
জমিদারীর অন্দরমহলে একদিন
(পর্ব-১)
বারিদ বরন গুপ্ত
"স্মৃতি আজ বিস্মৃতির আড়ালে
ইট কাঠ পাথরের ভগ্নস্তূপে
বারে বারে উঁকি মারে স্বর্ণযুগের দ্যুতি !"
মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহ করে! একঘেয়েমি কাজ থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাই মাঝে মাঝে ছুটে যায় নদী-নালা খাল বিল বিস্তীর্ণ প্রান্তর যেখানে প্রকৃতি নয়নাভিরাম ডালি সাজিয়ে রেখেছে আপন খেয়ালে। দুচোখ ভরে শুধু গিলে নাও, শীতের রুক্ষতা সরিয়ে মেখে নাও বসন্তের ঠান্ডা বাতাস, জান প্রাণ একটু শীতল হোক, দম বাধা হৃদয় একটু সুর নিয়ে খেলা করুক! কাছে পিঠে এছাড়া আর কিবা পাওয়ার আছে?
শিব চতুর্দশীর পুণ্য লগ্নে বেরিয়ে পরলাম বাবা ভোলেনাথের একটু মহাপ্রসাদের সন্ধানে। মন্তেশ্বরে মন্ত্রেশ্বর শিব দর্শন করে মন্তেশ্বর থেকে সোজা ধরেছি জামালপুর পাটুলি রোড, একটু এগোতেই সামনেই দেখা যায় দু হাজার বছরের প্রাচীন পতঞ্জলি আশ্রম, কথিত যে যোগাচর্য পতঞ্জলি স্বয়ং এখানে আশ্রম স্থাপন করে যোগ সাধনা করে গেছেন, কতদিন এই আশ্রমে যোগ সাধনা হয়েছে তা হয়তো বলা যাবে না, তবে অনেকেরই ধারণা প্রাক গুপ্ত যুগেও এই আশ্রম টিকে ছিল, যোগাচার্য পতঞ্জলি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তারই এক শিষ্যা এই আশ্রম বেশ কিছুদিন চালিয়েছিলেন বলে জানা যায়! এই বিশাল আশ্রমের পূর্বপ্রান্তে ছিল এক বিশাল পুকুর, যা বর্তমানে যোগাদ্যা পুকুর নামে পরিচিত, এই পুকুরের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে ছিল তিনটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ, যা বর্তমানে আর নেই, তা আপনা আপনিই বার্ধক্যের কারণে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তাহলে সহজেই বোঝা যায় কত প্রাচীন ছিল এই যোগাদ্যা উদ্যান !
যাইহোক পরবর্তীকালে অর্থাৎ সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল এই যোগাদ্যা উদ্যানের উত্তর প্রান্তে গড়ে উঠেছিল এক ভাস্কর্য ক্ষেত্র, তৎকালীন সময়ে বাংলার ভাস্কর্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এটি , মূলত প্রথম দিকে পাথরের কুর্মাকৃতি ধর্ম, লোকেশ্বর বিঞ্চু, শিবলিঙ্গ ইত্যাদি তৈরি হতো, তবে পাল যুগের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন মাতৃকা মূর্তি ও এখানে তৈরি হয়েছে, তাছাড়া তৈরি হতো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, হয়তো পাল যুগের শেষের দিক থেকেই ভাস্কররা একে একে এখান থেকে চলে যায়, খুব সম্ভবত দামোদরের স্রোত যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন রাজমহল থেকে পাথর আনা এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়ার অসুবিধার কারণেই এই ভাস্কর্য স্থান থেকে শিল্পীরা ভাগীরথীর নিকটবর্তী স্থানে, খুব সম্ভবত দাঁইহাটের দিকে চলে যায়। সেই পালযুগ থেকে এখনো তাদের ফেলে যাওয়া পাথর এবং অর্ধ সমাপ্ত পাথরে বাঁটালির দাগ আজও অমলিন হয়ে আছে! এখানেই ভাস্করা ওষধি হিসেবে এক সময় বিহার থেকে এনে লাগিয়েছিল ক্ষীর খেজুর গাছ, আজও সেই গাছ তাদের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে! এই ভাস্কর্য উদ্যানের পূর্ব প্রান্তেই বিশাল উঁচু স্থানেই হয়তো বিরাজ করতেন কূর্মাকৃতি ধর্মরাজ! খুব সম্ভবত পাল যুগের শেষের দিকে এবং সেন যুগের শুরুতে এর স্থান দখল করে অনাদি লিঙ্গ বাবা পত্তেশ্বর! তবে প্রাচীন মন্দিরটিকে একটি বটগাছ আদর করে আঁকড়ে ধরে বহুদিন ধরে রক্ষা করছিল, বর্তমানে পুরনো স্মৃতিকে ধরে রেখে মন্দির সংস্কার করা হয়েছে! হয়তো সেই সেন যুগ থেকেই বিরাজ করছেন বাবা-পত্তেশ্বর, হাজার বছরের ইতিহাস বুকে জড়িয়ে অনন্তকালের পথে, এই পত্তেশ্বর শিবের আদি সেবাইত কে বা কারা ছিল তা জানা যায় না, তবে এই গ্রামের ঘোষাল পরিবার দীর্ঘদিন বাবা পত্তেশ্বরের আরাধনা করেছেন, পরে দৌহিত্র সূত্রে মুখার্জি পরিবার বাবা পত্তেশ্বরের আরাধনার ভার পায়, আজ দেখলাম হাজার ভক্তের মাঝে দাউরাডাঙ্গার মুখার্জি মশাই আপন মনে ধ্যান ভঙ্গ করছেন! আমার ডায়রির পাতায় কয়েকটা কালির আঁচড়, প্রায় ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই, আর দেরি নয়, ডাকছে বাবা দীনেশ্বর যেথায় কেশবের বাল্যলীলা বৃন্দাবনের প্রভুর খেলা" চলেছিল, উঠে এসেছিল চৈতন্য ভাগবত" ! কে জানে সাক্ষী ছিল স্বয়ম্ভু বাবা 'দীনেশ্বর' 'ভোলেনাথ'! আজকে দীনেশ্বরের প্রাঙ্গন যেন বৈষ্ণব বৈষ্ণবীদের লীলাখেলা! খোল করতালে হাজার বছরের নিদ্রা ভাঙছে বাবা দিনেশ্বর! তাই মনে মনে ভাবলাম --
হরিনামে মুখরিত ভক্তের দল!
বৈষ্ণব শৈবের এখানে নেই কোন্দল!!
এখানে কেশবের ভ্রাতুষ্পুত্রের বংশধরেরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে দিনেশ্বরের সেবা করে চলেছেন! ওনাদের কাছে অনুমতি নিয়ে দেন্দুর ছাড়লাম! সোজা ধরেছি পাটুলি জামালপুর রোড! একেবারে উঠলাম হালদি পাড়ার ব্রিজে, ব্রিজ থেকেই শোনা যায় শিবায়ন গান, শুনলাম এখানকার বুড়োশিব ও নাকি বেশ প্রাচীন! পুটশুড়ির জমিদার গন বাবুরা নাকি প্রতিষ্ঠা করেছেন! যাই হোক শিব দর্শন ছেড়ে খড়ি নদীর ধার বরাবর সোজা চলেছি, দুদিকে কৃষ্ণচূড়ার সারি ফাগুনের মৌড়ালা বাতাসে দোল খাচ্ছে , দুদিকে বিস্তীর্ণ খাল বিল মনোরম দৃশ্যের মাঝে হালদি নপাড়া পেড়িয়ে সোজা মুকসিমপাড়া, হঠাৎ সামনে অশ্বথ গাছের তলায় গাড়ি থামিয়ে দিলাম, কে জানে জমিদার নলিনাক্ষ বাবু হয়তো সেই সাদা ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন! নয়তো বসে আছেন কোন নীল কর সাহেব, হাতে শংকর মাছের চাবুক! গুটি গুটি পায়ে এগুলাম, পার হলাম হাতিশালা, ঘোড়াশালা ময়ূর -ময়ূরীর নিত্য লীলা! কোথাও গেল উড়ে? আজ চেয়ে আছে ভগ্নস্তুপ! সামনে দেখা যায় বিশাল লাটমন্দির , ঠিক উল্টো দিকেই জোড়া শিব মন্দির! শুনলাম অনন্তরাম বাবুর আমলেই নাকি এগুলি তৈরি হয়েছিল! বিশাল পুকুর আমবাগান দিয়ে ঘেরা আর খড়ি নদীর হাওয়া, একদিন শোভা পেত বসতবাড়ি আর বকুলতলার কাছারি! কোথায় গেল স্বর্ণযুগের দ্যুতি? উত্তর আছে জমিদারির অন্দরমহলে! এখানেও রয়েছে হালদার পরিবারের প্রাচীন দুই শিব মন্দির,আজ শিব চতুর্দশী তিথিতে নবরুপে সেজে উঠেছে!
আর দেরি নয়, রক্তিম সূর্য মাথার উপরে! বিষন্ন হৃদয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম, ডাইনে গোবিন্দপুর
বামে কালিনগর, এখানে রয়েছে, বেশ কয়েকটি গঙ্গার প্রাচীন খাত বর্তমানে বেশিরভাগই ইট ভাটার দখলে, কিছুদূর যেতেই সামনেই পরে হালদার ঘাট, শোনা যায় এখানেই ছিল প্রাচীন গঙ্গার পারাপারের ঘাট, হয়তো মুকসিম পাড়ার জমিদার হালদারদের নাম অনুসারে এই ঘাট হালদার ঘাট নামে পরিচিত হয়েছে! তবে এখানে বেশ কয়েকটি হালদার পরিবার সেই প্রাচীনকাল থেকেই বসবাস করছে, তারা একসময় ঘাট মাঝি ছিল বলে জানা যায়। আরও একটু অগ্রসর হয়ে বাম দিকে মোড় নিয়েছি সামনেই দেখা যায় বিশাল বাগান দিয়ে ঘেরা গরুর হাট, প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী হাট, একসময় এই হাট এই অঞ্চলের মানুষদের প্রাণকেন্দ্র ছিল! স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়া কাণ্ডের এক অন্যতম ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীর হাট! সামনে দিয়ে বয়ে গেছিল গঙ্গার একটি শাখা, আজও তার অস্তিত্ব চোখে পড়ে, হয়তো অনেকটাই আজ মানুষের দখলে!
আরো সামান্য একটি এগুতেই ভেসে এলো বাবা বুড়োরাজের জয়ধ্বনি! আপন খেয়ালে চলেছে ভক্তের দল! কেউ কউ চলেছেন পাটুলি সুরধনীর সন্ধানে, আমিও চললাম বাবার অনুমতি নিয়ে শরীরটা একটু শুদ্ধ শীতল করে আসি! নিমদে থেকে শুরু করে ছাতনী দমপাল ,নারায়ণপুর, পিলা অগ্রদ্বীপ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাগীরথীর ভাঙা গড়া খেলায় বারে বারে ভৌগলিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, অতীতে পাটুলির কাছে গঙ্গার দুটি প্রবাহ দেখা গেছিল ১৯৮৫ সালের পর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, গঙ্গার প্রাচীন খাতের স্মৃতি বহন করছে পদ্মবিল নিমিখ্যা খাল, শুধু এখানকার নয় গোটা পূর্বস্থলীর উত্তর পূর্ব প্রান্তের বেশিরভাগ অঞ্চল ভাগীরথীর দিক পরিবর্তনের ইতিহাসের সাথে আপন অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, উৎসাহী গবেষকরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সেই সত্যতাই উঠে আসবে! এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সে নিয়ে ব্যাখ্যা করার জায়গা দেওয়া যাবে না!
যাইহোক পাটুলি থেকে সোজা চলে এলাম বেলেরহাঢ , তার আগেই পড়ছে মধুপুর! এখানে দেখলাম একটা প্রাচীন জমিদার বাড়ি অনেক স্মৃতি বুকে জড়িয়ে ভগ্ন স্তুপ এর চেহারায় একাকি দাঁড়িয়ে আছে! একদল লোক পাশে গরু চড়াই করছিল তাদের মুখ থেকেই শুনলাম যে এটা সেই বিখ্যাত জমিদার সিংহ দের বাড়ি, একসময় মধুপুর নিমদে বেলেরঘাট জামালপুর সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের জমিদারি ছিল। শোনা যায় এই সিংহ বংশের পূর্বপুরুষ নন্দলাল সিংহ এক সময় বর্ধমান মহারাজাদের বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন, তিনি স্থানীয় বিভিন্ন জমিদারির রাজস্ব আদায় করতেন! খুব সম্ভবত ১৭৬৫ সালের পর পাটুলি বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলগুলো বর্ধমান মহারাজদের কর্তৃত্বে আসে, খুব সম্ভবত মহারাজ তিলক চাঁদের আমলে নন্দলাল সিং এই অঞ্চলের জমিদারি পায় এবং সদৃশ্য কাছারি এবং গৃহ নির্মাণ করেন! যথেষ্ট দাপুটে এবং প্রজাহিতৌষি জমিদার হিসেবে এই অঞ্চলে তাদের সুনাম ছিল! বিভিন্ন হাট ঘাট স্কুল হসপিটাল তাদের দেওয়া জায়গায় নির্মিত হয়! জামালপুর গরুরহাট এবং বেলের হাটে এখনও তাদের অংশ রয়েছে!
এই সিংহ পরিবার খুব ধুমধাম করে মহামায়ার আরাধনা করতেন বলে জানা গেল! পূজার কটা দিন যাত্রাপালা বাউল নাচ গান খানাপিনার এলাহী বন্দোবস্ত থাকত! আজকে যেন নিঝুমপুরী অতীতের ছায়া! জমিদার দিলীপ সিং এর পর থেকেই এই সিংহ পরিবার এখানকার বাস উঠিয়ে অন্যত্র চলে যায়! একসময় যে বাড়িতে সাধারণ মানুষজন প্রবেশ করতে ভয় পেতো এখন নির্দ্বিধায় গরু ছাগল ইত্যাদি বিচরণ করছে! আর কয়েকটা পায়রা বাদুর চামচিকে গৃহ দেবতার নিদ্রা ভঙ্গ করছে!
ক্রমশঃ
========================
লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।