কবি সুবোধ সরকারের কবিতা -
"ঘোড়া কেনার টাকা"
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সুবোধ সরকার একালের একজন শক্তিমান কবি। আমাদের চারপাশের চলমান জীবনের বাস্তবতা তাঁর কবিতায় সহজ, সরল নীরাভরণ,স্বতঃস্ফূর্ত ও সংযত আবেগে রূপায়িত। তিনি সহজ কথায় গভীর চিন্তা ও দর্শনকে চলমান জীবনের মাটি খুঁড়ে তুলে আনেন।'দীপ প্রকাশন 'কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুবোধ সরকারের "প্রতিবাদের কবিতা" সংকলন গ্রন্থের "ঘোড়া কেনার টাকা"কবিতাটির একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
" ঘোড়া কেনার টাকা" কবিতায় কবি প্রথমেই বলছেন " রিকশ থেকে নেমে যারা রিকশঅলাকে চড় মারে তারা কারা?"এ তো অকৃতজ্ঞ এক শ্রেণির সামাজিক মানুষের অমানবিক রূপ। এর মধ্যে আত্মগোপন করে আছে সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যের কদর্য দিকটা। কিছু মানুষ তিনতলায় একরকম কথা বলে ,আবার দোতলায় একরকম কথা বলে। এসব মানুষেরা মনে ও মুখে এক নয়। এরা সূচতুর ,কৌশলী ও স্বার্থপর। মন রাখা কথা বলতে অভ্যস্ত। এরা এক ধরণের ভন্ড, ঠক ও প্রতারক। তিনতলা ও দোতলা সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের স্তরটিকে নির্দেশ করছে। তবে এর সঙ্গে জটিল মানব মনস্তত্ত্বও আছে। আত্মস্বার্থ রক্ষার জন্য বহু মানুষই এরকম অবস্থান নেয় পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী। এ যেন এক ধরণের ভালো সেজে থাকার অভিনয়। কিন্তু অভিনয় তো ধরা পড়ে যায়। এভাবেই মুখ হয়ে যায় মুখোশ। কবি বলছেন এক শ্রেণির গুন্ডা মানুষ এক গরিব মাস্টারের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেরত দিয়ে গেছে। এখানে একটা সময়ের চিহ্ন আছে। আজকের সমাজে শিক্ষকদের অনেকটাই অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে সামাজিক স্ট্যাটাস। শিক্ষকদেরকে এখন আর গরিব বলা যায় না। ষাটের দশক সত্তরের দশকে এরকম অবস্থা ছিল। এখানে গরিব মাস্টার বলতে ওই সময় পর্বের মাস্টারমশাইদের কথাই কবি বলেছেন। তখন অনেক অভাব অনটন ও দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে মাস্টার মশাইদের দিনযাপন করতে হতো। তবে তাঁরা ছিলেন সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক। এ হেন মাস্টার মশাইয়ের মেয়েকে গুন্ডারা তুলে নিয়ে যায়,তাকে ছিন্নভিন্ন করে কিংবা ধর্ষণ করে আবার ফেরত দিয়ে যায়। অন্ধকার জগতের এইসব মানুষেরা সমাজে রয়েছে আজও। তাই পথে ঘাটে একের পর এক ঘটে যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা, ইভটিজিং এর ঘটনা। কখনো কখনো ঘটছে নির্ভয়াদের মত পরিণতি। এইসব অন্ধকার জগতের মানুষগুলো সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা চোখে দেখছি, কানে শুনছি, তাদেরকে আমরা ভালোভাবেই চিনি কিন্তু তাদের নাম বলতে আমরা সাহস পাইনা। আত্মরক্ষার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমরা অনেকেই প্রতিবাদী মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে রয়েছে মাঝামাঝি শ্রেণির মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। যারা একতলার নয়, ন' তলার নয়, নৌকার নয়,মারুতির নয়, বস্তির নয়, আলিপুরের নয়, মাটির নয় আবার মেঘেরও নয় । এইসব মানুষদের অবস্থা দোদুল্যমান। এরা কোন কিছু হারানোর ভয়ে সব সময় আশঙ্কা ও সন্দেহে দিন কাটায়। সন্দিগ্ধ মানসিকতায় পোড়ে। আজকের দিনে মানুষ ফিসফিস করে কথা বলে। অকপটে জোর গলায় সত্য প্রকাশ করার সৎ সাহস নেই।
এভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে আছে সংকট ,আছে অসহায়তা ও যন্ত্রণা। তাই কবি বলেন "তোমরা ভাল আছ ?"কিন্তু কবি জানেন এরা ভালো নেই। এরা হোমিওপ্যাথির শিশিতে বিষ ভরে রাখছে। এ যেন আত্মহননের পূর্বাভাস। এইসব মধ্যবিত্তদের হাতে একদিন পৃথিবীর অনেকটা ছিল। কিন্তু আজকের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ফলে সেই অবস্থান টুকু নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মধ্যবিত্ত ভুগছে এক অস্তিত্ব সংকটে। নিরুপায় ক্ষোভ, অসন্তোষ, ও রাগ তাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। অসহায়ের মতো দেখছে কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না। এর থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে মনের মধ্যে তীব্র রাগ। এই রাগের আগুন তাদেরকে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ করছে। তাই মনের মধ্যে শান্তি নেই। কবি তাই দার্শনিকের মত তাদেরকে রাগ শান্ত করার একটা পথ বাতলে দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে জীবনের নশ্বরতা। কবি বলছেন মণিকর্ণিকার ঘাটে সূর্যাস্ত দেখতে। এই মণিকর্ণিকা হল কাশী বা বেনারসের বিখ্যাত শ্মশান। এখানে প্রতিদিন প্রচুর শব পোড়ানো হয়। মৃত্যুতাড়িত জীবনের এই নশ্বর পরিণতি দেখলে মনে আর ক্ষোভ বা রাগ থাকে না। সাদাকালো ,আলো অন্ধকার একটা দার্শনিক চিন্তায় জারিত হয়ে মিলেমিশে একাকার হয় এবং মনের যন্ত্রণাও প্রশমিত হয়। মধ্যবিত্ত মানসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে কবি বলছেন যে তারা মদ খেয়ে দেখে কিন্তু মদ খায় না, গলি দিয়ে যায় কিন্তু গলিতে ঢোকে না, ভোট দিয়ে আসে কিন্তু রাজনীতি করে না। এক কথায় মধ্যবিত্তরা আলগোছে থাকে, কোন কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যায় না। তবে নীতি-নৈতিকতার কারণে রাত আটটায় বোন বাড়ি ফিরলে তাকে পেটাই। অর্থাৎ নিজস্ব পরিবারের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার জায়গাটা বজায় রাখার চেষ্টা করে। যেটা তারা বৃহত্তর সমাজে রাখতে পারে না বা সমাজকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে না । এরা দোলাচল মানসিকতায় সব সময় ভোগে। ঘোড়া কিনবার জন্য টাকা জমায় কিন্তু কিনতে চায় না। ঘোড়া নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে। এই ঘোড়া থেকে খারাপ কিছু হবে কিনা এই নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। তাই ঘোড়া কেনার সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। এই ঘোড়া হলো মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্নের প্রতীক। তারা সেই স্বপ্নকে মনে লালন করে কিন্তু পূরণ করতে পারেনা সন্দেহ প্রবণ মানসিকতার জন্য। কবি নিজেও এই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ বা তার প্রতিনিধি। তিনি সন্দেহে ক্লান্ত। মনের অবদমিত ইচ্ছা গুলো তাড়না করলেও তা পূরণ করার ক্ষমতা মধ্যবিত্তের নেই। অতিরিক্ত সন্দেহ নিয়ে জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায় না। তাই কবির বক্তব্য -"ভাল করে বাঁচতে হলে সন্দেহটা কমাতে হয়।"কবি জোর দিয়ে বলছেন - "আগে খাদ্য চাই পরে জল-বাতাস থেকে যতটুকু খাদ্য পাব তাতেই বাঁচব।"মানুষের জীবনে আগে দরকার অন্ন । এটা না হলে চলে না। তাই খাদ্য সংস্থানের উপর জোর দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আজকের জীবন বড় দ্বন্দ্ব সংঘাত ময়। মানুষকে বিশ্বাস করা বড় কঠিন হয়ে উঠেছে।কবি বলছেন -"আমি মেয়েটিকে আদর করছি, তুমি খাটের তলায় অস্ত্র নিয়ে বসে আছ।" আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ চলছে ভিতরে বাইরে। আমরা অন্তর্ঘাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছি। তাই কবির বক্তব্য-"আমরা কি কেউ কারও ক্ষতি না করে বেঁচে থাকতে পারিনা?" অথচ ভাই ভাইকে মারতে আসছে। ভুলে গেছে অতীতের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া প্রীতির সম্পর্ক। সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি বলছেন -"ভাই, আমাকে মারিস না/আমরা এক ভাঙা থালায় ভাত খেয়ে বড় হয়েছি ।"কিন্তু আজকের পৃথিবী ষড়যন্ত্রে ভরা। আমরা অতীতকে ভুলেছি, ভুলেছি ঐতিহ্য ও শিকড়কে ।আমরা কেউ ভালো নেই। আমাদের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে - "কীট ও কীটনাশক।" তাই আমাদের ঘোড়া কেনার স্বপ্ন সার্থক হচ্ছে না। ঘোড়ার পরিবর্তে আমরা হয়তো পাচ্ছি ঘোড়ার ডিম নামক শূন্যতা।তাই কবির অনুরোধ ভাইয়ের প্রতি - "খাটের তলা থেকে তুই বেরিয়ে আয়/ আমরা মানুষ এখনও তেমন কোন দোষ করিনি যে এ ওকে মেরে ফেলব।"এ কবিতার গভীরে ছায়া ফেলেছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, মানুষের অস্তিত্ব সংকট, যুগের অবক্ষয় ,মূল্যবোধ হীনতা ইত্যাদি যা আমাদেরকে এক জ্বলন্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং আমাদের চেতনায় অভিঘাত সৃষ্টি করে।
________________________________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবুবাগান
পোস্ট- সাঁইথিয়া
জেলা- বীরভূম