কেউ কি ছিল!
সুস্মিতা পাল
আর একটু হলেই বলটা দুম করে মাথায় লাগত। আমি ঘরের মধ্যে টেবিলে বসে পড়ছিলাম।, দুদিন পরেই ফার্স্ট ইয়ারের সেমেস্টার ।বইয়ের মধ্যে প্রায় ডুবে গেছি, এমন সময় বলটা তীরের গতিতে কপালের পাশ ঘেঁষে ছুটে গেল।রিফ্লেক্স অ্যাকশনে মাথাটা সরিয়ে না নিলে একটা অঘটন ঘটে যেত।এত বিরক্ত লাগে না! চোখ তুলতেই দেখতে পেলাম শ্রীমানকে।যথারীতি বারান্দায় বল নিয়ে প্র্যাকটিশ করে চলেছে।একটা জোরালো শট বোধহয় বেহিসাবী হয়ে ঘরে হানা দিযেছে।বলটার সঙ্গে একদলা বিরক্তি ছুঁড়ে ফেললাম।একটু থতমত ভাব নিয়ে সরে গেল মূর্তিমান।
এটা ঋজুদার গল্প। আমার জীবনের এমন একটা ঘটনা যার ব্যাখ্যা আমি নিজে অখবা অন্য কেউ আজও বুঝে উঠতে পারিনি। মেঘ যেমন চাঁদকে ঢেকে দেয়, তেমনি অলৌকিক কি এক ব্যঞ্জনা ঘিরে রয়েছে এতে। তোমরা শুনে দ্যাখো, কিছু বুঝতে পারো কিনা। ঋজুদাকে আমি চিনেছি অনেকটা বড় বয়সে। তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি। তার কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে একটা কালো ছায়া দুম করে ঢুকে পড়ল। খুড়তুতো বোনের একটা কঠিন অসুখ ধরা পড়ল।সে যেন এক অন্ধকার টানেল। সবাই মিলে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছি, কিন্তু আলোর দেখা নেই।অর্থ, মানসিক ও শারীরিক শক্তি - সব ক্ষয় করতে করতে দু বছরের কঠিন লড়াই ব্যর্থ করে দিয়ে বোন সবাইকে কাঁদিয়ে চিরকালের মতো চলে গেল। কাকু কাকিমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছো। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপারা দশা।কিছুতেই নিজেদের সামলাতে পারছেন না, অকূল সমুদ্রে বেহাল নৌকোর মতো হাবুডুবু খাচ্ছেন।ঠিক তখনই কাকিমার এক দূর সম্পর্কের ভাইপো কোলকাতায় চাকরির খোঁজে এল।উদ্দেশ্য ছিল থাকাখাওয়ার আস্তানা সন্ধানে কাকুর সাহায্য নেওয়া, কিন্তু ডুবন্ত নাবিকের মতো সন্তানহারা দম্পতি ঋজুদাকে আঁকড়ে ধরলেন। নিজেদের কাছেই তাকে রেখে দিলেন, ঋজুদার বাবা মাও তাতে স্বস্তি পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
চিনলাম ঋজুদাকে, মজার মানুষ। সবসময় হাসিমুখ। সবার দরকারে এক পায়ে খাড়া। তবে বয়সের তুলনায় কিছুটা যেন অপরিণত। এই যেমন যখন তখন বাড়ির মধ্যেই ফুটবল খেলা, হৈচৈ করা। সেদিন যেমন পরীক্ষার আগে পড়ছি, বলটা নিয়ে খেলা চলছেই। আরে বাবা, ডিস্টার্ব হচ্ছে বুঝবে তো। শেষমেশ ব্যথা পেতে পেতে বাঁচলাম বলে রণে ভঙ্গ দিল। বাঁচোয়া। কাকু কাকিমা ওকে পেয়ে একটু যেন সামলে উঠলেন। বাড়ির সবাই সামান্য হলেও স্বস্তি পেল।
" কি গো ঋজুদা, আজ চুপচাপ বসে যে?"সেদিন বিকালে চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলাম। এখানে আসার পরে ঋজুদা একটা কম্পিউটার কোর্স জয়েন করেছে চাকরি পেতে সুবিধা হবে বলে। ও যে দূর শহরতলীতে থাকত সেখানে এসব সুযোগ কম।
"আর বলিস না। কি যে মাথা ব্যথা করছে। "
"তোমার মাইগ্রেন আছে নাকি?"
" গ্রেন টেন জানি না, তবে পেইন যা হচ্ছে কি বলব। কিছুদিন হলো এই এক ঝামেলা জুটেছে। এত যন্ত্রণা হয় না রে।"
" একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও।" বলে আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম।
কে জানত যে ঐ ব্যথা হলো আর এক ঝড়ের পূর্বাভাস। এরপর মাঝে মাঝেই , তারপর ঘনঘন হানা দিতে লাগল। ডাক্তারের কাছে বাধ্য হয়েই যেতে হলো। সামান্য ব্যাপার। হালকা ওষুধ আর প্রতিদিনের রুটিনে সামান্য রদবদল- চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে কারোরই মনে হয়নি।চোখটাও পরীক্ষা করে নিতে হলো । ঋজুদা খুব বই পড়ত, বিশেষ করে গল্পের ।আমার থেকে চেয়ে নিত , তারপর পড়ে ফেরত দিত।ঋজুদার স্বভাবে আলগা লেগে থাকত এক গ্রাম্যতা, তাই শহুরে মানুষেরা সবাই যে তাকে খুব একটা মান্যতা দিত, তা নয়। তবে পড়ার এই নেশাটা আমার সঙ্গে খুব ভালো মিলে যেত বলে কোথাও একটা পাত্তা দেওয়ার ব্যাপার কাজ করত। বই পড়ত বলেই ঋজুদার নিজস্ব কিছু ভাবনা ছিল, ইচ্ছে ছিল-বুঝতাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই গোলমালটা টের পেলাম। বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। সারা রাত নাকি ঋজুদা বমি করেছে, সঙ্গে অসহ্য মাথা ব্যথা। এবার তো হাসপাতাল ছা়ড়া উপায় নেই কোনো। ভর্তি করা হোলো, ঋজুদার বাবা মা এলেন। জানা গেল সেই অমোঘ ভয়ঙ্কর সত্যি- ব্রেন টিউমার।কাকু কাকিমা ভেবেছিলেন ওকে জড়িয়ে বাঁচবেন, ঋজুদাও হয়তো । কিন্তু ভবিষ্যতটা অন্যপথে বেঁকে গেল, যার শেষপ্রান্তে ঘন আঁধার।বাড়ি ফিরে এল ঋজুদা, চিকিৎসার সুবিধার জন্য আপাতত কোলকাতাতেই রইল। কিন্তু আমূল বদলে গেল প্রাণবন্ত ছেলেটা।কখনো চিৎকার করে কেঁদে উঠত,কখনো ডুবে যেত গভীর গহন ঘুমে।এক একটা সময় এমন পরিস্থিতি আসে যে চারপাশে কিছু মানুষ হাত ধরে টেনে তুলতে চাইলেও মানুষ ডুবতে থাকে।হাতড়ে বেড়ায় অবলম্বন।
সেদিনটা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম সবাই। ফাঁকা বাড়ি। কাকু শুধু বাড়িতে ছিলেন। তখনও আসল ট্রিটমেন্ট শুরু হয়নি। ওষুধের এফেক্টে প্রায় সারাদিনই ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকত ঋজুদা।ঘুমন্ত এক ঝলক রোদ্দুরের মতো দেখাত তাকে, যে রোদ্দুরের তেজ কমছে, নিভু নিভু।বিকোলে কাকু অভ্যাসমতো হাঁটতে গিয়েছিলেন। ঘরে শুয়ে ছিল ঋজুদা, কাকু বলেই বেরিয়েছিলেন। এমনিতে সুস্থই ছিল সেদিন। কাকু যখন ফিরলেন, সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে।চারপাশে এমন একটা ধূপছায়া রঙা কালো রং যাতে সামনে কেউ থাকলে আবছা অবয়বটুকু আন্দাজ করা যায়, কিন্তু চেনা যায় না। চাবি দিয়ে দরজা খুলে কাকু ঘরে ঢুকে ঋজুদাকে অভ্যাসমতো ডাকতে গিয়ে সাড়া না পেয়ে ভিতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখতে পান। ফ্যানের আংটা থেকে গলায় দড়ি দিয়ে নিষ্প্রাণ ঋজুদার ঝুলন্ত দেহ। পরিবারের দুশ্চিন্তা আর আর্থিক ব্যয় থেকে মুক্তির উপায় বেছে নিয়েছে।
কেটে গেল দিনরাত নিজের নিয়মে।সবকিছুই চলতে লাগল, স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে না পেলেও।সেদিন একটা বই খুঁজে না পেয়ে বা়ড়ি তোলপাড় করার পর মনে পড়ল ঋজুদা নিয়েছিল পড়বে বলে। তারপর অসুখের ঝামেলায় ভুলেই গিয়েছিলাম।কাকিমাকে বলে ঘরটাতে খুঁজেও পেলাম না। মনটা খুঁতখুঁত করলেও কলেজে গিয়ে ভুলতে সময় লাগল না।
সন্ধ্যায় টিউশন সেরে ফিরছি। বাড়িতে পৌঁছনোর আগে একটা লম্বা রাস্তা পার হতে হয়। দুপাশে বেশ গাছপালা, একটু নির্জন।হাঁটছিলাম নিজের মনে, কেনো অস্বস্তি ছিটেফোঁটাও ছিল না কোথাও। বাড়ির কিছুটা আগে যখন দূরে দেখা যাচ্ছে গেটটা, ঝপ করে ঋজুদার কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো , আমি যেন পিছনে কার পায়ের আওয়াজ পেলাম।কেউ কি ডাকল! অনেক কষ্টে পিছন ফিরেও কাউকে দেখতে পেলাম না। হঠাৎ কি যেন এক ভার চেপে ধরল আমাকে, পা টা যেন ইঁটের মতো ভারি। হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না। কেমন যেন স্বপ্নের মতো ঘোরে ডুবে যাচ্ছি মনে হলো।সামনের পথটুকুকে মনে হচ্ছে অনন্ত । হাত পা কেমন হিম হয়ে আসতে লাগল।ব্যাগটা হাত থেকে আলগা হয়ে পড়ে গেল। নাকি কেউ টেনে নিল, বোঝার ক্ষমতা ছিল না।মনে হলো আকাশছোঁয়া এক অনন্ত শূন্য প্রান্তরের যাত্রী আমি। স্বপ্নের মতো হাওয়ায় ভেসে এল সাইকেলের ঘন্টির ক্রিং ক্রিং। একজন পথচলতি মানুষের দেখা পেয়ে এতক্ষণে যেন সাড় ফিপে এল। লোকটি আমাকে দেখে অবাক হয়ে কি হয়েছে জানতে চেয়ে ব্যাগটা তুলে হাতে দিলেন।আমি কিচ্ছুটি না ভেবে একদৌড়ে রাস্তাটুকু পার হয়ে গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে সবার গলা শুনে , আলো দেখে একটু ধাতস্থ হলাম। মা পরে সব শুনে বলেছিলেন , অপঘাতে মৃত্যু ঘটলে সেখানে ব্যাখ্যাহীন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। বহুদিন পর্যন্ত আমি ঐ রাস্তায় রাতে একা যেতাম না।
বাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করা হলো। তবে কারো সঙ্গেই কিন্তু অপ্রীতিকর কিছু ঘটে নি। এতদিন পরে আর ঋজুদাকে তেমন মনেও পড়ে না। মনে হয় , এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় সবকিছু? এমনটাই হয়ে থাকে চিরকাল? আমিও কি এভাবেই কখনো সবার কাছে নেই হয়ে যাব? উত্তর মেলে না। শুধু একটা কথা বলা বাকি রয়ে গেল। সেই বইটা আমি পরদিন আমার কলেজের ব্যাগটায় খুঁজে পেয়েছিলাম। যেটা সেই রাতে হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। হলফ করে বলতে পারি , পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বইটা ব্যাগে ছিল না।
-------------*----------
সুস্মিতা পাল।
৩৪,আর্য্য বিদ্যালয় রোড
কোলকাতা।