ছবি - সংগৃহীত
পাহাড়ে প্রলয়
মিঠুন মুখার্জী
আজ এমন একটি সত্য কাহিনী সকলের সামনে তুলে ধরব যা শুনে প্রতিটি মানুষের রোম দাঁড়িয়ে যাবে, দুচোখ দিয়ে ঝরে পড়বে অশ্রুধারা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে এ জগতের সকলকে সুস্থ রাখার। অকালে মৃত্যু নয় মানুষের, অভিভাবকহীন করো নাকো কোনো সন্তানকে। সময়টা ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেদারনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে শিশু থেকে বুড়ো পর্যন্ত সব বয়সের মানুষেরা ছিলেন। কলকাতার শ্যামবাজার থেকে এক প্রাইমারি শিক্ষক তার ছেলে ও বউকে নিয়ে কেদারনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন। কিন্তু যাওয়ার সময় একবারও তারা বুঝতে পারেন নি, এই যাওয়াই তাদের প্রিয় মানুষের নিয়তির ইঙ্গিত। মৃত্যু দেবতা কার কখন জীবনের ইতি টেনে দেন কেউ তা জানেন না।
সময়টা ছিল জুন মাস। সবে সবে বাবা কেদারনাথকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়েছে। ছয় মাস দর্শন বন্ধ থাকায় মানুষের মধ্যে কেদারনাথ দর্শনের তৃষ্ণা ছিল প্রবল। কাতারে কাতারে মানুষের ঢল নেমেছিল চারধাম দর্শনের জন্য। কেদারনাথ- বদ্রীনাথ - গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী এই চার ধাম মানুষের স্বপ্নের জায়গা। ১২ই জুন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মনোতোষ মুখোপাধ্যায় তার বারো বছরের ছেলে স্বপ্নময় মুখোপাধ্যায় ও পত্নী রমলা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রথমে হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কুম্ভ এক্সপ্রেসে ছাব্বিশ ঘন্টা যাত্রা করে ১৩ই জুন হরিদ্বারে পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। এই প্রথম নয়, আগেও একবার মনোতোষ মুখোপাধ্যায় তার বাবা-মাকে নিয়ে কেদারনাথ দর্শন করতে এসেছিলেন। যদিও তখন তার বিয়ে হয় নি,সবে সবে চাকরি পেয়েছিলেন। খুব আনন্দ করেছিলেন সেবার। বাবা -মার বয়সও কম ছিল। তাই সেবার খুব ভালো চারধাম ঘুরে ছিলেন তারা। আজ তার বাবা গত হয়েছেন পাঁচ বছর হয়েছে। মাও বয়েসের ভাড়ে চলতে পারেন না। তাই হরিদ্বারে আসার আগে একমাত্র বোন অঞ্জলীর বাড়িতে এই কদিনের জন্য মাকে রেখে এসেছেন তিনি। ১৩ই জুন হরিদ্বারে পৌঁছে তিনি গিয়েছিলেন ভারতসেবাশ্রমে। সেখানকার বাঙালি পরিবেশ তার খুবই ভালো লাগে। আগের বারও বাবা-মাকে নিয়ে এখানেই উঠেছিলেন তিনি। তিনি পত্নী রমলা মুখোপাধ্যায়কে বলেন---"জানো রমলা, এখানে থাকলে বোঝাই যায়না আমরা কলকাতায় আছি না হরিদ্বারে। বেশিরভাগ বাঙালিরাই হরিদ্বার ও চারধাম ঘুরতে এলে এখানেই ওঠেন। এখানে প্রচুর ঘর। ঘর পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই। তাছাড়া ঘরের নির্দিষ্ট কোনো ভাড়া নেই। দর্শনার্থীরা খুশি হয়ে যা দেন তাই এনারা নেন। এখানকার মহারাজেরা খুবই ভালো। বাংলা ভাষা সকলে বুঝতে পারেন, বলতেও পারেন। খবার নিয়ে চিন্তাও নেই। তিন বেলা কুপন কেটে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাঙালিদের প্রিয় খাবারগুলোই এরা প্রতিদিন রান্না করেন। সবচেয়ে তোমার ভালো লাগবে প্রনবানন্দের মন্দিরে দুবেলা পুজো ও আরতি দেখে।" তিন জনের পক্ষে উপযুক্ত একটি ঘর মহারাজের সঙ্গে কথা বলে তারা নেন। তারপর ঘরে গিয়ে স্নান সেরে তিনজনেই ফ্রেশ হয়ে নেন। তাদের সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার ছিল। সেগুলো তারা বিকেল বেলা খেয়ে নেন। সন্ধ্যা ছটার সময় তিন জন মিলে হর কী পৌরীর ঘাটে যান সন্ধ্যা আরতি দেখতে। দেখার মতো সে আরতি। গঙ্গা নদীর দুপাশে বাঁধানো ঘাট। হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ভিড়। তিল ধারণের জায়গা নেই। কোনো ভাবেই লোকজন ঠেলে নিজেদের দাঁড়ানোর জায়গা করে নেন তারা। ছটা কুড়ি মিনিটে গঙ্গারতি শুরু হয়। মনোমুগ্ধকর অসাধারণ দৃশ্য দেখে সকলের মন তৃপ্ত হয়ে যায়। বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে প্রায় আট-দশ জন পুরোহিত প্রদীপদানী নিয়ে নেচে নেচে আরতি করতে থাকেন। আবার কখনো গঙ্গা মায়ের ভক্তিগীতি মাইকে বাজানো হয়। স্বপ্নময় ও রমলা দেবী আরতির সঙ্গে সঙ্গে হাতে তালি দেয়। গঙ্গা মায়ের নামে জয়ধ্বনি দেয় হাজার হাজার মানুষ। প্রদীপ ধরিয়ে গঙ্গা নদীর শীতল জলে ভাসিয়ে দেয় প্রচুর পুন্যার্থীরা। মিনিট পনেরো পর আরতি শেষ হয়ে যায়। গঙ্গাজল হাতে নিয়ে মনোতোষ মুখোপাধ্যায় পত্নী, ছেলে ও নিজের মাথায় দিয়ে সকলের মতো আরতির ঘাট থেকে ভারতসেবাশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাওয়ার সময় একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে চারধাম ঘোরার কথা বলেন। বাসের তিনটি টিকিট তিনি বুক করে দেন। চারধাম ঘোরানো, থাকা-খাওয়ার পুরো দায়িত্বটা তারা গ্ৰহন করেন। পরদিন ভোর পাঁচটার সময় তাদের বাস ছাড়বে বলে জানিয়ে দেন তারা।
ভারতসেবাশ্রমে যখন তারা এসে পৌঁছেছিলেন তখন রাত আটটা বাজে। প্রনবানন্দজীর মন্দিরে তখন আরতি চলছে। কিছুক্ষণ মন্দিরে সময় কাটিয়ে তারা ঘরে যান। হাত-মুখ ভালো করে ধুয়ে খাওয়ার জন্য ভারতসেবাশ্রমের ক্যান্টিনে তারা চলে যান। গঙ্গারতি দেখতে যাওয়ার আগে মনোতোষ মুখোপাধ্যায় রাতের খাবারের তিনটি কুপন কেটে নিয়েছিলেন দায়িত্বে থাকা মহারাজের কাছ থেকে। সেদিনের মেনুতে ছিল দেরাদুন চালের ভাত, মুগডাল, আলুভাজা, সুক্ত, টমেটোর চাটনী ও পাঁপড় ভাজা। রাত নটায় খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরে চলে যান তারা। পরদিন সকাল সকাল চারধামের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তাই একটা ব্যাগে পাঁচ-ছয় দিনের মতো তিন জনের জামা-কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঘুমাতে যান তারা। অচেনা জায়গা হলেও ঘুম আসতে তাদের বেশি সময় লাগে না।
পরদিন ১৪ই জুন ভোর সারে চারটের মধ্যে মনোতোষ বাবুরা তিনজন স্নান সেরে দাঁত ব্রাশ করে তৈরী হয়ে নেন। তারপর ছোট্ট লাগেজটা নিয়ে চারধামের উদ্দেশ্যে যাওয়া বাসটিতে ওঠেন। কিছুক্ষণ পর ট্রাভেল এজেন্সির একজন এসে জানান-- "বিশেষ কারণ বশত যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রী যাত্রা আজ থেকে একসপ্তাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আজ থেকে একসপ্তাহ শুধুমাত্র কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের জন্য বাস ছাড়া হবে। যারা যেতে চান তারা প্রত্যেকে মাথা পিছু কিছু টাকা ফেরত পাবেন। বুকিং টিকিট দেখালেই আমরা তা হিসাব করে দিয়ে দেব। আর যারা যেতে চান না তারা বুকিং টিকিট দেখিয়ে আমাদের কাউন্টার থেকে টাকা ফেরত নিয়ে নেবেন। বাস একঘন্টা পরে ছাড়বে।" মনোতোষ মুখোপাধ্যায়রা কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন তারা কেদারনাথ ও বদ্রীনাথেই যাবেন।
একঘন্টা পর বাস ছাড়ে। বাসটি হৃষিকেশ গিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়। সেখান থেকে কিছু যাত্রী বাসে উঠেছিলেন। তারপর বাসটি সারাদিন ধরে একপাহাড় থেকে অন্যপাহাড়ে ছুটে চলেছিল । সাত-আট ঘন্টা পর বাসটি শোনপ্রয়াগে এসে থামে। ওই দিনটি সেখানেই কাটাতে হয় তাদের। মনোতোষ বাবুরা হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সেই রাতটি একটা হোটেলে কাটান। অচেনা জায়গা হওয়ায় কারোরই প্রথম প্রথম ঘুম আসছিল না। ঘন্টা দুয়েক পরে তারা তিন জনেই ঘুমিয়ে পড়েন। ১৫ই জুন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেড়ে হালকা কিছু খেয়ে পঞ্চাশ টাকা জনপ্রতি দিয়ে একটা গাড়ি করে পৌঁছান গৌরীকুন্ডে। এখান থেকে কেদারনাথ বাইশ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা। কোনো গাড়ির ব্যবস্থা নেই। ডুলি জনপ্রতি পনেরোশো টাকা ভাড়া। একেবারে মন্দিরে নিয়ে যাবে। এছাড়া ঘোড়ার ব্যবস্থা আছে। জনপ্রতি আঠারোশ টাকা ভাড়া। ফাটা থেকে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা ছিল। তারজন্য আগে থেকে ইন্টারনেটে টিকিট কাটতে হয়। যাওয়া-আশা মিলে ৫৫০০-৬০০০ টাকা পর্যন্ত পড়ে। অনেক সময় দিনের দিনও হেলিকপ্টারের টিকিট পাওয়া যায়, তার জন্য ভাড়া একটু বেশি লাগে। মনোতোষ বাবুরা দুটো ঘোড়া ভাড়া করে কেদারনাথের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাওয়ার সময় চারিপাশের অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে যান। ঘোড়ার পিঠে তারা সকলেই এই প্রথমবার চেপেছেন। ফলে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও করছিল খুব। সমতল হলে ততটা ভয়ের ছিল না, কিন্তু পাহাড়ি বন্ধুর রাস্তায় ঘোড়া একটু বেসামাল হলে তারা একেবারে খাদে। জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে না। ঘোড়ার মালিককে রমলা মুখোপাধ্যায় বলেন --- " দাদা ঘোড়া লাফ মারবে না তো? সুস্থ শরীরে কেদারনাথে পৌঁছাতে পারব তো? আমাদের খুব ভয় করছে।" তাঁর কথা শুনে ঘোড়ার মালিক আখতার আলি জানান -- "ম্যাডাম আপ টেনশন মত করিয়ে। ম্যায় ইধার বিশ শালোসে এ কাম কররাহাহু । কাভিভি এ্যায়সা নহি হুয়া। এ মেরা বহুত আচ্ছা ঘোড়া হ্যায়।" স্বপ্নময় বাবাকে বলে --- " বাবা দেখো দূর থেকে সূর্যটা কী ভালো লাগছে। পাহাড়ের গা ঘেষে উঠেছে। চারিদিকের সবুজ গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীটাই যেন সবুজ। " মনে মনে খুবই আনন্দ হচ্ছিল স্বপ্নময়ের। গতবছর কেদারনাথে আসার জন্য বাবাকে খুব জালিয়েছিল সে, কিন্তু বাবা ব্যস্ত থাকার কারনে আসতে পারেন নি। এবার স্বপ্নময়ের স্বপ্নপূরন হতে যাওয়ায় তার মনের মধ্যে অসাধারণ একটা অনুভুতি হচ্ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। স্বপ্নময়ের বাবা মনোতোষ মুখোপাধ্যায় শুধু ছেলেকে দেওয়া কথা রাখতে দশদিন অফিস ছুটি নিয়ে কেদারনাথে এসেছেন। নতুবা কাজের চাপে এবারও তার আসা হত না। বাড়ি ফিরে এই কদিনের জমে যাওয়া কাজগুলো তাকে অতিরিক্ত সময় নিয়ে করে দিতে হবে, নতুবা এরপর আর কখনো তিনি একদিনের বেশি ছুটি নিতে পারবেন না। ঘন্টা পাঁচেক পর তারা তিনজন কেদারনাথে পৌঁছেছিলেন। প্রকৃতির একটি উদাসীন রূপ তাদের চোখে পড়েছিল। কেদারনাথের কয়েক কিলোমিটার আগে পর্যন্ত প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সকলের চোখ জুড়িয়ে যায়। মনোতোষ মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল 'ঈশ্বর তাঁর সৌন্দর্যের অমৃতভান্ড থেকে সমস্ত সৌন্দর্য যেন গাড়োয়ালের এই জায়গায় ঢেলে দিয়েছেন।' কেদারনাথের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই দিন তারা তিনজন একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কেদারনাথে থেকে যান। হাত-পা ধুয়ে ছাতি নিয়ে কেদারনাথের মন্দিরে ঘুরতে যান। রমলা মুখোপাধ্যায় ও তার ছেলে আনন্দে ও উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে। কেদারনাথের মন্দিরে আসার ইচ্ছা তাদের অনেক দিনের। সেই ইচ্ছা অনেক অপেক্ষা ও কষ্টের পর পূরণ হওয়ায় এই প্রতিক্রিয়া। মহাদেবের আশীর্বাদ না থাকলে এই অসম্ভব সম্ভব হয় না। একঘন্টা মন্দির চত্বরে অতিবাহিত করে তারা হোটেলে ফিরে আসেন। রমলা দেবী মনোতোষ বাবুকে বলেন--- " আমার যে কী ভাল লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছে বাকি জীবনটা এখানে থেকে যাই।" পরদিন সকালে পুজো দিয়ে তাদের সকলের গৌরীকুন্ডে ফেরার জন্য যাত্রা করার কথা ছিল। গৌরীকুন্ড থেকে শোনপ্রয়াগ। সেই দিনটি শোনপ্রয়াগে কাটিয়ে পরদিন অর্থাৎ ১৬ই জুন বাসে ওঠার কথা ছিল। সেখান থেকে বাস বদ্রীনাথের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কিন্তু নিয়তি তাদের একবারের জন্যও বুঝতে দেয় নি আগামীকাল কি হতে চলেছে।
পরদিন ভোররাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। সকলে মনে করেছিলেন সাধারণ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। স্থানীয় মানুষজনও মহাপ্রলয়ের পূর্বাভাস পায় নি। তারা সকলে ছাতা ও বর্ষাতি নিয়ে তাদের কাজকর্ম করছিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে থাকে। জায়গায় জায়গায় জল জমতে থাকে। মনোতোষ বাবু ছেলে ও পত্নীকে নিয়ে ছাতি মাথায় দিয়ে জল ডিঙিয়ে কেদারনাথের মন্দিরের ভিতরে এসে আশ্রয় নেন। তিনি রমলা দেবীকে বলেন--- " হোটেলের থেকে আমাদের মন্দিরে থাকা বেশি ভালো হবে। বিপদ বলে আসে না। দিনের বেলা কেমন চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে দেখতে পারছ । মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।" তার কথা শেষ হতে না হতেই পাহাড়ের উপর থেকে হড়পা বান বিশাল উচ্চতা নিয়ে পাথরের বড় বড় খন্ডের সহিত কেদারনাথের দিকে ধেয়ে আসে । চারিপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় পাহাড়ে মহাপ্রলয় ঘটছে । মহাদেবের রুদ্ররূপের জাগরন ঘটেছে। বিদ্যুৎ চমকানি, মেঘের গর্জন, মানুষের চিৎকার সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। সমগ্ৰ পাহাড় যেন ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাসে কেঁপে উঠছে। প্রচন্ড জলোচ্ছ্বাসে কে কোথায় ছিটকে যায় তা টের পাওয়া যায় না। কেউ কেউ আবার মন্দিরের ঘন্টা ও দরজা ধরে বাঁচার চেষ্টায় ছিল। একটা বড় পাথর খন্ড মন্দিরের পিছনে এসে আটকে যায়। ফলে ওই পাথরের গায়ে হড়পা বানের জল লেগে দুপাশে ভাগ হয়ে যায়। নিজের প্রান বাঁচাতে তখন মানুষেরা অত্যন্ত তৎপর। অন্যের জীবনের চেয়ে নিজের জীবন বড় হয়ে ওঠে। মানবিকতার মৃত্যু ঘটেছিল তখন। জলের সঙ্গে ভেসে যায় রমলা মুখোপাধ্যায় ও তার ছেলে স্বপ্নময় মুখোপাধ্যায়। মনোতোষ মুখোপাধ্যায় কোনো প্রকারে মন্দিরের ঘন্টা ধরেই বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু খুবই খারাপ অবস্থা হয়েছিল তার। একটা সময় একজন ব্যক্তি নিজে বাঁচার জন্য তাকে জলের মধ্যে চুবিয়ে ধরেন। অনেক চেষ্টা করে তিনি জলের বাইরে মাথা বের করেন। আর কিছুক্ষণ জলের মধ্যে থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। মন্দির চত্বরে একব্যক্তি দুজন মৃত ব্যক্তির উপর দাঁড়িয়ে কোনোক্রমে জলের উপর মুখ বের করে মন্দিরের দরজা ধরে বেঁচে ছিলেন।
জল নেমে গেলে সর্বনাশের বহরখানা বোঝা গিয়েছিল। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। প্রিয়জন হারানোর ক্রন্দন। স্থানীয়মানুষ থেকে শুরু করে ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীদের মৃত্যুমিছিল। অসংখ্য মানুষের কোনো হদিস ছিল না। মনোতোষ মুখোপাধ্যায় তার পত্নী ও ছেলেকে না পেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন। চারিদিকে মৃতদেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তখনও পাহাড় থেকে জল নামছে, তবে মন্দিরের দুই পাশ থেকে। একটু সুরক্ষিত জায়গায় এসে তিনি দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর সেখানে হেলিকপ্টার আসে অবশিষ্ট মানুষদের উদ্ধারের জন্য। মনোতোষ মুখোপাধ্যায়ের মন না চাইলেও এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হেলিকপ্টারে ওঠেন অন্যান্যদের সঙ্গে। হেলিকপ্টার তাদের ফাটাতে নিয়ে আসে। তখন ছেলে-বউকে হারিয়ে তিনি রীতিমতো শোকস্তব্ধ। কিভাবে কি করবেন তিনি তা বুঝতে পারেন না। তবে রমলা ও স্বপ্নময়কে না নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরবেন না বলে মনোস্থির করেন। সারা দেশে মুহূর্তের মধ্যে এই ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধার কার্য চলে। উত্তরাঞ্চলের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জায়গায় জায়গায় ক্যাম্প খোলা হয়। টোলফ্রি নম্বর দেওয়া হয় যোগাযোগের জন্য। মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে গৌরীকুন্ড ও তার আশেপাশের কয়েকটি হাসপাতালে রাখা হয়। সেখানে মৃতদেহ চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করা হয়। অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা করে চোট অনুযায়ী রাখা হয়। সকলের চোখে -মুখে একরাশ হতাশার ছাপ । প্রিয়জন হারিয়ে বাড়ি গিয়ে কে কি বলবেন তা বুঝতে পারেন না। পাহাড়ের প্রায় সব হাসপাতালে মনোতোষ মুখোপাধ্যায় তার পত্নী ও ছেলে স্বপ্নময়কে খোঁজ করেন, কিন্তু খুঁজে পান নি। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রিয়জন হারিয়ে তিনি রীতিমতো দিশেহারা হয়ে যান। মনে মনে বাবা কেদারনাথের উদ্দেশ্য বলেন--- " হে প্রভু, তোমার এ কী লীলা খেলা!! তোমার দর্শনে এসে শেষমেষ আমি প্রিয় হারালাম। এ রকম দুর্যোগে আমার সংসার শেষ হয়ে গেল। তুমি ওদের রক্ষা করো। ওদের কিছু হলে তুমি আমাকেও নিয়ে নিও। ওরা ছাড়া আমার এ জীবনের কোনো মূল্য নেই।" এরপর খুবই কাঁদেন তিনি। হঠাৎ তাঁর সামনে থেকে কয়েকজন সেন্ট্রাল পুলিশ কিছু দর্শনার্থীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যে তিন-চার জন মৃত ছিল। দু-একজনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাদের মধ্যে তিনি তার ছেলেকে খুঁজে পান। ওর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তিনি পাগলের মতো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যান এবং একজন ডাক্তারকে বলেন তিনি ওই রুগীর বাবা। ডাক্তার তখন তাকে বলেন--- " এখনি আপনার ছেলেকে 'ও' নেগেটিভ রক্ত দিতে হবে, নতুবা বাঁচান যাবে না। আমাদের এখানে এই গ্ৰুপের রক্ত নেই। ওর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে।" মনোতোষ মুখোপাধ্যায় এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে রক্তের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। এক স্বেচ্ছাসেবী দলের মুসলিম সদস্যরও ছিল 'ও' নেগেটিভ রক্ত। তার অনুরোধে তিনি স্বপ্নময়কে রক্তদিয়ে প্রানে বাঁচান। চোখের জলে ওই মুসলিমকে জড়িয়ে ধরেন মনোতোষ বাবু। ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হতে দুসপ্তাহ সময় লেগেছিল। এই সময় তিনি পত্নী রমলা মুখোপাধ্যায়ের খোঁজ করেন, কিন্তু তাকে খুঁজে পান না। হরপার জল তাকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার হদিস দেওয়া খুব কঠিন বিষয়।
স্বপ্নময় সুস্থ হয়ে ওঠার পর একমাস ধরে বাবা ও ছেলে রমলা মুখোপাধ্যায়ের খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু তার হদিস পান নি। তাদের দুজনের চোখে-মুখে ছিল হতাশা ও যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ। শেষমেষ রমলা দেবীকে খুঁজে না পেয়ে নিরুপায় হয়ে দুজন কলকাতায় ফিরে আসেন। প্রিয়জনকে হারিয়ে এভাবে ফিরে আসা যে কতটা যন্ত্রনার তা তাদের দুজনকে দেখলেই বোঝা যায়।পাহাড়ের প্রলয় তাদের সুখী সংসারকে মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দেয়। এ জীবনে কার কোথায় নিয়তি তা মানুষের বোধগম্য নয়। মানুষ নিয়তি ও প্রকৃতির কাছে একেবারে অসহায়।
---------------------------------------------
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা।