রডোডেনড্রনের দেশ থেকে
জয়শ্রী ব্যানার্জি
ঋতুরাজ্ঞী চক্রবর্তী
সিকিম
১৭ মার্চ থেকে ২৩মার্চ ২০২৩
১৭ মার্চ রাত ১১ রাতের ট্রেন ..
প্রিয় অরণ্য,
রডোডেনড্রনের চিঠি
আমি রেলগাড়িতে ছুটি..,
তোমার খুব চেনা রিং টোন
আমার উড়নচণ্ডী মন !
আমার ঘুম ঘুম দুই চোখ ,
আজ রোদ্দুর মেঘ ঝড় বৃষ্টি যা হবার তাই হোক ..!
তোমার ক্যামেরার ওই রূপকথা ..
আমার ম্যাগাজিনের খোলা পাতা !
তুমি বৃষ্টি বাস মেখো,
.আমার গল্পে প্লিজ থেকো !
তুমি বোঝো বড়ো কম ,
আমার ভালোবাসা ডট কম।
তুমি রোদ রঞ্জন ওই পাহাড় দেশে..
আমি তিস্তা হয়ে তোমার পাশে ।
১৮ মার্চ বিকাল ৩:৩০
অবশেষে বর্ধমান থেকে দার্জিলিং মেলে এই মুহূর্তে আমি রডোডেনড্রনের দেশে । এসেছি আমার প্রিয়র সাথে দেখা করতে । আচ্ছা রডোডেনড্রন কি পুরুষ না মহিলা ফুল ? তোমার কি মনে হয় ?যদি পুরুষ হয় তাহলে সে প্রিয়জন হোক আর যদি মহিলা হয় প্রিয় সখী মোর ।
গ্যাংটকে পৌঁছেই দেখি ঝিরঝিরে বৃষ্টি । শীত করা ঠান্ডা হাওয়া তো আছেই সাথে .. যাক কিছুদিন অন্তত বর্ধমান কলকাতার নাজেহাল করা গরম থেকে ছুটি । এখানে সান মাউন্ট হোটেলের ব্যালকনি থেকে অদূরের পাহাড়গুলোকে বৃষ্টিতে কেমন আবছা ঝাপসা লাগছে .. গ্যাংটকের বৃষ্টিতে অভ্যস্ত কিছু মানুষ যাচ্ছে আসছে। কেউ বা ছাতা নিয়ে কেউ বা রেনকোট পড়ে ......সামনেই রেস্টুরেন্ট স্পা সেন্টার ,পাহাড়ী ধাপে ধাপে বেশির ভাগ কাঠ এর কোনোটা সিমেন্টের ছোট ছোট বাড়ি । লাগোয়া বারান্দায় ঝুলন্ত টবে আইভিলতার ঝাড়, কোথাও অর্কিড,কাঠের বারান্দা ঘেঁষা গোলাপী বোগেনভিলিয়া. কবিগুরু বোধায় এরই নাম বাগান বিলাস দিয়েছেন ,আরও সব আপাতত নাম না জানা লাল নীল হলদে বেগুনি ফুল ।....না এখনও আমার প্রিয় রডোডেনড্রনদের এর দেখা পাইনি । আমি তার জন্য প্রতীক্ষারতা ।
ভীষণ ভালো লাগছে বৃষ্টির এই বিকালবেলা । কিন্তু এই রডোডেনড্রন আর বৃষ্টির দেশে কোনো একজনকে খুব মিস করছি এখন এই মুহূর্তে ..
এই অরণ্য বৃষ্টি কি তুমি পাঠালে ? যাতে তোমায় ভুলে না যাই ...! তাই সারাক্ষণ বৃষ্টি হয়ে সাথে থাকবে বুঝি ? তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই ....!
আশা করি সংবাদ সব কুশল তোমার । লাস্ট চিঠিতে জানিয়েছিলে তুমি হালকা জ্বর সর্দি কাশি হাঁচিতে একটু কাবু ।এখন ঠিক আছো তো ? আর তোমার পিঠে ব্যথা? তিনি কি এখনও পিঠে অধিষ্ঠান করে আছেন? কি করছো গো?
ঘুম ঘুম আসছে হাই উঠছে আমার !। ডিমের ঝোল স্যালাড ভাত আর আলুভাজা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরেছি। সেই জলপাই গুড়িতে লুচি আলুরদম ডিমভাজা মিষ্টি খেয়েছিলাম । বাসে বমির ভয়ে কিছু আর খাইনি। জোয়ান লবঙ্গ চিবোতে চিবোতে এসেছি । ইরাদিকে বলেছিলাম দিদি তোমায় বর্ধমানে কার্জন গেটের কাছে রামপ্রসাদের স্পেশাল লস্যি খাওয়াবো , জানালার দিকে সিট পেলে আমায় দিও প্লীজ ।শেষে কোথায় কি সবাই হুড়মুড়িয়ে বাসে সিট ধরে নিলো । আর আমরা অগত্যা পিছন দিকে ! ইরাদি এত দেরি করে খায় ! কি বলবো !
দিদি তো লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েই গেলো বোধায় ।পাশের রুমে দীপিকাদি আর সুতপা। বাকিদের মধ্যে একটা দল আমার পাড়ার, অন্যরা অচেনা আলাপ হয়নি এখনো ,সন্ধ্যেয় বৃষ্টি থামলে বেরিয়ে আসবো কাছে কোথাও ,পিঠের ব্যথার কেয়ার নিও আর তোমার প্রিয় চা খেয়ে এনার্জি নিও কাজে ।মন ভালো রেখো কেমন ! এখন এই টুকু টা টা ..!
রাত ১০ ..
খেয়ে এসে সোজা বিছানায় । সেই তোমায় চিঠি লিখে কি ঘুম ঘুমিয়েছি আমি আর ইরাদি ! ঘুম ভাঙে ৬ তখন । দীপিকারদির ডাকে । একদম সামনে একটা রেস্টুরেন্টে আমরা মোমো খেতে গেছিলাম । চারজনের একটু আড্ডা ।
ইরাদি এত মজার মজার কথা বলে ! ওকে ছাড়া ঠিক জমে না । হেডমিস্ট্রেস দীপিকাদি বরাবর কম কথা বলেন । শান্ত প্রকৃতির। স্কুলে গম্ভীর কিন্তু বেড়াতে এসে সবার সাথেই মিশে যান । আর সুতপা তো তার সাজগোজেই ব্যস্ত। পুরো বি.বি.সি চ্যানেল । আমার ফোনের ওপরে খুব কৌতূহল বুঝলে তো! যতই কথা বলুক চোখ কিন্তু ঠিক ঘুরে ফিরে আমার ডায়েরি তে ।
সন্ধ্যেয় ছাতা নিয়েই বেড়িয়েছিলাম। বৃষ্টি এখনও হচ্ছে । রাত ভর চলবে .. গ্যাংটকের বৃষ্টি ! কি করছো জানিনা এখন তুমি! লিখছো কিংবা তোমার ছবির কাজ চলছে হয়তো । বেশ ! কাজ শেষ করে ঘুমোতে যেও । শুভ রাত্রি গো !
১৯ই মার্চ সকাল ৭
কথা হয়েছিল বেড়াতে বেড়িয়ে নো মেসেজ নো ফোন। শুধু চিঠি লিখব রোজ একটু একটু করে বর্ণনা দিয়ে, আর তুমি সেই পুরো চিঠি একসাথে পড়বে। কিন্তু তাই বলে শরীর খারাপ ঠিক হয়েছে কিনা জাস্ট একটু তো জানাতে পারতে! মন খারাপ সারাদিন । কারণ দেখলাম । সেটা স্ট্যাটাসে দিতে পারছ তো ! জানি আমায় বন্ধু ভাবো না যেমন আমি ভাবি, তাই শেয়ার করো না আমার সাথে এত , অন্যদের বা অন্য কাউকে বলো । আমি হয়তো তেমন যোগ্য না ..!
সকাল ৮:৩০
লাচুং যাবো । ব্যাগ গোছানো রেডি । ব্যালকনি তে এলাম । সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি একটানা .. রাস্তায় লোক জন । সামনের বাড়ি গুলোয় বাসিন্দারা রোজকার কাজে রত। স্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা । হালকা ঝাপটা আসছে । জ্যাকেটে এসে লাগছে ।
ব্রেড ডিম কলা চা দিয়ে আজকের ব্রেকফাস্ট সারা হলো । গাড়ী আসতে বোধায় ১১ টা হয়ে যাবে। শুনছি লাঞ্চ সেরে বেরোনো । কাল রাতে খিচুড়ি হয়েছিল । সাথে ডিম ভাজা আলু ভাজা আর বেগনি । স্বাদ দারুন ছিল খিচুড়ির।
১৮ ই মার্চ বেলা ১২
"ধরা দিল কেউ অল্প চাওয়াতে ... উড়ে গেলো কিছু গল্প হাওয়াতে .. অকারণে আমি অল্প আঘাতে হচ্ছি অভিমানী ..."
না, তোমায় বলছি না; গাড়িতে গান হচ্ছে । কেউ বোধায় ফোনে চালিয়েছে। তুমি তো ধরা দেবে না জানি । বসে আছি এখনো গাড়ি ছাড়েনি । সাইট সিন দেখতে দেখতে লাচুং যাবো আজ ।হয়তো রাত ৮ কি ৯ বেজে যাবে ।
এখন রাখছি সুতপা পাশে বসে, চিঠির দিকে চোখ জানি ওর ।
বেলা ১:৩০
বাঃ, অপূর্ব ! সত্যি প্রকৃতি কি সুন্দর হয় !তার ন্যাচারাল বিউটি । গাড়ী ছুটছিল আর যেদিকে তাকাই পাহাড় জুড়ে আমার রডোডেনড্রন । রোদরঞ্জন. ! আর তার পাশে বয়ে যাচ্ছে মন খারাপের তিস্তা ।
ধরো তুমি এই রডোডেনড্রন বাংলায় যার কাব্যিক নাম রোদরঞ্জন আর আমি এই বয়ে চলা মন খারাপের তিস্তা।
তোমার সাথে হয়না দেখা
তবুও তুমি সঙ্গে থাকো ,
যেমন করে একলা নদীর
বন্ধু থাকে ভাঙা সাঁকো!
আমার গল্পে তুমি থাকো রোজ
তোমার গল্পে আমি হয়তো বা না
কতটা কাছের কতটা দূরের
তুমি জানো আর বৃষ্টিরা!
আচ্ছা যাও রাগ নেই আমার । ভীষণ ইচ্ছা করছে একটু জড়িয়ে ধরি তোমায় ! রডোডেনড্রনের জন্য মাফ করে দিলাম । এই চললাম ছবি তুলি একটু । সব নেমেছে গাড়ি থেকে । চমৎকার ভিউ এখানে ।ছবি পাঠাবো দেখো । ভিউ দেখেই বোলো। আমারটা বলতে হবে না জানি আমি শ্রীদেবী না ।
বেলা ৩ টে ….
" Well I know I am not your type
But I hope you wouldn't mind
If I kept leaving roses (read Rhododendron) at your door "...
উইল কুকসনের গানটা শুনেছ ? গানটা শুনে জানিও কেমন লাগলো ? ফোনে শুনছি । অজস্র পাহাড় , ঝর্ণা ,জলপ্রপাত,ফার্ন , রডোডেনড্রনের ঝাড় ,পাহাড়ি অলি গলি পথ পেরিয়ে ... ছুটে চলা !মেঘ গুলো যেনো মনে হচ্ছে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়বে ...ইচ্ছে করছে যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁই !
গাড়ী এখন থেমেছে । সবাই চা খাচ্ছে । এখানে খুব সুন্দর ভিউ ।নাম টা ড্রাইভারের কাছে জেনে বলবো ।
ইতস্তত কাঠের ছোট ছোট বাড়ি । একটা রেস্টুরেন্ট। চা বিস্কুট খাচ্ছি । গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বাইরে । সবাই ছাতা নিয়ে এদিক ওদিক দেখছে । একটা বেড়া দেওয়া জায়গা রেস্টুরেন্টের পাশে সেখান থেকে অপূর্ব দৃশ্য। মেঘ গুলোকে আমার আইসক্রিমের মতো লাগছে ।মনে হচ্ছে এক কামড় দিই। মনে হচ্ছে কাপে চামচ দিয়ে মেঘ নিয়ে নিই। হাসছো তো? সত্যি লাগছে । নীল সাদা মেঘের ভেলা কোথাও পাড়ি দিচ্ছে ...কোথাও কোনো মেঘবালিকা চুপটি করে বসে , কোথাও বা মেঘ দূত বৃষ্টির বার্তা নিয়ে আসছে
কিংবা কোনো মেঘ পিয়ন চিঠি নিয়ে আসছে ...
তোমার পাড়ায় মেঘ পাঠালাম ..বৃষ্টি এলে বোলো।
খুব মিস করছি গো তোমায় ! Lewis Capaldi এর 'someone you loved' গানটা শুনছি নির্জনে, ছাতা নিয়ে ছবি তুলে আসি ।
কিছু পর............
এই গাড়িতে আমাদের সাথে এক মামা ভাগনা আছেন ।ওনারাও আমাদের দলের সাথেই এসেছেন । খাবার ঘরে আলাপ তার পর এখন গাড়িতে । আমাদের চার জনের সাথে ওনারা দুজন দলে আছেন । সবার কাছেই মামা বাবু হয়ে গেছেন । চন্দন নগরে বাড়ি। ওখানে আমার এক কাজিন মাসী থাকে। ডলি মাসী ।খুব মিশুকে আর গল্প করতে দারুন ভালোবাসে । বলবো একদিন ডলি মাসীর কথা । ডলি মাসীর জা টুনু কাকিমা কি যে হিংসুটে কি বলবো! এর ওর নামে খালি নিন্দা করে ।আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছে । ওর ভাইপোর ছবি পাঠিয়েছে মা কে মাসীর হাত দিয়ে ! ধুৎ!
মামা বাবুর নাম সৌভদ্র মিত্র। ভাগ্না সন্দীপ সেন । দুজনেই অবিবাহিত। সন্দীপবাবু আমার চা বিস্কুটের দাম দিয়ে দিয়েছেন । উনি নাকি বর্ধমান প্রায় আসেন সে কথাও বললেন । আমি কোন স্কুলে পড়াই জিজ্ঞাসা করছিলেন। ওনার নাকি মামার বাড়ি বর্ধমানে । সুতপা খুব হেসে হেসে কথা বলছে সন্দীপ বাবুর সাথে দেখতে পাচ্ছি ।
মেকাপ টিপটপ ওর । কি ঠান্ডা গো ! টুপি খুলতে ইচ্ছা করছে না । একে তো ঠান্ডা হাওয়া তার ওপরে খুললে কোনো পাখি ভুল করে আমার চুলকে তার বাসা ভাবতে পারে ! কোনো রকমে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। বৃষ্টি ঝাপটা আসছে অল্প ।
বেলা চারটে ...
লাচুং আসার পথে বেশ কটা জলপ্রপাত দেখেছি । নাগা ফাঁকা ,ভীম নালা ফলস , সেভেন সিস্টার্স ফলস , মিয়াং চু ফলস , অমিতাভ বচ্চন ফলস...
সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গের প্যানোরামা দ্বারা বেষ্টিত ,তাদের অস্থির গর্জনে মিশে আছে এক মেলোডি ,নির্জন কাঠের পাহাড়ে সেই মন মোহিত করা পিয়ানোর ছন্দ সুরের শব্দ তরঙ্গের মাঝে সকাল সন্ধ্যে কাটিয়ে দেওয়া যায় ।
পাহাড়ে ঘেরা গাছপালার ঝোপ থেকে অচেনা পাখি ডেকে যায় ... তিস্তার সখী উপনদীরা কোথাও ঝিরিঝিরি বয়ে চলে।
বাইনোকুলার দিয়ে পাহাড়ি দৃশ্য দেখছি। এটা বাবা আমায় জন্মদিনে দিয়েছিল একবার । বাবার দেওয়া শেষ উপহার ছিল আমায় দেওয়া দুটো কানের দুল । বাবা চলে যাবার পর ওটাই আমি পড়ে থাকি এখন! এখন আমার দূরবীন নিয়ে সবাই দেখছে বলে বসলাম একটা ব্রিজের ধারে একটু । এখানে শান্ত আকাশ । এখন বৃষ্টি নেই ।পাস দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিস্তা। জলের রঙ সবুজ এখানে । এদিক ওদিক টুরিস্ট দের ভীড় । টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে । ছোটো ছোটো দোকান খাবারের পসরা সাজিয়ে .. আমার চাউমিন খেতে মন করছে । খেয়ে আসি ।
সন্ধ্যে ৬ ..
অন্ধকার নেমে গেছে । এখন আমরা লাচুং এর পথে । জায়গা চিনিনা কোথাও একটা চেকিং হচ্ছে ।
রাত ৯:৩০ ..
লাচুং এ পৌঁছে দেখি বেশ বৃষ্টি। আমার আর এনার্জি নেই নিচে নেমে খেতে যাবার ।এই হোটেলে রান্না আর খাবার জায়গা টা নিচে নেমে সামনেই একটু হেঁটে যেতে হয় শুনছি । খুব টায়ার্ড আমি । ইরাদি রা সব গেছে । ড্রেস চেঞ্জ এর প্রশ্ন ই ওঠে না । প্রবল ঠান্ডা । জল খেতে ভয় করছে । এই শীতে বাথরুম যাওয়া বিশাল এক শাস্তি বোধায়।জ্যাকেট পড়েই শুয়ে পড়লাম । শুভ রাত্রি গো ।
সকাল ৭টা ,২০ মার্চ
সুপ্রভাত, রোদ রঞ্জন
দিন ভালো যাক তোমার
মন মেজাজ শরীর ভালো থাক।
ব্যালকনি থেকে অদূরের পাহাড় গুলো দেখছি। কুয়াশা আর ধোঁয়া যেন পাহাড় চূড়ায়। কি যে অপূর্ব লাগছে । কোথাও কোথাও হালকা সোনা রোদ পড়েছে ।সবাই দেখছি ব্যালকনিতে ভিড় জমাচ্ছে।ছবিও তুলছে ।আমিও তুলেছি । সত্যি মুগ্ধ হলাম । আহা ! কি রূপ! যেন আঁকা ছবি! বেড়ানো যেনো স্বার্থক হলো এটা দেখে ! ব্রেকফাস্ট সেরে বের হবে সবাই ।আজকের গন্তব্য জিরো পয়েন্ট। তার পর ওখান থেকে ইয়ুমথাং যাবো।
সকাল ৯
গাড়ি ছুটছে এখন জিরো পয়েন্টের দিকে পরোটা , ঘুঙনি আর মিষ্টি খেয়ে বেড়িয়েছি ।সাথে জল ,পাউরুটি বাটার মিষ্টি বিস্কুট কলা র প্যাকেট সব গাড়িতে গাড়িতে। ৩০ জন আছি আমরা ৫ টা গাড়ি চলছে ।
। আগের দিনের মতোই গাড়িতে আমরা চারজন আর মামা ভাগনা। সামনে সন্দীপ সেন। পিছনে মামা বাবু আর ইরাদি । মাঝে আমরা তিনজন ।আমি তো জানালার দিকে । মাঝে দীপিকা দি আর ওদিকে জানালার ধারে সুতপা। যাক নজর টা একটু সরবে !
বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি , গাড়ির কাঁচে বৃষ্টি গুঁড়ো, লং ড্রাইভ.. ফ্লাস্ক এ চা সাথে পপকর্ন উঁচুতে শ্বাসকষ্টে কাজে লাগে বলছে ,গল্প ..আর সিকিমের বৃষ্টিতে বাংলার বসন্ত হাজির । সন্দীপ সেন গান চালিয়েছেন ফোনে ... বাতাসে বহিছে প্রেম.. নয়নে লাগিল নেশা কারা যে ডাকিলো পিছে , বসন্ত এসে গেছে ..
হম! প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি একটা। কি মনে হয়? ইরা দি আর মামার বাবুর প্রেম জমে উঠবে সিকিমে ?
সুতপা কি পারবে সন্দীপ কে প্রেমের জালে ফাঁসাতে? আগের অনেক গুলো ভেগেছে জানি তো!
দেখু ম্যা তুঝে ইয়া দেখু কুদরত কি নাজারে..
মুশকিল মে হ্যায় ইয়ে দিল মেরা .....
ঠিক এই গানটাই গাড়িতে বাজছে। শূন্য বিন্দুতে শূন্য তাপমাত্রা.. জিরো পয়েন্ট ঢুকছি ..
বর্ণনা করার ভাষা নেই ,জাস্ট অসাধারণ পার্থিব নান্দনিক দৃশ্য.. জিরো পয়েন্ট বা ইউমেসামডং।
ইউমেসামডং যাওয়ার পথটি সুন্দর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গেছে , আঁকা বাঁকা কোথাও এবড়ো খেবড়ো রাস্তাও মিলেছে । রডোডেনড্রন ,অ্যান্থোপোগনের রঙিন ঝোপ (নেপালি ভাষায় সানপাটি নামে পরিচিত) দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় সূক্ষ্ম সুগন্ধে পুরো বায়ুমণ্ডল জুড়ে, এই গাছগুলি স্থানীয় লোকেরা তাদের ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য ধূপ হিসাবে ব্যবহার করে। .
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫৩০০ ফুট উঁচু । তিনটে পাহাড়ি সরু নদীর মিলন হয়েছে এখানে । ইয়াক , নীল ভেড়া চড়ে বেড়ায় ,। কি কনকনে ঠান্ডা গো !
শুধু বরফ আর বরফ । সারা পাহাড় গাছপালা সব ঢাকা বরফে ।তার ওপরে কোথাও কোথাও চিলতে রোদ্দুর পড়ে ঝিকমিক করছে । ফ্লোরা ফনা সহ নানা রঙিন বাহারি পাহাড়ি ফুলের বর্ণ সম্ভার আর সূর্যের সরাসরি প্রতিফলিত রশ্মি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ।
জিরো পয়েন্টকে পৃথিবীর স্বর্গ বললে ভুল হবে না । এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিরাজমান এখানে । তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেলো গাড়িতে আসতে আসতে। আপাতত ১৩০০০ ফিট ওপরে এখন । ভিকুনা চীন সীমান্ত জিরো পয়েন্টের বাইরে ।সেখানে পর্যটক দের যাবার অনুমতি নেই । যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে । ওঠার ভীষণ শ্বাস কষ্ট লাগছিল । কৌটোয় কর্পূর নিয়ে এসেছি । সেটা তে অনেক হেল্প হয়েছে ।এখন ঠিক আছি । নামি এবার ।
এখন বেলা সাড়ে এগারোটা ...
ইরাদি তো নামবো না বলছিল মোটা মানুষ হাঁপিয়ে গেছেন । মামা বাবু অনেক হেল্প করছেন । আমিও সেই একই মোটার দিকেই যাচ্ছি ,তবে এখন এনার্জি লাগছে বেশ ।সবাই বরফ ছুড়ছে এর ওর দিকে । উফফ! দেখছ ববিতা আমায় দূর থেকে বরফ ছুড়ছে। আমাদের দলের একজন । স্বামী ছেলে নিয়ে এসেছে । ভারী মিশুকে আর স্মার্ট ।আমার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে । আরে এবার ইরা দি। এখন রাখছি ।
সত্যি ভারতবর্ষ এমন একটা দেশ যেখানে সব রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর দেখা মেলে । ভারতবর্ষের ভিতর কত ভারতবর্ষ । শুধু খুঁজে নিতে হবে ।বেরিয়ে পড়ো অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ... কোথাও শস্য শ্যামলা ক্ষেতের সমতল ,কোথাও উত্তাল লহরী নিয়ে সমুদ্রের গর্জন , কোথাও পাইন , দেবদারু রডোডেনড্রন এর পাহাড়ি তল কোথাও বা বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া। সোনা রোদ ঝলমল করে সেখানে । কোথাও রুক্ষ শুষ্ক মরুভূমি তো কোথাও গহীন সে অরন্য। আবার কোথাও বা মন্দির দর্শনের জায়গা।মন পবিত্র হয়ে যায় গেলে । আবার কোনো প্রান্তিক জায়গায় চোখে পড়ে জলের কষ্ট জীবনের কত কষ্টের দিক! তাও কেমন করে বাঁচে তারা প্রতিকূলতা কে হারিয়ে ...আবার কোথাও আদিবাসী দের সহজ সরল জীবন !
তোমার ছবি তে যেমন দেখি তোমার কাহিনী গুলোয় যেমন তুলে ধরো এমন টুকরো ভারতের কথা । এমন করে তুলে ধরতে ইচ্ছা করে আমারও । কাজের পরিধি বাড়াতে মন হয় এদের নিয়ে এইসব নিয়ে ... অজানা ভারতের নানা কথা জানুক ভারতীয় রা ।
সন্দীপ সেন ডাকছেন । বলছেন কি করছেন ম্যাডাম এসে থেকে কি এত লিখছেন ! এদিকে আসুন। ভদ্রলোকের একটু ইন্টারেস্ট দেখছি আমার প্রতি , নানা কথা জিজ্ঞাসা করছেন । কথায় আচরণে বুঝতে পারছি ।মেয়েরা বোঝে জানো তো ! ছেলেদের মতো না, যদি কোনো মেয়ে বলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ছেলে ভাববে বোধায় পেট ব্যথা করছে ! যেমন তুমি অনেক কিছুই বোঝো না।
কি মুশকিল ! আরে সুতপা আছে তো সাথে ।আবার আমায় কেনো ! আর নো চান্স।বাড়ির লোক ব্রাহ্মণ ছাড়া এগোবে না ! এই খেতে ডাকছেন দীপিকাদি আমাদের । পরে লিখবো আবার ।জিরো পয়েন্ট এর অনেক ছবি তুলেছি । ভিডিও করেছি । পাঠাবো সব। দেখো ।কাছেই একটা বরফে ঢাকা শিব মূর্তি দেখছি । প্রণাম করলাম । জয় দেবাদিদেব! ওম নম শিবায়।
একরাশ ভালোলাগা আর মন খারাপ নিয়ে জিরো পয়েন্ট ছাড়লাম । জানিনা আর আসা হবে কিনা ! আপাতত তাকে পিছনে ফেলে গাড়ি এখন ইয়ুমথাং ভ্যালির দিকে ... দেড় ঘন্টা মতো লাগে ।
বেলা ২:৩০
ইয়ুমথাং ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস -
ফুলের ঋতু ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত , এই উপত্যকায় সবুজ গালিচায় অগণিত রামধনু বর্ণের বসন্তের ফুল ফোটে। তিস্তা নদীর একটি উপনদী উপত্যকা এবং নিকটতম জনবসতি কেন্দ্র লাচুং শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ভ্যালিতে বরফের কার্পেটে বসে আছি । শ্বেতস্নিগ্ধ বরফের সম্ভার । প্রকৃতি মনোরমা। আলপাইন উদ্ভিদ এর ফুল চোখে পড়েছে । না জানি কোন চিত্র শিল্পী প্রাণবন্ত রং দিয়ে এই পটভূমি এঁকে গেছেন । দু চোখ ভরে দেখছি শুধু ।
চারদিকে ভ্রমণ পিপাসুদের দল। আর বাঙালি তো সব জায়গায় মিলবে ! ইতিউতি কিছু গাছ সবই বরফে ঢাকা । বাড়ি দোকান রেস্টুরেন্ট গুলোর সামনে বরফ কুচি । তাদের ছাউনী তে সব বরফ পড়েছে।একটু হাঁপিয়ে গেছি ।বসেছি একটা গুঁড়ির ওপরে ।
ক্যামেরা বন্দি করছি কিছু মুহুর্ত। যা আর ফিরবে না কোনোদিন ।নর্মাল জুতোতেই আছি ।ভিজে গেছে দেখছি বরফে । একটু চা আর তার সাথে টা হলে মন্দ হয়না এই সময় ! । পাহাড়ি পথে সব হজম হয়ে গেছে । মন রোল খেতে চায়ছে।
'মন মেতেছে মন ময়ুরীর কি খেলায় ...নাম না ফুল ফোটানোর এই বেলায় ...'
সন্ধ্যা ৭ ..
ফিরেছি সন্ধ্যে হবার আগেই ।এখন গরম গরম আলুর চপ কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল মাখিয়ে মুড়ি খাওয়া চলছে সান্ধ্যকালীন আড্ডাতে । ফোনে টাওয়ার নেই । তোলা ছবি গুলো দেখছি টুকটাক । বেশ ঠাণ্ডা । হ্যাঁ বৃষ্টিও পড়ছে টিপটিপ, জোরালো না ।
জানিনা কি করছো তুমি ! বেশ কাজ সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। একটু খেয়াল রাখো শরীরের । শরীর খারাপ করবে তো! তোমার কিছু হলে আমার ভালো লাগে না বোঝোনা সেটা !
সকাল ৭:৩০ ২১ মার্চ
'এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হবে তুমি বলোতো '?
হ্যাঁ, জানি উত্তরে বলবে তুমিই বলো ..
ছাঙ্গুর পথে চলছি। ১৭ মাইল অব্দি পারমিট পাওয়া গেছে । প্রবল তুষার পাত আর ধসে সব বন্ধ । বাবা মন্দির নাথুলা কিছুই পারমিট মেলেনি। ঠিক আছে যেটুকু পাই তাই দেখে যাই...
গ্যাংটক থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে এবং ১২৩১৩ কি সম্ভবত ১২৪০০ ফুট এমন উচ্চতায়, অতীব সুন্দর ঠান্ডা সোমগো লেক বা ছাঙ্গু হ্রদ প্রতিটি দর্শনার্থীর ভ্রমণের জন্য আদর্শ। এর অর্থ ভুটিয়া ভাষায় জলের উৎস। হ্রদটি ,হ্রদের চারপাশের পাহাড়ের গলে যাওয়া তুষার থেকে জল আহরণ করে। কিংবদন্তি সৌন্দর্যে শীতকালে শান্ত হ্রদটি হিমায়িত এবং এর চারপাশের এলাকা তুষারে আবৃত থাকে। আর বসন্তের শেষের দিকে প্রস্ফুটিত ফুল গুলো লেকের চারপাশে রঙের দাঙ্গা লাগায়।
হ্রদ পৃষ্ঠ ঋতু পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন রং প্রতিফলিত করে এবং স্থানীয় সিকিমি জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে সেই পরিবর্তনের উৎসব পালন করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গবেষণার পর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে হ্রদটি রঙ পরিবর্তন করছে। শীতের সময় মে মাসের মাঝামাঝি শেষ হওয়ার পরে, হ্রদের পরিধিতে রডোডেনড্রন, প্রিমুলাস, নীল এবং হলুদ পপি, আইরিস এবং আরও অনেক কিছুর প্রস্ফুটিত প্রজাতির সুন্দর ফুলের বর্ণময় শোভা মন হরণ করে । এছাড়াও লেকের এলাকায় ব্রাহ্মণী হাঁস সহ বেশ কিছু প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর দেখা মেলে ।
আজ চা বিস্কুট খেয়ে স্নান সেরে বেড়িয়েছি । সাথে লুচি, সরু করে কাটা আলু চচ্চড়ি আর মিষ্টি টুকটাক ফল বিস্কুটের প্যাকেট । কাল রাতে দুটো রুটি ,একটা চিকেন লেগ পিস আর দু পিস আলু ব্যাস ! তুমি ভাবছো আমি এত খাবারের কথা লিখি কেনো ! আমার ভালো লাগে আসলে জানোতো !ওই ছোটবেলায় পড়তাম অনেক লেখা যেসব লেখক রা গল্প তে খাবারের বর্ণনা দিতেন বেশ ভালো লাগতো ।তাই আমিও দিই আর কি !
বেলা ১১:৪৫
' যায় রে যায় রে বেলা যে বয়ে যায় রে .যায় রে ...
পারিনা কেনো হায় রে হায় রে বাঁধিয়া রাখিতে
এই প্রাণ ,এই প্রাণ,এই প্রাণ,এই প্রাণ...'
কি বলবো অপূর্ব, অপরূপ ,অনন্য অনবদ্য অসাধারণ... রোদ্দুর দেখে ভেবেছিলাম আজ বোধায় বৃষ্টি পড়বে না । জ্যাকেট পড়ে আসিনি সোয়েটার পড়ে এসে দেখছি বেশ ঠাণ্ডা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । আর কি !ভাড়া করতে হলো জ্যাকেট আর বরফে যাবার জুতো । কফি স্ন্যাকস ও খেলাম ওই দোকানেই । গাড়িতে জল খাবারও খাওয়া হয়ে গেছে সব । চারদিকে বরফ জমে শুধু । টুরিস্ট দের ভীড়। পাহাড়ি বৃষ্টি পিছু ছাড়ছে না । ঢাল দিয়ে আসছে যাচ্ছে গাড়ি গুলো । আমরা ছাতা নিয়ে একটু ঘুরলাম বরফে মধ্য দিয়ে । এদিক ওদিক দেখলাম । মন ছোট বাচ্ছা এখন ! বরফ নিয়ে খেলাও করলাম সবাই । আর সাথে ছবি তোলা তো আছেই।এখানে শীতের পোষাকের সম্ভার নিয়ে বেশ কিছু দোকান ।খাবারের তো আছেই । বাকি অন্য এটা ওটা ।এই এতদূরে কত উঁচুতে জীবিকার জন্য সব আসে । এই বৃষ্টি ,কখোনো বা ধস কতো প্রতিকূল জীবন ।
কত মেয়ে দোকান চালাচ্ছে । হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলছে । পাহাড়ি মানুষ সহজ সরল। সমতলের মানুষ দের মত মনে জিলাপির প্যাঁচ নেই !
সন্দীপ সেন কে কফি স্ন্যাকস খাওয়ালাম । উনি আমায় সেদিন খাইয়েছিলেন । ইরাদি আর মামাবাবু বেশ গল্প গুজবে মত্ত । গাড়িতে বসে আছি। ছাড়বে একটু পরই। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছেন । দুটো গাড়ি বেরিয়ে গেলো আমাদের ।ওদের সবে তাড়া! এসে থেকে কম্পিটিশন করছে সব জায়গায় আগে যাবার। ও মাই গড! আরে স্নো ফলস হচ্ছে তো হটাৎ! এই রাখছি !
কি ভাগ্য আমাদের ! এখানে স্নো ফলস দেখা মানে সুন্দর বনের বাঘ দেখা । আর একটু হলেই গাড়ি ছেড়ে দিত ! সবাই হুড়মুড়িয়ে দৌড় লাগিয়েছে রাস্তায় । ভিজতে কি ভালো লাগছিল । ড্রাইভার কে বললাম দাদা ভালো করে ছবি তুলে দিন তো আমার ! তুষারপাতের মধ্যে দু হাত বাড়িয়ে ভিজেছি আমি । যাক নয়ন স্বার্থক হলো ।মন ভরলো । অতি চালাক দল আর দেখতে পেলো না । শুনবে এখন আমাদের কাছে । আমি তো আমাদের পাড়ার ওই হিংসুটে ন্যাকা ঝুমা বৌদিকে বেশি করে করে বলবো দেখো , ওরাও ওই গাড়িতেই চলে গেছে আগে । এখন টা টা ! গাড়ি ছাড়লো।
বিকাল ৪
ফুলকপির তরকারি , ডাল ,আলু পেঁয়াজ ভাজা , মাছের ঝাল ,চাটনি আর পাঁপড় আর সাবুর পায়েস দিয়ে লাঞ্চ সেরে এখন গাড়ি ফিরছে গ্যাংটকের পথে , লাচুং এ রান্নার দাদা দের বলছি আপনাদের এখানে কি ঠান্ডা ! কি করে থাকেন ? বলে কি এই ঠান্ডা কিছুই না এর থেকেও বেশি ঠান্ডা পড়ে। "শরীরের নাম মহাশয় যা সওয়াবে তাই সয়"।বুঝলে রোদরঞ্জন।
লাচুং এ জানো তিস্তার দুই উপনদী মিলিত হয়েছে ।লাচেন আর লাচুং। সিকিমের দুই রত্ন । 8,838 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, লাচেন উত্তর সিকিম হাইওয়েতে অবস্থিত। এই ছোট গ্রামটি লাচেনের গুহা গিরিখাত দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি সবুজ সমতল ভূমিতে অবস্থিত। তুষারময় চূড়া এবং কালো ক্লিফ সহ বহু রঙের পর্বত লাচেন থেকে উঠে এসেছে । লাচেনে খুব কম লোক বাস করে। তবে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা আরামদায়ক করতে প্রাথমিক ব্যবস্থা রয়েছে। লাচেনে বৌদ্ধ মঠ আছে । এই আদিম দুটি স্থানে যতবার যাবে প্রেমে পড়ে যাবে । প্রেমে পড়বে তাদের সৌন্দর্যের, সরলতার, সহজতার। ওই সব দেখতে দেখতে যাওয়া সেদিন অল্প অল্প করে !
পড়ন্ত বিকালে ঝিরঝির বৃষ্টি সাথে ! কি সুন্দর জলের টুপটাপ শব্দ ! মন খারাপ লাগছে আবার ভালো ও লাগছে ! বুঝেছি এই বৃষ্টি হয়ে কে আমার সাথে ! মিস ইউ ...! এখন তবে থাক । আবার পরে ।
রাত ১১ ৪৫ ...
গ্যাংটকের নিস্তব্ধ ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাত । এখানে ফিরে এসে আর সময় পাইনি ,এসেই দলের সবাই গ্যাংটকের বাজারে ছুটেছি । বৃষ্টি নিয়ে দু ঘন্টা বাজারে কাটিয়ে , সিঙ্গারা রসমালাই খেয়ে ফিরে এসে ডিনারে চিকেন বিরিয়ানি সাঁটিয়ে ব্যাগ বেশির ভাগ গুছিয়ে অবশেষে তোমার সাথে রাতের অবকাশের চিঠিতে এখন ! টুকটাক যা পড়ে আছে সকালে গুছিয়ে নেবো ।সময় পাবো । কাল ফিরে যাব জলপাইগুড়ি , সেখান থেকে রাত ৮ টার ট্রেন । ভোরে পৌঁছে যাবো বর্ধমান । বাড়ির এর ওর জন্য নিলাম এটা ওটা । নিজেরও আর তোমার জন্য কি নিলাম; থাক সারপ্রাইজ! বলবো না এখন । পাঠিয়ে দেবো কুরিয়ার করে । জানো ওখানে কি হয়েছে ..
গ্যাংটকের এক শীতের পোশাকের দোকানে হঠাৎ দেখা ইরা দি আর তার প্রাক্তন তমাল দার.. তিনিও এসেছেন বেড়াতে স্ত্রী ছেলে নিয়ে । ইরা দি আর বিয়েই করলো না । খুব ভালোবাসত তমাল দা কে । কত হেল্প করেছে ...হঠাৎ করে তমালদা চেঞ্জ হয়ে গেছিল । বাড়ীতে নাকি ইরা দি কে পছন্দ করেনি ।বলেছিল মোটা কালো । সত্যি কি অদ্ভুত !মানুষ কে বিচার করা হয় শুধুই তার রূপ দেখে । ইরা দি কি ভালো মনের মানুষ ।কি মিশুকে । গুণী। পড়াশোনায় ভালো । টিচার । এসবের কিছুই মূল্য নেই ! মামা বাবু মানুষটি ভালো যদি সত্যি ওদের এই কুসুম কুসুম প্রেম পরিণতি পায় হয়তো ইরা দি সুখী হবে । তমাল দার সাথে কথা বলেনি ইরা দি বউ ছেলে ছিল তো ! তমাল দাও চমকে গেছেন দেখেই বোঝা যায়! ইরা দি চোখের জল মুছছিল রুমালে আমি দেখেছি ।
সত্যি ! আমাদের তছনছ করে দেয় একমাত্র ভালোবাসা ! ভালোবাসার কাছেই আমরা হেরে যাই।মাথা নত করি । ঠিক উজান ও আমায় এমন করেই ভেঙে চলে গেছিল ...! সস্তা চটকদার জিনিসের মোহে আমার ভালবাসা কে দুমড়ে মুচড়ে চলে গেছিল । যে বলতো আমার মতো ভালো মনের মেয়ে নাকি সে দ্যাখেনি । সারাজীবন পাশে থাকবে বলেছিল ...সে সব শুধুই কথার কথা ! বুঝলাম যখন তখন আমি ওর জন্য ভালোবাসা তে পাগল । বড়ো কষ্ট হয়েছিল , মনে হয়েছিল বুঝি আমার হৃদয়টা দুটুকরো হয়ে গেছে । যন্ত্রণা ফিল হতো এত ;অনেক কষ্টে নিজেকে আবার হিল করতে পেরেছিলাম । খুব কঠিন অসুখে যেমন মৃত্যুর ইচ্ছা মিশে থাকে ঠিক তেমন করে চাইতাম ওকে।
বর কনে বিদায়ের সময় মাকে কনকাঞ্জলী দিয়েই মেয়ে কে গাড়িতে উঠে পড়তে হয় আর গাড়ি ছেড়ে দেয় , অপ্রস্তুত কনে তাকানোর সময়টুকু ঠিক করে পায়না নিজের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি আর বাড়ির লোক দের দিকে ..ঠিক ততটাও পাইনি ওকে । এখন সে সহায়িকা বই এ কম গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্নের মতো রয়ে গেছে শুধু । তারই হোক সেসব ভালো যা একসময় আমাদের হবার কথা ছিল ।
ফোনে আমার খুব প্রিয় গান বাজছে মৃদু স্বরে .. "তোমার কথা ভাবতে গেলেই চাঁদ হয় অভিমানী ,
বলে জোৎস্নার চেয়ে মুখটি কি তার অনেক বেশি দামী?
তোমার গান গাইতে গেলেই পাখিদের অভিযোগ, বলে , এত গান গাই তোমার জন্য তবু ওর দিকে চোখ!
আমি কি করি কি করি কোন দিকে যাই,
কোন পথে হারাই..
রক্ত প্রবাহে স্লোগান উঠেছে তোমাকে তোমাকে চাই!
আমি কি করি কি করি কোন দিকে যাই,
কোন পথে হারাই..
রক্ত প্রবাহে স্লোগান উঠেছে তোমাকে তোমাকে চাই!
তোমায় যদি আমার মন খারাপের কথা বলি ধরে নাও তুমি ডায়েরী আমার । তুমি ই বলেছিল তোমার যা ইচ্ছে হয় লিখো আমায় , সব শুনবো । আমার বিকাল বেলা , অলস রোদ্দুর ,হলদে পালক , হঠাৎ আসা বৃষ্টি ,আমার রডোডেনড্রন ,বারান্দার রেলিং , পুকুরঘাটের পাতা ঝরা সিঁড়ির ধাপ ,বাড়ির পাশের কৃষ্ণচূড়া, আমার মাঝরাতের কান্না ,চোখের কালি , আফসোস পাগলামি ,চুমু সব তোমার ।
আমাদের অভিজ্ঞতা আছে কেমন করে কাছে আসতে হয়,কেমন করে দূরে যেতে হয় ! কেমন করে অপ্রকাশিত রাখতে হয় ...! প্রকাশ করার সাহস আর নেই ।পুরোনো ক্ষত বাধা দেওয়ার জন্য দাগ রেখে গেছে । পুরোনো ইতিহাস মনে করে নিজেকে আবার কষ্ট দিতে ভয় করে ! এর চেয়ে এই থাক ! দু কাপ চায়ের মাঝে বিস্কুটের একটা ছোট প্যাকেট থাক । আমাদের বোধায় ইচ্ছা নেই শুধু দুজনে ভালো থাকা কামনা করা ছাড়া ...
স্বপ্নিল চক্রবর্ত্তীর কটা কবিতা পড়েছিলাম এমন কিছু কথা কবিতাতে লিখেছেন যা মিলে যায় নিজের বলতে চাওয়া কথা গুলোর সাথে কিছু কিছু ....!
তুমি বুঝে নিও সমুদ্র তুমি, আর আমি সেই সমুদ্রের পাড়ে বসে তোমার অনন্ত ঢেউ দেখি একলা , সমুদ্র চারী বাতাস বয়ে যায় ঢেউ এত মতোই ,কখোনো কাছে আসো কখোনো বা দূরে ....ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও তুমি ! কখনও দিনে উত্তাল লহরী আবার রাতের সৌম্য শান্ত রূপ তোমার । আমি তোমার কাছে হেরেছি ,তোমার মধ্যে ডুবেছি তোমায় পেয়ে বেঁচেছি !
ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল চিঠির পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে । বুঝতে পারবে পড়তে পড়তে ঠিক এই সময় কেউ একজন তোমার জন্য কাঁদছিল পৃথিবীর কোনো এক কোণে...! একদিন আমায় ঠিক বুঝবে ! আমি অভিনয় জানিনা অরণ্য!
আগের গান শেষ হয়ে শুরু হয়েছে - তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহুর্তরা..
কি জানি কি আবেশে দিশাহারা !'
গানগুলো এমন করে কেনো মন খারাপ করায় অরণ্য? আই অ্যাম ক্রায়িং! মিস ইউ !মিস ইউ !মিস ইউ!
রাজাদিত্য ব্যানার্জির 'আমি বাড়ি ফিরিনি' বই এ একটা 'গঙ্গা ও ভালোবাসা' নামে একটা কবিতা আছে তাতে দুটো লাইন সেই .."ভালোবাসাকেও বাঁচানো সম্ভব ,
শুধু মনে রাখতে হবে ভালোবাসি বলা চলবে না , জড়িয়ে ধরে রাখলেই হবে " !
ইদানিং কালের প্রিয় কবি আমার । কি ভালো লেখেন ! ভাষা নেই আমার । স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম পড়ে। হিংসা হচ্ছে বুঝি রাজাদিত্য বাবু কে ?
চলো আজ শুভ রাত্রি । 'প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে আমার মন খারাপের রাতে'
সকাল ১১ :৩০ ,২২ মার্চ
বাই বাই গ্যাংটক ... কিছু স্মৃতি রেখে গেলাম কিছু নিয়ে গেলাম ।... পোস্ত ডাল আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে লাঞ্চ সেরে জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ।তার পর যে যার জায়গায় যে যার কাজে ! বিদাই নিলাম মামা বাবু, সন্দীপ, ববিতা দের কাছ থেকে । মামা বাবু ফোন নাম্বার নিলেন আমার ।
সান মাউন্ট হোটেলের সবার কাছ থেকেও বিদাই নিলাম । কদিন বেশ আলাপ জমে গেছিলো ।
আজ শরীর টা বিশেষ ভালো লাগছে না ।সকালে খালি পেটে অম্বলের ওষুধ খেয়েছিলাম । এসে থেকে কিছু হয়নি , দিব্যি গেছি সব জায়গায় এনার্জি নিয়ে । যদিও আমার মনের ভিতরের খবর কে রাখে ! তুমি আর বৃষ্টি ছাড়া ! কি জানি বমি হবে কিনা ! ভালো লাগছে না !
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা
ট্রেনে উঠে পড়েছি । ভীষণ বমি হচ্ছে ! আজ আর কিছু লিখছি না । শরীর একেবারে ভালো নেই ঠিক যাবার দিনই এমন হলো ! বাড়ি ফিরে জানাবো । গুড নাইট।
ভোর বেলা ২৩ মার্চ ..
ফিরলাম বর্ধমানে । কষ্ট হচ্ছে খুব ! চিঠি পেলে উত্তর দিও ।কেমন সব লাগলো জেনে । ভালো থেকো । অপেক্ষায় থাকবো ।
ইতি
তোমার পাগলি ( ঋতু)
অরণ্য চ্যাটার্জি
বালিগঞ্জ প্লেস,
২৪/বি সেকেন্ড অ্যাভিনিউ
বালিগঞ্জ
কলকাতা।
--------------------------------------------------
পাল্লারোড, পূর্ব বর্ধমান।