বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

বৈশাখী স্মৃতিচারণ ।। দীপক পাল

 

ছবি - সংগৃহিত

 

 বৈশাখী স্মৃতিচারণ 

   দীপক পাল

      

বসন্ত সখার ডানায় উত্তাপ ছড়িয়ে ফিরে আসে বৈশাখ। এই বৈশাখেই নতুন বছরের শুরু।তাই নববর্ষ বা বর্ষবরণ উৎসবের সূচনাও হয় ১লা বৈশাখ থেকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কাপড় পরে এই নববর্ষ উপলক্ষে। বড়রাও কেউ কেউ নতুন পোশাক পরে। আমাদের ছোটবেলায় ১লা বৈশাখে নতুন পোশাক পড়ার সেরকম কোন চল ছিল না। তবে সেই দিনটায় সবাই বিকেল থেকে মোটামুটি ধোপদুরস্ত থাকত। সেদিনের বাজারটা হতো বিশেষ ভাবে স্পেশাল। বাড়ির যে জন বাজার যেত প্রতিদিন, প্রয়োজনে সে সঙ্গে বাড়িরই কাউকে নিয়ে যেত বাজারে। বাজারটা হতো পকেটের কথা না ভেবেই। অতএব সেদিন রান্নাঘরের ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন পদ রান্নার সুবাস ভেসে আসত বাইরে। দুপুরে বাড়ির ছোটরা আর বড়রা একসাথে বসে চলত পংক্তি ভোজ আর সঙ্গে চলত রসালাপ দুপুরে ভুঁড়ি ভোজের পরে একটু বিশ্রাম। বাড়ির মহিলাদের খেয়ে উঠতে উঠতে তিনটে সাড়ে তিনটা বেজে যেত। তারপর সব গুছিয়ে নিয়ে বসতে বসতে আরও দেরি হতো। বর্তমানে অণু ফ্যামেলির যুগে এই ব্যাপারটা প্রায় অনুপস্থিত। এখন এত সময় কেউ দিতে পারে না। তাই কেউ কেউ বাইরে থেকে ভালো ভালো খাবার আনিয়ে নিয়ে খায়। খাওয়ার পদে তাই আগের বাঙালিয়ানা আর নেই বলা চলে বড়োজোর  ঘরের বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নববর্ষ পালন করে। তারপর হয়তো অন লাইনে আগে থেকে কোনো সিনেমার টিকিট কেটে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে


            প্রতি বছর ১লা বৈশাখে ব্যবসায়ীদের কাছে
হালখাতা একটা পবিত্র অনুষ্ঠান। পুরোহিতকে দিয়ে গনেশ ও লক্ষ্মী পুজো করিয়ে লাল খাতায় সিঁদুর পরিয়ে রাখে। আমন্ত্রিত খদ্দেরদের কাছ থেকে তাদের দেওয়া টাকা গচ্ছিত রেখে খাতায় নাম আর গচ্ছিত টাকার অঙ্ক লিখে রাখে। পরে কেনা-কাটার মাধ্যমে সে টাকা কাটাকুটি হয়। এই ব্যবস্থা খদ্দের সারা বছরের জন্য ধরে রাখার চেষ্টা। তারপর খদ্দেরদের মিষ্টি মুখ করানো হয়। এতে ব্যবসাদার ও খদ্দেরের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এখন এই ব্যবস্থা প্রায় উঠে গেছে আর থাকলেও খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে হয়। সেখানে আমন্ত্রিতদের হাতে একটা নতুন বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার আর একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়। দোকানে ভীড় হতে দেয় না


          এরপর আছে কালবৈশাখী ঝড়। এটা বিশেষ
করে বৈশাখ মাসেই বেশি দেখা যায়। আকাশের এক কোনায় প্রথমে একটু কালো মেঘ দেখা যায় তারপর সেই কালো মেঘ ধীরে ধীরে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে।  তারপর  ধুলোবালি উড়িয়ে ওঠে প্রচন্ড বেগে ঝড়। বড় বড় গাছগুলো  তখন যেন নিচু হয়ে মাটি ছুঁতে চায়। কারো টিনের চাল বা অন্য কিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। রাস্তার লোকেরা ছুটে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। তারপর শুরু হয় প্রবল  বৃষ্টি। তার স্থিতি হয় অনেকক্ষণ। একটু বৃষ্টি কমলে লোকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরে। এই ঝড় বৈশাখের আগে পরে হলেও সেটাকে লোকে কালবৈশাখী বলে থাকে


            এই মাসেই বাঙালির প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ। বাঙালির নিজস্ব চাওয়া পাওয়া, দুঃখ আনন্দ, বেদনা উল্লাস সব কিছুই যেন তার গানে আমরা খুঁজে পাই। মনের গহনে তার গান যেন প্রাণের অন্তরে প্রবেশ করে নিজেরই গহীন গোপন কথার সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যায়। নিজেকে চেনা যায়


            আমি থাকতাম মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলের দেবলেনে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬১ সালে আমাদের বাড়ির অতি নিকটে পদ্মপুকুর পার্কে বেশ বড়ো করে কয়েকদিন ধরে রবীন্দ্র জন্ম শত বার্ষিকী পালন করা হয়েছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সংগীত আবৃত্তি ইত্যাদির আসর বসতো আমিও প্রতিদিন বিকাল হলেই সেই আসরে যেতাম তিন চারজন বন্ধুকে নিয়ে। তখন আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে প্রি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। পড়ার ও বিশেষ কোনো চাপ ছিলনা। আর সেখানেই শ্রদ্ধেয় দেবব্রত বিশ্বাস, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় , সুচিত্রা মিত্র, সুমিত্রা সেন ইত্যাদি বিখ্যাত গায়ক গায়িকাদের গান একদম সামনে থেকে শুনি। আবার ওখানেই আমার কিছু প্রিয় বন্ধুদের সাথে আলাপ হয়েছিল যা এখনও বজায় আছে, অবশ্য যারা এখনো বেঁচে আছে।  যাই হোক যে কদিন পদ্মপুকুরে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব চলেছিল, আমি সেটাকে উৎসবই বলবো কারণ এলাকার সবাই ওই উৎসবে শামিল ছিল। তাছাড়া বহু লোক প্রতিদিন আসত সেই উৎসবে। তারপর থেকেই আমি ভীষন রবীন্দ্র অনুরাগী হয়ে পড়ি। সকাল থেকেই মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজত। দ্বিজেন এর ' ওই জানালার ধারে বসে আছি করতলে রাখি মাথা ', চিন্ময়ের, 'না যেও না যেও নাকো মিলন পিয়াসী মোরা ', সাগর সেনের 'ওই মালতী লতা দোলে' সুমিত্রা সেনের, 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে' হেমন্তের 'পথ দিয়ে কে যায় গো চলে' সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের, ' যেতে দাও গেল যারা, তুমি যেও না' ইত্যাদি আর কত বলা যায়। এসব গান শুনে শুনে মনটা তখন যেন রঙিন পাখায় ভর করে উড়ে যেতে চাইতো কোথাও।  ঘোর কাটতে চাইতো না সহজে


            এরপরে প্রতি বছর আমরা বন্ধুরা ২৫শে
বৈশাখ সকাল সকাল বাজারের থলে দুটো রান্নাঘরে মায়ের সামনে ফেলে দিয়ে চা টা খেয়ে ছুটতাম রবীন্দ্র সদনের সামনে। তখন নন্দন ছিল না। তাই বিশাল জায়গা নিয়ে প্যান্ডেল বেঁধে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হতো। আমি ও আমার কোন কোন বন্ধু দেবব্রত বিশ্বাসের খুব ফ্যান ছিলাম। কিন্তু সাড়ে আটটার আগে পৌঁছে গিয়েও শুনি উনি গান গেয়ে চলে গেছেন। হতাশ হলেও আমরা প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে গান শুনতাম। প্যান্ডেলের ভেতরে খুব গরম। আমরা পৌঁছে গিয়ে হয়তো শুনতাম তখন অর্ঘ্য সেন বা অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় বা অন্য কেউ গান গাইছে। কত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী যে গান গাইতে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। নীলিমা সেন, বনানী ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র ও তার রবিতীর্থ শিল্পীরা, দক্ষিণীর শুভ গুহঠাকুরতা, রুমা গুহঠাকুরতা ও আরও কত বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে কিভাবে যে সময় কেটে যেত। তবু একসময় আসর চলাকালীন বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটে বাজিয়ে দিতাম। মা বলতো, ' কখন স্নান করবি আর কখন খাবি?' সন্ধ্যেবেলা বন্ধুরা আবার একত্রিত হয়ে আড্ডা দিতে দিতে আলোচনা চলত। প্রসঙ্গ আবার সেই রবীন্দ্রনাথ আর তার সঙ্গীত
-------------------------------------------------------------------              

Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.

 ------------------

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.