দেবদাস কুণ্ডু
ছোটবেলা থেকে সৌরিনের ঘোড়া পচ্ছন্দ। পৃথিবীতে কত জন্ত আনোয়ার রয়েছে তার কিনা পছন্দ হলো ঘোড়া। এর পিছনে আছে একটা কারন। তার বয়স যখন বারো সে কুকুর বিড়াল ছাড়া আর কিছু দেখেনি। তারা থাকতো সি আই টি কোয়াটারে। তাদের কোয়াটারের পিছনে সুইপারদের কোয়াটারে। সে প্রথম যেদিন ঘোড়া দেখলো সে মুগ্ধ হয়ে গেল। শুধু ঘোড়া নয় সংগে ছিল গাড়ি। মানে ঘোড়ার গাড়ি। সেই গাড়িটাকে সাজানো হয়েছিল ফুল দিয়ে। অপূর্ব লাগছিল গাড়িটাকে। যেন পুস্পরথ। । সুইপার কোয়াটারের একটা ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে। তার নাম মোহনলাল।রামলালেল ছেলে। তাদের কোয়াটারের ময়লা নিতো রামলাল। সিঁড়ি ঝাড়ি দিতো। রামলালেল বয়স হলে তার ছেলে মোহনলাল এখন সুইপারের কাজ করে। ঘোড়ার গাড়ির কাছে চলে গিয়েছিল সৌরেন। ছ ফুট উচ্চতা নিয়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়েছিল শক্ত চার পায়ে। খয়রি রঙের ঘোড়া। ঝক ঝকে ত্বক। লম্বা ঘাড়। চিরুনীর দাঁড়ের মতো ঘাড়ে খাড়া পশম। লম্বা সূচলো মুখ। ঘাস খাচ্ছি ঘোড়াটা পায়ে লোহার খুড়। ঘাস খাওয়া হয়ে গেলে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। সৌরেন ঘোড়ার শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল নরম করে। বিদুৎ তরঙ্গের মতো তার শরীরের ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত এক শিহরণ। বরের আসতে দেরি হচ্ছিল। বিরক্তিতে পা ঠুক ছিল ঘোড়াটা। সহিসটা বলল-উওর ঠ্যার জাইয়ে।আভি চলে গা। এমন সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি করে সেও বিয়ে করতে যাবে। এমন একটা ইচ্ছে মনের কোনে বাসা বাঁধে সৌরেনের। সে প্রথম তার ঘোড়ার সংগে প্রেম। ঘোড়ার চোখ দুটো দেখতে পায়নি। চামড়া দিয়ে ঢাকা ছিল। যখন পনের বছর বয়স তখন সে চলে যেত রাজাবাজার। সেখানে ঘোড়া আর গাড়ি আলাদা থাকতো। রাস্তার ওপর মুক্ত ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। তার গলায় লাগাম নেই। চোখে নেই পট্টি। আ:কী আপৃর্ব মায়াময় নীল চোখ। তার অন্তরে সেই চোখ আঁকা হয়ে গেল চিরতরে।সেদিন তখনও বর বাইরে আসে নি। সহিসের হাতে ছিল লাগাম। ঘোড়া ছটপট করছিল। অপেক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সহিস নরম গলায় বলেছিল-আউর থোয়া ঠারো। এরপর তার যখন কুড়ি বছর বয়স তখন তাকে তার বন্ধু নিয়ে গেল রেসের মাঠে। বন্ধু অসীম চৌধুরী রেসের মাঠে টিকিট কাউন্টারে বসতো। রেসের মাঠে গিয়ে তার হলো এক অর্বনীয় অভিজ্ঞতা। বিশাল মাঠ জুড়ে গোল গ্যালারি। তাতে বসে আছে অসংখ্য জুয়ারি দর্শক। ঘোড়াদের নানা নাম। সেই নামেই টিকিট কাটে জুয়রিরা। যে ঘোড়া ফাস্ট হয় সেই ঘোড়ার নামে যারা টিকিক কেটেছে তারা তিনগুন চারগুন টাকা পায়। সৌরেন গ্যালারিতে বসে দেখছিল ট্যাকের ভিতর দিয়ে এক একটা ঘোড়া ছুটছিল। কী দূরন্ত গতি। বাতাস তার কাছে মিয়মান। কী অপূর্ব ছন্দময় চলাচল। তার কাছে নৃত্য মলিন। কী নিপুন দক্ষতায় পা তুলে তুলে ছুটছে। যেন ছোটার জন্যই ঘোড়ার জন্ম। এক এক সময় তার মনে হচ্ছে যেন মাটিতে নয় ঘোড়া গুলো শুন্যে ছুটছে। হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। সৌরেনের চোখ মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হয়েছিল সেদিন। সৌরেন খুব সিনেমা দেখতো। দর্পনা সিনেমা হলে ছবি শুরু হবার আগে বিঞ্জাপন দেখাতো। একটা বিঞ্জাপন তার খুব ভালো লাগতো। চার মিনার সিগারেটের বিঞ্জাপন। একজন সুপুরুষ চারমিনার পান করে ঘোড়ার পিটে চেপে ছুটছে। সামান্তরাল ভাবে ছুটছে আরো ঘোড়া। জনপদ মাঠ ঘাট নদী ঝরনা পার হয়ে ছুটছে তো ছুটছে। অন্য ঘোড়া গুলো পিছনে পড়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য তার মাথায় ফ্রেম বন্ধী হয়ে গেল। একদিন একটা ছুটন্ত ঘোড়ার ছবি এঁকে ফেলল। তার আঁকার হাত ছিল ভাল। ঘোড়ার সেই ছবিটা আজও তার ডাইনিং দেওয়ালে ঝুলছে। মাঝে মাঝে সৌরেনের মনে হয় ঘোড়াটা ফ্রেম থেকে বেরিয়ে ছুটছে। ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। আর চিঁ হি চি হি ডাক ছাড়ছে। সে দুহাত দিয়ে দেওয়াল গুলো সরিয়ে দেয়। ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে এক দীর্ঘ প্রান্তর পার হয়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে এলো ফ্রেমে। দেওয়াল গুলো আবার যথাস্থানে চলে এলো। সৌরেন জানে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সে প্রবল ভাবে বিশ্বাস করে। কারন তার মাথার ভিতর এই ঘটনাটা ঘটে চলেছে অনবরত।
দুই
-আমার বার বার মনে হয়েছে তোমার রিপোর্ট ভুল।
-সেদিন তো তুমি একথা বলোনি। আজ বলছো কেন? এখন তোমার মনে হচ্ছে রিপোর্ট ভুল।
-আমি যদি বলতাম তুমি বিশ্বাস করতে না সৌরেন।
-বিশ্বাস করতাম না আমি?
-না। অনিন্দিতা গলায় জোর দিয়ে কথাটা বলল।
-কেন? দু চোখে বিস্ময় নিয়ে জবাব চায় সৌরেন।
-আমি সরকারী হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। এখন সিস্টার ইন চার্জ। তিরিশ বছর চাকরি করছি। তবু তুমি আমার কথার গুরুত্ব দাও না।
-গুরুত্ব দেই না?
-না। এতটুকু দাও না। বললেই বলো তুমি কি ডাক্তার?
-কথাটা তো সত্য যে তুমি ডাক্তার নও।
-আমি কি বলেছি মিথ্যে? কিন্তু একটা ব্যাপার তুমি ভেবে দেখলে না কোনদিন?
-কি ব্যাপার?
-আমরা ডাক্তারদের সংগে কাজ করি। চম্বুকের সংগে লোহা ঘষলে লোহা চম্বুক হয়ে যায়। ডাক্তারের মতো আমাদেরও অভিজ্ঞতা হয়। । আমরা রুগীর সংগে ডাক্তারদের চেয়ে বেশী সময় কাটাই।
-চব্বিশ ঘন্টা কাটালেও তোমরা ডাক্তার নও। প্রেসকিপশন লিখতে পারো না।। সে রাইট তোমাদের নেই।
-বিদেশে লিখতে পারে। আমাদের এখানেও সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে কোন কারনে হোক তা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জুনিয়র ডাক্তার আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে সিস্টার ঐ পেশেন্টটাকে কি মেডিসিন দেওয়া যায় বলুন তো? তখন আমরা মেডিসিনের নাম বলি। আমরা একজন পেশেন্টের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে বলে দিতে পারি মানুষটার কী রোগ হয়েছে।কতটা অসুস্থ। ভর্তি হবার প্রয়োজন আছে কিনা। তেমনি রিপোর্ট দেখে বলতে পারি কোন রিপোর্ট সঠিক কোন রিপোর্ট সন্দেহজনক।
-হার্টের অসুখ।ইকোকার্ডিয়ামের মতো একটা গূরত্বপূর্ন রিপোর্ট দিল সাইথ সিটি ডায়গোনেস্টিক সেন্টার আর সেটা দেখে তোমার মনে হলো সঠিক রিপোর্ট নয় তবু তুমি আমায় কিছু বললে না। আমার তখন অসুখ নিয়ে ভীষন টেনশন। বুকে ব্যাথা শ্বাস নিতে কষ্ট। ফ্ল্যাটে একা থাকি। তুমি বহরমপুর মেডিকেল কলেজে ডিউটি করছো। রোজ ভাবতাম রাতে যদি কিছু হয়ে যায় কে নিয়ে যাবে আমাকে হাসপাতালে?
-কেনো বলিনি জানো? অনিন্দিতা হাত দিয়ে কপালের কয়েকটা সাদা চুল সরিয়ে দিয়ে বলল-আমি যদি তখন বলতাম ঐ রিপোর্ট নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে তা শুনে তোমার হার্টবিট আরো বেড়ে যেতো। কারন তুমি সব ব্যপার নিয়ে বেশি বেশি টেনশন করো। তখন সম্যাসা আরো জটিল হতো।
-আচ্ছা মানুষ তো তুমি। চোখ দুটো সরু করে অনিন্দিতাকে দেখলো সৌরেন রায়। একষস্টি বছর বয়স অনিন্দিতার। আর এক বছর পর সরকারি চাকরি থেকে রিটিয়ার করবে। । তিরিশ বছর বয়সে ফার্স্ট পোস্টিং নিয়ে অনিন্দিতা চলে যায় রামপুরহাট এস ডি ও মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সেখানে তিনবছর থাকার পর স্বাস্থ্য দপ্তরের একজন মহিলা স্টাফের সাহায্যে টান্সফার নিয়ে চলে এল কলকাতা মেডিকেল কলেজ। তখন অনিন্দিতা ঘন ঘন অসুস্থ হতো। ডিউটি করতে করতে বুকে ব্যাথা হতো। নিজের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেত। আর হাসপাতাল থেকে তাকে একটা ফোনে তা জানিয়ে দিত। সে ছুটে যেতো। হার্টের সব রকম পরীক্ষা করা হতো কিন্তু কিছু দোষ পাওয়া যেতো না। তবু কেন শ্বাস কষ্ট হতো? এর উওরে ডাক্তারগুলো বলতেন-সিস্টারের হার্টের কোন প্রবলেম নেই। এটা ওনার মানসিক অসুখ। তারপর তাকে একটা মোক্ষম প্রশ্ন করতেন-আপনাদের দাম্পত্য লাইফ কী রকম? সৌরেন তখন পরিস্কার গলায় বলতো-খুব ভালো। আমরা দশ বছর প্রেম করে তারপর বিয়ে করেছি। আমাদের একটা তিন বছরের কন্যা সন্তান আছে। আমরা হ্যাপী লাইফ লীড করছি। ডাক্তারা তখন মাথা নেড়ে বলতো-না না। আপনি ঠিক কথা বলছেন না। সে জিগ্যেস করেছিল – তাহলে ঠিকটা কি? ডাক্তারেরা বলতেন-সিস্টারের এটা সাইকো প্রবলেম। হার্টের কোন অসুখ নয়। দশ বছর এভাবে চলার পর সাউথ ইন্ডিয়ার এক ডাক্তার, নাম রবি কিশোর পুরনো একটা ই সি জি রিপোর্ট দেখে বললেন-ওনার একটা প্রবলেম আছে। সামান্য একটা অপারেশন করলে উনি দশ বছর সুস্থ থাকবেন। সেদিন অবাক হয়ে তারাদুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর সৌরেন বলেছিল- দশ বছর পর কি হবে?
-আবার এই অপারেশনটা করতে হবে।
-তারপর? এভাবে দশ বছর পর পর..
তাকে থামিয়ে দিয়ে রবিকিশর বলেছিলেন-তারপর আর অপারেশন করতে হবে না। শুধু একটা মেডিসিন কনটিনিউ করে যেতে হবে।অপারেশন হয়ে ছিল সাইথ ইন্ডিয়ায়। ব্যাঙগালোর।এখন সুস্থ আছে অনিন্দিতা। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে ই সি জি রিপোর্ট দেখে এখনকার একাধিক ডাক্তার বলেছেন হার্টের কোন প্রবলেম নেই। এটা সাইকো প্রবলেম।সেই একই ই সি জি রিপোট দেখে দেখেকিশর বললেন হার্টের অসুখ। আর ওনার কথাটাই আজও সত্য হয়ে আছে। সেখানে একটা ইকো রিপোর্ট ভুল হতেই পারে। মনে মনে এসব ভেবে সৌরেন বলল-তুমি তো ডেনজারেস মহিলা।
-আমি মদি ডেজারাস মহিলা হই তবে তোমাকে পি জি তে নিয়ে যেতাম না।
অনিন্দিতার কথাটা মিথ্যে নয়। অনেক দিন ধরে ব্যাথা হচ্ছে বুকের মাঝখানে। ওষুধ খেয়েছে সৌরেন। ব্যাথা কমে নি। বহরমপুর থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে অনিন্দিতা এলো কলতাকায়। তাকে নিয়ে গেল পি জি। ইউ এস জি করাতে ধরা পড়ল ফ্যাটিলিভার স্টেজ টু। খুব ভয়ের। এর পরের স্টেজ সিরোসিস অব লিভার। ভয় পেয়ে সৌরেন ডাক্তারের কাছে ফ্যাটিলিভার এর কথা তুলতে ডাক্তার রেগে গেলেন – হ্যাঁ ফ্যাটিলিভার ফ্যাটিলিভার করে সবাই এখানে এসে হুমরি খেয়ে পড়ছে। আরে ফ্যাটিলিভারে কজন মারা যায়? কার্ডিয়াক সমস্যায় মারা যায় বেশি মানুষ। ফ্যাটিলিভার ফ্যাটিলিভার করে মরছে এরা। তিনি রেফার করলেন কার্ডিয়াক ডিপার্টমেন্টে। ই সি জি তে ধরা পড়ল হার্টের সম্যাসা। তারপরের দিন সাইথ ডায়গোনেস্টিক সেন্টার থেকে করা হলো নানা রক্ত পরীক্ষা। নতুন করে ই সি জি। ইকোকার্ডিয়ো। এইসব রিপোর্ট নিয়ে অনিন্দিতা তাকে নিয়ে গেল এন আর এস এর নাম করা কার্ডিয়াক দেবশংকরের চেম্বারে। বেলেঘাটা লেকের কাছে। দেবশংকর রিপোর্ট দেখে শয়তানের মতো হাসতে লাগলেন-খুব সিগারেট খেয়েছো না? খুব সিগারেট খেয়েছো না? প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করছেন আর হাসছেন। সৌরেন রায় হঠাৎ রেগে উঠলো-হ্যাঁ। আমি অনেক সিগারেট খেয়ছি। দিনে তিন প্যাকেট। সো হোয়াট? তখন দেবশংকর শান্ত হয়ে গেলেন। নরম গলায় বললেন-বেড়ে শুয়ে পড়। পরীক্ষা করতে করতে দেবশংকর মৃদু গলায় বললেন-বাড়ির কারো হার্টের অসুখ আছে?
-বাবার বুকে ব্যাথা হতো। একদিন ই সি জি করতে নিয়ে যাচ্ছি। মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়লেন। বললাম কি হলো? বাবা বললেন-তোরা আমাকে মারার জন্য যড়যন্ত করছিস। আমি ই সি জি করবো না। বাড়ি চলে এলেন।অনেক বুঝিয়ে ছিলাম। বলেছিলাম তুমি ভুল ভাবছো বাবা।
-তারপর?
-একদিন ঘুমের ভিতর স্টোক হয়ে গেল। মারা গেলেন।
-আপনার মার আছে?
-মার পঁচাশি বছর বয়স। সামান্য শ্বাস কষ্ট আছে।
-উঠে পড়ুন।
দেবশংকর প্রেসকিপশন লিখলেন। বললেন-সিস্টার এই ওষুধ গুলো দুমাস খাবে। তারপর আসবেন। একটা এঞ্জো করতে হবে। বাইপাস করতে হতে পারে।
সৌরেন রায় বলল-বাইপাস আমি করবো না।
-কেন?
-আমি দেখেছি যারা বাইপাস করেছে তারা খুব একটা সুস্থ থাকে না। কমে যায় তাদের চলার গতি। দাসত্ব হয়ে পড়ে ওষুধের। নিয়মশৃখঙলায় পরাধীন হয়। একরকম গাধার মতো জীবন। আমি বাঁচবো ঘোড়ার মতো। না হলে মরে যাবো। দেবশংকর অদ্ভুত চোখে তাকে দেখেছিলেন। আর বোধ হয় মনে মনে ভাবছিলেন, এই উজবুক পেশেন্ট কোথা থেকে এলো? বলে কী? এই রকম পেশেন্টের সংখ্যা বাড়লে তাকে ভিখিরির মতো জীবন যাপন করতে হবে। দেবশংকর আর কথা না বাড়িয়ে বললেন-তুমি এখন এসো।
সেদিনই অনেক বছর পর আমার ঘোড়ার কথা মনে পড়ল। আমর আঁকা ঘোড়ার ছবিটা দেখছি না দেওয়ালে। অনিন্দিতা কবে সরাল ছবছবিটা? আমি রেগে গেলাম-আমার ঘোড়ার ছবিটা কোথায়?
-সেটা দিয়ে এখন কী হবে?
-তুমি বুঝবে না। কোথায় রেখেছো বল?
-খাটের নীচে।
এক সমুদ্র রাগ নিয়ে খাটের তলা থেকে ধুলো মলিন ঘোড়ার ছবিটা বার করল সৌরেন রায়। ভেজা কাপড় দিয়ে পরিস্কার করে আবার মথা স্থানে রাখলো। একটা দূরন্ত ঘোড়ার ছবি কিনে আনলো সে। প্রতিদিন অপলক চোখে ঘোড়ার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার ভিতরে ছোটাছুটি করতো একটা অন্য রকম অনুভূতি। অনিন্দিতা বলল-তুমি যে অপারেশন করতে চাইছো না, তবে সুস্থ হবে কি করে?
- মরে যাবো। অপারেশন করবো না। বাঁচবো তো ঘোড়ার মতো বাঁচবো। ছুটবো। তুমি তো দেখেছো আমি কতো জোরে হাঁটি। স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রতি বছর ফার্স্ট হতাম। ভুলে যেও না সেই মানুষ গাধার মত জীবন কাটাবে? অসম্ভব। আর আশ্চর্য এই যে সেদিনও তুমি বলো নি ডাক্তারকে-আচ্ছা ডাক্তারবাবু আমার মনে হচ্ছে এই রিপোর্ট ভুল আছে। ইনজেকশন ফরটিফাইভ হতে পারে না। ডাক্তারকে এইসব কথা বলো নি। আমাকে বাইপাশ এর দিকে ঠেলে দিতে চাইলে। তুমি একটা নিষ্ঠুর মানুষ।
-আমি নিষ্ঠুর মানুষ? এই কথাটা তুমি বলতে পারলে? অনিন্দিতার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠলো।
-হ্যাঁ তুমি একটা নিষ্ঠুর মানুষ ছাড়া আর কী? জেনে বুঝে আমাকে একটা অপারেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলে।
-অপারেশনের আগে এঞ্জো করতো। তার রিপোর্ট দেখে বাইপাশের সিদ্ধান্ত নিতো। আর ডাক্তার বলেছিলেন বাইপাশ করতে হতে পারে। করতেই হবে এমন কথা বলেন নি।
-বুঝেছি। এঞ্জোটা তো করতো। ইকো রিপোর্ট নিয়ে তোমার মনে যখন সন্দেহ দানা বেধেছিল, তখন অন্য আর এক জায়গা থেকে আবার একটা ইকো করতে বলতে পারতে। এই এঞ্জোটা তো একটা পরীক্ষা। অকারনে সেই পরীক্ষায় যাবো কেন?
-তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আমি বহরমপুর মেডিকেল কলেজের ডাক্তারের সংগে তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা আমাকে বলেছেন সিস্টার আপনি যখন বলছেন আপনার হ্যাঁ ব্যান্ডের ইনজেকশন ফরটি ফাইভ হতে পারে না, তখন আপনি একবার ঐ ডায়গোনেস্টটিক সেন্টারে যান। আপনার সন্দেহের কথা ওদের বলুন। ভুল রিপোর্ট হতে পারে। চুপচাপ থাকবেন কেন? কিন্তু আমি ঝামেলায় যেতে চাইনি।
-আর একটা ইকো তুমি করতেই চাওনি। আমি গেলাম ডাক্তার দেবাশীষ ঘোষের কাছে। তিনি আয়ুবেদে এম ডি। আমর রিপোর্ট দেখে বললেন, আপনাকে এঞ্জো করতে হবে না। বাইপাশ করতে হবে না। আপনি শুধু দু বেলা একঘন্টা করে হাঁটুন। এখন আপনাকে হাঁটতে বলেছি। পরে আপনাকে ঘোড়ার মতো ছুটতে হবে। এই কথা শুনে আমার ভিতরে জেগে উঠলো একটা ছুটন্ত ঘোড়া। তার খুড়ের ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার রক্তের ভিতর একটা দামাল ঘোড়া লাফাচ্ছে। ছুটছে। চি হই চি হি ডাক ছাড়ছে। আমার সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক দামাল বালকের উতেজনা। তুমি বলে ছিলে অনিন্দিতা, তোমার হার্টের সম্যাসা ।একজন কার্ডিয়াক ছেড়ে তুমি আয়ুবেদ ডাক্তারের পরামর্শে চলবে? কিছু হয়ে গেলে আমি কিন্তু ঐ আয়ুবেদ ডাক্তারকে ছেড়ে দেবো না। আমি বলেছিলাম-আমি মরে গেলে তুমি কি করবে না করবে তা আমি দেখতে আসবো না। আমি দেশবন্ধু পার্কে দু বেলা একঘন্টা করে হেঁটেছি। সে কী কষ্ট। এক পাক দিয়ে এসে বসে পড়তাম। হাঁফাতাম। খুব কষ্ট হতো বুকে।মনে হতো এই বুঝি মরে যাবো। পরখনে আমার মনে পড়তো আমাকে ঘোড়ার মতো ছুটতে হবে। আবার হাঁটতাম। দু বেলা দুমাস।তারপর ইকো করলাম। রিপোর্ট নিয়ে গেলাম দেবাশিস স্যারের কাছে। তিনি বললেন, ইনজেকশন সিক্টি টু। গুড। আরো দু মাস হাঁটুন।কিন্তু মনে রাখবেন একদিন আপনাকে ঘোড়ার মতো ছুটতে হবে। আমি জিগ্যেস করেছিলাম-, এই ইজেকশনটা কী? দেবাশিস স্যার বললেন, পার মিনিটে আপনার হার্ট কতবার পাম্প করছে তার হিসেব। আমি বললাম, নরম্যাল রেঞ্জ কতো? তিনি বললেন, সিক্টিটু টু সিক্টি ফাইভ। আপনি এখন নরম্যাল রেঞ্জের ঢুকে গেছেন। কিন্তু ঐ যে বলেছি আপনি ঘোড়ার মতো ছুটবেন। তাই আরো দুমাস হাঁটুন। সেদিন তুমি বলতে পারতে, স্যার দুমাসে ফরটি ফাইভ থেকে সিক্টি টু হয়ে গেল, তার মানে ইকো রির্পোট ভুল ছিল। তুমি কিন্তু কিছু বলো নি। কেন বলো নি?
-কী বলবো? আমার কাছে সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। তোমার প্রোগেস দেখে আমি এতোটা বিমোহিত হয়ে গেছিলাম যে মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে আমার ভিতর বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচাল শুরু হতে লাগলো। তাই কিছু বলতে পারি নি।
-তারপর আমি আরো দুমাস হাঁটলাম।আগের চেয়ে অনেক জোরে। পার্কের দাসদা একদিন বললেন, ও রায়দা এতো জোরে হাঁটছেন কেন? আমি জবাব দেইনি। মনে মনে বলেছি, এটা কিছু নয়। আমি ঘোড়ার মতো ছুটবো। হ্যাঁ এই ষাট বছর বয়সে ঘোড়ার মতো ছুটবো। দুমাস পর আবার ইকো। এবার নিজেই রিপোর্ট দেখলাম, সিক্টি সেভেন। দেবাশিস স্যার এক মুখ হাসি নিয়ে বললেন, বলেছিলাম তো এঞ্জো করতে হবে না। বাইপাশ করতে হবে না। মিলতো আমার কথা। যান এবার আপনার হার্ট সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনার গ্যাসের প্রবলেম।
অনিন্দিতা এতোক্ষণ চুপচাপ শুনলো।একটা বোতল টেনে নিয়ে কিছুটা
ঠান্ডা জল ঘাড় হেলিয়ে গলার নালিতে ঢালল। তারপর সৌরেনের দিকে তাকালো। সৌরেনের এখন সিক্টি। তার থেকে এক বছরের ছোট। মুখে যৌবনের উজ্জ্বলতা লুট হয়ে গেছে। আগে দেখতে লাগতো কপিলদেবের মতো। কালো ভরাট মুখ। এক মাথা কালো কোঁকড়ান চুল। কালো মোটা গোফ। লম্বায় প্রায় ছ ফুটের মতো। বন্ধুরা বলতো - , অনি তোর কপিলদেব ভিজিটারস রুমে অপেক্ষা করছে। চলে যা।সময় বিশ্বাসঘাতকের মতো কপিলদেবের সব চিহ্ন ওর শরীর থেকে মুছে দিয়েছে। এখন কানের দুপাশে সাদা ঝুলফি মনে করিয়ে দেয় সুনীল গাংগুলির মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিতা বলল-তুমি একটা জায়গায় ভুল করছো।
-কোথায় ভুল করলাম?
-ডাক্তার দেবাশিস ঘোষ নয়। আমি তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম মেডিকেল কলেজে। আমি তখন বহরমপুর থেকে বদলি হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে। একদিন আমি তোমার সব রিপোর্ট নিয়ে গেলাম কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর নীলাঞ্জন স্যারের কাছে। তিনি সব রিপোর্ট দেখে বললেন - আপনার হ্যাজব্যান্ডের তো অনেক রোগ। তার ওপর কার্ডিয়াক… ঠিক আছে আপনি কাল নিয়ে আসুন ওনাকে। আমি নিজে হাতে ইকো করবো। পরদিন তোমাকে ইকো করলেন স্যার। ডাকলেন আমাকে। আমি গেলাম। স্যার বললেন,- সিস্টার আপনার হ্যাঁজব্যান্ডের হার্ট তো ঘোড়ার মতো ছুটছে।
-হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। নীলাঞ্জন স্যার বলেছিলেন বটে। আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন, - কি করেন? আমি বলেছিলাম, - গল্প উপন্যাস লিখি। তিনি বলেছিলেন-, লিখতে মস্তিস্ক আর হার্ট লাগে। আপনার দুটোই সুস্থ। লিখে যান। সৌরেন একটু থেমে বলল-না না এই কথা নীলাঞ্জন স্যারের আগে দেবাশিস স্যার বলেছিলেন।
-বলছি না। তুমি রিপোর্ট বের কর। অনিন্দিতা জোর গলায় বলল।
-দরকার নেই।
-এখনই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে।
-আমার কাছে যে আজও একটা ব্যাপার পরিস্কার হলো না অনিন্দিতা।
-কোন ব্যাপার?
-তুমি আমাকে ভালোবাসা। এখনও ভালোবাসা। এব্যাপারে তিলমাত সংশয় নেই। সেই তুমি একটা সংশয়পূর্ন রিপোর্ট নিয়ে এক বছর চুপ করে ছিলে? কোন যুক্তিতে? অনায়াসে আর একটা ইকো করাতে পারতে। টাকা তো সরকার দিতো। আমি কি নতুন করে ইকো করতাম না? তুমি যদি সেদিন একবার বলতে, তোমার ইজেকশনটা ফরটি ফাইভ হতে পারে না। এই রিপোর্ট ভুল। তোমার হবে ফিফটি থেকে ফিফটি ফাইভ। আমি উৎসাহ নিয়ে একবার কেন, দুবার ইকো করতাম। ইকো করতে যন্তনা হয় না। চুপচাপ শুয়ে থাকা। একটা ভুল রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করতে যাচ্ছিলেন। তুমি তখন বহরমপুর। বুকের ব্যাথা তখনও কমে নি। এদিকে ইকো রিপোর্ট ভালো। কিন্তু একটা ব্যাথা অনড় হয়ে আছে বুকের ঠিক মাঝখানে। যেন কেউ একটা পেরেক পুঁতে দিয়েছে বুকে। গ্যাসের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি, কমছে না। দশ টাকার রঙ তুলি কিনে আনলাম। প্রতিদিন এঁকে গেছি একটা করে ঘোড়ার ছবি। অনেক ছবি এঁকেছি যৌবন বয়সে। বয়সের হেরফেরে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। একজন আর্ট টিচারের কাছে কিছু দিন আঁকা শিখেছিলাম। তুমি দুদিনের জন্য বহরমপুর থেকে এলে। টান্সফারের তর্দ্দির করতে গেলে স্বাস্থ্য ভবন। ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে বলেছিলে-এতো ঘোড়ার ছবি কেন? আমি সেদিন তোমাকে কিছু বলিনি। কেন বলিনি? তখনও বুকের ব্যাথাটা সম্পূর্ণ নির্মূল হয় নি। তীব্রতা কমেছে। ব্যাথাটা হচ্ছে নদীর কুলু কুলু ধ্বনির মতো। রোজ রাতে ঈশ্বরকে বলতাম, আমাকে ঘোড়ার স্বপ্ন দেখাও। ঈশ্বর আমার কথা রেখেছিলো। প্রতিদিন স্বপ্নে আমি ঘোড়া দেখতাম। দেখতাম একটা তেজি ঘোড়া ছুটছে। তার পিছনে ছুটছে একটা মানুষ। আর একদিন দেখলাম একটা ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসে আছে এক পৌঢ়। সকাল হলে আমি আঁকতে বসে যেতাম ঘোড়ার ছবি। আর সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম সেই সব ঘোড়ার দিকে। দেখতাম ঘোড়ার পা। পায়ের নিচে সিলেট রঙের খুড়। খয়রি রঙের লোমশ শরীর। দেখতাম চোখ মুখ নাক লেজ কেশর। অনুভব করতাম ঘোড়ার প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ আমার ভিতর। কী আশ্চর্য একদিন স্বপ্ন দেখলাম, আমি আর মানুষ নেই। হয়ে গেছি সম্পূর্ন একটা তেজি ঘোড়া।ছুটন্ত ঘোড়া। দূরন্ত ঘোড়া।
স্বপ্ন ভেঙে যায়। আমি ধরমর করে উঠে বসি। আলো জ্বালি । তাকাই চারদিকে। দেওয়ালে অনেক ঘোড়া। সাদা খয়রি কালো।সেই ছবি থেকে নেমে এলো ঘোড়া গুলি। আমি বিছানা থেকে মেঝেতে নামি, আমাকে ঘিরে ঘোড়া গুলি লাফাচ্ছে। চি হই চি হি ডাক দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সামনের পা দুটো তুলে দিচ্ছে শূন্যে। তারপর ওরা লাইন দিয়ে দাঁড়ল স্কুল বালকের মতো। আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলো একটা সবুজ মাঠে। আমি সামনে, ওরা পিছনে। ওরা ঠেলছে। ঠেলে যাচ্ছে। দু পা, চার পা করে আমি ছুটতে লাগলাম। ওরাও ছুটছে। একটা বড সবুজ মাঠ প্রদিক্ষণ করলাম তিনবার। তারপর শুয়ে পড়লাম ঘাসের ওপর। ওরা লেজ দিয়ে আদর করল আমায়। একা খয়রি ঘোড়া কানের কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করল-বুকে ব্যথা হচ্ছে এখন?
-না। আমি বললাম।
-কুলু কুলু নদির ধ্বনির মতো ব্যথা নেই তো? একটা সাদা ঘোড়া জিগ্যেস করল।
-না। কোন ব্যথা নেই। আমি জোর গলায় বললাম।
-এবার কেউ জিগ্যেস করলে কি বলবি? একটা কালো ঘোড়া জিগ্যেস করল।
-বলবো ব্যাথা নেই। সুখে আছি।
-আর যদি বলে তোর নাম কি? একটা সাদা কালো ঘোড়া প্রশ্ন করল।
--বলবো সৌরেন রায়।
-না। সব ঘোড়া গুলো এক সংগে গর্জে উঠলো।-বলবি আমার নাম সৌরেন ঘোড়া। মনে থাকবে?
-থাকবে। আমি দৃঢ় গলায় বললাম।
আমি ঘরে ফিরে আসি। খুব জোর বাথরুম পেয়েছে। ছুটে বাথরুমের দিকে যাচ্ছি । আমার প্রতিটা পদখেপে ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ঠক ঠক ঠক ঠক ঠক…..।
-------------------------------------------------
Debdas kundu
6D Gorapada sarkar Lane
Block B flat 4
GANAPATIAPPRTMENT
Kolkata
-