গল্প ।। ত্তড়ান ।। রানা জামান
ছবি - সংগৃহীত
ত্তড়ান
রানা জামান
চত্ত্বরে সময় কাটাতে থাকা লোকগুলোর মধ্যে আব্রাহাম উপরে তাকিয়ে বিস্মিত হলেও হাততালি দিতে থাকলেন। পাখা ছাড়া মানুষ উড়ছে কিভাবে! দুটো মানুষ উড়তে উড়তে নামছে নিচের দিকে। পুরুষ না মহিলা বুঝা যাচ্ছে না।
এটা একটা নিরাপত্তা বেষ্টিত আবাসিক এলাকার চত্ত্বর। জয়নগর হাউজিং আবাসিক কমপ্লেক্স। চারদিকে চারটি বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন। প্রত্যেকটি ভবন তেরো তলা। মাঝখানের মাঠে ফুটবল থেকে শুরু করে সব খেলাই খেলা যায়। এই চার ভবনের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই সমঝোতার মাধ্যমে সময় ও মাঠ ভাগ করে পছন্দের খেলা খেলে আসছে। প্রত্যেকদিন বিকেল হলে শিশুরা খেলতে বা ছুটাছুটি করতে এবং আয়েশ করতে নেমে আসে নিচে।
কিশোর আব্রাহামের হাততালির শব্দে বিরক্তি নিয়ে অনেকেই তাকালো ওর দিকে। আব্রাহাম উপরে দেখিয়ে বললো, দেখেন, দুটো মানুষ উড়তে উড়তে নিচে নামছে। কী চমৎকার না?
আব্রাহাম বুঝতে না পারলেও বয়স্করা বুঝতে পারলো যে কোনো কারণেই হোক দুটো মানুষ যে গতিতে নিচে নামছে, তাতে ভর্তা হয়ে যাবে, যদি না মোটা জাল বা কাপড়ের মতো কিছু একটা ধরা হয় ওদের নিচের দিকে।
এদিকওদিক তাকিয়ে প্রোঢ় জামশেদ বললেন, আপনারা কয়েকজন ভলিবল খেলার নেটটা ধরুন, তাহলে ওরা আঘাত পেলেও বেঁচে যাবে!
যুবক যারা ছিলো, সবাই ছুটলো ভলিবলের নেট লাগানো পোল দুটোর দিকে। দুটো পোল থেকে জালটা খুলে ছুটলো পড়তে থাকা মানুষ দুটোর দিকে। জালটা পৌঁছাতে পেরেছে মানুষ দুটোকে ধরার জন্য; কিন্তু ভার নিতে পারলো না। জাল রয়ে গেলো উপরে, আর জাল ছিঁড়ে মানুষ দুটো পড়লো বিকট শব্দে ভূতলে; ঠিক ভূতল না, পাকার উপরে। এখন চেনা যাচ্ছে ওদের শরীরের গঠন এবং পরনের কাপড় দেখে। একজনের পরনে পেণ্ট-শার্ট ও আরেকজনের পরনে সেলোয়ার-কামিজ। দু'জন উপুড় হয়ে পড়লো পাশাপাশি। পুরুষের একটা পা সামান্য নড়লেও মহিলার শরীর একদম স্থির। চার এপার্টমেণ্টের বাসিন্দা সহ সবাই ছুটে জড়ো হতে থাকলো পতিত দুই শরীরের দিকে। ক্যাম্পাসের বাহির থেকেও উৎসাহী দর্শক ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলো; কিন্তু ফটকে কড়া প্রহরার কারণে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না, জড়ো হতে থাকলো ফটকের বাইরে।
সমব্যথী হয়ে দু'জন দুই আহত শরীরের কাছে গিয়ে হাত দেবার জন্য উবু হলে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশের আইজি শমশের আজিজ ভেতরে ঢুকে উচ্চকণ্ঠে বললেন, নো নো! ওদের ছোঁয়া যাবে না! এটা পুলিশ কেস!
দু'জন উবু অবস্থায় আহতদের না ধরে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজির দিকে তাকালেন। চক্রাকারে দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের সামনে থাকা সড়ক উন্নয়ন অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বললেন, ওরা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে স্যার! তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না নিলে মারা যেতে পারে।
আরেকজন বললেন, উনি ঠিক বলেছেন। দ্রুত হাসপাতালে না নিলে ওরা মারা যেতে পারে!
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা শমশের আজিজ অনড়। তিনি বললেন, পুলিশি ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমি নিষেধ করছি।আমি রিটায়ার্ড এডিশনাল আইজি। আমি এখনই কাফরুল থানায় ফোন করে দিচ্ছি এবং সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্সও ডাকছি। ডোণ্ট অরি!
মোবাইল ফোনটা হাতেই ছিলো। কাফরুল থানায় ফোন করে নিজ পরিচয় দিয়ে একটা এ্যাম্বুলেন্সসহ একজন এসআইকে আসতে বললেন শমশের আজিজ। উবু হয়ে থাকা লোক দুটো চলে গেলো সারিতে।
আহত দেহ দুটো উপুড় হয়ে পড়ে আছে। উভয়ের দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে চত্বর রঞ্জিত করছে। মহিলার দেহটা স্থির হলেও পুরুষ দেহের একটা পা মাঝে মাঝে নড়ছে।
উপস্থিত লোকদের মাঝে গুঞ্জন চলছে: কারা এরা? এই এপার্টমেণ্টগুলোর কেউ? কোন এপার্টমেণ্টের? নারী পুরুষ একসাথে পড়লো কেনো? পড়লো না ঝাঁপ দিলো? প্রেমঘটিত ব্যাপার? চেহারা দেখা না যাওয়ায় চেনা যাচ্ছে না।
শমশের আজিজ সবার কথা মনযোগ দিয়ে শুনছেন। একসময় বললেন, আপনাদের মতো আমার মনেও ওসকল প্রশ্ন আসছে। ঝামেলাটা পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে আমরা স্বস্তিতে থাকতে পারবো এবং তখন জানতে পারবো এরা কারা এবং কেনোই বা উপর থেকে নিচে এভাবে পড়লো।
দশ মিনিটের মাথায় এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের সাইরেন শোনা গেলে সবাই তাকালো প্রধান ফটকের দিকে। ভেতরে ঢুকে জটলার কাছাকাছি পাশাপাশি দাঁড়ালো। পুলিশের পিকাপ থেকে এসআই জুনায়েদ এবং এ্যাম্বুলেন্স থেকে দুটো স্ট্রেচার নিয়ে চারজন এটেন্ডেণ্ট নেমে জটলার দিকে আসতে থাকলে একদিকের লোকজন সরে ওদের ভেতরে ঢোকার রাস্তা করে দিলো।
এসআই জুনায়েদ অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজি শমশের আজিজের সামনে এসে স্যালুট ঠুকলে শমশের আজিজ বললেন, ইনজুরডদের কাউকে হাত লাগাতে দেই নাই। তুমি তাড়াতাড়ি জখমীদের উল্টে চেহারা দেখাও। আমাদের জানা দরকার ওরা কারা।
জ্বী স্যার!
বলে জুনায়েদ জখমীদের পাশে বসলো। স্ট্রেচার দুটো দুই জখমীর পাশে রাখা হলো। এসআই জুনায়েদ পরপর দু'জনকে চিৎ করার পরে এটেন্ডেণ্টগণ আহত দু'জনকে দুই স্ট্রেটারে তুলে চিৎ করে রাখলো। উপস্থিত লোকজন ওদের চিনতে পারলো না।
শমশের আজিজ বললেন, আমি এদের চিনতে পারছি না। চার এপার্টমেণ্টের ম্যানেজাররা এদের দেখে বলো চিনতে পারো কিনা।
জটলার মধ্য থেকে চার ম্যানেজার এগিয়ে এলো। দুই জখমীকে ভালো করে পরখ করে একে অপরকে একবার দেখে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজি শমশের আজিজকে জানালো যে এরা চার এপার্টমেণ্ট ভবনের কোনো এপার্টমেণ্টের বাসিন্দা না।
আহতদের নিয়ে পুলিশ চলে গেলে শমশের আজিজ ঢুকলেন নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সিসিটিভির ফুটেজ দেখার জন্য। প্রথমে প্রধান ফটকের ফুটেজ দেখছেন। পুরুষ লোকটি আগে এসেছে। রিকশা থেকে নেমে নিরাপত্তা প্রহরির সাথে দুটো কথা বলে ঢুকে গেলো ভেতরে। তিন মিনিট পরে আরেকটি রিকশা এসে থামলে, ওটা থেকে নামলো ভদ্রমহিলাটি। একইভাবে প্রহরির সাথে কথা বলে ঢুকে গেলো ভেতরে।
ফুটেজ দেখা বন্ধ করে শমশের আজিজ একজনকে বললেন, এই গার্ডকে ডেকে নিয়ে আসো। কী বলে ভেতরে ঢুকলো শুনি আগে, পরে তিন নম্বর এপার্টমেণ্টের সিসিটিভির ফুটেজ দেখবো।
প্রহরি জমির এলে ফুটেজ দুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুই জনকে তুমি ভেতরে ঢুকতে দিলে কেনো? কী বলেছিলো তোমাকে?
ফুটেজ দুটো দেখে জমির বললো, দুই জনই আপনার আত্মীয় কইলো।
রাগ সামলে নিয়ে শমশের আজিজ বললেন, কারো আত্মীয় বললেই তুমি ভেতরে ঢুকতে দিবে কেনো? ইণ্টারকমে কথা বললে না কেনো?
আইজ সকাল থাইকা ইণ্টারকমটা কাম করতাছে না ছার। ম্যানেজার ছারকে জানাইছি। অহনো ঠিক হয় নাই।
ওকে। তুমি যাও।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি তিন নম্বর এপার্টমেণ্ট ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে আরম্ভ করলেন। দু'জন একসাথে এপার্টমেণ্টের ভেতরে ঢুকে সরাসরি চলে গেলো লিফ্টের দিকে। এরপরে আর কিছু নেই। কারণ ছাদে কোনো সিসিটিভি নেই।
ওদিকে হাসপাতালে নেবার পথে এ্যাম্বুলেন্সে মহিলাটি মারা গেলেও পুরুষ লোকটি বেঁচে থাকে। জরুরি বিভাগ থেকে ওকে ওটিতে স্থানান্তর করে প্রয়োজনীয় অপারেশনের পরে পোস্টওপারেটিভ বেডে স্থানান্তর করা হলো। থানায় একটি অপমৃত্যু ও একটি দূর্ঘটনার মামলা দায়ের হলো। দুটো মামালারই তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জুনায়েদ। এসআই জুনায়েদ ভিডিও ফুটেজ দেখার জন্য চলে এলো জয়নগর হাউজিং কমপ্লেক্সে। ফুটেজ দেখা শেষ হলে পরামর্শের জন্য শমশের আজিজের এপার্টমেণ্টে গেলেন।
সব শুনে শমশের আজিজ বললেন, ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ডাটাবেইজের সাথে দুজনের চেহারা ম্যাচ করাও। তাহলে ওদের নাম ধাম পেয়ে যাবে। বাকি তথ্য নেবে ইনজুরড পার্সনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর একটা কথা, এ ব্যাপারে আমাদের এই কমপ্লেক্সকে আর ঝামেলায় ফেলো না।
অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি শমশের আজিজকে স্যালুট দিয়ে জুনায়েদ চলে এলো হাসপাতালে। দু'জনের ছবি তুলে চলে এলো থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলে ঢুকলো নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেসের সাথে দু'জনের ছবি মিলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এসআই জুনায়েদ। পুরুষ লোকটির নাম রুবাইয়াত হোসেন, বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় এবং মৃত মহিলার নাম রুখসাৎ শারমিন, বাড়ি লক্ষীপুর।
এসআই জুনায়েদ মনে মনে বললো: দেশের দুই প্রান্তের দু'জন মিললো কিভাবে? ঢাকার কোথায় থাকতো?
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে পরদিন বেরিয়ে পড়লো জুনায়েদ। প্রথমে এলো রুবাইয়াৎ হোসেনের বাড়ি। রুবাইয়াৎ জীবিত আছে শোনে বাড়ির লোকজন অবাক হলেও খুশি হতে দেখা গেলো না কাউকে। বয়স্কদের সাথে কথা বলে এসআই জুনায়েদ যা জানতে পারলো তা এরকম:
পাঁচ বছর বয়সে রুবাইতের মা-বাবা ঘরে আগুন লেগে মারা গেলে ছেলেটা পাগলের মতো হয়ে যায়। ওকে বাড়িতে রাখা সম্ভব না হওয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় পাগলা গারদে। বাড়ির কেউ না কেউ কিছুদিন পরপর ওকে দেখে আসতো। কুড়ি বছর পরে একদিন খবর আসে যে রুবাইয়াৎ সুস্থ হয়ে গেছে। ওরা ওকে বাড়িতে নিয়ে এলো। শমশের কারো সাথে কথা বলতো না, খেতে দিলে খেতো, না দিলে চাইতো না। একদিন কাউকে না বলে বাড়ি থেকে কোথায় যেনো চলে গেলো। থানায় সাধারণ ডায়রি করা হয়। একদিন খবর এলো সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে শমশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে শমশের মারা গেছে। সময় মতো লাশের কোনো দাবিদার না যাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে শমশেরের লাশ দাফন করা হয়েছে একটি গোরস্থানে।
তাহলে ওকে ঢাকায় জীবিত দেখা যাচ্ছে কিভাবে? কোথাও ভুল হচ্ছে ঢাকার পুলিশের। এসআই জুনায়েদ মোবাইল ফোনে শমশের আজিজের ছবি দেখালে বাড়ির সবাই ওকে চিনতে অস্বীকৃতি জানালো। ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! মনে মনে বলে মুচকি হেসে এসআই জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলো, শমশের আজিজ কুড়ি বছর পাগলা গারদে ছিলো। ওর এনআইডি হলো কিভাবে?
বাড়ির কর্তা জানালেন যে ওর বয়স আঠারো বছর হলে পাগলা গারদ থেকেই এই ঠিকানায় এনআইডি হয়েছে।
ওর বাবার ভাগে সম্পত্তি কতটুকু পড়েছিলো? কী অবস্থা ঐ সম্পত্তির?
বাড়িসহ পাঁচ একরের কিছু বেশি। জীবিত সবার কাছে আছে!
এসআই জুনায়েদ ভাবতে ভাবতে একটা ইজিবাইকে চড়লো: জীবিত শমশেরকে চিনতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে কেনো শমশেরের পরিবার? সম্পত্তি হাতানোর জন্য মৃত থাকলেই লাভ! তাহলে কি সম্পত্তির জন্য সড়ক দুর্ঘটনায় শমশেরকে হত্যা করতে চেয়েছে? এমনটা কি ভাবা যায়, একই কারণে ওর মা-বাবাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে? সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র! সম্পত্তির জন্য মানুষ কত জঘন্য ধরনের অন্যায় যে করে যাচ্ছে! এদিকটা পরে দেখতে হবে। এখন যেতে হবে রুখসাৎ শারমিনকে জানার জন্য ওর বাড়িতে।
পরদিন সন্ধ্যায় এসআই জুনায়েদ লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানায় ঢুকলো। থানার রেস্টহাউজে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল আটটায় গেলো রুখসাৎ শারমিনের বাড়িতে। শারমিনদের বাড়িটা উপজেলা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কয়রা গ্রামে। এসআই জুনায়েদ শারমিনের বাবা আতিয়ার রহমানের সাথে কথা বলে যা জানলো তা এই:
রুখসাৎ শারমিনরা দুই ভাই-বোন। কলেজে পড়ার সময় এক তরফা প্রেমে পড়ে মেয়ের সাড়া না পেয়ে ওর বড় ভাই ওবায়েদ রহমান পাগলের মতো হয়ে যায়। পরিবার ভেবেছিলো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখালে সুস্থ হয়ে যাবে। কাজ না হওয়ায় পাবনার মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। রুখসাৎ বাবার সাথে নিয়মিত পাবনা যেতো বড় ভাইকে দেখার জন্য। ওখানে শমশেরের সাথে রুখসাতের পরিচয় ঘটে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো: রুখসাতের সাথে পরিচয়ের পর হতে শমশেরের পাগলামি কমতে থাকে এবং তিন মাসের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। শমশের পাগলা গারদ থেকে বের হয়ে রুখসাতের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে।
একটু থেমে আতিয়ার রহমান বললেন, আমার মেয়ে সম্পর্কে জানার জন্য এতদূর আসছেন ক্যান স্যার? আমার মেয়েটার কিছু হয় নাই তো?
এসআই জুনায়েদ সিদ্ধান্তঃ নিলেন এখনই রুখসাতের মৃত্যুর খবরটা জানানো ঠিক হবে না। আগে সব তথ্য জানা দরকার। জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, শমশের আপনার বাড়ি এসেছিলো?
জ্বী। ও আসার পরই আমার মেয়েটা ওর সাথে ঢাকা চলে যায়।
তার মানে ঢাকায় আপনার কোনো আত্মীয় বাড়ি আছে। আপনার মেয়ে শমশেরকে ওখানেই নিয়ে যায়। কারণ, ইতোপূর্বে শমশের কখনো ঢাকা যায় নাই। আর একটা কথা, শমশেরকে কি আপনাদের পছন্দ হয়েছিলো?
একটা মূর্খ, এর উপর বিশ বছর পাগলা গারদে থেকে কিছুদিন আগে বাইর হয়া আইছে, এমন ছেলেকে জামাই হিসাবে কারো পছন্দ হওয়ার কথা? বলেন স্যার?
ঢাকায় কে থাকে আপনাদের? বাসা কোথায়?
আমার সমন্ধি তথা রুখসাতের বড়মামা। বাসা উত্তরায় তের নম্বর সেক্টরে।
সশব্দে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এসআই জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালে আতিয়ার রহমান বললেন, আমার মেয়ের কী হইছে না বইলাই চইলা যাইতাছেন স্যার?
শুকনো কণ্ঠে জুনায়েদ বললো, আপনার মেয়ে মারা গেছে!
এতক্ষণ দরজার ওপাশে থেকে বাড়ির লোকজন ওদের কথা শুনছিলো। রুখসাৎ মারা গেছে শোনার সাথে সাথে বিলাপ করে কান্না শুরু করে দিলো সবাই। আতিয়ার রহমান কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইলেন কিভাবে রুখসাৎ মারা গেছে।
সব শোনার পরে আতিয়ার রহমান বললেন, আমার মাইয়ার লাশটা আনন যাইতাছো না স্যার?
আপনি আনতে চাইলে অবশ্যই পারবেন।
একবার হেচকি টেনে আতিয়ার রহমান জিজ্ঞেস করলেন, আমার মা-মণিটা ঐভাবে মরলো ক্যান?
এই কারণ জানার জন্যই তদন্ত করছি। আমাকে এখনই ঢাকা যেতে হবে। উত্তরা গিয়ে আপনার সমন্ধিকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আমি লাশ আনতে কবে ঢাকা আসবো স্যার?
আপনি দুই তিন দিনের মধ্যে চলে আসুন।
মূহুর্তে আতিয়ার রহমানের বাড়িটা মড়াবাড়ি হয়ে গেলো। সবাই ডুকরে কাঁদছে। এসআই জুনায়েদের মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। পেছন ফিরে বাড়িটা একবার দেখে এগিয়ে গেলো সামনে।
ঢাকার উত্তরায় রখসাতের বড়মামা রিয়াজ ইসলামের বাসায় এসে জানতে পারলো: রুবাইয়াৎ রুখাসতের সাথে একদিন বাসায় এসেছিলো; কিন্তু থাকে নি। রিয়াজের মনে হয়েছে রুখসাৎ রুবাইয়াতের প্রতি দুর্বল থাকলেও রুবাইয়াৎ রুখসাতের প্রতি তেমন দুর্বল ছিলো না। রুখসাতের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে শুনে কান্নার রোল পড়ে গেলো রিয়াজ পরিবারে।
আধাঘণ্টা পর। এসআই জুনায়েদ বসে আছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকের মুখোমুখি। রুখসাৎ-রুবাইয়াৎ দূর্ঘটনা সংক্রান্ত তদন্তের অগ্রগতি বিস্তারিত জানালো এসআই জুনায়েদ।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিক বললেন, রুবাইয়াতের মা-বাবার মৃত্যু দূর্ঘটনা না হত্যা, তা তদন্তের জন্য তাড়াইল থানার ওসিকে একটা রাইট আপ পাঠিয়ে দেবো। কেসের তদন্ত নিস্পত্তির জন্য তোমার হাতে রয়েছে ভিকটিম। তুমি ডিউটি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখো। ভিকটিমের সেন্স ফিরে এলে ওকে ইণ্টারোগেট করে রহস্য বের করে রিপোর্ট দাও।
এসআই জুনায়েদ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষ থেকে বের হয়ে নিজ চেম্বারে এলো। চেয়ারে বসে চোখ বুজে ভাবছে: লেখাপড়া জানা একটা মেয়ে একটা পাগলকে কিভাবে ভালোবাসতে পার? প্রেম অন্ধ হলে এতোটা অন্ধ? ওরা উত্তরা থেকে জয়নগর এপার্টমেণ্টে এলো কিভাবে? ক'দিন ঢাকায় এসে রুবাইয়াতের পক্ষে উত্তরা থেকে জয়নগর যাওয়া সম্ভব না। এটা রুখসাতের কাজ। কিন্তু কেনো? জয়নগর গিয়ে হাউজিং কমপ্লেক্সের একটা এপার্টমেণ্টের ছাদ থেকে লাফ দিলো কেনো? বড় প্রশ্ন: ওরা আত্মহত্যা করতে গেলো কেনো? রুখসাতের বাবা রুবাইয়াতকে পছন্দ না করার কারণে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ভিকটিম রুবাইয়াতের জ্ঞান ফিরে এলে। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে কথা বলে জখমীর অবস্থা জেনে ফের চোখ বুজলো এসআই জুনায়েদ।
'ভিকটিমের জ্ঞান ফিরেছে!' পরদিন সকাল এগারোটায় এসআই জুনায়েদ কর্তব্যরত ডাক্তারের ফোন পেয়ে চলে এলো হাসপাতালে। বেডের কাছে এসে রুবাইয়াতকে বেডের সাথে চার হাত-পা বেঁধে রাখতে দেখে থমকে গেলো।
জিজ্ঞেস করলে কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন: ভিকটিম আবার পাগল হয়ে গেছে। এখান থেকেই ওকে পাগলা গারদে পাঠানো হবে। ও আবার কবে স্বাভাবিক হবে বলতে পারবেন না; এটা বলতে পারবে মেণ্টাল হসপিটালের ডক্টর।
-------------------------------------------
রানা জামান
ঠিকানা: আনিলা টাওয়ার
বড়বাগ। মিরপুর-২;
ঢাকা। বাংলাদেশ।