
অনুবাদ গল্প ।। আফ্রিকান লোককথা ।। বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
আফ্রিকান লোককথা
যে মেয়েটি সিংহকেও পোষ মানাতে সক্ষম
বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
ইথিওপিয়ার এক পাহাড়ি গ্রামের একটি ছেলে ও মেয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়ে। বছরখানেক প্রেমযাপনের পরে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ছমাস কাটতে-না-কাটতে দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের তর্ক এমন চরমে পৌঁছাত যে তা আর তাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না; প্রতিবেশিদের কানেও তা পৌঁছে যেত। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ভুল বোঝাবুঝির কারণে সুন্দর একটি সম্পর্ক দিনের পর দিন আরও খারাপ হতে থাকে। তিতিবিরক্ত হয়ে মেয়েটি একদিন গ্রামের মোড়লের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করে বসে।
প্রৌঢ় মোড়ল প্রাজ্ঞ মানুষ। মেয়েটির আবেদন শুনে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন ভেবে নিলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, তোমাদের বিয়ের তো একবছরও হয়নি এখনও, এর মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ চাও কেন ? তুমি কি তোমার স্বামীকে আর ভালোবাসো না?
মেয়েটি বলল, আমি তাকে খুব ভালোবাসি, সেও আমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু একসঙ্গে থাকলে সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে মতান্তর শুরু হয়, তারপর তুমুল ঝগড়া বেধে যায়।
মোড়ল বললেন, যদি তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে থাকো তাহলে ঝগড়া বাধার কারণই বা কী?
মেয়েটি বলল, ধরুন ও বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় ঘরে ছড়িয়ে রাখল, আমি গুছিয়ে রাখতে বললাম, ও শুনল না ব্যাস ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। আমি কোনো কাজ করতে বললে ওর তখন অন্য কাজ পড়ে যায়। এইভাবে দিনের পর দিন ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য আর ভালো লাগে না। ওর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে আমার সুন্দর জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে গেল।
মোড়ল বললেন, বুঝলাম। আচ্ছা আমি যদি এমন এমন একটা জাদু-ওষুধের ব্যবস্থা করে দিই যাতে তোমাদের ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য দূর হয়ে যায়, তাহলেও কি তুমি বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইবে ?
মেয়েটি বলল, না না তাহলে তো সব মিটে গেল। দিন দিন দোহাই আপনাকে ওষুধটা আমাকে দিন।
মোড়ল বললেন, ওষুধটা আমার কাছে নেই তৈরি করে দেব। তবে ওষুধের একটি উপকরণ তোমাকে সংগ্রহ করে আনতে হবে।
মেয়েটি আগ্রহের সঙ্গে বলল, বলুন হুজুর, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
মোড়ল বললেন, আমার কাছে সরে এসো।
মেয়েটি মোড়লের কাছে সরে এলে তিনি পাহাড়ের নীচ থেকে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে চরে বেড়ানো একটি সিংহ দেখিয়ে বললেন, ওরকম তেজি একটা সিংহের লেজের একটি লোম তোমাকে আনতে হবে।
মেয়েটির কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, সিংহের কাছে গেলে সে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে। হুজুর অন্য কোনো উপায় কি নেই ?
মোড়ল বললেন, না, নেই।
মেয়েটি তার স্বামীকে সত্যিই খুব ভালোবাসত। যে-কোনো মূল্যে সে তাদের সম্পর্কটাকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। পরের দিন সে খুব সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে সিংহটার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছায়। সিংহটা তখন নদীতে জলপান করছিল। উপর থেকে তার চেহারা ও থাবা দেখে মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে যায়। প্রায় ছুটতে ছুটতে সে বাড়ি ফিরে আসে। পরের দিন সে আবার যাত্রা করে। এবার সে একটা বস্তায় কিছু টাটকা মাংস নিয়ে যায়। নদীর চরের বালিতে নেমে সে সন্তর্পণে সিংহের ডেরা থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে বস্তা থেকে মাংসখণ্ডগুলি রেখে আসে। একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে সে অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পরে সিংহটি এসে মনের আনন্দে মাংস চিবোতে থাকে। পরের দিন মেয়েটি আবার মাংস নিয়ে যায়। এবার সে সিংহের ডেরা থেকে একশো গজ দূরে মাংস রাখে। এইভাবে দিনের পর দিন মেয়েটি সিংহের থেকে মাংসের দূরত্ব কমাতে কমাতে সিংহের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মেয়েটির মনে সিংহ সম্পর্কে যে ভীতি ছিল তা ক্রমশ কেটে যায়। সিংহটিও বুঝে যায় মেয়েটিই তার মাংসের যোগানদাতা। ফলে সেও পোষাপ্রাণির মতো নম্র আচরণ শুরু করে। শেষমেশ একদিন মেয়েটি সিংহের লেজ থেকে একগাছি চুল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে সে মোড়লের বাড়িতে পৌঁছে শোরগোল ফেলে দেয়। মোড়ল হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন।
মেয়েটি চিৎকার করে বলল, এই যে দেখুন আমি সিংহের লেজ থেকে একগাছি লোম নিয়ে এসেছি। আমাকে জাদু-ওষুধ তৈরি করে দিন।
মোড়ল বললেন, শোনো মেয়ে আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছি। কোনো জাদু-ওষুধ আমার কাছে নেই।
মেয়েটি মোড়লের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মোড়ল মেয়েটিকে বললেন, জাদু-ওষুধ তো তুমি নিজেই তৈরি করে ফেলেছ। সে সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় তুমি দিয়েছ সেটাই তো জাদু-ওষুধ। ওই জাদু-ওষুধের বলে তুমি তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ককে মেরামত করে নিতে পারবে।
মেয়েটি হাসি মুখে মোড়লের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল।
==========