বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

ছোটগল্পঃ স্বস্তির শ্বাস ।। দীনেশ সরকার



ছবি - সংগৃহিত


   স্বস্তির শ্বাস

দীনেশ সরকার

 

 

               ভবানীবাবু শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন। কিছুতেই আর ঘুম আসছে না। একটা চাপা টেনশন মনটাকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে। উঠে বসলেন। সুমনা পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ভবানীবাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল সুমনার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। হাত বাড়িয়েও হাতটা সরিয়ে নিলেন পাছে সুমনার ঘুম ভেঙে যায়। বেচারীর কাল যা ধকল গেছে। ও আর একটু ঘুমাক। আজ আবার ছুটতে হবে। কালকের ড্রাইভারকে ঠিক আটটার সময় গাড়ি নিয়ে আসতে বলা আছে। ঠিক আটটাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এই মফসসল শহর থেকে গাড়িতে করে কলকাতার বাই-পাসের ধারের হাসপাতালে পৌঁছুতে আড়াই-তিন ঘন্টা লেগে যায়। তারপর গতকালের রিপোর্টগুলো কালেক্ট করে বারোটার সময় ডাক্তার দেখাতে হবে। ভবানীবাবু উঠে পড়লেন। ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে চারটে বাজে। অন্য দিন সাড়ে পাঁচটায় উঠে মর্ণিংওয়াকে বের হতেন। আজ আর মর্ণিংওয়াক হবে না। কিন্তু শুতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। চেয়ারে বসলেন।   

             যে মানুষটা দীর্ঘ ৩৫টা বছর মাথা উঁচু করে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। কোনদিন কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি, বরং বলা যায় কোন চাপ তার মনে প্রভাব ফেলতে পারেনি, অবসর গ্রহনের আঠারো বছর পর আজ সেই মন এক অজানা আশঙ্কার চাপে তোলপাড় হচ্ছে। বার-বার মনে হচ্ছে সুমনার বায়োপসি রিপোর্ট নিগেটিভ আসবে তো! আর নিগেটিভ না হয়ে, যদি পজেটিভ হয় মানে টিউমারটা যদি ম্যালিগন্যান্ট হয় অর্থাৎ যদি ক্যান্সার হয় তখন তিনি কি করবেন! এই আটাত্তর বছর বয়সে তিনি চিকিৎসার জন্য সুমনাকে কোথায় নিয়ে যাবেন, কিভাবে চিকিৎসা করাবেন! এই সব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে ভবানীবাবু ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন।    

             যে মানুষটা সারাজীবন নিজের কর্মের উপর বিশ্বাস রেখেছেন, নিজের কর্মফলকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, কোনদিন কোন মন্দির-মসজিদ-গুরুদোয়ারা-চার্চে মাথা ঠেকাননি, সেই তিনি আজ ভোর না হতেই স্নান সেরে সুমনার ঠাকুরঘরে ঢুকে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন, 'হে ঠাকুর, সুমনার বায়োপসি রিপোর্ট যেন নিগেটিভ আসে। এই বৃদ্ধবয়সে আমাকে যেন বেশী দৌড়ঝাঁপ না করতে হয়। তুমি দেখো ঠাকুর - - - '

             সুমনা ঘুম থেকে উঠে ভবানীবাবুকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তার ঠাকুরঘরের দরজা খোলা দেখে পায়ে পায়ে এসে ঠাকুরঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। চমকে উঠলেন। মানুষটা তো এতটা দুর্বল নয়। আজ তার কি হল! ঠাকুরের কাছে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছেন। সুমনা সরে এসে স্নান করতে ঢুকলেন।  

             রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে জানলেন, রিপোর্টের সফট কপি ডাক্তারবাবুর ল্যাবটপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর হার্ড কপি আজ বিকেল চারটের পরে পাওয়া যাবে। সুমনার ফাইলটা জমা দিয়ে ডাক্তারবাবুর চেম্বারের সামনে অন্যান্য রোগীদের সাথে সুমনা আর ভবানীবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভবানীবাবুর পার্লস বিট দ্রুত ওঠানামা করছে। চাপা উত্তেজনায় ফ্যানের নীচে বসেও দরদর করে ঘামছেন। বারবার ভাবছেন সুমনার বায়োপসি রিপোর্ট নিগেটিভ হবে তো। মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি থাকে কানাডার মন্ট্রিলে। সুমনার অসুস্থতার খবর তাদের  জানান হয়নি। মাস দুয়েক আগে তারা এসেছিল। ভবানীবাবু আর সুমনার ৫০তম বিবাহবার্ষিকী সেলিব্রেট করে গেছে। এখন খবর পেলেও তারা আর আসতে পারবে না। শুধু-শুধু টেনশন করবে। তাই ভবানীবাবু মেয়ে-জামাইকে খবরটা জানাননি। কিন্তু রিপোর্ট যদি খারাপ হয় তখন তো মেয়ে-জামাইকে জানাতেই হবে। তখন কি হবে! ভবানীবাবু আর ভাবতে পারছেন না।

             সুমনা বেরার নাম ডাকতেই সুমনাকে নিয়ে দুরুদুরু বুকে ভবানীবাবু ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঢুকলেন। হার্টবিট দ্রুত ওঠানামা করছে, দরদর করে ঘামছেন। ডাক্তারবাবু তার ল্যাবটপে সুমনার রিপোর্টগুলো একমনে দেখছেন। তারপর ভবানীবাবুর দিকে ফিরে বললেন, 'এ কি মিস্টার বেরা! আপনি ঘামছেন কেন? শান্ত হয়ে বসুন। শুনুন মিস্টার বেরা, সুমনাদেবীর রিপোর্টগুলো আমি খুব ভালো করে দেখেছি, ভয়ের কিছু নেই। বায়োপসি রিপোর্ট নিগেটিভ তাই অপারেশনে কোন ঝুঁকি নেই। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। সময় সুযোগমতো অপারেশনটা করিয়ে নেবেন। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি, এখন এগুলোই চলবে।

             ভবানীবাবুর বুক থেকে একটা স্বস্তির শ্বাস উঠে এল। যিনি কোনদিন কোন ঠাকুর-দেবতার উপরে আস্থা রাখেন নি, তিনি মনে মনে আর একবার ঠাকুরকে স্মরণ করলেন।

 

                                                      *******************************************************************************************

 

 

 

দীনেশ সরকার

১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,

প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ---- ৭২১৩০৬

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.