সবিতার স্মৃতি
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
অবসর নিতে গোকুলবাবুর আর মাস দুই বাকি আছে। তারপর অবসরকালীন পাওনা গণ্ডা বুঝে পেতে যা একটু সময় লাগবে। সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে গেলে পুরানো ভিটে বাড়িটা বিক্রি করে চলে যাবে কলকাতায় ছেলের কাছে। ছোট ছেলে ওখানেই থাকে। চাকরি করে। বৌমাও স্কুল টিচার। বড় ছেলে দিল্লীতে আছে। একমাত্র মেয়ে পাঞ্জাবে।
ছেলে মেয়েরা অনেক দিন ধরেই বলছে বাড়িটার একটা সদগতি করতে। বহুদিনের পুরানো বাড়ি কবে ভেঙ্গে পড়ে কে জানে। বাড়ির শ্রী অনেক দিন আগেই গেছে। ছিঁটে ফোটা যা আছে পুরানো জমিদাড়ির একটা তকমা বহন করছে।
তবে বাড়িটা দেখার মতন। বড় বড় দালান। ছড়ানো উঠোন । চওড়া বারান্দা। খোলা ছাদ। ছাদের উপর চিলেকোঠাতে নোটন পায়রার সংসার। বাড়ির দুইদিকে সিঁড়ি। পিছনের সিঁড়ির পাশে একটা ছোট গাড়ি বারান্দা আছে। সামনের বাগানে ফল আর ফুলের গাছে ভর্তি। সারাদিন পাখিদের চিচির মিচির লেগেই থাকে।
গোকুলবাবুর দাদুর বাবার আমলের বাড়ি। বর্তমানে বাড়িতে একজন কাজের লোক আর রফিক থাকে। রফিক বহুদিন ধরে এ বাড়িতে আছে। আগে কেয়ার টেকার ছিল। উনি সম্প্রতি মারা গেছেন। এতবড় বাড়িতে গোকুলবাবু একাই থাকেন। সবিতা মারা যাবার পর থেকে আরো একা হয়ে গেছেন।
তবে ছুটিতে , পুজোতে ছেলেরা আসলে বাড়ি গম গম করে ওঠে। যেন চাঁদের হাট বসে। দুবছর হল ছেলেরা আসা ছেড়ে দিয়েছে। নাতি নাতনিদের পরীক্ষা। পড়া শোনার চাপ বেড়েছে। চাকরিতে প্রোমোশনের পর থেকে কাজের ব্যস্ততাও অনেক।
বেশ কিছু দিন ধরে একা অত বড় বাড়িতে গোকুলবাবু হাঁফিয়ে উঠেছেন। কাজের লোকটারও বয়স হচ্ছে। দুদিন অন্তর দেশের বাড়ি ডুব মারে। রফিকও শুনেছে দেশের বাড়ি চলে যাবে। সব কাজ নিজেকেই মাঝে মাঝে করতে হয়।
তাই সব দিক ভেবে বাড়ি বিক্রি করে চলে যবাার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভাল প্রোমোটার পাওয়া গেছে। দামটাও ভাল দেবে। বলেছে। কাজেই আপত্তি করার কোন কারণ থাকে না। ছেলেরাও রাজী। এক সাথে অনেক টাকা হাতে আসবে।
অফিস থেকে ফিরে এসে গোকুলবাবু বারান্দাতে এসে বসলেন। আজ ঊনি একা আছেন ঘরে। এক কাপ চা হাতে করে চেয়ারে বসলেন। আজ মশা একদম নেই। বাড়ি বিক্রি হবে শুনে মশার দল হয়ত ভাগতে বসেছে।
দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলেন। ঝিরঝিরে বাতাস ঘরে ঢুকছে। একটূ আগেই বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির সোঁদা গন্ধটা নাকে আসছে। আজ পুরানো স্মৃতি মনের মধ্যে বড্ড ঘুরপাক খাচ্ছে। সবিতার স্মৃতি। ওর টুকরো টুকরো কথা কানে বাজছে। বারো বছর হল সবিতা নেই। তবু একবারের জন্যে গোকুলবাবর মনে হয়না সবিথা নেই। সবিতা না থেকেও ওর উপস্থিতি সব সময় টের পান।
"কি বিশাল বড় বাড়ি তোমাদের। কত গুলো ঘর। আর কি পরিপাটি করে সাজানো।" সবিতা পাখার বাতাস করতে করতে বলল।
"আমার ঠাকুরদার বাবার আমলের বাড়ি। একটা সময় বহু গুণী মানুষ এ বাড়িতে পা রেখেছেন। রবি ঠাকুর , বঙ্কিম চন্দ্র , ঋষি অরবিন্দ, আরো অনেকে।" গোকুলবাবু পেপার থেকে মুখ তুলে বললেন।
"রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এ বাড়িতে ?" সবিতার চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করে।
"একটা সময় রীতি মতো সাহিত্য চর্চা হত। অনেক নামী দামী লোকের চরণ ধূলি পড়েছে। ইংরেজদেরও নাকি আনা গোনা ছিল। দোতলার ঘরে সাহেব মেমদের বহু ছবি আছে। উনাদের দেওয়া কিছু উপহারও আছে।"
"সত্যি বলছ ?"
"একদম। একটা নাচ মহল ছিল। সেখানে নাচ গানের আসর বসত। এখন ওটার জরা জীর্ণ অবস্থা। তবে আমার দাদা মশাই আর উনার বাবা বেশ চাপা স্বভাবের ছিলেন। তাই এ বাড়ির গৌরব লোকেদের অনেকটাই অজানা।"
সবিতার কথা ভাবলে গোকুলবাবুর চোখ টস টস করে ওঠে। বার বার অতীতকে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে। এই ফিরে দেখার মধ্যে একটা নির্মল আনন্দ আছে।
গোকুলবাবুর মনে আছে এত বড় বাড়ির বৌ হয়েও সবিতা খুব ছিমছাম ছিল। একেবারে সাধারণ যাকে বলে। কোন দিন মুখ তুলে কথা বলেনি। একটা সময় এখানে যৌথ পরিবারের বাস ছিল। পরে আসতে আসতে সব ফিকে হতে থাকে। পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্য অকালে মারা যান। বংশরক্ষার তেমন কেউ ছিল না। একমাত্র শিব রাত্রির সলতে গোকুলবাবু শেষ বংশধর। টিম টিম করছে। বাকি সদস্যের অনেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
দুদিন হল গোকুলবাবু অবসর নিয়েছেন। আর কদিন পরেই বাড়ি বিক্রি করে চলে যেতে হবে। মনটা খারাপ হলেও কিছু করার নেই। জীবনের বাস্তবকে মেনে নিতে হবে।
বিকেলে দীঘির পাড় থেকে ফিরে এসেই আবার বারান্দাতে বসলেন। বারান্দা চাঁদের রূপালী আলোতে মেখে রয়েছে। অনেক স্মৃতি ভাসছে। মনের মধ্যে। তারা সমস্বরে হৃদয়ে মাদল বাজাচ্ছে।
হাতে আর দু সপ্তাহ আছে। প্রোমোটারের সাথে ফাইনাল ডিল এখনও হয়নি। পনেরোই আগষ্টের দিন দুই ছেলেই আসছে ডিল পাকা করতে। তার আগে একবার বাড়ির মাপ যোগ হবে। তারপরেই......
গোকুলবাবুর পুরানো ঘটনা ফিরে ফিরে আসছে। ফিরে দেখতে স্বাদ জাগছে হারিয়ে যাওয়া লুপ্ত অতীতকে। অনেক ঘটনা। গা শিউরে উঠছে।
বেল গাছ থেকে ছোট ছেলেটা একবার ঘুরি ধরতে পড়ে গিয়েছিল। মনে আছে। মনে পড়ছে বৈঠক খানা ঘরে মেয়ের নাচের অনুষ্ঠান। কত লোক এসেছিল নাচ দেখতে। বড় ছেলের বন্ধুদের নিয়ে খোশ গল্প। নাটকের সংলাপ বলা। ছুটির দিনে সবিতা বারান্দাতে বসে সুর করে পাঁচালী পড়ত।
গোকুলবাবুর মনে আছে উঠোনে দুর্গা পুজো দেখতে জাতি ধর্ম নির্বিবেশে বহূ মানুষের সমাগম হত। পূজোর সব কাজ সবিতা একা হাতে করত। পুজোটা আর হয় না। এখন পাড়ার ছেলেরাই ওটা করে। খরচ গোকুলবাবুই দেন।
সন্ধ্যের পরে গোকুলবাবু ভিজে চোখে সবিতার ঘরে ঢুকল। ঘরটা আগের মতন আছে। সব নিপুনভাবে গোছানো। শুধু মানুষটা না থেকেও যেন আছে।
বিয়ের সময় সবিতার বাড়ি থেকে বলেছিল একটা বড় শোকেস দেবে। গোকুলবাবুর বই রাখার জন্যে। দেয়নি। বদলে একটা ট্রাঙ্ক দিয়েছিল। সেখানে অনেক টুকি টাকি জিনিস আছে।
গোকুলবাবূ ট্রাঙ্কটা খুলল। বহুদিন পরে। সবিতার গায়ের মোলায়েম গন্ধটা যেন ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে। আর বেরিয়েই গোকুলবাবুর পাঞ্জাবীতে দোল খাচ্ছে। একটা সবিতার ব্যবহারের শাড়ি। নজরে পড়ল। শাড়িটা বুকে ধরে গোকুলবাবু একটা ঘন শ্বাস নিল। দূ ফোটা জল চোখ থেকে শাড়িতে পড়ল।
দু সপ্থাহ কেটেছে। ছেলেরা এসেছে। বাড়ি বিক্রি ফাইনাল করতে। রাত পোহালেই সব শেষ। বাড়িটা প্রোমোটার আদিত্য সিনহার দছলে চলে যাবে।
গোকুলবাবুর চোখে ঘুম নেই। বাথরুমে যেতেই ছেলেদের আলোচনা কানে এল।
"শোন , বাবাকে কলকাতায় তোর ফ্ল্যাটে রাখার দরকার নেই। তার চেয়ে ভাল কদিন তোর বাসায় রেখে একটা ভাল বৃদ্ধাবাসে বাবাকে পাঠিয়ে দে। তোর বাসাতেও তো একা থাকবে।" বড় ছেলে বলল।
"আমি সেটাই তো বলছি। মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবে আমাদের।" ছোট বৌমা বলল।
"তাছাড়া বাবার শরীরের যা অবস্থা। তাতে তোদের পক্ষে দেখা করা সম্ভব নয়। তোরা সারাদিন অফিসেই থাকিস।"
"ঠিক কথা।"
সকাল হতেই প্রোমোটার এসে হাজির। সাথে উকিল।
গোকুলবাবু উনাদের দেখেই তোপ দাগলেন , "আদিত্যবাবু আমি মত পরিবর্তন করেছি। এ বাড়ি আমি বিক্রি করছি না।"
"তাহলে ?"
"এ বাড়ির আনাচে কানাচে সবিতার স্মৃতি ভেসে আসে। ওকে আমি চাক্ষুষ দেখতে পাই। আমার অবর্তমানে এই বাড়িতে দুঃস্থদের স্কুল হবে। আর উকিলবাবু আপনি দলিলটা সেই ভাবেই তৈরী করবেন।" বলেই গোকুলবাবু মুচকে হাসলেন।
--------------------------------------------------------
Address: 85, Kalibari Road, Nalta
Near Air Port Auto Stand
PO: Italgachha
Kolkata -28
North 24 Parganas