
ঐতিহাসিক দুর্গ
শ্যামল হুদাতী
এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে চমৎকার ও ঐতিহাসিক বেশ কিছু দুর্গ আছে। যার বেশিরভাগই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় আছে। এগুলোর কাঠামো ও সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। একই সঙ্গে দুর্গের অতীতের নিদর্শন দেয়।
এসব দুর্গ অতীতে রাজ্য প্রশাসনের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এসব দুর্গ পর্যটকদের কাছে এক বিশাল আকর্ষণ। চলুন তেমনই কয়েকটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা দুর্গ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
আগ্রা ফোর্ট:
উত্তর প্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত, এই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানটি ১৭ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুঘল সম্রাটদের প্রধান বাসস্থান ছিল।
এই দুর্গে জাহাঙ্গীর প্রাসাদ, খাস মহল, দিওয়ান-ই-খাস ও মুসামান বুর্জের মতো কাঠামোসহ অত্যাশ্চর্য স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য আছে। আগ্রা ফোর্ট তাজমহল থেকে মাত্র ২.৭ কিলোমিটার দূরে।
চিতোরগড় দুর্গ:
ভারতের বৃহত্তম দুর্গ এটি। এর অবস্থান রাজস্থানে। এটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ ও রানী পদ্মিনীর কিংবদন্তির জন্য পরিচিত। দুর্গটিতে রানা কুম্ভ প্রাসাদ, বিজয় স্তম্ভ (বিজয় টাওয়ার) ও কীর্তি স্তম্ভের (খ্যাতির টাওয়ার) মতো দুর্দান্ত সব কাঠামো আছে।
জয়সলমের দুর্গ:
হলুদ বেলেপাথরের কারণে সোনার দুর্গ নামে পরিচিত এটি। এর অবস্থান রাজস্থানে। এই দুর্গের ভেতরে এখনো উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা বসবাস করে। এই দুর্গের মধ্যেই আছে প্রাসাদ, মন্দির ও আবাসিক এলাকা।
দক্ষিণ কোরিয়ার সুওন হাওয়াসেং দুর্গ:
১৮ শতকের শেষের দিকে নির্মিত, সুওন দুর্গটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এক স্থান। এটি সেই সময়ের ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান ও আধুনিক স্থাপত্যের এক নির্দশন।
শ্রীলঙ্কার সিগিরিয়া:
লায়ন রক নামেও পরিচিত এটি। এই প্রাচীন পাথরের দুর্গটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বিবেচিত। পঞ্চম শতাব্দীতে রাজা কস্যাপ দ্বারা নির্মিত এই দুর্গে আছে একটি প্রাসাদ, বাগান ও ফ্রেস্কোর অবশিষ্টাংশ।
পাকিস্তানের লাহোর ফোর্ট:
শাহী কিলা নামে পরিচিত পাকিস্তানের লাহোর ফোর্ট। লাহোরের এই দুর্গ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে আছে শিশ মহল (আয়নার প্রাসাদ) ও আলমগিরি গেট। যা মুঘল যুগের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে।
শ্রীলঙ্কার গল ফোর্ট:
পর্তুগিজরা গল ফোর্ট নির্মাণ করলেও পরে ডাচরা এর সম্প্রসার ঘটায়। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের এই সাইট শ্রীলঙ্কার গালে শহরে অবস্থিত। গল ফোর্টে আছে এর প্রাচীর, দুর্গ ও ঔপনিবেশিক ভবন আছে।
ব্রিটিশের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে দুটি ফোর্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
কুরম্বেরা দুর্গ গগনেশ্বর নামে একটি গ্রামে অবস্থিত - খড়গপুর থেকে প্রায় 27 কিমি দূরে। এটি এখন প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ আইনের অধীনে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া দ্বারা সংরক্ষিত একটি দুর্গের মতো। এটি জানা যায় যে এটি ওড়িশার সুরজা বংশী রাজা গাজীপাতা কপিলেন্দ্র দেবের (1438-1469) শাসনকালে সম্ভবত আওরঙ্গজেবের শাসনকালে নির্মিত হয়েছিল। তবে কিছু পুরুষ বিশ্বাস করেন যে এটি প্রাচীনকালে নির্মিত হয়েছিল, রাম, সীতা বনবাসের সময় এই স্থানটি পরিদর্শন করেছিলেন। দুর্গটিতে একটি মন্দির/মসজিদ সহ একটি প্ল্যাটফর্মের উপর তিনটি ডোমের কাঠামো রয়েছে। ওডিশা মন্দিরের ধরন অনুসারে কাঠামোটি তৈরি করা হয়েছিল। এটিতে লেখা একটি শিলালিপি ওড়িয়ার অনুরূপ। কিছু লোক বলে যে এটি মুসলিম সৈনিকের নামাজের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং তাই এটি একটি মসজিদের মতো ছিল। ল্যাটেরাইট পাথরের খিলনের দ্বারা তৈরি দীর্ঘ বারান্দাটি একটি অসাধারণ কাঠামো। তবে যারা এটি নির্মাণ করেছিলেন বা এখানে বসবাস করেছিলেন তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। স্তম্ভযুক্ত করিডোর দ্বারা ঘেরা বিশাল উঠান রয়েছে এবং মাঝখানে তিনটি গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। মাঝখানে একধরনের বেদিও আছে। এটি একটি প্রাচীন দুর্গ।
বক্সা দুর্গ: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার আলিপুরদুয়ার মহকুমার কালচিনি সিডি ব্লকেবক্সা টাইগার রিজার্ভের 867 মিটার (2,844 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এটি নিকটতম শহর আলিপুরদুয়ার থেকে 30 কিলোমিটার (19 মাইল) দূরে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকেও এই কারাগারে রাখা হয়েছিল বলে কথিত আছে ৷ বক্সা ফোর্টের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্বে বক্সা ফোর্ট জায়গাটি ভুটান রাজাদের ছিল ৷ পরে ইংরেজদের সঙ্গে ভুটানের লড়াইয়ে এই জায়গাটি ইংরেজ সরকার দখল করে নেয় ৷
বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার জন্যে পাহাড়ের ওপর দুর্গম এই স্থানকে বেছে নেয় ইংরেজরা। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এখানে মোট বন্দী ছিলেন ৫২৫ জন। বন্দী বিপ্লবীরা একবার জেলের ভেতরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেন, এবং কবিকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানান। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখন দার্জিলিং অবস্থান করছিলেন। এ কথা জানতে পেরে তিনি তার প্রত্যুত্তর দেন এই বলে -
"অমৃতের পুত্র মোরা কাহারা শোনাল বিশ্বময়,
আত্মবিসর্জন করি আত্মারে কে জানিল অক্ষয়"
হিজলী জেলে গুলিচালনার প্রতিবাদে বক্সায় বন্দী বিপ্লবীরা অনশন করেছেন। প্রমথ ভৌমিক, জ্ঞান চক্রবর্তী, কৃষ্ণপদ চক্রবর্তী প্রমুখ অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের এই দুর্গে ১৯৩০-এর দশক অবধি বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালেও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় চৌধুরী, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, ননী ভৌমিক, পারভেজ শাহেদী, চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখ কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও বুদ্ধিজীবী এই দুর্গে বন্দী ছিলেন ১৯৫০-এর দশকে।
---------------------------------------------------------------
শ্যামল হুদাতী
357/1/13/1, Prince Anwar Shah Road,
P.O. Jodhpur Park,
Kolkata - 700 068