- মৃণাল কান্তি দেব
"Change not thy nature, gentle bloom,
Thou violet, sweet and pure…. "
৬ই জানুয়ারি,১৮৯৬। নিউইয়র্ক থেকে স্বামীজী Sister Chirstine এর উদ্দেশ্যে লিখলেন এমন একটি কবিতা যার বিস্তৃতি কেবল কবিতা, কিছু গভীর অর্থ, কিছু উন্নত ভাবনার পরিধিতিতেই আটকে থাকলো না, বরং তা নতুনভাবে জাগ্রত করলো সামাজিক চোরাখাতে আটকে থাকা বৃহত্তর সৃষ্টি, ছন্দ ও লড়াইয়ের প্রশাখাকে। একথা আমরা জানি যে স্বামীজী ছিলেন একজন প্রকৃত ও ব্যতিক্রমী অনুসন্ধানী, আবিষ্কারক যিনি কঠিন ও ভয়ঙ্কর আবহর মাঝে থেকেও সংগ্রহ করতে পারতেন সৃষ্টি, সৃজন, শিল্প ও বিশ্বচেতনার শিকড়কে। না,তিনি তাঁর ভাবনাকে কেবল তাঁর ভাবনার গন্ডিতেই আটকে রাখেননি - তিনি তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে বিশেষত সংবেদনশীল মানুষ ও যুবসমাজের মাঝে। স্বামীজী দেখিয়েছেন, অতি সূক্ষ কিংবা সাধারণ চোখে তুচ্ছ এমন বিষয় থেকেও দুর্দান্ত জ্ঞান আহরণ করা যায় এবং সেই জ্ঞানকে বৃহত্তর পরিধিতে মিশিয়ে দিয়ে সমগ্র বিশ্বের শিরা উপশিরাকে উন্নত চেতনাশিরায় রূপান্তর করা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই, যেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয় আবেগময় সাধারণ চোখেও স্নিগ্ধতা হিসেবে ধরা পড়ে, সেখানে স্বামীজীর মতো বিশ্লেষক, অনুসন্ধানী মানুষও যে বিষয়টিকে আরো বৃহত্তম দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়। স্বামীজী সেই মানুষ যিনি জীবনের বর্ণালীতে আর শাশ্বত পর্দায় দেখিয়েছিলেন প্রাচ্যর উন্নত বোধ আর পশ্চিমের শোভা -এই দুই এ মিলেই তৈরী হয় বিশ্ববাদী তরঙ্গ। স্বদেশের মাটি থেকে বিদেশের মাটি সর্বত্র তিনি অন্বেষণ করতে চেয়েছেন উন্নত গভীরতা-গভীর ভাব, গভীর বোধ, গভীর আবহ, গভীর নান্দনিকতা, গভীর চেতনা, গভীর প্রেম তথা বিশ্বপ্রেম। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা তো এটাই, আর এটাকেই অধ্যয়ন করে গিয়েছেন তিনি আজীবন। প্রকৃতিপ্রেম আর বিশ্বপ্রেম বৃহত্তর প্রেমেরই শাখা। দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও স্বামীজী তা এক করে দিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞ ভাবনা থেকে। তিনি বার্তা দিয়েছেন, জটিল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে অগভীর স্রোতের বিপরীতে চলতে থাকা মানুষদের নিজস্ব কাজ করে যেতে হবে, বিকশিত করতে হবে ঠিক প্রকৃতির কোলে প্রস্ফুটিত কুসুমের মতো। বেগুনি পাপড়ি সামগ্রিক প্রকৃতি ভালোবাসে তাই সে দুর্যোগের মাঝেও ধরা দিতে চায়। সে চায় প্রকৃত সময়ের আগেই নিজেকে বিকশিত করতে, তার স্বপ্নউড়ানকে বাঁচিয়ে রাখতে। প্রকৃতঅর্থে সে চায় প্রতিকূল অবস্থায় নিজের স্বাভাবিক ছন্দের উপর ভর দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি স্তরে লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে দিতে। ফুল প্রকৃতি ভালোবাসে। আবার ফুল চায় সময়ের আগে নিজের বিকাশ ঘটিয়ে সামাজিক দেওয়ালে জুড়ে থাকা প্রকৃতিকে বার্তা দিতে। স্বামী বিবেকানন্দ ব্যতীত এরকম ভাবনা আর কার মাথায় আসতে পারে? স্বামীজীর সাধনপথ ও রচনা থেকে জানা যায়, প্রকৃতিবাদ,রোমান্টিকতা আর আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে এক হয়ে যায় অন্বয়বাদী ভালোবাসার দুরন্ত বহির্বিশ্বে এবং বিশ্ববাদে। কিন্তু এগুলো বাদেও যে বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন তা হলো স্বামীজীর অন্তর্বিশ্বতে যে সৃষ্টিশীল তরঙ্গ তৈরী হয়েছিল তার স্বরূপ নিয়ে। কারণ এই তরঙ্গ একদিকে যেমন রোমান্টিকতাতে পরিপূর্ন, অন্যদিকে এটি পরিপূর্ণ জীবনের লড়াইমন্ত্রে।
কোমল হৃদয় দৃঢ়তায় মোড়া রশ্মিতে আলোকিত হলে তবেই সমাজে আনা যায় রেনেসাঁ। প্রাচ্যতেও আলো আঁধারের লুকোচুরি খেলা চলে, পাশ্চাত্যতেও তাই। দুই স্তরের আলোর মধ্যে গঠনগত ভিন্নতা থাকলেও স্বামীজী চেয়েছেন তাকে এক করতে। তাই স্বামীজী বারেবারে গুরুত্ব দিয়েছেন সামগ্রিকতাকে। যুবসমাজ সারা বিশ্বের। তাই তিনি বৃহত্তর দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন। যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে, পরিধি বাড়াতে, সংযোগ তৈরী করতে, অন্বয়ীটানের অগ্নিকে বরণ করতে, আর প্রজ্ঞাঘেরা বিশ্বপ্রেমকে স্বীকৃতি দিতে। একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, সূক্ষতাকে গুরুত্ব দিলে শিকড় চেনা যায়, শিকড় চিন্তে পারলেই সমাজ বোঝা যায়, আর স্নিগ্ধতাকে ভালোবাসলে আপনজনের পরিধিকে বৃদ্ধি করা যায়। আর এটা হলে তবেই ঈশ্বরের ঐশ্বরিক রেখাকে অনুভব করা যায়।
উন্নত ভাবনার "বিগ টেন্ট" রূপে দণ্ডয়মান থাকা নিউইয়র্কের আবহকে তিনি বুঝেছিলেন। সেই আবহর একদিকে আবহহাওয়াভিত্তিক শীতলতা, অন্যদিকে নগর সভ্যতার জটিল কঠিন অসুখ। আর সেই কঠিনতার চোখে চোখ রেখেই কেউ বেড়ে উঠতে চায়। স্বামীজী যখন "To an Early Violet " লিখছেন তখন আরো প্রকট হতে শুরু করেছে সম্পর্কের শীতলতা, স্বার্থপরতা, তীব্র কূটনীতি, মিষ্টি ঘাত -প্রত্যাঘাত, ক্ষমতা দখলের লড়াই। সবথেকে যে বিষয়টা তাঁর হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো তা হলো- উন্নত সভ্যতার উজ্জ্বলতাতে বেড়ে ওঠা তরুণ তুর্কিদের একাংশ তাদের ঠিকঠাক বিকশিত করতে পারছে না। স্বামীজী ভীষণ দক্ষ পর্যবেক্ষক ও দার্শনিক বলেই এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। যেকোনো দেশে একটা সমস্যা কমন। তা হলো - সময়ের নিরিখে এগিয়ে থাকা কুঁড়িরা বারংবার আছড়ে পড়ে প্রতিকূল আবহের ভয়াবহ গতির সম্মুখে। স্বামীজী সেই জন্যই চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা বলতেন। স্বরকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে সমাজের স্বরলিপি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পরিব্রাজক হিসেবে, অন্বেষণকারী হিসেবে ঘুরতে ঘুরতে স্বামীজী মুগ্ধ হয়ে যান হালকা বরফের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভায়োলেট ফ্লাওয়ারগুলোকে দেখে। এও তো প্রেমের এক বিশেষ দিক। রহস্যা প্রকৃতিকে ছুঁতে চাওয়া এক বিশেষ সৃষ্টি যেন সাধনা করে যাচ্ছে! তিনি উল্লেখ করেছেন "Frozen earth "এবং " chilling blast " এর মতো শব্দবন্ধ। বরফের মাঝে বাসন্তীকে সত্ত্বা জাগ্রত হলে তাকে যে দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, মূলত সেটাই তুলে ধরেছেন স্বামীজী। অর্থাৎ স্ব বিকাশ ও বৃহত্তম লক্ষ্যপূরণের জন্য গঠনকারী মানুষদের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। "Frozen " কথাটি তিনি ব্যবহার করেছেন এটা বোঝাবার জন্য, যে বিশ্বর প্রধাণ শিরা নিস্তেজ। ঝিমিয়ে থাকা, শীতল হয়েছে জমে যাওয়া সভ্যতার বুকে ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত কুয়াশার অবস্থানকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। Earth কথাটি তিনি ব্যবহার করেছেন সমগ্র বিশ্বকে বোঝাবার জন্য। সমস্ত বিশ্বজুড়ে প্রতিকূলতায় গজিয়ে ওঠা বাসন্তীক ইচ্ছেস্রোতকে তিনি তুলে ধরেছেন,উৎসাহ প্রদান করেছেন। স্বামীজীর চেতনা যে বিশ্বের প্রতিটি শিকড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় নানা বাক্যবন্ধে। যেমন
"Thy sky with gloom o'ercast –" কিংবা "...... if bad o'er good prevail…"
স্বামীজী প্রকৃতির সাথে একাত্ম। আর খামখেয়ালি প্রকৃতির সাথে একাত্ম সেই ভায়োলেট। খামখেয়ালি প্রকৃতির সাথে মিশেছে সামাজিক দূষণ যাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে যে ভালোর উপর সকল মন্দ জাঁকিয়ে বসেছে। স্বামীজী সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করেছিলেন যে মানবপ্রেমকে যতদিন না সামাজিক শিরার সাথে জুড়ে ফেলা যায়, ততদিন এই বিষয় চলতে থাকবেই। তাই তিনি ভায়োলেটকে বলেছেন,
তুমি তোমার মতো বিকশিত হও, নিজের সত্ত্বাকে পরিবর্তন কোরো না। যে মানুষের কাছে আধ্যাত্মিকতার অর্থ অনেক গভীর, যা বিশ্ববাদী অক্ষকে ছাপিয়ে আরো ঊর্ধমুখী, সে মানুষের কাছে প্রকৃতির সাহানারাগে জন্ম নেওয়া লড়াকু কুসুমকে যে মনের সরগমের সাথে বেঁধে রাখবেন এটাই স্বাভাবিক।
Sister Christine স্বামীজীর সাথে পরিচিত হন ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি ধর্মসভা থেকে। ওই সভাতে স্বামীজীর কণ্ঠে মানবপ্রেম,বিশ্বপ্রেম এর কথা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। স্বামীজীর সাথে তাঁর বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছিল । পত্রের মারফত যোগাযোগ বেড়েছিল। পরবর্তী সময়কালে তিনি স্বামীজীর দেখানো পথ অনুসরণ করেন এবং শিক্ষাবিস্তারের কাজে ব্রতী হন। Sister Christine ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। স্বামীজী চেয়েছিলেন তাঁর গভীর ভাবনা স্পর্শ করুক Christina Greenstidel কে। প্রতিকূলতার বেড়াজালকে মনের জোরে, আত্মবিশ্বাসের সাথে পরাজিত করে এগিয়ে যাওয়াটাই প্রকৃত লড়াই এর পরিচয়। স্বামী বিবেকানন্দ এই জায়গাটাকেই চিহ্নিত করেছিলেন। Violet যদি টিকে থাকে, তাহলে আমাদেরও টিকে থাকা উচিত এবং সমাজের অভিমুখকে বদলে দিয়ে সামাজিক কাঠামোর পুনরুদ্ধার করা উচিত।
এসবের পাশাপাশি আর একটি বিষয়ের দিকে মনোনিবেশ করতেই হয়, তা হলো ".... Love itself doth fail…এই অংশটি। স্বামীজী বলেছেন অন্ধকার মুহূর্তেও সাদা সাদাই থাকে, মিষ্টিভাবও বজায় থাকে। এর পাশাপাশি তিনি উক্ত বিষয়টিও বলেছেন। কেন বলেছেন? বলেছেন তার কারণ জীবনে চলার পথে এমন কিছু বিষয় থাকে, যেখানে আমরা হয়তো সবসময় জিততে পারি না বা অর্জন করতে পারি না। কিন্ত আমাদের জেতার ইচ্ছে,অর্জনের প্রচেষ্টা? এ জিনিস কখনোই আমাদের ছেড়ে যায় না। আর সবথেকে বড়ো বিষয় কোনো কিছুর অপ্রাপ্তিতে কিংবা আঘাতে কি আদৌ আমাদের inner beauty, sweetness এর উপর black spot পড়ে? কখনোই নয়। স্বামীজী violet এর মাধ্যমে বুঝিয়েছেন এমন স্নিগ্ধতাকে, যাকে ভালোবাসতে পারে এমন সত্ত্বা, যে স্নিগ্ধতা, লাবণ্যতে মোড়া। ঝিমিয়ে পড়া, বরফে জমে যাওয়া, উষ্ণতার বদলে আরো হিমশীতল অবস্থার দিকে চলে যাওয়া মুহূর্ততে প্রেমের মল্লার ধাক্কা খাবেই। কিন্তু তার কারণে থেমে থাকা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, বদলে ফেলা কিংবা লড়াই করতে করতে পিছিয়ে আসা -এগুলোর একটাও করা যাবে না। Early Violet তাঁরাই যারা সময়ের আগে প্রস্ফুটিত হয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যান।স্বামীজী দেখিয়েছেন, যুবসমাজ এক একটা ভায়োলেট ফ্লাওয়ার, কাজেই তাঁদের আত্মবিশ্বাস,কোমল হৃদয় এবং দৃঢ়তা -সবকিছু নিয়েই এগোতে হবে।
– ১৮৯৭ সালের ৯ই জুলাই। আমেরিকা নিবাসী বন্ধুর উদ্দেশ্যে স্বামীজী লিখলেন "The Living God" কবিতাটি। তিনি লিখলেন,
"He who is in you and outside you,
Who works through all hands,
Who walks on all feet,
Whose body are all ye,
Him worship, and break all other idols!"
যদি ভারতবর্ষকে চেনার অন্যতম প্রধাণ উপায় হয় স্বামীজীকে জানা, তাঁকে গভীরভাবে বোঝা ও অধ্যয়ন করা, তাহলে স্বামীজী, ঈশ্বর ও হিন্দুত্ববাদকে উপলব্ধি করার অন্যতম প্রধাণ উপায় হল স্বামীজীর লেখা এই কবিতাটিকে আরো গভীর ও বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা। খুব ভালো ভাবে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে, স্বামীজী খুব দৃঢ়ভাবে কর্মযোগকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি এতটাই দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন "break all other idols "। কেন এই কথা বলেছেন, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ন কোন সময়ে তিনি এই কথা বলেছেন। প্রচলিত ও ঘন অধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ স্তর ছোয়ার পরেও তিনি হেটেছেন মানবজাতির অন্দরে যে ঈশ্বর থাকেন সেই ঈশ্বরপথের দিকে। আর ঠিক এই পথেই আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত অর্থটি প্রোথিত। যদি আমরা সময়রেখার উপর তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, স্বামীজী সেই শুভ্র সুন্দর পরমসত্যে রঞ্জিত জ্যোতির দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তিনি বলেছেন অন্যান্য পুতুলপ্রতিমাকে ভাঙতে। ঠিক এখানেই এক হয়েছে স্বামীজীর দার্শনিকতা, উচ্চ বোধ, সুতীব্র সমাজচেতনা, অনিন্দ্যসুন্দর বিশ্ববাদী ভাবধারা। স্বামীজী মনে করতেন, "each soul is potentially divine.."। ঝিমিয়ে থাকা তারুন্যকে লাবণ্যময় করে তুলতে,সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বোধ, প্রজ্ঞা, যুক্তি, গঠনকারী মানসিকতাকে আনতে এবং মানুষের যে একটাই পরিচয় সে মানুষ -এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই তিনি উক্ত কথাটি বলেছিলেন। এর মানে এটা নয় যে তিনি দেবমূর্তি ভাঙতে বলেছেন। তিনি বলেছেন সঠিককর্ম, সঠিকপথ কে মন্ত্র, যজ্ঞ ও আচারে মোড়া গন্ডির থেকে মুক্তি দিতে। মূর্তির মধ্যে দেবত্ব সত্ত্বা বিদ্যমান কিন্তু মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। অর্থাৎ নিস্তেজ হয়ে থাকা সত্ত্বাকে সতেজ করে তুলতে হয়। স্বামীজী বুঝেছিলেন, যেখানে প্রাণ ইতিমধ্যেই রয়েছে সেখানে প্রাণের সক্রিয়তাকে বৃদ্ধি করতে পারলেই সামাজিক কাঠামোতে আনা যাবে প্রকৃত চেতনধারা। কাজেই তিনি জোর দিয়েছিলেন জাগ্রত দেবতার দিকে। ভারতবর্ষের সামাজিক কাঠামোতে থাকা দুটো বিষয় স্বামীজী নিরীক্ষণ করেছিলেন। এক - ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিকতা, দুই - ভেদাভেদ। দুটি বিষয় পরস্পর বিপরীতধর্মী। ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম এক স্তম্ভ হিসেবে থাকা আধ্যাত্মিকতাকে মূলত সমন্বয়ী উপাদান হিসেবেই পরিলক্ষিত করার হয়।
সৌভাতৃত্বেবোধ আর মানব কল্যাণের জন্য এগিয়ে যাওয়া -এই দুই বিষয়ের মাঝেই রয়েছে বৃহত্তর ঈশ্বরবাদ। এখানেই স্বামী বিবেকানন্দ সবথেকে বড়ো বিপ্লব আনলেন। আধ্যাত্মিকতাকে তিনি "ক্ষুদ্র পরিসর " থেকে বার করলেন এবং ভেদাভেদে আচ্ছন্ন থাকা সমাজকে ভেদাভেদহীন রূপে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হলেন। স্বামীজীর প্রাসঙ্গিকতা তো ঠিক এখানেই। তাঁর লেখা নানা প্রবন্ধ, কবিতাতে এই বিষয় বারেবারে নানাভাবে উঠে এসেছে। সমাজের বুকে ভালো কাজ করতে হলে এবং সমাজকে গঠন করতে হলে জাগিয়ে তুলতে হবে অন্তঃস্থ সৃজনীশক্তি। তিনি দেখিয়েছেন,ঈশ্বর হলো এমন জ্যোতির্ময় বা জ্যোতির্ময়ী সত্ত্বা যিনি সৃষ্টিতে কৃষ্টিতে মিশে থাকেন। আর প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে এক ব্যতিক্রমী সৃজনীশক্তি, যা জাগ্রত হয় কর্ম, উৎসাহ আর সমন্বয়ের স্রোতে।
এই সবের পাশাপাশি যে বিষয়টির উল্লেখ করতেই হয় তা হলো thematic explosion ,যা স্বামীজীর সৃষ্টিতে উঠে এসেছে বারেবারে। এখন প্রশ্নটা হলো thematic explosion কী এবং স্বামীজী তা কীভাবে, কেন প্রয়োগ করেছেন। Thematic explosion হলো বহু theme এর এমন এক সমন্বয় যা মূলত তুলে ধরে নানা ভাবনা,চিন্তা সূক্ষতা এবং বহুস্তরীয় দৃষ্টিকোণকে। এর নানা ভাগ রয়েছে। স্বামীজী গ্রহণ করেছিলেন এই thematic blast এর মধ্যে থাকা naturalism, humanism আর universalism নামক উপাদানকে। ঈশ্বরবাদের পথে হেঁটে স্বামীজী বুঝেছিলেন, বৃহৎ creativity র প্রতিটি অংশেই থাকে ঐশ্বরিক শিখা, যা সঞ্চারিত হয়েছে জীবের রেখায়, জীবনের আবহে। আর এই সূক্ষ চিন্তনই স্বামীজীকে পৌঁছে দিয়েছিলো আরো উন্নত অক্ষতে। আমরা দেখেছি উন্নত সভ্যতার সাথে মিশে থাকা রাজকীয়তা, ঐতিহ্য ও বাহ্যিক শুভ্রতার মধ্যে তিনি কোথাও খুঁজে পাননি সেই স্নিগ্ধতা, সমন্বয়ী শিখাকে যা সঞ্চার করে মানবপ্রেম আর বিশ্বপ্রেম। স্বামীজী দেখেছিলেন, আমিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া মানুষদের মধ্যে অন্তঃস্থ ঈশ্বরের কক্ষ ও চেতনার দ্বারকে উন্মোচন করার কোনো প্রয়াস নেই। যদি আমরা আরো গভীরে যাই, আমরা দেখতে পাবো স্বামীজীর ঈশ্বরকে অন্বেষণ করাএবং মানবপ্রেম,বিশ্বপ্রেম কে ঈশ্বরসাধনার অঙ্গ রূপে প্রতিষ্ঠা করা মিশে গিয়েছিলো তাঁর গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং সংবেদনশীলতার সর্বোচ্চ স্তরের সাথে। স্বামীজীর কাছে nature বরাবরই হয়ে উঠেছিল তাঁর চেতনকক্ষের প্রিয় সাহানা। অনুভবী হৃদয় বারংবার তাঁকে নিয়ে যেত প্রকৃতির বুকে থাকা ছোট্ট ছোট্ট স্পন্দিত কুসুমরাগের কাছে। ফুলের কোমলতা, মেঘের ঘনত্ব আর জমাটবদ্ধ ভাষার মাঝে একদিকে যেমন রয়েছে রহস্য, অন্যদিকে রয়েছে সৃষ্টিশক্তি। দুটো বিষয়ই জুড়ে যায় মূলধারার সেই জ্যোতির সাথে। জীবের মাঝে থাকা ঈশ্বরকে জাগ্রত করার মাঝেই স্বামীজী মনোনিবেশ করেছিলেন Natural Sweetness এর সাথে। Flame আর Sweetness কে একযোগে বেঁধেছেন তিনি। প্রকৃতি, রহস্য, সূক্ষতা আর ছন্দময় চলনকে যদি না সংশ্লেষ করা যায়, তাহলে কোনোদিনই অন্তঃস্থ শক্তির প্রকৃত জাগরণ ঘটানো যায় না। ফলস্বরূপ Universalism এর শাখাকেও ছোঁয়া যায় না। আর universalism কে ছোঁয়া না গেলে বিভেদ, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ বা দমন করা যায় না। স্বামীজী তাঁর লেখায় বোঝাতে চেয়েছেন thick cloud আর bright sun জীবনের গতি ও সামাজিক গতির সাথে যুক্ত। গঠনকারী উপাদান হিসেবে "Fire" কে তুলে ধরেছেন স্বামীজী। একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে স্বামীজী বৃহত্তর পরিসরের মধ্যে অহরহ ঘটতে থাকা ঠান্ডা লড়াই এর তরঙ্গকে অনুভব করেছিলেন। স্বামীজী প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃতির কোলে জন্ম নেওয়া দুরন্ত violet প্রতিকূল অবস্থাতেও গভীরের বন্ধুত্বর চিঠি পাঠায়। আর এই প্রকৃতি ও প্রকৃতির অলংকার রুপে থাকা পুষ্পরাগ তৈরী করে ছন্দ আর দুরন্ত সুর। প্রসঙ্গ যখন ঐশ্বরিক জ্যোতি আর সাধনার,তখন মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, মূল্যবোধ, ভাবের আদানপ্রদান এই বিষয়গুলোই প্রধাণ। আর সাধনার এই পথের একটা বড়ো অংশ নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক শোভা আর শৈলীর খেয়ালিরাগের দ্বারা।
"Language of emotion" কে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছিলেন স্বামীজী। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, তিনি এই emotional wave কে aestheticism এর মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তাকে উপস্থাপন করেছেন যুবসমাজের অন্তঃস্থ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার উপায় হিসেবে। এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় যে, স্বামীজী স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণ ও সরগম জুড়েছিলেন নানা সৃষ্টিতে। নানা শব্দকে এমনভাবে স্বামীজী ব্যবহার করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে, যা তুলে ধরে "Special movement of tricky air"।
"Cloud" স্বামীজীর কাছে একদিকে যেমন স্বাভাবিক রহস্য হিসেবে ধরা দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে cloud ধরা দিয়েছে প্রত্যাঘাতের প্রতীক হিসেবে। আবার এক জায়গায় cloud অন্ধকারের একক হিসেবে উপস্থাপিত হলেও তা কিছু সময় পরেই পরিবেশিত হয়েছে এক লড়াই এর শিখা হিসেবে। "Deepest sorrow " কে তিনি দেখিয়েছেন "Soul of light" হিসেবে। কবিতা অনেক কবির কাছে দ্বন্দ্ব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু স্বামীজীর কাছে কবিতা হয়ে উঠেছে দ্বন্দ্ব নিরসনের মাধ্যম এবং আশাবাদী মানসিকতা প্রকাশের মাধ্যম। একদিকে যখন তিনি তুলে ধরেছেন আহত সর্পকে, অন্যদিকে তুলে ধরেছিলেন বাগানের সৌন্দর্য কিংবা বিশ্বপ্রেমকে ছুঁয়ে যাওয়া স্নিগ্ধতা। Sweetness একদিকে যেমন মিষ্টতা তুলে ধরে, তেমনি অন্যদিকে তুলে ধরে বিশ্বচরাচরের ভাষা, যা সামাজিক কাঠামোতে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তোলে।
পরিশেষে বলতেই হয় প্রতিকূল অধ্যায়ে এসে সবরকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিত্বপূর্ণভাবে রুখে দাঁড়িয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সমাজের বুকে বিবেকবাণী, চেতনাভাষা, দুরন্ত প্রজ্ঞার নব উদ্বোধন ঘটানো ব্যক্তিই স্বামী বিবেকানন্দ!!
------------------------------------------------------------
মৃণাল কান্তি দেব
(বাচিক শিল্পী, প্রাবন্ধিক, World Literature, International Relationship ও আঞ্চলিক ইতিহাস সংক্রান্ত, গবেষণার সাথে যুক্ত। বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানেও বিশেষ আগ্রহী। সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রশিক্ষক )
ঠিকানা :ঘাটাল, কোন্নগর,
পশ্চিম মেদিনীপুর।