অনেক কাল আগের কথা। দেড়শো থেকে দুশো বছরের পুরণো এই কাহিনী। আমার দাদু, বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাগেরহাটের জমিদার বাড়ীর বড় ছেলে রনদাকান্ত রায়চৌধুরী তখন আই এ পড়ার জন্য কলকাতার মেসে থাকেন। জমিদার বংশ তখন পড়তির দিকে। তার বাবা ও চাকরী করেই উপার্জন করেন। তিনি ছিলেন জেলার ইন্সপেক্টর জেনারেল। তাকে পরিদর্শক হিসেবে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত।
রনদাকান্ত সেবার স্কটিশচার্চ কলেজের গরমের ছুটী উপলক্ষে গ্রামের বাড়ীতে এসেছেন। জৈষ্ঠ মাস চলছে, সেবার খুব গরম পড়েছে। তখন তার সতেরো বছর বয়স। এককালের বিরাট জমিদার বাড়ির একটা অংশে তারা থাকেন। বাকী অংশ ভেঙে পড়ে যাচ্ছে কিন্ত সেসব মেরামতির কাজে দাদুর বাবাকে যতটা সময় বা টাকা খরচা করতে হবে তা ওনার ছিল না।
কাজেই সপরিবারে মাত্র তিনটে ঘরেই তারা থাকেন। রনদাকান্তর ভাই এবং ছোট তিন বোনকে নিয়ে মা আছেন।
সেদিন ছিল সাংঘাতিক গরম, এখনকার মত তো তখন ঘরে ঘরে ফ্যান ছিল না। রনদাকান্তর অবশ্য কলকাতার মেসের ঘরে ফ্যান আছে। সেই জন্য তার যেন আরও গরমে কষ্ট হতে লাগল ! রাত তখন প্রায় একটা বাজে। তার বাবা কাজে গেছেন পাশের জেলা বরিশালে । মা আর ভাইবোনেরা বাড়ীতে। কাউকে কিছু না বলে রনদাকান্ত বেরিয়ে আসেন বাড়ি থেকে। দুটো বাড়ীর পরেই থাকে বন্ধু সুশীল, তার শোবার ঘরের জানলায় টোকা মারেন। সুশীল জানলা খুললে তাকে বলেন , " চল সুশীল, একটু হাওয়া খেয়ে আসি। যা গরম পড়েছে। " সুশীল ও এক বাক্যে রাজী, কারণ তারও তো একই অবস্হা, গরমে ঘুম আসা তো দূরের কথা দমবন্ধ অবস্হায় বিছানায় ছটফট করছিলেন এতক্ষণ।
দুই বন্ধু এবার চললেন হাওয়া খেতে। সুশীল বলল, " রনদা, চলো, নদীর ধারে পুরনো শ্মশানের দিকটায় যাই, জলের ধারে গেলে একটু হাওয়া পাওয়া যাবে হয়তো। "
সত্যিই এইদিকে আসতে আসতে একটু যেন ঠান্ডা হাওয়ার পরশ পাওয়া গেল । শ্মশানের ধারে একটা বট গাছের গুঁড়ির ওপর এসে দুই বন্ধু বেশ গুছিয়ে বসলেন। একটু দূরে এখন নতুন শ্মশান ঘাট তৈরী হওয়ার পর থেকে এখানে আর দাহ করতে কেউ আসেনা।
তারপর এ গল্প ও গল্প চলতে লাগল। সুশীল তার বাগেরহাট কলেজের গল্প করতে লাগল, রনদাও কলকাতার কলেজের, মেসের অনেক মজার অভিজ্ঞতা বলে চলেছে !
ঠান্ডা হাওয়ায় তাদের শরীরও জুড়িয়ে যেতে লাগল। খোশগল্পে দুজনেই মত্ত !
এমন সময় তারা লক্ষ্য করল , অনেক দূর থেকে, যেন একজন কেউ এদিকেই আসছে, দুজনেই ভীষণ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল ! এত রাতে কে এটা ? জনমানব শূণ্য এই পুরনো শ্মশান ঘাটে কে আসছে? আর একটু কাছে আসতে বোঝা গেল, কোনও মহিলা আসছে। দুই বন্ধুর গল্প মাথায় উঠল, দুজনেই সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আরও একটু কাছে আসতে বোঝা গেল, লাল শাড়ী পরিহিতা এক লম্বা চওড়া মহিলা, তার মাথায় এলো চুল, কপালে মস্ত বড় লাল টিপ, আর হাতে একটা ঝাঁটা , হনহন করে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। " তোরা কারা ? " জলদ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল সে। দুজনেই তোতলাতে লাগল ভয়ে, বলার চেষ্টাও করল, " আমরা ছাত্র, একটু হাওয়া খেতে এসেছি ।"
" রাইত দুফারে মড়ক খোলায় আইছো হাওয়া খাইতে?"
কটমট করে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে আবার হনহন করে চলে যেতে লাগল সেই নারী মূর্তি।
তারা দুজনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়ে গেল যেন। ততক্ষণে আর দেখা গেল না তাকে। দুই বন্ধু একটু ধাতস্হ হয়ে যখন এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগল, তখন এই পান্ডব বর্জিত পুরনো শ্মশান ঘাটে, কোনও মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুর বেড়ালও চোখে পড়ল না।
অথচ এই এক মুহূর্তের মধ্যে এরকম অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তারা তাজ্জব বনে গেল ! কে ছিল এই নারী ?
শুধু সেদিন নয়, চিরকালের মত তাদের কাছে এটা একটা প্রশ্নই থেকে গেল। সে কি ছিল মায়া নাকি ছলনা ? তারা দুজনেই কি একই সাথে চোখে ভুল দেখল ? নাকি আশেপাশের গ্রামের কোনও অপ্রকৃতিস্হ বা শ্মশান চারিনী নারী ? নাকি সত্যিই কোনও প্রেতাত্মা ?
তারপরে দাদুর মেয়ে , মানে আমার মায়ের মুখে শোনা এই গল্প, আমিও আমার মেয়েকে শুনিয়েছি । একটা প্রায় ভূতের গল্প হিসেবে ! এর সবচেয়ে সঠিক ব্যখ্যা হিসেবে আমার দ্বিতীয় টাই মনে হয়েছে । তখনকার গ্রাম জীবনের কত ঘটনাকেই অলৌকিক আকার দেওয়া হত, যদিও তার পেছনের লৌকিক, সামাজিক অনেক কারণ থাকত !😊
--------------------------------------------------------
কাকলী দেব
কলকাতা।