গল্প ।। নব-বিভ্রাট ।। সুস্মিতা পাল
নব-বিভ্রাট
এ বৎসর তপনদেব
প্রথম হইতেই কিঞ্চিত অধিক
তেজোদীপ্ত। দুই
দিবস পূর্বে নতুন বৎসরের
শুভাগমন ঘটিয়াছে। নববর্ষ
কোনো নবীন সুসংবাদ বহন
করিয়া আনিতে পারে নাই। বরং
দমবন্ধ গরমের চোটে শহরবাসীর
ত্রাহি ত্রাহি দশা।
কাজের চাপে ও গ্রীষ্মের
তাপে কৃষ্ণকরণ হাঁসফাঁস করিতেছিল।সন্ধ্যার
পূর্বে মৃদু মৃদু বাতাস
প্রবেশের পথ পাইয়া কক্ষের
গুমোটভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণ হইলেও দূর
করিতে সক্ষম হইল।
আহা! হৃদয়ের পাষাণভার যদি এমত কোনো
উপায়ে দূরীকৃত হইত, কৃষ্ণকরণ কতই
না ধন্য হইত।
কিন্তু, তাহার কি কোনো
আশা আছে? যত
দিন যাইতেছে, ততই আশাতরু ক্ষীণ
হইতে ক্ষীণতর হইতেছে। আপিসের
পর গৃহে ফিরিয়া যাইতে
আজ চিত্ত বড়ই অনিচ্ছুক। কিন্তু,
কৃষ্ণকরণ বড়ই নম্রস্বভাব।
গৃহলক্ষ্মী যতই অপ্রিয় হউক,
উদ্বাহুবন্ধনে আবদ্ধ, অগ্নিসাক্ষী করিয়া
আনীত পত্নীকে কোনোভাবেই পরিত্যাগ করার সাধ্য অথবা
সাহস তাহার নাই।
সম্প্রতি
রবি ঠাকুর "চোখের বালি" শীর্ষক
এক কাহিনী লিখিয়া সোরগোল
ফেলিয়া দিয়াছেন।মহেন্দ্র
নামে কলিকাতার এক যুবাপুরুষ সতীসাধ্বী
প্রেমময়ী স্ত্রী বর্তমান থাকিতেও
বিনোদিনী নাম্নী সুন্দরী বিধবা
দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া লইয়া পলায়ন করিয়াছেন। সরলা
নির্দোষ বালিকা আশালতার সে
কি দুর্ভোগ! সমাজ
সংসারে পাঠক পাঠিকাকুল বিষম
নিন্দা - সমালোচনায় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছেন।
অথচ যথেষ্ট এবং যথোপযুক্ত
কারণ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণকরণ
নিরুপায়।
শৈশবে
পিতৃমাতৃহীন কৃষ্ণকরণ পিতামহীর ছত্রছায়ায় বাড়িয়া উঠিয়াছে। স্নেহের
অভাব না থাকিলেও শাসনের
আধিক্যও কিছু কম হয়
নাই।দুই
বৎসর পূর্বে পৌত্রের বিবাহের
অনতিবিলম্বে তিনিও নিশ্চিন্ত হইয়া
পৃথিবীর মায়া কাটাইয়াছেন ।তাই নবপরিণীতা সুষমাকে
লইয়া প্রেমবুভুক্ষু কৃষ্ণ পরম আড়ম্বরে
সংসারকুঞ্জের রাসমঞ্চে প্রবেশ করিয়াছিল।
কূজনে গুঞ্জনে সংগীতময় জীবনগীত রচনা করিতে দুইজনের
কাহারো কোনো আপত্তি না
থাকিলেও বাধ সাধিল নববধূর
এক অদ্ভুত পীড়া।
কি
ভীষণ নিষ্প্রেম কর্কশ তাহার নাম। আধকপালে। আজন্ম
এমন বিদঘুটে পীড়ার সংবাদ তাহার
অজানা ছিল।আকাশে
রোদের তেজ অধিক হইলে
এই রোগ বৃদ্ধি পায়,
আবার মেঘলা দিনেও তিনি
দুয়ারে থুড়ি কপালে করাঘাত
করেন। মন
খারাপ করিলে যেমন তেমনি অধিক
আনন্দ উল্লাসেও তিনি দেখা দেন। কারণের
অভাব ঘটে না।
নব্যযুবক কৃষ্ণ পোশাকআশাকে যেমন
খাদ্যাভাসেও তেমনই শৌখিন। পিতামহীর
জীবদ্দশায় কোনোদিন তাহার কোনো বিষয়ে
অসুবিধা ঘটে নাই।
কিন্তু ইদানীং সংসারচক্র অচল
হইবার উপক্রম হইতে চলিতেছে। দৈনিক
পরিশ্রম শেষে কোনোদিন সান্ধ্য
আহার প্রস্তুত থাকে না, কোনোদিন
বন্ধুগৃহে নিমন্ত্রনযাত্রার পূর্বে সুষমার শয্যাগ্রহণে সমস্ত
সাজসজ্জা বৃথা হইয়া যায়
, পূর্ণিমা রজনীতে প্রেমপূর্ণ হৃদয়
লইয়া নিষ্ফলা যুগলশয্যায় বিনিদ্র শয্যাকন্টকী কৃষ্ণকরণের
জীবন অসহনীয় করিয়া
তুলিয়াছে। অদ্য
প্রভাতে আপিসে আগমনের প্রাক্কালে
দেখিয়া আসিয়াছে, সুষমার চন্দ্রাননে কালিমার
ছায়া। এ
কিসের পূর্বাভাস, কৃষ্ণ
জ্ঞাত আছে। বিনিদ্র
নিশা কাটিবে বুঝিয়া অনিচ্ছুক
চিত্তে গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য
প্রস্তুত হইতে হইতে অজ্ঞাতসারে
তাহার কন্ঠ অস্ফুটস্বরে বলিয়া
উঠিল, "মুক্তি দাও, ভগবান।"
শুনিয়াছি,
ইচ্ছাপূরণের দেবতা নাকি দিবারাত্র
যত্রতত্র পদচারনা করিবার সময় কচ্চিৎ
কদাচিৎ কাহারো কাহারো মনস্কামনা
শুনিয়া 'তথাস্তু' বলিয়া ফেলেন।
সেইদিন বোধহয় তিনি প্রফুল্লহৃদয়ে
কৃষ্ণকরণের আপিসগৃহের আশেপাশে উপস্থিত ছিলেন। যাহাই
হউক, বৈশাখে জ্ঞাতিভগিনীর বিবাহ
উপলক্ষে গ্রামে গিয়া সুষমা
মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হইয়া
সাতদিনের মধ্যে ভবসংসারের মায়া
কাটাইয়া বিদায় নিল।
তাহার স্বামী শোকে আকুল
হইল এবং তাহাতে খুব
একটা খাদ ছিল, এমনটা
নহে।
যাহাই
হউক, ঘনকালো রাত্রির অবসানেও
তরুণ তপন দেখা দেন,
জগৎসংসারের সেই নিয়ম মানিয়া
কৃষ্ণও শোকশয্যা ত্যাগ করিয়া পুনরায়
পূর্বতন প্রাত্যহিক জীবনে প্রবেশ করিল। কয়েক
মাস অতিবাহিত হইলে পূজার ছুটিতে
পশ্চিমে ভ্রমণে গেল, সঙ্গী
সুহৃদ আকাশতরু। সে
বড়ই হাস্যমুখ, লঘুচিত্ত কিন্তু বন্ধুবৎসল, আমোদপ্রিয়
যুবক। অচিরেই
কৃষ্ণকরণের মানসিক ভার অপনোদন
হইয়া সে কতকটা স্বাভাবিক
হইয়া উঠিল।একদিন
প্রতিবেশী এক বাঙ্গালী পরিবারের
সঙ্গে আলাপও হইল।
ফলশ্রুতিতে সান্ধ্য চা-পানের নিমন্ত্রনযাত্রা
করিল দুই ইয়ার।
সেখানেই চক্ষুবিনিময় হইল কিশোরী চন্দ্রাবতীর
সহিত এবং অচিরেই কৃষ্ণকরণ
দুটি কাজলকালো চোখে স্বীয় সর্বনাশ
প্রত্যক্ষ করিল। এস্থানে
একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পাঠককুলের প্রয়োজনে জ্ঞাত করা আবশ্যক
মনে করি। উক্ত
অনুভূতি কৃষ্ণ আকাশতরুর নিকট
একান্ত আলাপে ব্যক্ত করিয়াছিল। কলিকাতার
লেখকসমাজে আকাশতরুর গতিবিধি ছিল স্বচ্ছন্দ।
কোনো এক মুহূর্তে সে
বিশ্বখ্যাত এক লেখকের কাছে
সেই কাহিনী কয়েক ছটাক
মধুরতা মিশ্রিত করিয়া বর্ণণা করিয়া
ছিল। বেশ
কিছু বৎসর কাটিয়া যাওয়ার
পর উক্ত লেখকের 'আপন
মনের মাধুরী' মিশ্রিত করিয়া রচিত একটি
কবিতার পংক্তি ব্যাপক জনপ্রিয়তা
লাভ করে এবং পরবর্তীকালেও
তা কালজয়ী হইয়া বিরাজ করিবে,
এমত অনুমেয়। "প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন
চৈত্রমাস / তোমার চোখে দেখেছিলেম
আমার সর্বনাশ।" হায়, অনুপ্রেরনাকে কেই
বা আর স্মরণে রাখে!
যাহাই হউক,
সুহৃদের মধ্যস্থতা ও সহায়তায় অচিরেই
চারিহস্ত এক হইল।
দোজবরে বলিয়া তেমন কোনো
আপত্তি হয় নাই, কারণ
এমন সুপাত্র সচরাচর সুলভে মিলিবার
বস্তু নহে। দিবস
রজনী লঘুপদে সঞ্চারমান মেঘের
মত ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
এত সুখ লইয়া কৃষ্ণকরণের
নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখী মনুষ্য বলিয়া
প্রতিভাত হইতে লাগিল।
চন্দ্রাবতী সুগৃহিণী, সংসারতরণী গঙ্গাবক্ষে বজরার ন্যায় পাল
তুলিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল।
অগ্রহায়ণে
কলিকাতার সন্ধ্যায় ঠান্ডা
জাঁকিয়া না বসিলেও শীতের
আমেজ মাখিতে শুরু করিয়াছে।আপিস
হইতে ফিরিয়া কৃষ্ণ দেখিল, গৃহে
আলো জ্বলে নাই।
বহুক্ষণ করাঘাত করিবার পর
গৃহভৃত্য নিদ্রাজড়িত চক্ষে দ্বার উন্মোচন
করিলে ত্রস্ত, আশঙ্কিত কৃষ্ণ তাহাকে বহু
তিরস্কার করিল। শেষে
ছুটিয়া শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল,
চন্দ্রা উপুড় হইয়া পালঙ্কে
শায়িতা,তাহার তরুণী দেহলতা
মৃদু মৃদু কম্পিত হইতেছে। অভিমানিনীর
এহেন রূপ প্রেমিকের হৃদয়ের
অন্তঃস্থল পর্যন্ত আন্দোলিত করিয়া তুলিল।
- " চন্দ্রা, প্রিয়তমা,
কি আনিব বলো।
কেন ক্রন্দন করিতেছ?"
মস্তক
সামান্য উত্থিত করিয়া স্ফীতগন্ড
চন্দ্রাবতী পূর্বে অশ্রুত তীক্ষ্ম ধারালো কন্ঠে বলিয়া
উঠিল,
- " শীঘ্র ওষুধ
লইয়া আইস।শীত
আসিলেই আমার দন্তযন্ত্রণা হইয়া
থাকে। এখন
তিন - চারি মাহিনা যখন
তখন ভুগিতে হইবে।
মা গো!মরিলাম ......."
বজ্রাহত
কৃষ্ণকরণ প্রস্তরবৎ চলচ্ছক্তিহীন হইয়া বসিয়া রহিল। বিধাতা
যাহার ভাগ্যে জ্বালাতন লিখিয়া
পাঠাইয়াছেন তাহার কিই বা
নূতন, কিই বা পুরাতন। তথাপি,
এত দুঃখের ভিতরও কৃষ্ণ
সৌভাগ্যক্রমে শীতের দেশে না জন্মিয়া
কলিকাতার মতো গ্রীষ্মপ্রধান শহরে
জন্মিয়াছে বলিয়া কিঞ্চিৎ আশ্বাসপ্রাপ্ত
হইল। বাহিরে
ততক্ষণে মন্দিরে পূজারী সান্ধ্য আরতি
করিতে করিতে গাহিতেছেন-- "হরি
দিন তো গেল সন্ধ্যা
হল পার করো আমারে।"
চিত্রঃ সংগৃহীত।
-----------*----------
সুস্মিতা পাল।