাফিক পুলিশ ছিল, অগত্যা তাই চেপে যায়। কোন দিক দিয়ে কোন বিপদে জড়িয়ে পড়ে তাঁর তো কোন ঠিক নেই । সেদিন একটু বাড়াবাড়ি হলে হয়ত সারাদিনের জন্য সব প্রোগ্রাম মাটি হয়ে যেত, তারপর উকীল জোগাড় করে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরতে হত । এ ধরনের মেয়েলি কেসে নিজের বাড়ির লোকও হয়ত কোন পুরুষকে সন্দেহের উর্ধ্বে রাখে না । শহরের রাস্তা ঘাটে বিশেষ করে পুরুষের সাথে ঝগড়াঝাটিতে মহিলাদের অনেক অ্যাডভান্টেজ। চিৎকার জুড়লেই হোল, সবাই ধরেই নেয় পূরুষটাই দোষী। এসব ক্ষেত্রে পুরুষকে ভিলেন বানানো মানুষের জীবনে সহজতম কাজ। ঘরে হোক বা বাইরে অ্যালগরিদিমিক্যালি মহিলাদের সাথে বিতর্কের অবসান ঘটানো অত্যন্ত সহজ উপায় হল, অবশ্য যদি কোন পূরুষ সারাজীবন এই উপদেশটুকু মাথায় রেখে চলতে পারে, সেটা হোল এই- "হে বিজ্ঞ মহাপূরুষ আসলে তুমি তো কোন নারীর গর্ভেই জন্ম নিয়েছে। সুতরাং তুমি তাঁকে বিতর্কে বা ঝগড়াঝটিতে অনায়াসে হারাইয়া দেবে একথা কখনও তুমি ভাবিতে যাইও না। তোমার এই ভাবনা নিতান্তই বাতুলতা বলিয়া গোটা বিশ্ব গন্য করিবে " ।
কেন যে একটা মানুষের বিষয় আরেকটি মানুষের জানার দরকার বা জানতে ইচ্ছে হয় সেটা প্রতীক ওর স্ত্রীকে কি করে আর বোঝাবে । এটা ঠিক কোন গোমড়া মুখো স্বভাবের মানুষ যদি কারো সাথে কথা বলতে না চায় তাহলে তো প্রতীকদের মত মানুষের দায়িত্ব অনেক কমে যায়। প্রতীক যে যৎসামান্য লেখালেখি করে, তার উপকরণ খুঁজতেই ওর এই স্বভাবটি ওকে অনেক সাহায্য করে। যেটা অনেকের চোখে কখনও হয়ত বিসাদৃশ্য বা হ্যাংলামোপনা মনে হতে পারে।
মেয়েটিকে প্রতীককে এবার জিজ্ঞেস করে আপনাদেরকে ছুটি কটায় হয় ? মেয়েটি উত্তর দেয় – সন্ধ্যে ছ'টায়, তবে প্রতিদিন বেরোতে আমার একটু দেরিই হয়।
–তাহলে আজ বোধ হয় একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছেন তাই তো?
একদম তাই, আমার আরও আগে বেরোনোর কথা ছিল, আসলে শরীরটা আজ সকাল থেকেই ভাল লাগছিল না, মা ফোন করে বলল শরীর যখন ভালো লাগছে না তখন একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে আয় । কিন্তু তা আর হয়নি, প্রায় পুরো অফিস আওয়ারস কাটিয়েই আসতে হল। অফিস থেকে বেরিয়ে এসে এই বাসটাকে দেখতে পেয়ে উঠে পড়লাম, ভাবলাম একটু আরামে যাওয়া যাবে। প্রতীক জিজ্ঞেস করে- শরীর ভাল নেই তো আজ ছুটি নিলেই তো পারতেন।
- না না, ছুটি নেওয়া অসম্ভব, কাজের অস্বাভাবিক চাপ। ছুটির দিনেও কখনও কখনও বাড়িতে ল্যাপটপে বসে কাজ করতে হয়। কতদিন ধরে বস কে বলি আরেকটা লোক দিন, কিন্তু সে আর দিল কোথায়?প্রতীক জিজ্ঞেস করে – আপনি কোন অফিসে আছেন ? মেয়েটি বলে
--ইন্টেলিজেন্ট মেরিন এন্ড লজিস্টিক এজেন্সি। আমাদের কাজ হোল মূলত ক্লিয়ারিং এজেন্সির, এছাড়া আমরা লজিস্টিক সাপোর্টও প্রোভাইড করে থাকি । সাড়া দেশে আমাদের আটটা স্টেটে ব্রাঞ্চ অফিস আছে । মুম্বাইতে হেড অফিস। এছাড়াও লন্ডন কেপটাউন,সিডনিতেও অফিস আছে।
মেয়েটি প্রতীককে জিজ্ঞেস করে - আপনি কোথায় আছেন?
প্রতীক জানায় ও একটি প্রাইভেট ব্যাংকে আছে।
এরপর বাসের চাকা ঘোরার সাথে সাথে ওদেরও কথা চলতে থাকে ।
প্রতীক আরও স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করে -- আচ্ছা বাড়ি ফিরে টিভি সিরিয়াল , সোশ্যাল মিডিয়া এসব করেন?
মেয়েটি হেঁসে বলে - কোনটাই করি না। ওসব আমার ভালোই লাগে না, ওই সারাদিন ধরে এদিক ওদিক হোয়াটসঅ্যাপে উল্টো পাল্টা মেসেজ ঢুকছে আর ওগুলো দুনিয়াভর একে তাকে ফরওয়ার্ড করে বেড়াও। বড্ড চিপ লাগে। এর মধ্যে নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ কোথায়? তাছাড়া সারাদিনের অফিসের কাজ সারাদিন খাটা খাটুনির পর ওসব কি আর ভাল লাগে ? সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে একেবারে রাত ন'টা সাড়ে ন' টা নাগাদ সরাসরি ডিনার সারি তারপর শুয়ে পড়ি । আবার সকালে উঠে ঘরের কিছু কাজকর্ম করি তারপর সেই এক রুটিন অফিসে যাওয়া। নষ্ট করার মত সময় কোথায়! তাছাড়া আমি ঘুমোতে খুব ভালবাসি বলেই মেয়েটি একটু জোড়ে হেসে ফেলে।
প্রতীক বলে - আচ্ছা যদি ধরে নি ন'টা নয় দশটা থেকে ছ'টা অবধি আপনি ঘুমোলেন মানে গোটা আটঘন্টার একটা ঘুম। তার থেকে যদি এক ঘন্টা সময় ধার করে নিজের জন্য একটু সময় বের করা যায় তাহলে আরেকটু ভাল হয়না? ওই সময়তে একটু গান শোনা, ভাল সিনেমা দেখা বই পড়া এসব করলে তো দারুন হয়। মেয়েটি বলে - সত্যি বলতে কি, আমার এসব কিছুই ভাল লাগে না। এই তো বেশ ভাল কাটছে। প্রতীক লক্ষ্য করে মেয়েটির চোখে মুখে কোথাও যেন ক্লান্তি এক অদ্ভুত ঔদাসীনতা বিরাজ করে তাই একটু সাহস করে বলেই ফেলে -
আচ্ছা ম্যাডাম আপনার কথাবার্তাগুলোতে এত স্যাডিজম এর ছোঁয়া মেশানো কেন, পৃথিবীটি কি এতই খারাপ?
-কই নাতো, আমি সেটা বলিনি তো। আমার হয়ত এসব ভাল লাগে না তাই বলে পৃথিবীটা কেন খারাপ হতে যাবে? যেটা আমি ফিল করি সেটাই বললাম।
- হুঁ আপনি ঠিকই বলেছেনা।
আপনার বাড়ীতে মা ছাড়া আর কে কে আছে ম্যাডাম ?
কেন আমি!
- আপনার ফ্যামিলি?
একটু চুপ করে থেকে ঠোঁটের এককোনে হাসি রেখে বলে- একসময় সবই ছিল আজ আর কিছু নেই, শুধু মা-ই আমার একমাত্র আশা ভরসা ।
আর আপনার বাবা?
উনি গত ২০২০ সালে কোভিডে মারা গেছেন প্রায় বিনা চিকিৎসায়। ওর জন্য আমরা কিচ্ছু করতে পারিনি। চারিদিকে তখন লকডাউন, অরাজকতা, কোথা থেকেও কেউ কোন সাপোর্ট দিল না। বাড়ীতে দুজন মেয়ে মানুষ আর কিই বা করতে পারে? অবশ্য ছেলে হলেই বা কি করতাম?
- ওনার কত বয়স হয়েছিল?
- বাবা যখন মারা যান তখন বয়স হয়েছিল সিক্সটি ওয়ান। প্রতীক কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। তেমন কিছু কথা মাথায় আসে না যা সেই মুহূর্তে জিজ্ঞেস করা যায়। যতই হোক জীবনে কারো সাথে প্রথম কথা বলার সুযোগে যা কিছু মনে আসে তাঁর সব কিছু বলাও যায় না। ইতিমধ্যে বাসের কন্ডাকটর ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়, টিকিট চায়। প্রতীক পার্স বেড় করতে যাবে এমন সময় ওকে কোন সুযোগ না দিয়েই মেয়েটি একশো টাকার একটি নোট বের করে কন্ডাকরের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে দুটো চল্লিশের টিকিট দিন।
প্রতীক বলে ওঠে - আমি দিচ্ছি আপনি রাখুন। মেয়েটি নাছোড়বান্দা, ভাড়াটা ওই কাটল। প্রতীক বলে -- এটা কি ভাল হলো? আপনি কেন কাটলেন,
—-কেন কি হয়েছে? অফিস পাড়ায় তো মাঝে মাঝে দেখা হবেই, আরেকদিন না হয় আপনিই টিকিটটা কাটবেন।
তা অবশ্য ঠিক তবে যদি দেখা হয়।
-কেন হবে না?
- ওকে, আচ্ছা ম্যাডাম আপনার বিশেষ কোন হবি বা বেড়াতে যাওয়ার শখ এগুলো নেই?
থেকে কি হবে? বেড়াতে অবশ্য বছরে একবার দুবার অল্প ক'দিনের জন্য যাই। মায়ের বয়স হয়েছে, বেশি দিনের জন্য হয় না। আজকাল মা বেশি ধকল নিতে পারে না। আর হবি বলতে আগে একটা সময় আমার পোট্রেট আঁকার খুব শখ ছিল। অল্প বয়সে বেশ কিছুদিন শিখেও ছিলাম। আঁকার হাতটা মোটামুটি ছিল কিন্তু এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। মা একদিন বলল যখন আঁকবি- ই তখন ওসব জিনিসপত্র রেখে ঘরের জঞ্জাল বাড়িয়ে লাভ কি? ওগুলো বাচ্চা কাচ্চাদের কাউকে দিয়ে দে। সেই কথা শুনে একদিন বিরক্ত হয় আমি আশেপাশের কয়েকটি বাচ্চাকে রং তুলি ড্রইং বুক খাতা বড় দুটি ক্যানভাস যা কিছু ছিল সব দিয়ে দিলাম।
প্রতীক বলে - কিন্তু এটাতো ভাল জিনিস ছিল, ছাড়তে গেলেন কেন? অ্যাটলিস্ট এটাতে তো নিজের মনের ক্ষিদে তো খানিক মেটে। দেখুন আমি কিন্তু আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছি না আমি এসব সবাইকেই বলি। কারন আমার মনে হয় এক্সট্রা কোন হবি মানুষের জীবনে থাকলে মানুষের মাথায় সারাক্ষন ধরে খারাপ চিন্তা আসার প্রবণতা বা সম্ভাবনা কমে যায়। ওই আপনি বললেন না সোশ্যাল মিডিয়া, এতে আখেরে তো আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে।
- সেটা ঠিকই বলেছেন কিন্তু আমার ভাল লাগত না। ধরুন আমি ছবি একলাম কিন্তু আমার আঁকা ছবি কে দেখবে? কে বলবে তুমি আঁকা টা চালিয়ে যাও?
- কেন আপনি নিজেই দেখবেন, নিজেকে নিজেই অ্যাপ্রিশিয়েট করতেন। অন্যে আমার কাজ ভাল বললেই ভাল না হলে আমার কাজের কোন মূল্য নেই?
মেয়েটি হেঁসে বলে – তাই কখনও হয়, সবাই কি আর নিজের তারিফ নিজে করতে পারে ? তাছাড়া মাথায় তো অনেক চিন্তা, আগে পিছে কেউ নেই এসব যাকে শেয়ার করা যায় ।
এখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা সারাদিন ঘুরপাক খায় । দমদম এয়ারপোর্টের কাছে তিন বছর আগে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছিলাম । সেটা যে কবে কমপ্লিট হবে তাও জানি না। এখন যে ফ্ল্যাটে থাকি সেটা চার তলায়, সেখানে লিফ্ট নেই। ওই চারতলায় মায়ের ওঠানামায় খুবই কষ্ট হয়। ডাক্তার স্ট্রিক্টলি বারন করেছে। আমিও হয়ত সারাদিনে একবার দুবার পারি। লিফ্ট ছাড়া আমারও খুব কষ্ট হয়। তার উপর মা সুগারের পেসেন্ট, হার্টেরও ব্যাপক সমস্য আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে তাও আইসক্রিম মিষ্টি এসব খায়। কোন কথাই শোনে না। প্রতীক জিজ্ঞেস করে –
ওনার সুগার লেভেল মোটামুটি কত থাকে?
ফাস্টিং নর্ম্যালি ২২০ আর পিপি তো কোনদিনই সারে তিনশোর নীচে নামে না। –ওনার বয়স কি রকম হবে? –কত হবে ষাটের কাছাকাছি ।
–বয়স তো বেশি নয় তবে এই বয়সেই অনেক কমপ্লিকেশন । সুগারের জন্য উনি কি ওষুধ খান না ইনসুলিন নেন?
না ওষুধের উপরেই আছেন, তবে ডাক্তার বলেছেন আগামি দশ পনেরো দিনের মধ্যে সুগার না কমাতে পারলে ইনসুলিন চালু করতে হবে। মা ওসব পরোয়াই করেন না। খাওয়া দাওয়ায় কোন রেস্ট্রিকশন মেনে চলেন না। গরমে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা ওনার আইসক্রিম চাই। মাঝে মাঝে কাজের মাসিকে দিয়ে লুকিয়ে মিষ্টি আনিয়ে ও খায়। বকা ঝকা করি বটে আবার পরক্ষনেই বেচারীর জন্য খারাপও লাগে।
মা মেয়ের পারস্পরিক এই স্নেহ- আবেগ জড়িত খুনসুটি শুনতে প্রতীকের ভালই লাগে। তাই এসব শুনে হেসেও ফেলে । অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলে -- তো ওই নতুন ফ্ল্যাটটা যেটা বুক করেছেন ওটা হ্যান্ডওভারের ব্যাপারে প্রমোটার কিছু বলছে না?
–- যতবার ফোন করি বলছে মাস খানেকের মধ্যেই দিয়ে দেবে কিন্তু তারপর আর কিছুই বলে না অথচ আমি প্রায় পুরো টাকা ওদের পেমেন্ট করে দিয়েছি।
প্রতীক বলে - ওরা কি বলছে, হ্যান্ড ওভারে ওদের কি অসুবিধে ?
– ওরা বলছে কমপ্লিশন সার্টিফিকেট এখনও পাওয়া যায়নি তাই হ্যান্ড ওভারে দেরি হচ্ছে ।
- ওটা তো মিউনিসিপ্যালিটির ব্যাপার, ওটা পেয়ে গেলে হয়ত দিয়েও দেবে খুব শিগগিরি । যদিও অনেক ফ্ল্যাট বাড়িতে ওসব পাওয়ার আগেই কাস্টমার কে হ্যান্ডওভার দিয়ে দেয়।
-- দেখা যাক, কি হয় ।
—আচ্ছা পুরোনো ফ্ল্যাটটা তাহলে কি করবেন, বিক্রি করে দেবেন?
- এখনও কিছু ঠিক করিনি, হয়ত ভবিষ্যতে তাই করতে হবে। মেয়েটি হেসে বলে - আমাদের অবর্তমানে এসবের কি হবে কে জানে?
প্রতীক বলে - সেটাই, ওই একটা বাড়ি-ই ঠিক আছে। তাছাড়া এসব মেইনটেইন করাও বিরাট ঝক্কি ঝামেলার বিষয়। আজ এত কর্মব্যস্ততা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে তার উপর এসবের হেডেক নিতে গিয়ে নিতে জীবন আরও জেরবার হয়ে ওঠে । প্রতীক মজা করে বলে - যাইহোক ম্যাডাম গৃহ প্রবেশে নেমতন্ন পাচ্ছি তো?
মেয়েটি হেসে বলে - সারটেইনলি বাচ্চা বৌদি সমেত একেবারে গোটা পরিবার মানে সবান্ধবে সেদিন উপস্থিত থাকতে হবে।
--থ্যাংক ইউ, একদিনের পরিচয়ে যদি একটা নেমতন্ন বাগিয়ে নেওয়া যায় সেটা তো বিরাট সৌভাগ্যের, তাই না?
দুজনেই হেসে ওঠে। প্রতীক প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যায়। নেমে যাওয়ার আগে প্রতীক বলে – আনলেস ইউ মাইন্ড আপনার মোবাইল নম্বরটি পেতে পারি?
—অফ কোর্স, আমি নম্বরটি বলছি আপনি এই নম্বরে কল করুন।
প্রতীক ওর নম্বরে কল করতেই ফোনটি বাজে, তারপর জিজ্ঞেস করে কি নম্বরে সেভ করব? - - কেন ট্রু কলারে কিছু দেখাচ্ছে না?
- হ্যা, দেখাচ্ছে ভারি সুন্দর নাম "জয়িতা সেন" দুজন দুজনের নম্বর পেল, দুজনেই মোবাইলে দুজনের নাম সেভ করে নিল।
প্রতীক জিজ্ঞেস করে —এটাতে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ আছে তো?
- হ্যাঁ আছে।
প্রতীক সিট ছেড়ে ওঠার সময় বলে " আপনার হোয়াটসঅ্যাপে - আমার একটি লেখা পাঠাব, যা আজ সকালেই আমি লিখেছি, আপত্তি নেই তো ?
মেয়েটি বলে - কিসের আপত্তি?
– বলতে পারেন লেখালেখি আমার একটা হবি, ইনফ্যাক্ট এসব নিয়ে থাকতে আমার ভাল লাগে, অবসর সময়টাও কেটে যায়, জীবনের একঘেয়েমি গুলো দূরে থাকে। তবে জানিনা আপনার ছবি আঁকার মত আমার এই হবিটা একদিন উধাও হয়ে যাবে কিনা!
- তা কেন হবে, সবার কি আর আমার মত উড়নচণ্ডী মন?
প্রতীক সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় , বলে - গল্প করতে করতে সময়টা বেশ কেটে গেল, নাইস টকিং টু ইউ। ভাল থাকবেন
মেয়েটি বলে- থ্যাঙ্ক ইউ, আপনিও ভাল থাকবেন।
বাড়ির কাছের বাস স্টপে নামার জন্য গেটের দিকে এগিয়ে গেল। চারিদিকে সন্ধ্যে নেমেছে । ফুটপাতের গুমটি থেকে রাস্তার ছোট বড় সব ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের আলো গুলো গম গম করে জ্বলে উঠেছে, জ্বলে উঠেছে রাস্তার বাতি স্তম্ভ গুলো । গ্রীষ্মের উত্তাপ আর যেন সহ্য হয় না। তাই হয়ত স্বস্তির খোঁজে রাস্তায় নেমে পড়েছে গরমে হাঁসপাশ করা মানুষেরা । প্রতীক বাড়িতে ঢোকার রোজ ওর স্ত্রীকে ফোন করে জেনে নেয় , সংসারের কোন প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি জিনিষ পত্র, ছেলের টিফিন, পড়াশুনার প্রয়োজনীয় বিবিধ জিনিষ লাগবে কিনা । সেই মত কিনে ঘরে ঢোকে। কিন্তু আজ যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে বাড়িতে ফোন করাটা ভুলেই গেল।
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রতীক ভাবছে - মেয়েটার জীবনটা আর পাঁচ জন মেয়ের মত নয় বরং খানিকটা অন্য রকম। অথচ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর বুকের মধ্যে অহরহ বেজে চলেছে এক অসম্পূর্ণতার সুর । মেয়েটির কাঁহিনীর মধ্যে সব চাইতে হন্টিং পার্ট অবশ্যই "একদিন সব ছিল আজ আর কিছু নেই " কথাগুলো যেন বিরহ যন্ত্রনার কোন কবিতার মতই শোনায় । তবুও মেয়েটা লড়ছে, অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে সাথে নিয়েই লড়ছে। মানুষের জীবনে কত কিছু থাকার পরেও কোথাও যেন ভীষন অভাবী। স্বপ্ন তবু তাঁর পিছু ছাড়ে না। যেমন এই মেয়েটির নতুন ফ্ল্যাটের স্বপ্ন, নিজেকে ভালো রেখে মাকে ভালো রাখার স্বপ্ন , এরকম আরও কত কি!
প্রতীক মূখে গুনগুন করতে কলিং বেলে হাত রাখে। ওর স্ত্রী দরজা খোলে বলে - কি ব্যাপার আজকে ফেরার পথে ফোন করলে নাতো, তার উপর একেবারে রোমান্টিক মুডে মূখে গীত গজল - "কারু না ইয়াদ মগর কিস তরহা ভুলাউ উসে" কিসের এত পুলক? বাইরে কি বরফ পড়তে দেখে এলে ?
– না না আসলে আজকে একজনের সাথে বাসে পরিচয় হোল। সে আবার আগামী দু-একমাসের মধ্যে তাঁর নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে আমাদের ফ্যামেলী সুদ্ধ নেমন্তন্ন করবে।
- তাই নাকি, একদিনের পরিচয়েই নেমতন্ন? এতো ফাটাফাটি ব্যাপার। আগে পাও তারপর না হয় এসব বোলো। ঠিক আছে এসব গল্প পরে হবে এখন ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি চা বানাতে যাচ্ছি। প্রতীক জিজ্ঞেস করে – ছেলে কোথায়?
– ও পড়ার ঘরে আছে, ওর টিচার এসেছে।
- ওকে , ইউ ডু ইওর জব,ইউ আর সিম্পলি গ্রেট। আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
চা হাল্কা জলখাবার খেয়ে প্রতিদিনের অভ্যেস মত ইভিনিং ওয়াকিং এ প্রতীক ছাদে যায়। শরীর ঠিক রাখতে রোদ ঝড় জল বৃষ্টিতেও ওর এই আধ ঘন্টার হাটা কখনও ব্রেক হয় না। হাটতে হাটতে শুধু মেয়েটির কথাই মনে পড়ে। বাসে যে কথা প্রতীক বলে এসেছিল, সেই অনুযায়ী মোবাইল থেকে গতকাল সকালে লেখা কবিতাটি মেয়েটির হোযাটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিল।
সেদিন রাতে ওই নম্বরে কোন গ্রিন টিক ছিল না মানে মেয়েটি মেসেজটা দেখেইনি। পরের দিন শনিবার, প্রতীকের ছুটি, অফিস যাওয়ার কোন তাড়া নেই, ছুটির দিনের দোকান বাজার শেষ করার পর, পাড়ার বন্ধুদের ঘন্টা খানেকের আড্ডা শেষে করে প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে প্রতীক দেখে, ম্যাডাম জয়তী সেনের হোয়াটস অ্যাপ থেকে ওর ফোনে একটি মেসেজ এসেছে। ও লিখেছে - "স্যার আপনার কবিতাটি কিন্তু খুবই সুন্দর হয়েছে, কাকতালীয় ভাবে সেটা আমার জীবনের সাথে আজ হুবহু মিলেও গেল। কিভাবে মিলল জানিনা। আজ সকালে অফিসে এসে প্রথম যে মেলটা পেলাম সেটা HR হেড এর কাছ থেকে। আমাকে আগামি সোমবারই সমুদ্র শহর ভাইজাগের অফিসে জয়েন করতে হবে, হাতে সময় খুব কম, শুধু কালকের দিন রোববারটা । অর্থাৎ এই এক দিনের মধ্যে সব গোছগাছ করে নিতে হবে। প্রথমবার মাকে নিয়ে যাচ্ছি না । পরে না হয় দেখা যাবে। আপনি খুব ভাল লেখেন। ওটা ছাড়বেন না। ভালো থাকবেন "।
প্রতীক উদাসভাবে কি যেন খুঁজে বেড়ায়, মস্তিষ্কের অবলোকনে বোঝার চেষ্টা করে, একটি মধ্য ত্রিশের মেয়ে যে নিজের পোট্রেট আঁকার শখ ছেড়ে দিয়েও প্রতীকের শখের লেখা চালিয়ে যেতে বলে, নতুন কেনা ফ্ল্যাটটাকে নিয়ে যার এত ভাবনা ,মায়ের শরীর নিয়ে যার এত দুশ্চিন্তা, তাঁর সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম গুলো রাতারাতি কেমন যেন বদলে দিল অফিসের একটি মেল। একদিনের মধ্যে ওকে তৈরি হয়ে সব পিছুটান ছেড়ে ফেলে রেখে ওকে পারি দিতে হবে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরের সমুদ্র শহরে, যেখানে আগামী সপ্তাহের প্রথম দিন, মাত্র একদিন পরে এক নতুন পরিবেশ নতুন অফিস ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। প্রতীকের মনে পরে গত দিনের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন,
"কখন যে কোথা থেকে হাজির হবে সে ডাক
ফিস ফিস করে আমার কানে এসে বলে যাবে
সময় হয়েছে,এবার তো বদলাতে হবে
তোমার পথের বাক,
ভাবছি, আমি কি সত্যি পারবো ভেঙে বেরোতে
চেনা অভ্যেস, চেনা ছন্দ বেবাক!
গতকাল অফিস থেকে ফিরে প্রতীক ওর স্ত্রীকে বলেছিল একটি গৃহ প্রবেশের নেমতন্নের কথা।
এখন সেটা ভেবে ওর হাসি পায়। মনে পড়ে ওর স্ত্রী বলেছিল - আগে তো নেমতন্নটা পাও তারপর না হয় বোলো । জীবন যেন সত্যিই এক অলিখিত পাণ্ডুলিপি যার পরতে পরতে রয়েছে অজানা বাঁক ।
-----------------------সমাপ্ত ---------------------------------------------