বন্ধুত্ব
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
চরিত্র লিপি : সৌরভ , গৌরব , নীরব ।
( ভোরের পাখির কলরব, হরিনাম )
সৌরভ // আজ এত দেরি হল যে ?
গৌরব// দেরি আর কোথায় ? এইতো পাঁচ- সাত মিনিট লেট । গিন্নীর শরীরটা একটু ---
নীরব// গিন্নি ! বৌঠানের আবার কি হলো ?
গৌরব// না মানে --
সৌরভ // আরে -বলো না কি হয়েছে ?
গৌরব // কালকে রাতে খাওয়াটা একটু বেশি হয়েছে ।
নীরব // বুঝেছি । ছেলে- বৌমা -নাতি -নাতনি- মেয়ে জামাই- নিয়ে বেশ তো ভুরি ভোজে পড়েছ । তাই না ?
গৌরব // হ্যাঁ, তা বলতে পারো । তা হয়েছে কি, বড় মেয়ে-, একটু ছানার বড়া বেশি করে খাইয়েছে । জানোই তো -- ওর আবার ওটা খুব প্রিয় ।
সৌরভ// তাই বলো। তা বেশি করে খাওয়ালে কেন ? বেশি হলে তো আমরা ছিলাম ?
নীরব // বৌঠান কি আমাদের কথা ভুলেই গেলেন ?
গৌরব // না -না তা কেন ? তোমরা কি ভুলে যাবার জিনিস ? পরম আত্মীয় কাছের মানুষ ।
নীরব // বয়স হয়েছে রয়ে বসে খেতে হবে ।
গৌরব // ছিল ঠিকই । বুঝলে কিনা - রাতে আবার রেওয়াজি ; ছেলে আনলে-- ; বললে-- বিদেশে খাওয়া ঠিক হয় না । বৌমা তো বেজায় খুশি !
সৌরভ// আর ভাই । তোমার তো এখন পৌষ মাস ।
নীরব // হ্যাঁ, তা বলতেই পারো । সবাই চাকরি করে । তোমাদের পেনশন ।
সৌরভ // সোনায় সোহাগা সংসারের জন্য তো আফসোসে মরছি ।
নীরব // কেন কেন ? নীলেশ কি খোঁজ খবর নেয় না ?
সৌরভ // আহাম্মক ছয় যে ঘরের কথা পরকে কয় ।
গৌরব // রাখো তো তোমার হেঁয়ালি । সত্যিটা বলো-- তাতে কার কি হলো ; ফাটলো- চটলো- দেখার দরকার নেই ।
সৌরভ// সব ঠিকই ছিল । যেই না ছেলের বিয়ে দিয়েছি সে আর আমাদের মনে রাখতে পেরেছে কিনা বলতে পারি না ।
গৌরব // হুম্ ; তা যা বলেছ- কি দিনকাল পড়ল ভায়া ?
সৌরভ // তা চলো। আর এখানে বসে কাজ নেই ; হাঁটো --
নীরব // আজ আমি চায়ের পয়সা দেব । যতীন, আমি বিকেলে দিয়ে যাব ; লিখে রেখো ।
গৌরব // আরে নেই তো আমি দিয়ে দিচ্ছি ।
নীরব // আরে না না একদম না । তুমি তো বেশিরভাগ দিন দিয়েই যাচ্ছ । আমরা আপাততঃ এক আধ দিন দিই। না কি, সৌরভ দত্ত কি বলো ?
সৌরভ // হ্যাঁ তা ঠিক। চলো চলো , আমার আবার রেশন তুলতে যেতে হবে ।
গৌরব// আচ্ছা সৌরভ, আমার রেশনটা তো তুমি নিতে পারো ?
নীরব // কেন ? তুমি কি মহানুভবতা দেখাচ্ছ ?
গৌরব // না না সেই চাল আটা বাড়িতে পচছে ।
নীরব // ওগুলো মাছের জন্য পুকুরে ফেলছ বলে শুনলাম ।
গৌরব // কি করবো বলো ? পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে ।নীরব // তাহলে দাও । তোমার তো আবার অনেক সদস্য । পাও তো অনেক । তুমি দিলে তো বন্ধু বাঁচে ।
গৌরব // তা বৈকি ।
নীরব // এক কাজ করো সৌরভ ; মামলা ঠুকে দাও । সৌরভ // মামলা ! কেন ?
গৌরব // মামলা করতেই হবে, আজকাল মামলা মোকর্দ্দমা করেই তো ছেলে বৌমার ভাত পেতে হবে ভায়া । আমার মামাতো ভাইয়ের ওই একই কেস।
নীরব // মামলা করে যদি ভাত কাপড় পেতে হয়, সন্তান জন্ম হ'বার পর চ্যূক্তিতে সই সাবুদ করে লেখাপড়া শেখানো উচিত ছিল ।
(ওরা সকলে হাসলো হাসি থামার পর )
সৌরভ// মামলা যে ঠুকব, পয়সা কোথায় ? লোকে শুনলেওবা কি বলবে ? তার চেয়ে ভিক্ষে করে খাওয়া ভালো। লোকে দেখুক ছেলে মানুষ করার জন্য সর্বশান্ত বাবা কেমন ভিক্ষে করছে ?
গৌরব// বলো না ভায়া । তা যাই হোক , পূজার সময় কিছু তো পাঠানো উচিত ছিল ? নীলেশ মেধাবী শান্ত ছেলে বলে জানতাম কিন্তু বিচারবোধ কি করে হারিয়ে গেল ?
নীরব // তোমার জামা কাপড় নিশ্চয়ই পেয়েছ ?
গৌরব // পাবো না ! সব্বাই দিয়েছে তা অনেক তো ।
নীরব // বাহ, বাঃ বাঃ
গৌরব// যে কথা বলতে এলুম । তোমাদের কিন্তু সস্ত্রীক যেতেই হবে --- এই দুপুর বেলা থেকে ।
সৌরভ // আমার তো আবার পিছুটান --
গৌরব// তা বললে তো শুনবো না ভায়া । ওখানে ক'দিন থাকা আর খাওয়া । আমার বৌমার কড়া নির্দেশ !
নীরব // কি খাওয়াবে বলো ?
গৌরব// সঅব হবে সব হবে । যা খুশী ইচ্ছে মতো ।
নীরব // আরে আগে শুনে নিই । এখন থেকে পেট পরিষ্কার করতে হবে তো ?
গৌরব // কেন ? আমার বউমা স্টোমাক স্পেশালিস্ট। গড়বড় হওয়া মাত্রই নিদান দেবে ।
সৌরভ // বেশতো বৌমা পেয়েছ ভাই ।
নীরব // তুমি আবার কথা ঘুরিয়ে দিও না । আগে বলো কি কি রান্না হবে ?
গৌরব // বলছি ভাই বলছি। কাঁকড়া চিংড়ি পাতুরি - ধনিয়া মুরগি , মোচার পোলাও, পুর ভরা ভেটকি, মাংসের ঘুগনি, ডবল অনিয়ন ঘি রোস্ট মটন , মাছের চপ , ভেজিটেবল কাটলেট, মটন প্যাংথোরাস , চিকেন বিরিয়ানি, মটন বিরিয়ানি , চিকেন কাৎসু , চিকেন ট্রাফেল সুই মেই , ওয়াসাবি টাইগার , প্রনস , মোচার চপ,ফিস ফিঙ্গার , মালাইকারি , কাতলা কালিয়া, মটন ডাক বাংলো , ফুচকা, ফুলকো লুচি, শুঁটির কচুরি , মাছের তো বহু পৎ থাকছেই ।
সৌরভ// যা বলো তা বলো বাঙালি ডাল ভাত রুই মাছের ঝোলে বেশি পছন্দ ।
গৌরব// থাকবে, সব ব্যবস্থা থাকবে । তোমাদের যেটা রুচি সেটা খেয়ো । আসলে বৌমা সুদূর আমেরিকা থেকে নিজের হেঁসেলের কিচেনার এনেছে । বৌমাও খুব পারদর্শী ভায়া । ভাগ্য গুণে পেয়েছি ।
নীরব// নাঃ । আমার বিপত্নীকতা নিয়ে যেন ঠাট্টা করো না । যা সঞ্চয় আর পেনশন সবটুকু দিয়েও জামাইয়ের মন ভরেনা ।
সৌরভ // যম জামাই ভাগিনা তিন নয় আপনা।
গৌরব// আবার হেঁয়ালি ?
নীরব // সত্যি কথা ভাই । নিজের থাকে খাও পরো পরের দিকে চেয়ে থাকো ।
গৌরব// ভাবছি আমার কয়েকটা নতুন জামা কাপড়--
সৌরভ // বুঝেছি ; আমায় দেবে তো ? কিন্তু, আমি কি ছেলে বৌমার কথা ভুলতে পারবো ?
গৌরব // শোনো-- শোনো। বয়স পঞ্চাশ হ'বার পর কালা- বোবা- অন্ধ সেজে থাকতে হয় । ওদের কথা ওরা বলুক । শুনে যাও শুধু । উত্তর - উত্তর করো না বোবা হয়ে থাকো । মশা কামড়াচ্ছে কামড়াক-- মারা যাবে না ; হাত চালিয়ে উড়িয়ে দিয়ে হটাও । ওরা যা করুক চোখ দিয়ে দেখে যাও । যেন কোনও তুমি দেখোনি । ব্যস ঝামেলা মিটে গেল । হে হে হে -
নীরব // একটু দাড়াও । মাইনাস করি--
সৌরভ // ডায়াবেটিস হয়নি তো ? এত ঘন ঘন ইয়ে করছ ?
নীরব// চেক্ আপ করিয়েছি । কিছুই ধরা পড়েনি। বয়স হলে যা হয় । এই যে আমাদের মর্নিং ওয়াক এতেই কম উপকার হয় ভেবেছ ?
গৌরব // হয় হয় । শরীরটা তো মেসিন । তেল মোবিলে চলে । মনের মধ্যে হাবিজাবি চিন্তা করেছ তো পটল তুলেছ । হার্ট অ্যাটাক বুঝলে ভায়া ? রিল্যাক্স রিল্যাক্স করো । বয়সের সাথে খাবারেরও সামঞ্জস্য থাকা চাই । এই -- এইতো সেই মহিষবাড়ী । আজকে এই অবধি থাক । আমি আসছি- তোমরা একটু পরে এসো কিন্তু ! সৌরভ এসো গিন্নিকে অবশ্যই সঙ্গে করে এনো । আর নীরব -- তুমি কিন্তু নাতি-নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে এসো । অবশ্যই এসো । সময় মত যেও কিন্তু ---
( আগমনী সুর- ঢাকের বাদ্যি- একটু পরে বিজয়ার মিছিল )
গৌরব // আসছে বছর আবার হবে, আসছে বছর আবার বাপের ঘরে উমা আসবে । আবার আসবে বারে বারে আসবে । আসে - সপরিবারে আসে- । কেবল আমরা যা যাবো আর আসব না । আমাদের বন্ধুত্ব মিষ্টি মধুর দীর্ঘদিনের । আমরা একে অন্যকে পরস্পর কখনো যদি ছেড়ে যাই আর কোনওদিন ফিরব না । ( গলা ভারী হয়ে ওঠে )
সৌরভ // আসি বন্ধু । আবার আগামী বছর যদি বেঁচে থাকি সস্ত্রীক এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করব ।
নীরব // বৌমা , বৌমা সত্যিই তোমার বৌমা না হয়ে নিজের মেয়ে । তোমাকে কত কি বিষয়ে প্রশ্রয় দেয় ! একেই বলে শিক্ষিতা সর্বগুণান্বিতা মেয়ে ।
সৌরভ// চাওয়া পাওয়াটা বড় কথা নয় গৌরবদা, এই যে হাসি -আনন্দ -দুঃখ -যন্ত্রণা নিয়ে আমরা কতদিন আছি ভুলেই যাব এমনিতেই । চোখে ঘুম এলে সব শেষ ! পরের বাড়ি মেয়ে হতে পারে , আপন করে নেবার সৎ সাহস- যোগ্যতা- কৌশল জানা চাই । কোনো মেয়ে বাপের বাড়ির মান মর্যাদা খোয়াতে চায় না ।
গৌরব// তা যা বলেছ । বাবা-মার মান সম্মান খোয়াতে বউমারা ব্যস্ত হয় সব পরিবারে । ভাবেই না তারাও বাবা মা হয়েছে । তাদেরও ওই পথে যেতে হবে। এই বুড়ো ভামদের কথা একটু হলেও ভাবতে পারত নীলেশ ।
নীরব // আসা-যাওয়া মাঝখানে মাত্র ক'টা দিন । যা করো তুমি আমাদের সব যন্ত্রণা ভুলেই ছাড়ো ।
গৌরব // এসো ভাই ; আমরা চিরকালের বন্ধু ! প্রতি প্রত্যেকের বাবা-মা ঠিকানা আলাদা । কিন্তু বন্ধুত্বের ঠিকানাটা প্রতি বছরই আমার ঘরে উৎসব আনন্দে খাওয়া দাওয়া নতুন পোশাক বুক ভরা আনন্দ মুখভরা হাসিতে কাটিয়ে দিই । এটাও ক'জন বন্ধু করে ?
সৌরভ// পরিবারের রক্তের সম্পর্কে যারা ভাববার কথা তারাই ভাবল না এটাই আফসোসের !
গৌরব// ভুলে যাও ভাই । বন পুড়ে মানুষ দেখে মন পুড়লে কি কেউ দেখতে আসে ? কু-পুত্র কন্যা হয় কু- মাতা-পিতা কখনই নয় ।
সৌরভ // বৌঠান-- বৌমার আদর আপ্যায়ণ মন থেকে অমৃত্যু মুছে ফেলতে পারব না । শুনবে -- আমার স্ত্রীর ঢাকাই জামদানির পরবার শখ । ও বলেছিল , চাকরি পেয়ে ছেলের প্রথম বেতনের টাকায় ঢাকাই জামদানি পরব । কে দিল আর তুমি পরলে ।
গৌরব// তোমার ধুতি পাঞ্জাবি নিয়েছ তো ?
নীরব// ওই তো ওর হাতে । আমিও নিয়েছি । আসি বন্ধু -- তিন জনে বেশ তো জমিয়ে বাড়িতে উৎসবের মরশুম কাটালাম । বেঁচে থাক বন্ধুত্ব !!!
সৌরভ // আসি তাহলে ? আসি বৌমা - বৌঠান-- আবার দেখা হবে আগামী বছর।
গৌরব// বেশ বেশ । কালকে তাহলে আবার সেই যতীনের চা দোকানে দেখা হচ্ছে ?
( সৌরভ / নীরব ) আসছি তাহলে !
গৌরব // মন খারাপ করো না ভায়া। রিল্যাক্স করো রিল্যাক্স । এই আমাদের বন্ধুত্ব । বন্ধুত্ব কথাটার বিশাল অর্থ । ক'জন বোঝে ? ক'জনে বজায় রেখে চলে ? আফসোস নীলেশ ও তার স্ত্রী সৌরভের স্বামী স্ত্রীকে বাবা মার চোখে বন্ধু বলে মেনে নিতে পারল না। যা দেখছি আমাকেই চেষ্টা করে এর বিহিত ব্যবস্থা করতে হবে ।
--------------------------------------------------
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা ।