দেবাংশু সরকার
এক
এখানে যমুনা অনেকখানি বাঁক নিয়েছে। বেশ খরস্রোতাও। সচরাচর দেশি বিদেশি কোন নাও এখানে নোঙর বাঁধে না। লোকজন বনিক নাবিকদের খুব একটা যাতায়াত নেই যমুনা তীরের এই অঞ্চলটাতে। গাছগাছালিতে ঘেরা জঙ্গলাকীর্ণ এই নদী তটে রয়েছে এক পর্ণ কুটির। কবি জয় একাকী বাস করে সেই কুটিরে। অবশ্য পুরোপুরি একা নয়। সঙ্গীত তার সঙ্গী। কুটিরে বসে সে গান লেখে, সুর বাঁধে, সুর খোঁজে। যমুনার তটে বসে সে গান করে। তার একতারাতে খেলে যায় সাত সুরের সুর ঝঙ্কার। কত পানসি, কত নাও ভেসে যায় যমুনার বুক দিয়ে। বয়ে নিয়ে যায় হাজারো নাবিক, যাত্রীদের। তট থেকে ভেসে আসা জয়ের সেই গান তাদের কানে যায়। তারা চমকিত হয়, পুলকিত হয়, রোমাঞ্চিত হয়।
আরো একজন জয়ের গান শোনে। রজকিনী ভারতী। অস্পৃশ্য রজক কন্যা ভারতী। প্রত্যহ সকালে এদিকের নির্জন ঘাটে চলে আসে। অস্পৃশ্য রজক কন্যা বলে জনবহুল ঘাটে নামার অনুমতি নেই তার। সেইজন্য সে চলে আসে নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ এই ঘাটে। কাপড় কাচতে কাচতে সে গান শোনে। কি গান? কি তার মানে? কিছুই বুঝতে পারেনা সে। তবুও গান শোনে। মোহিত হয়ে গান শোনে। বিভোর হয়ে গান শোনে। নিজের কাজ থামিয়ে, হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে সে গান শোনে। গান থামলে তার সম্বিত ফিরে আসে, আবার সে নিজের কাজে মন দেয়।
একদিন সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় জয়ের কাছে। চোখ বন্ধ করে একাগ্র চিত্তে গান গাইছে জয়। সুর খেলা করছে তার গলায়, তার একতারায়। ভারতী গিয়ে বসে জয়ের পায়ের কাছে। এক সময়ে গান থামে, চোখ খোলে জয়ের। কিন্তু ভারতীর চোখ খোলে না। সুর মুর্ছনায় সে যেন মুর্ছিতা হয়ে পড়েছে।
- "কে গো তুমি কন্যে? কি চাও আমার কাছে?"
- "আমি ভারতী গো ঠাকুর। ভারতী রজকিনী। ঐ দুরের রজক পল্লীতে আমার বাস। ওখানেই কুটির বেঁধে থাকি আমরা। আরো অনেক রজকের বাস ওখানে। তারপর মাঝি পল্লী। সেখানে মাঝি মাল্লাদের বাস।"
- "তোমরা যমুনা তীরে ঘর বেঁধে থাকো। ঝড় বৃষ্টিতে অসুবিধে হয় না? তোমরা গঞ্জে থাকো না কেন?"
- "কি যে বলো ঠাকুর! আমরা হলেম ছোটজাত। অস্পৃশ্য, অচ্যুত। আমাদের গঞ্জে ঢুকতে দেয় না গো ঠাকুর। গঞ্জে বড় মানুষরা থাকে। রাজ পুরুষরা থাকে। গয়লারা থাকে। গয়লারাই তো দেশ চালায় গো ঠাকুর। দেশের যত গোশালা, গোধন সবইতো গয়লাদের ঠাকুর। দুধের ভান্ডার যে ওদের করায়ত্ব ঠাকুর। তুমি গয়লানীদের দেখনি, রোজ সকালবেলায় যমুনা তীরে দুধের বেচতে আসে।"
- "হ্যাঁ দেখেছি। রোজ ভোরে গোপ বালিকারা সারি দিয়ে গাগরী কাঁখে দুধ বেচতে আসে যমুনার ঘাটে। প্রায় মাঝ রাত থেকে কত নাও এসে ভেড়ে যমুনার তীরে। ব্যাপারী, পসারী, মাঝি মাল্লাদের ভিড়ে গমগম করে যমুনার তীর। তখন যমুনার এক রূপ আর অপরাহ্ণে অন্য রূপ। এই শান্ত স্নিগ্ধ যমুনাকে যে আমি দেখি গো কন্যে। দুচোখ ভরে দেখি। এই যমুনাকে যে আমি ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো গো কন্যে?"
- "আমাদের তো গয়লারা ওদিক পানে যেতে দেয়নে। তাই আমি ভিড় জমার আগে নদীর পাড় ধরে, গাছের আড়াল দিয়ে এখানে চলে আসি কাপড় কাচতে। আমি রজকিনী গো ঠাকুর, রজকিনী। ছোট জাত, নোংরা জাত। কিন্তু আমাদের হাতে পরিস্কার হয় বড় মানুষদের বস্ত্র। সেই বস্ত্র অঙ্গে নেয় বড় মানুষরা। আমরা নোংরা মেখে দূরে পড়ে থাকি, অস্পৃশ্য, অচ্যুত হয়ে।"
- "সে না হয় বুঝলাম। তোমার যন্ত্রনাটাও বুঝলাম। দুঃখ কোরোনা কন্যে। মনে বিশ্বাস রাখো একদিন তিনি আবার ফিরে আসবেন এই যমুনা তীরে। তাঁর মোহন বাঁশি আবার বেজে উঠবে এই যমুনা তটের কদম তলে। তিনি নিজের হাতে এই ছোটো, বড়, অস্পৃশ্যের ভেদাভেদকে মুছে দেবেন। সকলকে আশ্রয় দেবেন তার গিরি গোবর্ধনের তলে।"
- "কবে ঠাকুর, কবে সে আসবে? আমাদের দুঃখ কবে ঘুচবে?
- "আসবেন। নিশ্চয়ই তিনি আসবেন।"
- "ঠাকুর আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ। তোমার সব কথা বুঝতে পারিনে। তোমার গানও বুঝতে পারিনে ঠাকুর। কিন্তু শুনতে বড় ভালো লাগে। মন জুড়িয়ে যায়। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তোমার গান শুনতে শুনতে দুচোখ দিয়ে নেমে আসে জলের ধারা। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। কেন ঠাকুর কেন? কেন এমন হয়? তোমার গানে কেন এতো কান্না, এতো আবেগ জড়িয়ে থাকে? তুমি কি গান গাও ঠাকুর?"
- "ভগবানের নাম গান করি, কখনো প্রকৃতির গান আবার কখনো প্রেমের গান গেয়ে থাকি।"
- "প্রেমের গান! প্রেম কি গো ঠাকুর?"
- "প্রেম এক স্বর্গীয় অনুভুতি। ভগবানের দান। সকলের ভাগ্যে প্রেম জোটে না। পরম সৌভাগ্যবানই প্রেমের পরশ পায়।"
- "প্রেমের পরশ! তার মানে কি গো ঠাকুর?" কি করে পায় প্রেমের পরশ? প্রেম কোথায় থাকে গো ঠাকুর?"
- "দুর্জনে কয় শরীরে। সুজনে কয় হৃদয় মন্দিরে।"
- "হৃদয় মন্দির! সে কেমন মন্দির? ঐ যে দুরে দেখা যায় সোনায় মোড়া পাঁচ চুড়োর মন্দির, ওর থেকেও বড়? ওর থেকেও সুন্দর?" কথা বলতে বলতে ভারতীর চোখ চলে যায় যমুনার জলে। দেখে ব্যাপারীদের নাওগুলো ফিরতে শুরু করেছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, "ঐ দেখো ঠাকুর নাওগুলো আবার ভেসে চলেছে। তারমানে আজকের মত বেচাকেনা শেষ। গয়লানীরাও এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। এবার আমিও যাইগো ঠাকুর। বস্ত্রগুলোকে শুকিয়ে রাজা, মন্ত্রী, কোটালদের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিতে হবে। অনেক কাজগো ঠাকুর। এখন অনেক কাজ।"
কথা থামিয়ে ফিরে যায় ভারতী। তার পথপাণে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জয়। ভাবতে থাকে কে এই রজকিনী নারী? কেন সে বারে বারে ঢেউ তোলে তার মনে? কেন সে যমুনার ঘাটে বসে কাপড় কাচা থামিয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জয়ের দিকে? কি থাকে সেই দৃষ্টিতে? আকর্ষণ? মোহ? প্রেম? নাকি অন্য কিছু? রজকিনীকে দেখলে কেন জয় চিত্ত চাঞ্চল্য অনুভব করে? কেন এমন হয়? কেন? কেন? কেন? স্বভাব কবি জয় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গান গায়, সুর বাঁধে। সাধারণত সে ভক্তিগীতি গায়। গানের মাধ্যমে সে নিজেকে অর্পণ করে সর্বশক্তিমানের চরণতলে। কিন্তু রজকিনীকে দেখলে তার গানের সুর, তাল, লয় পাল্টে যায়। পাল্টে যাওয়া ভিন্ন মার্গের গীত যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত ভাসিয়ে নিয়ে যায় জয়কে। জয়ের প্রাণ, মন, আত্মাকে। অস্পৃশ্যা রমণী ভারতীর মধ্যে কিসের পরশ পায় সে?
বেলা বয়ে যায়। কাপড়ের বোঝা মাথায় নিয়ে ছুটে চলে রজকিনী ভারতী। কেন তার বারে বারে ছুটে আসতে ইচ্ছা করে জয়ের কাছে? কেন সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে জয়ের গান? কেন সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জয়ের মুখ পাণে? কেন তার শৈশবস্থার মত যমুনার তীরে খেলে বেড়ানোর বদলে ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করে? কেন? কেন? কেন? ভেবে চলে রজকিনী। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে!
কাপড়ের বোঝা মাথায় নিয়ে ছুটে চলেছে ভারতী। অষ্টাদশী রজকিনী ভারতী। তার পথ পাণে তাকিয়ে গান গাইছে জয়। কিন্তু কি গান গাইছে সে? গানের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! সুর যেন নিজের ছন্দে, নিজের লয়ে খেলে যাচ্ছে তার কণ্ঠে। যেন মা সরস্বতী তার কণ্ঠে বসে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। কিন্ত এ গানে তো ভগবানের স্তব নেই। স্তুতি নেই। নেই আরাধনা। এ গান যে ভক্তিগীতি নয়। এতো প্রেমের গান। ভালোবাসার গান। প্রেয়সীকে কাছে ডাকার গান। এ গানের সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠে কোকিল। শোনা যায় কুহুতান। পেখম মেলে ময়ুর। নেচে ওঠে বন ময়ুরী। জল কেলিরত মরাল মরালী ডান ঝাপটাতে থাকে। এ গানের সুরে সুর মিলিয়ে যমুনার তীরে বেজে ওঠে কোনো রাখাল বালকের মোহন বাঁশি। হাওয়ায় দুলতে থাকে তার শিখি পাখা। সেই বাঁশির ডাকে সাড়া দিয়ে ঝঙ্কার তোলে কোনো গোপ বালিকার নুপুর। জয়ের গান শুনে ফুটে ওঠে হাজারো ফুল।
যমুনাতে ভেসে চলেছে কত পানসি, কত নাও। তার সঙ্গে এক ময়ুরপঙ্খীও ভেসে চলেছে। ময়ুরপঙ্খীর মাঝি মাল্লারা হাল ছেড়ে একাগ্র চিত্তে শুনছে জয়ের গান। বেহাল ময়ুরপঙ্খী ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। কেবল মাঝি মাল্লারা নয়। জয়ের গান পৌছায় আরো একজনের কানে। ময়ুরপঙ্খী চড়ে ভেসে চলা রাজনন্দিনী বৃন্দার কানে। মন্ত্র মুগ্ধের মত গান শুনতে থাকে বৃন্দা। ভেসে চলে ময়ুরপঙ্খী, ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এক সময়ে আর শোনা যায় না জয়ের গান। কিন্তু যেটুকু গান শুনতে পেয়েছে বৃন্দা, সেইটুকু গান তার কান দিয়ে প্রবেশ করে, মরমে স্পর্শ করেছে।
পরের দিন আবার ময়ুরপঙ্খী ভেসে চলে যমুনার জলে। আজও ময়ুরপঙ্খীতে আছে রাজ নন্দিনী বৃন্দা। দুর থেকে দেখা যাচ্ছে কবি জয়ের পর্ণ কুটির। ভেসে আসছে তার গান। রজকিনী অনেক আগেই চলে গেছে। কিন্তু তার রেশ রয়ে গেছে জয়ের মনে, জয়ের গানে। বৃন্দার আদেশে গতি কমানো হয়েছে ময়ুরপঙ্খীর। ধীর লয়ে ভেসে চলেছে জলযান। যতক্ষণ জয়ের গান শোনা যায় চলতে থাকে ময়ুরপঙ্খী, কিছুদুরে গিয়ে মুখ ঘোরায়। এভাবে কয়েকদিন যমুনার জলে ভেসে বেড়ানোর পর বৃন্দার আদেশে ময়ুরপঙ্খী ভেড়ে যমুনার ঘাটে। বিশালাকার জলযানকে ঘাটে ভিড়তে দেখে গান থেমে যায় জয়ের। পরিচারিকা, সখি পরিবেষ্টিত রাজ নন্দিনী এগিয়ে আসে জয়ের দিকে। পরিচারিকাদের হাতে উপহারের ডালি। পরিচারিকাদের একজন বলে, "কবি, ইনি রাজনন্দিনী বৃন্দা। ইনি আপনার গানের গুনমুগ্ধ শ্রোতা। ইনি এসেছেন আপনার গান শুনতে।"
রাজ নন্দিনীকে প্রণাম জানিয়ে গান ধরে জয়। এবার আর তার গলা থেকে বের হয় না প্রেমের গান, ভালোবাসার গান, প্রেয়সীকে কাছে ডাকার গান। তার বদলে জয় গেয়ে ওঠে ভক্তিগীতি, ভগবানের প্রতি আত্মসমর্পনের গান।
ভালোলাগে না বৃন্দার। বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে তার মুখে। বৃন্দার মুখ দেখে তার মনের কথা বুঝতে পারে পরিচারিকা। সে জয়কে বলে, "দেবদেবীর গান নয়, কবি তুমি প্রেমের গান শোনাও। আমরা আসার আগে যে গান গাইছিলে, সেই গান আবার গাও।"
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে জয় আবার গান ধরে। কিন্তু স্রোতার মনের মত গান সে গাইতে পারে না। হাত জড়ো করে ক্ষমা চেয়ে সে বলে, "আমিতো নিজের ইচ্ছায় গান গাইতে পারি না মহাশয়া। কে যেন আড়াল থেকে আমাকে দিয়ে গান গাইয়ে নেয়।" বৃন্দা বুঝতে পারে জয়ের সমস্যা। সেদিনের মত সে ফিরে যায়।
ভারতী রজকিনী অনেক আগেই যমুনার ঘাট ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তার রেশ রয়ে গেছে জয়ের মনে। জগৎ সংসার ভুলে একাগ্র চিত্তে সে গান গেয়ে চলেছে। সুরের টানে, গানের ভেলায় যেন ভেসে চলেছে যমুনা তট । ফুলে ফুলে ভরে গেছে যমুনা তীরের কদম গাছ। শ্বেত বলাকারা ডানা মেলেছে নীল আকাশের বুকে। গান শুনছে হরিণ হরিণী, হংস মিথুন। আরও একজন মোহিত হয়ে গান শুনছে। আজ আর ময়ুরপঙ্খীতে নয়, ছোটো পানসিতে চেপে কেবল পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে যমুনা তীরে এসেছে বৃন্দা। জয়ের অলক্ষ্যে সে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে জয়ের কুটিরের পেছনে। জয়ের গীতসুধা পাণ করে প্রায় উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে বৃন্দা। পাগলিনী রাধার ন্যায় চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে তার। এক অমোঘ আকর্ষণে সে ছুটে যেতে চাইছে জয়ের কাছে। জয়ের সঙ্গে এক দেহে লীন হয়ে যেতে চাইছে সে। পরিচারিকা টেনে ধরে তার হাত। জয়ের কাছে ছুটে যাওয়া থেকে বিরত করে তাকে। কিন্তু কতক্ষণ? প্রেমের জোয়ারে ভাসতে থাকা বৃন্দা সব বাধা ছিন্ন করে ছুটে যায় জয়ের কাছে। দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে তাকে। থেমে যায় জয়ের গান। বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে বৃন্দা। বাহু বন্ধন আলগা হয়।
রাজ নন্দিনীর অনুরোধে আবার গান গাইতে শুরু করে জয়। কিন্তু এবার সে পারে না প্রেমের গান গাইতে। সে গাইতে থাকে ভক্তিগীতি। শুনতে ভাল লাগে না বৃন্দার। পিছিয়ে আসে সে। হাঁটতে থাকে পানসির দিকে।
জয় ভাবে কেন সে রাজ নন্দিনীর অনুরোধ রাখতে পারে না? কেন সে কেবল রজকিনীকে দেখলেই প্রেমের গান গেয়ে ওঠে? কি আছে রজকিনীর মধ্যে যা রাজ নন্দিনীর মধ্যে নেই? আজ আর কোনো গান সে গাইতে পারবে না। তার একতারা আজ আর তাকে সঙ্গ দেবে না। কুটিরে ফিরে আসে জয়। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। জঙ্গল থেকে আনা ফল দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে।
পানসিতে করে যেতে যেতে পৌঢ়া পরিচারিকা ভাবতে থাকে, কবি এত সুন্দর প্রেমের গান গায়। কিন্তু বৃন্দাকে দেখলে কেন তার গান বদলে যায়? রাজ নন্দিনীর রাজ পোষাক কি ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে কবিকে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? বিহ্বল বৃন্দাও ভেবে পায় না, কবি কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করে? কেন সে বৃন্দার সঙ্গে দুরত্ব বজায় রাখে? কেন সে বৃন্দাকে দেখলে সঙ্কুচিত হয়ে যায়? পরিচারিকার সঙ্গে সে আলোচনা করে, কিন্তু সদুত্তর খুঁজে পায় না। হদিস পায় না জয়ের মনের, আচরণের। কেন সে বৃন্দাকে দেখলে গান গাইতে পারে না? অন্য সময়ে সে কি করে গান গায়? কার জন্য সে গান গায়? কার উদ্দেশ্যে সে গান গায়? কে তাকে দিয়ে গান গাইয়ে নেয়? কোন শক্তি তাকে দিয়ে গান গাইয়ে নেয়?
পরিচারিকার সঙ্গে পরামর্শ করে গুপ্তচর নিয়োগ করে বৃন্দা। গাছের আড়াল থেকে গুপ্তচর নজর রাখে জয়ের ওপর। রোজ সকালে এক রজকিনী আসে জয়ের কুটিরের নিকটবর্তী ঘাটে। সে কেবল কাপড় কাচে না, সে জয়ের সঙ্গে কথা বলে, গান শোনে। রজকিনী আসার পর যেন গানের বান ডাকে জয়ের গলায়। এক মনে সে গান শোনে। হাতের কাজ শেষ করার পর অনেকক্ষণ সে বসে থাকে গান শোনার জন্য। নিঃশব্দে এগিয়ে আসে গুপ্তচর। গাছের আড়াল থেকে রজকিনীকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় গুপ্তচর। এটা কি করে সম্ভব? রজকিনীকে দেখতে অবিকল রাজনন্দিনী বৃন্দার মত! দুজন মানুষকে কি করে একই রকম দেখতে হয়?
গুপ্তচর গিয়ে খবর দেয় পৌঢ়া পরিচারিকাকে। পরিচারিকা তাকে বলে আরো খবর নিতে। কোথায় তার বাস? আর কে কে থাকে তার সঙ্গে? আবার গুপ্তচর পিছু নেয় ভারতীর। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সে গিয়ে পৌছায় রজক পল্লীতে। বহু বছরের অভিজ্ঞ গুপ্তচর জানতো না যে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য।
দুই
রাজ দরবারে বসেছে রাজ সভা। সুউচ্চ রাজ সিংহাসনে বসে আছেন মহারাজ নরসিংহ। পাত্র, মিত্র, সেনাপতি, কোটালরা উপস্থিত রাজ সভায়। উপস্থিত রয়েছে ভিন দেশী বনিকরা। বিচার প্রার্থী এবং বিচারাধীন বন্দিরাও আছে সেখানে। রাজ সভা চলাকালীন খবর এলো রাজ্যের উত্তর সীমানায় আবার পাহাড়ী উপজাতিরা হামলা চালাতে শুরু করেছে। তারা নির্বিচারে লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, নরহত্যা চালাচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠেছে নিরীহ প্রজারা। বারে বারে তারা প্রতিকারের জন্য রাজ দরবারে আসছে। বহু প্রজা ঘর বাড়ি, জমি জায়গা ছেড়ে বহুদুরে চলে গেছে। খবরটা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মহারাজ নরসিংহ। ভাবছেন এবার কঠোর হাতে এই হানাদারদের দমন করতে হবে। এবারে সশস্ত্র সেনা বাহিনী পাঠাতে হবে হানাদারদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
যুবরাজ ভরত নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবেদন করে যে সে এই সশস্ত্র সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দিতে চায়। মহারাজ চিন্তা করছেন ষোলো বছরের যুবরাজ ভরত গুরুকুল থেকে অস্ত্র শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। সম্পন্ন করেছে পুঁথিগত শিক্ষা। যুবরাজ ভরতের হাতের তির, তলোয়ারে বিদ্যুতের চমক দেখা যায়। কিন্তু এখনো তার যুদ্ধ শিক্ষা সেভাবে পরীক্ষিত হয়নি। এবারে সেই পরীক্ষার সময় এসেছে। মহারাজ সাড়া দিলেন তার আবেদনে। সঙ্গে দিলেন বিশাল এক সেনাবাহিনী এবং কয়েকজন দক্ষ সেনাপতিকে। যাতে অনভিজ্ঞ যুবরাজ যুদ্ধের প্রান্তরে কোনো ভুল না করে বসে।
প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। লড়াকু পাহাড়ী উপজাতি অস্ত্র হাতে রে রে করে তেড়ে এলো রাষ্ট্রীয় সেনা বাহিনীর দিকে। অভিজ্ঞ সেনাপতিরাও বুঝতে পারেনি যে এরকম প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু তরুণ যোদ্ধা ভরত এত সহজে হার মানতে রাজি নয়। তার নিপুণ হাতের অস্ত্র চালনায় এবং কুশলী সেনা পরিচালনায় এক সময়ে ভেঙে পড়ে পাহাড়ীদের প্রতিরোধ। ভরত তার অস্ত্রাঘাতে পাহাড়ীদের কেবল সীমানা ছাড়া করলো না, তাদের বহুদূর অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেল। অভিজ্ঞ সেনাপতিরা ভরতকে বারণ করেছিল যে শত্রুদের তাড়া করে বেশি দুরে না যেতে। কিন্তু অনভিজ্ঞ ভরত সে কথায় কান না দিয়ে ঘোড়ায় চেপে দৌড়ে চলে শত্রুর পেছনে। সে খেয়াল করেনি যে তার সেনারা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আচমকাই গাছের আড়াল থেকে ছুটে আসা একটা তির বিঁধে যায় তার পিঠে। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারায় ভরত।
প্রায়ান্ধকার কুটিরে টিম টিম করে জ্বলছে একটা মাটির প্রদীপ। মাটিতে খড়ের বিছানায় কিছুটা কাৎ হয়ে শুয়ে আছে ভরত। তার পিঠে জড়ি বুটির প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে এক বৃদ্ধ। দুধ ভর্তি মাটির পাত্র হাতে এক তরুণী পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় ভরত। জানতে চায় সে কোথায়। বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করে বলে যে সে নিরাপদে এবং সুরক্ষিত আছে। চিকিৎসার পর বৃদ্ধ সেই কুটির থেকে বেরিয়ে যায়। এগিয়ে আসে তরুণী। আহত অবসন্ন ভরত উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তরুণী এগিয়ে এসে তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে।
- "এই ঔষধি যুক্ত দুধটা খেয়ে নিন কুমার। দেখবেন আবার শরীরে বল ফিরে পাবেন।"
- "আমি এখানে এলাম কি করে? আমার সেনাদল কোথায়?"
- "আপনি একা ছিলেন কুমার। আহত হয়ে, মুর্ছিত হয়ে পথের ধারে পড়ে ছিলেন। গ্রামের মানুষরা আপনাকে তুলে আনে। আপনার পোষাক দেখে মনে হয় আপনি কোনো রাজ পুরুষ, কোনো যোদ্ধা।"
নিজের পরিচয় দিতে গিয়েও চুপ করে যায় ভরত। বুঝতে পারে না সব কিছু বলা ঠিক হবে কিনা। ভরত বুঝতে পারে না এরা শত্রুদের অধীনস্থ কিনা। কিন্তু কিছুতো বলতে হবে।
- "না মহাশয়া, আমি কোনো রাজ পুরুষ নই। আমি একজন সামান্য আখেটক। পশু শিকার করে দিন যাপন করি। আমি এক রাজ কুমারের সঙ্গে মৃগয়া করতে বেরিয়ে ছিলাম। সেই রাজ কুমার আমাকে এই পোষাক দান করেছে।"
- "কিন্তু আপনি যে বললেন আপনার সঙ্গে সেনাদল ছিল?"
চমকে ওঠে ভরত। ভাবে এবার থেকে সাবধানে, ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে। সে বলে, "হ্যাঁ ছিলতো। সেই রাজ কুমারের সঙ্গে একটা ছোটো সেনাদল ছিল। আমরা যখন আখেটের পেছনে ছুটে চলেছি, তখন সেনা দল অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। তারপর কি হলো জানিনা।"
- "তারপর আপনাকে গ্রামের লোকরা বৈদ্য মশাই অর্থাৎ আমার পিতার কাছে নিয়ে আসে। আপনার পুরো সুস্থ হতে এখনও কিছু দিন সময় লাগবে।"
কয়েক দিন কেটে যায়। এর মধ্যে কিছুটা সুস্থ হয়েছে কুমার ভরত। মনের দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি এসেছে ভরত এবং সেবা দানকারিনী তরুণী।
- "আমি আখেটক। আমার নাম ভরত। আমি প্রাণী হত্যা করে খাই। আর তোমরা প্রাণ বাঁচিয়ে খাও। কত অমিল আমাদের মধ্যে! তোমার নাম কি?"
- "আমার নাম গঙ্গা। কিন্তু কুমার তুমি কেন প্রাণী হত্যা কর? বেঁচে থাকার মত আর কোনো কাজ কি নেই এই পৃথিবীতে? ঘৃণা থেকে হত্যার ইচ্ছা জাগে। ঘৃণার বদলে ভালোবেসে দেখো। দেখবে তোমার পৃথিবীটা বদলে যাবে।"
- "ঠিক আছে গঙ্গা। তোমার কথা আমি রাখবো। আত্মরক্ষা ছাড়া আর কোনো কারনে আমি অস্ত্র ধরবো না।"
বৈদ্য মশাইয়ের চিকিৎসায় এবং গঙ্গার সেবায় দ্রুত সুস্থ হতে থাকে ভরত। গঙ্গার সেবা এবং আন্তরিক ব্যবহারে ভরতের মনে এক কৃতজ্ঞতার জন্ম নেয়। সেই কৃতজ্ঞতা ক্রমশ ভালোলাগাতে পরিনত হয়। অন্যদিকে শিকারি ভরতকে বেশ ভালো লেগে যায় গঙ্গার। এই ভালোলাগা ভালোবাসাতে পরিনত হতে বেশি সময় লাগে না। ছোট্ট মাটির কুটিরেই হয় মন দেওয়া নেওয়া। ক্রমশ কাছাকাছি আসে দুই মানব মানবী। ক্রমশ কাছাকাছি আসে তাদের মন। ক্রমশ কাছাকাছি আসে তাদের শরীর। একদিন ভরত তার আসল পরিচয় দেয়। সঙ্গে থাকা কিছু স্বর্ণমুদ্রা এবং রাজ বংশের বিশেষ কিছু স্মারক গঙ্গাকে দিয়ে বিদায় নেয়। কথা দিয়ে যায় কিছু দিনের মধ্যেই ফিরে এসে গঙ্গাকে নিয়ে যাবে।
রাজনীতির জালে জড়িয়ে পড়া ভরতের আর ফিরে আসা হয় না। অন্যদিকে অন্তঃসত্ত্বা গঙ্গা কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। বৃদ্ধ বৈদ্য মশাই মহা সমস্যায় পড়ে সদ্যোজাত কন্যাটিকে নিয়ে। অবশেষে এক নিঃসন্তান রজক দম্পতির আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেয় শিশুকন্যাকে। সঙ্গে দেয় ভরতের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রা এবং রাজ বংশের স্মারকগুলো।
তিন
ভারতীর পিছু পিছু গুপ্তচর এসে পৌছায় রজক পল্লীতে। যমুনা তটে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটা কুটির। মালিন্যে পুর্ণ কুটিরগুলিতে দারিদ্র্যতার ছাপ স্পষ্ট। প্রায় প্রত্যেকটা কুটিরের সামনে সুর্যালোকে শুকনো হচ্ছে পরিস্কার করে কেচে আনা সৌখিন অঙ্গ বস্ত্র। তেমনি এক কুটিরের সামনে এসে ভারতী রোদে শুকোতে দিচ্ছে সদ্য কেচে আনা কাপড়গুলো। একমনে নিজের কাজ করছে ভারতী। খেয়াল করেনি কখন এক ব্যাক্তি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
- "তোমার নাম কি কন্যে?"
ঘাড় ঘুরিয়ে অচেনা ব্যাক্তিকে দেখে সে বলে, "আমার নাম ভারতী। কিন্তু আপনি কে মহাশয়? আপনাকেতো আগে কোনো দিন দেখিনি!"
- "আমি একজন রাজপুরুষ। তোমার অভিভাবককে ডেকে আনো। বিশেষ দরকার।"
কিছুটা ঘাবড়ে যায় ভারতী। দৌড়ে সে কুটিরের মধ্যে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পরে এক বৃদ্ধ কুটির থেকে বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় গুপ্তচরের দিকে।
বৃদ্ধকে দেখে এগিয়ে আসে গুপ্তচর। নিজের গুপ্তচর বৃত্তিকে গোপন রেখে, রাজপুরুষ বলে পরিচয় দিয়ে ভারতীর পিতৃ পরিচয় জানতে চায়। বৃদ্ধ নিজেকে ভারতীর বাবা বলে পরিচয় দিলে, ধমকে ওঠে গুপ্তচর।
বৃদ্ধ রজকের কাছে ভারতীর সম্বন্ধে জানতে চায় গুপ্তচর। প্রথমে বৃদ্ধ রজক কিছু বলতে না চাইলেও, গুগুপ্তচরে ধমকে সবকিছু স্বীকার করে। রাজ বংশের স্মারকগুলো দেখায়।
গুপ্তচর এবার আর বৃন্দার পরিচারিকাকে নয়, সবকিছু জানায় মহারাজ ভরতকে। দেখায় স্মারকগুলো। গুপ্তচরের মুখে রজকিনীর কথা শুনে মহারাজের মনে পড়ে যায় অতীতের কথা। বৈদ্য কন্যা গঙ্গার কথা। সত্যিই অনেক অবিচার হয়ে গেছে গঙ্গার সঙ্গে। অস্থির হয়ে ওঠেন মহারাজ ভরত। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। মহারাজ ভরত ছুটে যান রজক পল্লীতে। কাছে টেনে নেন তার হারিয়ে ফেলা কন্যা ভারতীকে। অশ্রু সজল পরিবেশে মিলন হয় পিতা পুত্রীর। রাজনন্দিনী ভারতী সসম্মানে স্থান পায় রাজ প্রাসাদের অন্দর মহলে। আদরিনী কন্যাকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হয়ে ওঠেন মহারাজ ভরত।
- "পিতা, আমাকে একবার যমুনার তীরে যেতে হবে।"
- "কেন কন্যে?"
- "এক কবি থাকে যমুনার তীরে। সে আমাকে সাহস যোগাতো। বারে বারে বলতো একদিন আমার দুঃখ কেটে যাবে। সুদিন আসবে। তার কথা আজ সত্যি হয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে। মাত্র একবারের জন্য আমাকে যমুনার তীরে যাওয়ার অনুমতি দিন।"
- "যাও কন্যে যাও। তোমার শুভাকাঙ্খীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসো। তবে খালি হাতে যেও না। রাজকীয় উপঢৌকন নিয়ে যেও।"
সখি, পরিচারিকা পরিবেষ্টিত হয়ে রাজ নন্দিনী ভারতী পৌছালো যমুনার তীরে।
- "ঠাকুর আমি ভারতী। রাজ নন্দিনী ভারতী। তোমার শুভেচ্ছা আজ পুর্ণ হয়েছে আমার জীবনে। বাঁশিওয়ালার আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে আমার ওপরে। রজকিনী থেকে আজ আমি রাজ নন্দিনী। তোমার সঙ্গে আমি দেখা করতে এলাম ঠাকুর। হয়তো এই শেষ দেখা। আজ শেষবারের মত আমাকে গান শোনাবে না ঠাকুর? প্রেমের গান, ভালোবাসার গান।
অনেক চেষ্টা করেও প্রেমের গান গাইতে পারে না জয়। কি করে গাইবে সে প্রেমের গান? রজকিনী ভারতী যে তার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রেমের গানও বিদায় নিয়েছে তার কন্ঠ থেকে। তাহলে যমুনা তীরে থেকে কি করবে সে? সে বিদায় নিলো যমুনার তীর থেকে। শূণ্য হয়ে গেল তার পর্ণ কুটির।
পরিচারিকা এসে বৃন্দাকে খবর দেয়, আবার কোন এক রাজ নন্দিনী এসেছে প্রাসাদে। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই বৃন্দার। সে জানে মহারাজ বা অন্যান্য কুমারদের একাধিক পত্নী বা উপপত্নী থাকে। তাদের মধ্যে কারো কন্যা হয়তো এসেছে। সে সব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তার। সে আজ রাজ নন্দিনীর বস্ত্র ছেড়ে অঙ্গে তুলে নিয়েছে রজকিনীর বেশ। সে দেখতে চায় রাজ নন্দিনী বৃন্দাকে অবজ্ঞা করলেও, রজকিনী বৃন্দাকে কবি অবজ্ঞা করতে পারে কিনা?
- "একি! রাজনন্দিনী তোমার অঙ্গে এমন মলিন বসন কেন? কোথায় চললে এই পোষাক পরে?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পরিচারিকা।
- "অভিসারে গো, অভিসারে। রজকিনী বৃন্দা এখন যাবে কবির সাথে দেখা করতে। প্রেমের গান শুনতে। কবির সঙ্গে মন, প্রাণ, হৃদয় এক করে দিতে।"
শূণ্য ঘাট, শূণ্য কুটির। কবিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘাটে এসে একাকী বসে রজকিনী বৃন্দা। অপেক্ষা করতে থাকে কবির জন্য। দিন যায়, মাস যায়। রজকিনী বৃন্দার অপেক্ষার শেষ হয় না। সে বসে থাকে কবির অপেক্ষায়। হয়তো কোনো দিন আবার কবি ফিরে আসবে। গান গেয়ে রজকিনীকে ভাসিয়ে দেবে ভালোবাসার স্রোতে, প্রেমের জোয়ারে।
----------------------------------------------------------------------
দেবাংশু সরকার
34/10/A, M.G.ROAD
BUDGE BUDGE,
KOLKATA - 700137