
গল্প ।। দাম্পত্য ।। এস.আজাদ
দাম্পত্য
এস.আজাদ
প্রস্তাবনা
আজ রবিবার, বাক বিরতির তৃতীয় দিন।গতকাল জয়শ্রী ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। জয়শ্রী ও সুদর্শনের দেখাশোনা করে বিয়ে।প্রথম দেখা থেকে সাত মাস প্রাক-বিবাহ প্রেম, তারপর ছাদনাতলা।তাদের সাত বছরের দাম্পত্যে এটা সতেরোতম মনোমালিন্য।এই সময় কথারা ভাষা হারায়।জয়শ্রী চেঁচিয়ে ডাকে, — সুজয় বাবাকে বলো খেতে দিয়েছে। সুদর্শনও চেঁচিয়ে বলে, — সুজয়, মাকে বলো চা দিতে।মাকে বলো, মোজা দুটো কেচে দিতে।এটা দুই-তিন দিন চলে। জয়শ্রী হোয়াটসঅ্যাপে লেখে,
— আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-টমেটো-মাছ-বাজার…....
সুদর্শন লেখে,
—ওয়ালেট???
—দ্বিতীয় ড্রয়ারে।
এই সময়টাকে কি নাম দেওয়া যায় ভেবে পায় না সুদর্শন।ঠিক যুদ্ধ আর সন্ধির প্রাক মুহূর্ত।একটা শীতল নৈশঃব্দ বিরাজ করে তাদের এই তিন কামরা ফ্লাট জুড়ে।কিভাবে শুরু হয়েছিল? দোষ, কার বেশি, কার কম? এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দু'পক্ষই ভাবে আর একটু সহনশীল হতে হবে।কিন্তু ভাবনাই সার, উদ্ভূত পরিস্থিতির তাড়নায় মগজ ও জিভ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তারপর দু-দুটো রাতের উপবাস কাটিয়ে তৃতীয় রাত্রে আচমকাই নদীর বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার জল হু হু করে ঢুকে পরে, ভরিয়ে দেয় ধানক্ষেত, পথঘাট, খালবিল।ঠিক যেমন করে নদী সমুদ্রের বুকে মাথা রেখে নিজেকে হারিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। নগ্ন নিবিড় আলিঙ্গনে শপথ করে, আবার ভাঙে।
এবারে কিন্তু টোটাল সাইলেন্ট, নো হোয়াটসঅ্যাপ, নো চ্যাট, নো ভিডিও কল, ছেলেটা হয়েছে তেমনি।মা বাবার ঝগড়ায় বেশ মজা পায়, কারণ এই কটা দিন মাত্র দু'পক্ষেরই তোয়াজ পায়।অন্য সময় সেই তো প্রতিপক্ষ।
প্রথম দিন
সকাল সকাল অফিসের প্রস্তুতি, সুদর্শন আয়নার সামনে সেভিং-এ ব্যস্ত, জয়শ্রী রান্নাঘরে।সুযোগ বুঝে সারদার মা বলে, — দাদা খুব বিপদে পড়েছি, ৩০০ টাকা দিতে হবে, সরদার বাবার শরীর খারাপ।
ট্রিমার টা বন্ধ করে সুদর্শন হাঁক পাড়ে, — "জয়ী-ঈ…"
জয়শ্রী রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয়, — কি হলো? এখন যেতে পারবো না।
— কাল সন্ধ্যায় তোমাকে যে টাকা দিলাম, সেখান থেকে সারদার মাকে ৩০০ টাকা দিও তো।
জয়শ্রী কোন উত্তর করে না।
— শুনতে পেলে? সারদার মা দাদাবাবুর মুখের দিকে অসহায় কাঁচুমাচু মুখ করে চেয়ে আছে।
— শুনেছি।
সুদর্শন সারদার মাকে বলে,
—কাজ সেরে নাও। যাবার সময় নিয়ে যেও।
সারদার মা চলে গেছে সুদর্শন বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে অভ্যাসের হাঁক, — ভাত।
অন্যদিনের মতো সুমিষ্ট সুরেলা কন্ঠের প্রত্যুত্তর আসে না।খাবার টেবিলে দেখে খাবার ঠিকই সাজানো আছে।কিন্তু তিনি নেই। জানালার পাশ দিয়ে 'কু' ডেকে যায় যে ছাই রঙের পাখিটা, বোধহয় আবার এসেছে।ঘটনা প্রবাহে সে বুঝতে পারে নির্ঘাত কোনো অপরাধ করে ফেলেছে।অপরাধ খুঁজতে গিয়ে ছোট মাছের নরম কাঁটা আটকে যায় দাঁতের ফাঁকে।একটা খচখচানি একটা অস্বস্তি ঘিরে ফেলে চারিধার।
— 'একি, এক গ্রাস ভাত ও মুখে তোলোনি, শরীর খারাপ নাকি! দেখি' বলে, এক্কেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাম হাতের চেটোটা মেলে ধরবে কপালে। গরম ভাতের গন্ধের সাথে জয়ীর ঘর্মাক্ত শরীরের ভীষন চেনা গন্ধটা মিলেমিশে তৈরি করবে নতুন স্বাদের গন্ধ। তারপর ডান হাতে প্লেট থেকে সুদর্শনের মাখানো ভাত তুলে নিয়ে বলবে, 'দেখি হা করো তো, বড়ো করে হা করো।' গোল গোল চোখ করে বলবে, –– 'আমি ক'টা বাচ্চাকে সামলাবো?' আজ কিন্তু তেমন কিছু হলো না।
টিফিনের ব্যাগটা টেবিলের এক পাশে নামানোর শব্দে মুখ তুলে তাকালো সুদর্শন।যার দিকে তাকানো তিনি কর্মব্যস্ততার ভঙ্গিতে দ্রুত ত্যাগ করলেন স্থান। সুদর্শন বুঝতে পারে এই নীরবতা আসলে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস।
অতীত অভিজ্ঞতা বেরোতে নিষেধ করলেও সে উঠে পরে।দরজায় ইন্টারলক থাকলেও চেঁচিয়ে বলে, — আমি চললাম কেউ যেন দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
কেউ সাড়া দেয় না, সুদর্শন টিফিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজা খোলে বাইরে না বেরিয়েই দরজাটা জোর ধাক্কা দেয়। জয়শ্রী ঘর থেকে বেরিয়ে সুদর্শনকে ভিতরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায়।এরকম করে চমকে দিতে পেরে হাসি পায় সুদর্শনের, জয়ীও সাময়িক চমক কাটাতে হাসি হাসি মুখটা ঘুরিয়ে নেয়, যেটা দেখার জন্য সুদর্শনের এই চালাকি।
সুদর্শন বেরিয়ে যায় দরজা খোলা রেখে, জয়শ্রী এগিয়ে যায়। সুদর্শনের এগিয়ে যাওয়াটা দেখতে থাকে।অপলক।লিফট থেকে সম্পন্ন হয় শুভদৃষ্টি। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে সে দরজা বন্ধ করে নিজের কাজে চলে যায়।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় জয়শ্রী মুখটা না দেখলে সুদর্শনের মনটা কেমন যেন করে, যদিও, ব্যতিক্রম সাধারণত হয় না। সুদর্শনের অস্বস্তিটা কোনমতেই কাটছে না। বাতাসে শিশিরের ভেজা গন্ধ, শিউলি ভরা শরতে অ-কালবৈশাখীর কোন কারণ সে অনুসন্ধান করতে পারেনি। শেষবার, মাস তিনেক আগে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভেজা তোয়ালে বিছানার উপর ফেলে রাখার দীর্ঘ দিনের বদঅভ্যাস, যেটা জয়ী হাজার বার বলেও কাটাতে পারছিল না, বিনিময়ে দু'দিন বন্ধ রাখতে হয়েছে জীবন। আর ভুল হয় না।
অফিস পৌঁছে জয়শ্রীর মোবাইলে কল করে পরপর সাতবার, কোন উত্তর আসেনি যদিও অন্য দিন রিং করার সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হয়, যেন তারই কলের প্রতীক্ষায় ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে জয়শ্রী।অবশেষে হোয়াটসঅ্যাপে লিখে দেয় 'পৌঁছে গেছি'। দু-চার মিনিট পর পর চেক করতে থাকে উত্তর।এর মধ্যেই অফিসের পিওন সুখাই এসে খবর দিয়ে যায় বস ডাকছে, সকল থেকে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা পোকাটা টেবিলে রেখে, সন্দীপ ব্যানার্জীর চেম্বারে ঢোকে, সন্দীপ ব্যানার্জী, বয়সে তার থেকে ছোটই হবে অভিজ্ঞতাতেও।তাই তাকে একটু সমীহ করে, সুন্দর করে কথা বলে। চেম্বারে ঢুকতেই সুখাই কে চা আনতে বলা শুনেই সুদর্শন বুঝতে পারে বাড়তি কোনো কাজের বোঝা তার উপর চাপতে চলেছে, নাহলে বসেরা এতটা সুমিষ্টভাষী হয় না কখনো।সুখাই চা নিয়ে আসে সঙ্গে সুদর্শনের পছন্দের স্পাইসি বিস্কুট, বিস্কুটে আলতো করে একটা কামড় দিয়ে বস বলতে শুরু করেন,
— সুদর্শন বাবু, কোম্পানির নবনিযুক্ত এজেন্টদের একটা মিটিং আছে লাঞ্চের পর, অন্যদিকে দিল্লি অফিস এক্ষুনি মেইল পাঠিয়েছে বেলা একটা থেকে ইস্টার্ন জোনের রিজিওনাল অফিস হেডদের অনলাইন মিটিং হবে, দাসবাবু তিনদিনের ছুটিতে আছেন, এখন কি করি বলুনতো?
— আমার অনেক গুলো ফাইল দেখা বাকি, সাপ্তাহিক রিপোর্ট।
— রিপোর্টটা আজকেই লাগবেনা, আপনি বরং মিটিংটা কন্ডাক্ট করুন।
— ওকে, থ্যাংক ইউ। বলে, বসের চেম্বার থেকে বেরোনোর সময় সুদর্শন লক্ষ করে সন্দীপের চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ।তবে নিজের ডেস্কে পৌঁছাতেই সেই পোকাটা আবার ঢুকে পড়লো মাথার ভেতর।
টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে দেখে হোয়াটসাপে অনেকগুলো মেসেজ।প্রথমেই জয়ীর মেসেজটা ওপেন করে, শুধুমাত্র দুটো অক্ষর 'Ok' আর কিছু নেই, সে বোকার মতো আঁতিপাতি করে আগে পিছে খুঁজলো কিন্তু না… শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে মোবাইলটা টেবিলে রেখে মিটিং এর প্রস্তুতি তে মনোসংযোগ এর চেষ্টা করে।
সুদর্শন কোনরকম মিটিং অফিস সামলে জিভ দিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকানো কাঁটার অবস্থান পরীক্ষা করতে করতে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে উঁকি দেয়। দেখে দুটো ঘরেই দরজাই ভেজানো।অন্য দিন এই সময়ে মা বেটায় টিভি দেখে, আজ তাহলে…! পিছন ফিরে জুতার তাক টার দিকে তাকায় সুদর্শন। না! সব ঠিকঠাক।
শোবার ঘরের ভেজানো দরজা খুলে বের হতে হতে জয়শ্রী ছেলেকে বলে, — তোমার বাবাকে বলো হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে আসতে, খাবার দিচ্ছি, আর ছাড়া জামা প্যান্টগুলো যেন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দেয় আমি মেশিন চালাবো।
যার জন্য এই নির্দেশ সে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে খাবার টেবিলে বসে, ছেলে এসে বাবার কোলে চেপে বসে,
— বাবা জানো তো আজ স্কুলের কি হয়েছে।
— কি হয়েছে? ছেলে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ছেলেকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ছোট ছোট মোলায়েম চুলে নাক ডুবিয়ে ঘন নিঃশ্বাসের সুড়সুড়ি দিতে দিতে সুদর্শন যখন শুনতে চাইছিল তার কথা, ঠিক তখনই জয়শ্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে, — এখন না।আগে বাবার খাওয়া হোক তারপর।আচমকা স্বাভাবিক আচরণ করে ফেলে নিজেই খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়ে সুদর্শনের দিকে অকারণে পিছন ফিরে পরে নেয় অকারণ গাম্ভীর্যের ছদ্মবেশ।খাবার বেড়ে দিয়ে সোফায় বসে টিভি চালিয়ে আড়চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে সুদর্শনকে।
বলির আগে ছাগশিশু যেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে চিবিয়ে যায় কাঁঠালপাতা, জবার মালা, তেমনি অসহায় ভাবে শুধুমাত্র ক্ষুধা নিবৃত্তির সুদর্শন জন্য চিবিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় আলু পরোটা।জয়শ্রী সুদর্শন এর চিন্তা ক্লিষ্ট মুখটা দেখে ভাবে, হাড়িকাঠে গলাতো দিয়েই তো আছো তাহলে অত চিন্তা কিসের, ভাবতে ভাবতেই একটা তৃপ্তির হাসি সুড়সুড়ি দেয় হৃৎপিণ্ডে।কিন্তু মুখাবয়বে কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না।যদিও সে খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির নয় তবুও সুদর্শনের এই অসহায় আত্মসমর্পণ সে উপভোগ করে।
আজ সুদর্শন কে যেমন দেখাচ্ছে মোটেও সে এরকম ভোলাভালা সরল সাদাসিধে নয়।অফিসে ও যে অংশের ইনচার্জ তারা জানে ও কেমন মানুষ, আর জয়শ্রী জানে কথার কারিকুরি আর মারপ্যাঁচে তার সাথে পেরে ওঠা মুশকিল।যদিও প্রথম প্রথম জয়শ্রীর খুব অসুবিধা হতো।এখন সে নিজের মতো করে বিষয়গুলি বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে।তাই এখন সুদর্শন আর তার সাথে পেরে ওঠে না।
খাওয়া শেষ করে সুদর্শন পড়ার ঘরে চলে যায়।কোন কাজ নেই তবুও ল্যাপটপ খুলে এটা সেটা ঘাঁটতে থাকে। কলিংবেলের আওয়াজ কানে আসতেই জয়শ্রী ছেলেকে বলে, — তাড়াতাড়ি বইগুলো গুছিয়ে নাও।
পাশের ফ্লাটের যাদব বাবুর ছোট মেয়ে সুজাতা ইংলিশে মাস্টার্স করছে, তার কাছেই সুজয় কে টিউশন দিয়েছে, এই ব্লকেরই আরো দুইজন সেখানে পড়ে, ঠিক ছ'টায় ডেকে নিয়ে যায় সুজাতা। ইংলিশ মিডিয়াম প্রি-প্রাইমারি ছাত্রের টিউশন দরকার ছিল না, সে নিজেই যথেষ্ট। কিন্তু গত বছর পুজোর আগে সুজাতা নিজে এসে বলল, — বৌদি জানেন তো অবস্থা, বাবার পেনশনের উপর তো আর আমার পড়াশোনা খরচ চালানো যায় না, তাই যদি জয় করে আমার কাছে টিউশন পাঠান খুব ভালো হয়, আরো দুইজন আসছে পড়তে।
জয়শ্রীও ভেবে দেখে কতই বা বয়স তাদের? নিজেদেরও তো কিছুটা সময় দেওয়া দরকার। সপ্তাহে পাঁচ দিন সন্ধ্যায় দু'ঘন্টা একা পায় সুদর্শনকে। এই অন্যরকম সন্ধাটা তাদের কাছে নেশার মত। ব্যতিক্রম যে হয় না তা নয়, মাঝে মাঝে মা বাবা এসে থাকেন যদিও এক দুই সপ্তাহের বেশি না। গ্রাম থেকে আত্মীয়দের কেউ কেউ চিকিৎসা বা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার জন্য তাদের ফ্ল্যাটে এসে থাকে।
আজ ছেলেকে পড়তে পাঠিয়ে সুদর্শনের কাছে এলো না, জয়শ্রী, টিভির সামনেই বসে থাকলো। সে টিভি দেখছে না টিভি তাকে দেখছে বলা মুশকিল।
চূড়ান্ত বোঝাপড়া
জয়শ্রী যার অপেক্ষা করছে সে ল্যাপটপ বন্ধ করে এসে সোফায় গা ঘেঁষে বসে পড়ে, ডান দিকে জায়গা না থাকায় সরে যেতে পারে না, উঠে গেলেই হয়, সেটা সে পারে না। ইচ্ছা ও করছে না।
— কি হয়েছে তোমার, সকাল থেকে এরকম করছ কেন?
গলায় কৃত্রিম ঝাঁঝ নিয়ে উত্তর দেয়, — কই,কিছু হয়নি তো।
— এই যে, সকাল থেকে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছো, ভালো করে কথা বলছো না, কাছে আসছে না, কাছে এলে সরে যাচ্ছ। আমি কি করেছি বলো? অসহায়তার সুর শোনা যায় সুদর্শনের গলায়।
— জয়ী তুমি জানো আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারি না। বলো না কি হয়েছে?
— না কিছু হয়নি। একটু সরে বসো। সুদর্শন বোঝে 'না কিছু হয়নি' এর মানে, দাম্পত্য আবদ্ধ পুরুষ মাত্রই জানে।
— তুমি রাগ করেছো বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন রাগ করেছ সেটা বুঝতে পারছি না। কারণ না জানলে রাগ মানাবো কি করে?
— যাও যাও রাগ ভাঙাতে হবে না, আমি কে? কে আমি? বলো কে আমি?
— আমার জয়ী, আমার জান, আমার… আরো কিছু বিশেষণ যোগ করতে যাচ্ছিল সুদর্শন।
তাকে শেষ করতে না দিয়ে জয়শ্রী মুখ ভেঙ্গচে বলে, — আমার জয়ী! যাও যাও, আর সাধু সেজো না, ওসব দেখা আছে। মুখে বলবে আমার সোনা, আমার জান, আমার প্রাণ ভোমরা, আরো কত! আর কাজের বেলায় ঝি-চাকরানি। মুখে বলবে তোমার সংসার, আর কাজের বেলায় দাসী-বান্দীর মতো হুকুম তামিল করো! জয়ী এটা করো, জয়ী ওটা করো, জয়ী এটা কেন হয়নি? জয়ী ওটা কেন হয়নি?… বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলে।
সুদর্শন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে —কাঁদছো কেন? কি হয়েছে সেটা তো বলো। কি দোষ করেছি আমি? বলতে বলতে চোখের জল মুছিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
— থাকবো না আমি তোমাকে সংসারে, চলে যাব…!
— কোথায় যাবে?
— দুচোখ যেদিকে যায়।
— বেশ তাই যেও, ঠিকানা দিয়ে যেও! এখন বল কি হয়েছে?
জয়শ্রী ভাবে সে কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে? একটু রাগ করার অধিকার কি তার নেই! স্বামীর সাথে একটু ঝগড়া ও কি করতে পারবে না! তার কষ্টের কথা কাকে বলবে সে? স্বামী ভিন্ন অন্য কোন বন্ধু যে তার নেই। তাদের নিবিড় প্রগাঢ় ভালবাসা আর পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র হের হয়নি সাত বছরে একদিনের জন্য। একে অপরকে সেই প্রথম দিনের মতো চায় প্রতিদিন। জীবনের প্রতিটি রাত্রি যেন যেন তাদের ফুলশয্যার রাত তবুও তার কান্না আসে কেন? অফিস, জয়ী, জয় আর বাবা মা এ ভিন্ন তো কোন জগত নেই সুদর্শন এর তাহলে কেন? এই কেন এর উত্তর বোধহয় মনুষ্য সংসারে নেই, শুধুই প্রশ্ন।
সুদর্শন নির্বাক নিষ্পলক জয়ীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুজনেই দুজনের হৃদপিণ্ডের বিরামহীন শব্দ গোনে। সুদর্শন এখনো ভেবে পায় না তার দোষটা কী? সে জয়ীকে হুকুম করে ঠিকই, জয়ীও হাসি মুখে তা পালন করে, বলা ভালো পালন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। কোনদিন যদি ওয়ালেট টা সামনে থাকে আর অফিসে যাওয়ার সময় জামা প্যান্ট পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস না করে "জয়ী-ঈ ওয়ালেট কোথায়?" তাহলে পরদিন জয়ী ওয়ালেট লুকিয়ে রাখে, যাতে তাকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়।
— অফিস আর প্রয়োজনের নির্দেশ ভিত্তিক বাজার বা কেনাকাটা ছাড়া এ সংসারে কোন কাজটা তোমাকে দিয়ে হয় বলতে পারো?
ঠিকই তো অফিসের কাজ আর জয়ীর নির্দেশ মত বাজার বা কেনাকাটা ছাড়া নিজে থেকে এই সংসারের জন্য তো কোন কিছুই করে না। তাই স্বরের কমনীয়তা বাড়িয়ে বলে, — না, কিছুই করি না।
— তাহলে সকালে তুমি সারদার মাকে ৩০০ টাকা দিতে হুকুম দিলে কেন? তুমি জানো? প্রতি মাসেই কোন না কোন বাহানায় দু-তিনশ টাকা সে ধার হিসেবে নেয়, শর্ত মাইনে হোক কেটে নেবেন। কিন্তু মাইনের সময় নানা কথার ফুলঝুড়ি। শেষে আগের মাসে কেটে নেবেন বলে পুরো মাইনে নিয়ে চম্পট। ওর যা ধার আছে তিন মাস বিনা বেতনে কাজ করলে শোধ হবে না। আমাদের অভাব নেই এ কথা ঠিক, ওরা গরিব মানুষ। দু-তিনশ টাকায় হয়তো আমাদের কিছু যাবে আসবে না কিন্তু তার এই ফন্দি-ফিকির আমার ভালো লাগেনা।
— না, মানে, আমি তো এমন করে ভাবিনি। আর এত শত আমি জানি না।
— ভাববে না কেন? নাকি তোমার ভাবনার জন্য অন্য কিছু আছে যা তোমাকে এসব ভাবতে বাধা দিচ্ছে। জানো না কিন্তু জানার চেষ্টা করেছো কোনদিন? মাঝে মাঝে সারদার মা দু-তিন দিন ডুব মারে, তবুও তো তোমার, তোমার ছেলের নিত্য প্রয়োজনে কোন ব্যতিক্রম হয়নি। সব কাজ একা হাতে কেমন করে সামলাই জানতে চেয়েছ কোনদিন।
— না, মানে… !
— না, মানে…! কি? তুমি জানো? সরদার মা কাল থেকে তিন দিন না জানিয়ে কাজে আসবে না, শরীর খারাপ একটা বাহানা, সারদার বাচ্চা হয়েছে। ও যাবে নাতিকে দেখতে।
— বেশ, আমার ভুল হয়ে গেছে আর হবেনা। এই কান ধরছি।
— কি ভুল হবেনা? প্রতিবারই তোমার এই এক কথা, এক অভিনয়, যখন সারদার মাকে টাকা দিতে হুকুম দিলে তখন তো তোমার গলার স্বর এরকম ছিল না।
— বলছি তো, আর হবে না।
— এতদিন একসাথে আছি, তুমি বলতে পারবে? কোনদিন তোমার সাথে এমন ব্যবহার আমি করেছি, যাতে তোমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে।
গলার কাছে হারানো আত্মসম্মান গুলো কিরকির করতে থাকলেও যেকোনো মূল্যে সন্ধিতে আগ্রহী সুদর্শন বলে,
— না, করনি। আমি কি সেটা বলেছি কখনো?
— তাহলে তুমি কেন কর? কেন? কোন কাজ করার আগে একবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে বা আলোচনা করলে নিদেনপক্ষে জানালে কি ক্ষতি হয় শুনি !
— কোন ক্ষতি হয় না।
— তাহলে কেন? কেন এভাবে ছোট করো? আমি আর পারছি না, তুমি যাও তোমার অফিসের অনেক কাজ বাকি আছে শেষ করে নাও।
কোন কোন দিন অফিসের কিছু কাজ বাড়িতে বসে শেষ করতে হয় ঠিকই, তবে বেশিক্ষণ নয় এই এক-দু ঘণ্টা। আজ কার্যত অফিসে কোন কাজই করেনি, জুনিয়রদের মিটিংটা ছাড়া, কাল শনিবার সাপ্তাহিক রিপোর্ট উৎরে দিলে বাকি কাজ পরের সপ্তাহে। সে নড়ে না, বসে থাকে জয়ীর দিকে তাকিয়ে নিশ্চল পর্বত গাত্রে খোদিত মূর্তির মত পলকহীন চোখে।
জয়ী আর কিছু বলে না, সুদর্শন কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ চমক ভাঙ্গে, ঘড়িতে ৮:৩৫ সুদর্শন দরজা খুলে দেয়, শিশুদের এই বয়সটা বেশ আকর্ষণীয় ঘুম ভাঙা থেকে ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত শুধুই বকবক, নানা প্রশ্ন নানা অভিযোগ নানা কৌতূহল যতক্ষণ ঘরে থাকে একাই তিনশ! মাতিয়ে রাখে সকলকে। আর কোন কথা হয় না।
খাবার টেবিলে জয়ী শান্ত অথচ দৃঢ় ভাবে বলে, — সকালে আমি সুজয় কে নিয়ে মায়ের কাছে যাব, আজ তুমি ওই ঘরে শোবে।আমার শরীরটা ভালো নেই।
ছেলে মায়ের মুখে দাদু বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে একেবারে লাফিয়ে ওঠে, এঁটো হাতেই খাওয়া ছেড়ে এক প্রস্থ নেচে নেয়। সুদর্শনের হৃদপিণ্ড টা কেউ যেন ধরে আছে, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। তার ভাত শুদ্ধ হাতটা প্লেট আর মুখের মাঝখানে থেমে যায়। তার ভিতরের পৌরুষ হাহাকার করে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায়। সুদর্শন তাকে থামায়, নিজেকে শান্ত করে, সে জয়ীর দিকে তাকাতে পারে না, কিন্তু বুঝতে পারে তার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ চোখ জয়ীর দৃষ্টি এড়ায়নি।
ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে সুদর্শন বলে, —ঠিক আছে।
এখন বাকবিতণ্ডার সময় নয় বোঝে সুদর্শন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে বড়জোর দুই কি তিন দিন তারপর আবার পূর্বাবৎ। ইচ্ছা না থাকলেও কখনো কখনো সিরিয়াস হয়ে তাকে ঝগড়া চালিয়ে যেতে হয়। সংসারে সেনাপতির ইচ্ছাই যে শেষ কথা, সৈনিকের ভূমিকা বিশেষভাবে গৌণ।
দ্বিতীয় দিন
জয়ী সকাল সকাল ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। অগাস্ট মাস নয় তবুও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সুদর্শন এর কেমন যেন একটা স্বাধীনতা স্বাধীনতা অনুভূতি। নিজেকে মনে হয় মুক্ত পুরুষ, অন্তত জয়ী না ফেরা পর্যন্ত। তার যখন ইচ্ছা হবে, যতক্ষণ ঘুমোতে ইচ্ছা করবে ঘুমাবে, যতবার চা খেতে ইচ্ছা করবে খাবে, যখন খুশি সিগারেট ধরাবে বারণ করার কেউ থাকবে না। আহ! আহ! কি আনন্দ, এই অনুভূতিটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।সব বিবাহিত পুরুষ এর মর্মার্থ বোঝে, ঠিক যেন বিবাহিত জীবনে ব্যাচেলর ব্যাচেলর ফিল। কিন্তু বেলা যত গড়ালো খেলা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করল। এর আগে পর্যন্ত ঝগড়া করে জয়ী কখনো বাপের বাড়ি যায়নি তাই অসুবিধা বিশেষ হয়নি, কথা বন্ধ থাকলেও প্রয়োজনমতো সবই সময়ে পেয়েছে।
আজ কোনো ঝঞ্ঝাট নেই, দুপুরে ক্যান্টিনে খাবে, তাই আর একটু শুয়ে নেয় কোলবালিশ টাকে আঁকড়ে ধরে। আটটা নাগাদ উঠে রান্না ঘরে যায় এক কাপ চায়ের জন্য, ইন্ডাকশনের সুইচটা অন করে বাটিতে জল বসায়, কিন্তু কোথায় চা, কোথায় চিনি, কোথায় বা দুধ, জল ফুটে যায়, ইন্ডাকশন বন্ধ করে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কফির কৌটা হাতে পেয়ে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফিতেই শুরু করতে হয় স্বাধীনতা উদযাপন।
বেসিনের দিকে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ গতরাতের বাসনপত্রে ভর্তি।সারদার মা আসেনি যথারীতি, রান্না ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে সুদর্শন।কোন রকমের কফিটা শেষ করে খালি কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢুকে পরে, এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস।একেবারে স্নান সেরে বেড়িয়ে তৈরি হয়ে নেয়, অভ্যাস মত খাবার টেবিলে বসে নিজেরই হাসি পায়, অফিস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পরে।তার অনেক দিনের ইচ্ছা, অফিসের কাছেই রাস্তার ধারে বৌদির ফুলকো লুচি আর ঘুগনি, কলিগদের মুখে শুনেছে ঘুগনি নাকি বেড়ে বানায়।
অফিস ছুটির পর কলিগদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা, মন্টুর চপ কাটলেট, কার্তিকের স্পেশাল চা, সবশেষে রাত নটা নাগাদ মোড়ের মাথার হোটেল থেকে রুমালি রুটি আর ডিম তরকা নিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ। খাবারের প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে গন্ধের উৎসের অনুসন্ধান।অনভ্যস্ত হাতে থালা-বাসন ধুতে ধুতে তার প্রিয় চায়ের কাপটা ফসকে যায়। কাঁচের টুকরোগুলো গুছিয়ে খেতে বসে রুমালি প্লাস্টিক অতি কষ্টে ঠাণ্ডা তরকার সাথে তাই গলাধঃকরণ করে।টিভি চালায়।কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে চ্যানেল পাল্টায়।হোয়াটসঅ্যাপ খোলো সারাদিনে একটা মাত্র মেসেজ।সকাল আটটা ত্রিশে।'আমরা পৌঁছে গেছি, ভালো থেকো।'জয়ী কি তার মনোবাসনা বুঝতে পেরে মায়ের বাড়ি চলে গেল? মেসেজে 'ভালো থেকো' এর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে সেই শ্লেষ?
সুদর্শন আর কিছু ভাবতে পারে না, ভাবতে চায়ও না।কাল রবিবার ঠিক করে সারাদিন নিজের মতো ঘুরবে তার অনেক দিনের ইচ্ছা।সকাল-সকাল বাইক নিয়ে বেরোবে দুপুর পর্যন্ত শুধু যাবে আর যাবে যেদিকে রাস্তা পাবে, যেদিকে রাস্তা যাবে, অচেনা অজানা গ্রাম-গঞ্জ বাজার লোকজন অনেক দিন না দেখা প্রকৃতি, এর মধ্যে একটা চার্মিং ব্যাপার আছে, একটা থ্রিলিং আছে। তারপর ফিরবে, যদিও ফেরার কোন তাড়া থাকবে না! রাত পর্যন্ত ফিরলেই হলো।তবু ফিরবে।
আজ তৃতীয় দিন
জীবনে প্রথম রবিবার, যেদিন সকাল ছ'টায় ঘুম ভেঙে যায়, বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢোকে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের বয়সটা আজ একটু কমে গেছে মনে হচ্ছে। যদিও পেটটা একটু স্ফীত হয়েছে এই যা।
পার্কিং থেকে বাইক বের করে চলতে থাকে সুদর্শন শহরের কোলাহল দূরে সরিয়ে রেখে অনেকটা এগিয়ে এসে একটা চা দোকানের সামনে দাঁড়ায়। বাইক থেকে নেমে চারদিকটা দেখে নেয়। রাস্তার ধারে বাসস্টপ গ্রামটা ভিতরে গ্রাম সড়ক যোজনার পিচ রাস্তার একটা বোর্ড কাত হয়ে পড়ে আছে, সব মিলে তিন-চারটে অস্থায়ী দোকান তার মধ্যে একটা সবজির। সকালবেলার টাটকা সবজি গুলো দেখে বড্ড লোভ হয় সুদর্শনের। চায়ের দোকানের সামনে বাঁশের চাঙে বাসের অপেক্ষায় বসে দু তিনজন লোক চা খাচ্ছে, শহরের দিকে যাবার একটা বাস এলে লোকগুলো দৌড় দিল, সম্ভবত এরা শহরে শ্রমিকের কাজ করে। বাসটা চলে যেতে চারিদিকটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় রাস্তাটা না বেঁকে সোজা চলে গেছে। এরকম সচরাচর দেখা যায় না। রাস্তার দুই পাশে শিরিষ সোনাঝুরির সারি, তাদের ডাল গুলো রাস্তার দিকে এমন ভাবে ঝুঁকে পড়েছে যেন গলা বাড়িয়ে একে অপরের কপালে এঁকে দিচ্ছে ভালোবাসার চিহ্ন চুম্বন রেখা, আর সবুজের বুক চিরে রাস্তাটা যেন গ্রীন টানেল। সুদর্শন ওই রাস্তা দিয়ে গ্রামের কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসে। এই বড় রাস্তা দিয়ে সে অনেকবার গেছে, এরকম ভাবে রাস্তা তাকে কখনো ডাকেনি। সুদর্শন ধীর লয়ে চলতে থাকে আর দেখতে থাকে রাস্তাঘাট, গ্রাম, গ্রামের মানুষ, ধানক্ষেত, শরতের হিমেল বাতাসে ঝরতে থাকা শ্রীহীন কাশফুলের শুষ্ক শীষ।
চলতে চলতে কত কথা ভীড় করে আসে মনের ভেতর, প্রতিদিনের নানা স্মৃতি, কোনটা আনন্দের কোনটা বেদনার। হাজারো স্মৃতির ভীড়ে স্কুল জীবনের ছেঁড়া ছেঁড়া অস্পষ্ট স্মৃতি, কলেজ জীবনের অসমাপ্ত অব্যক্ত প্রেম। সুদেষ্ণা কে ভালো লাগতো, খুব ফর্সা টকটকে রং বা অপূর্ব সুন্দরী না হলেও একটা অন্যরকম সৌন্দর্য ছিল মেয়েটার চোখে মুখে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই কে জানে কেমন আছে সুদেষ্ণা? কোথায় আছে তাও জানেনা সুদর্শন। জানার প্রয়োজন ও নেই। তার মত কোন অনুভূতি সুদেষ্ণার ছিল কিনা তাও জানা হয়নি। কিছু জিনিস না জানাই ভালো।
রাস্তার পাশে সদ্য ভাজা কচুরির গন্ধ ঢুকে গেছে মগজে, মগজটা জায়গা নিয়েছে পেটের। অগত্যা দাঁড়াতে হলো। শালপাতার প্লেটে চারটে গরম পেটমোটা কচুরি খেয়ে হাত ধুয়ে কুলকুচির জলটা ফেলতে যাবে দেখে ময়লা ছেঁড়া প্যান্ট পরা ছয়-সাত বছরের শিশু অন্ধ বাবার হাত ধরে তার সামনে। এই রে, আর একটু হলেই…
একটা কচি হাতের রুক্ষু চেটো তার দিকে বাড়ানো। ফ্যাকাশে চোখে জগতের ক্ষুধা।
সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে, — কিরে, কচুরি খাবি?
—টাকা নেই। সাবলীল উত্তর। অক্ষর পরিচয় ধারাপাত বোঝার বয়সেই সে বুঝেছে গান্ধী মার্কা রঙবেরঙের কাগজের টুকরোর দাম।
— টাকার দরকার নেই, বস এখানে। বলে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চি দেখায়।
আরও দুই জায়গায় কচুরি দিতে বলে, বেঞ্চের আর এক প্রান্তে বসে ঝুড়িতে রাখা কচুরি গুলোর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটার মুখচ্ছবির পরিবর্তনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে সুদর্শন।
খাওয়া শেষ করে ছেলেটি সামনে এসে বলে, —তুমি খুব ভালো। ছেলেটির পরিতৃপ্ত হাসি মুখটা ঠিক সুজয়ের মতো।
— "স্কুল যাস?"
— "না। তালে খাবো কি?"
ভিক্ষা পাত্রে লুট হয়ে যাওয়া শৈশব, বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে সুদর্শন, চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠার আগেই ডান হাত সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকটা সময় ধরে বাইক চালাচ্ছে, মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে, কোন দিকে যাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে দেখে চারপাশ কেমন চেনা চেনা ঠেকছে ঠিক বুঝতে পারছে না। উল্টো দিকে আসা বাইক আরোহীকে জায়গাটার নাম জিজ্ঞাসা করবে ভেবে থামতেই হেলমেটের গ্লাস তুলতে তুলতে ওপাসের জিজ্ঞাসা, — জামাইবাবু এখানে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন? ওদিকে দিদি সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছে আপনার জন্য। এতো দেরি করে?
— তাড়াতাড়ি চলুন, আমি আসছি। বলে জয়শ্রীর খুড়তুতো ভাই বড় রাস্তার দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে খুব হাসি পায় তার কিন্তু জনমানবহীন দুপুরের রাস্তাটা ছাড়াও সে হাসির শব্দ আর একজন বোধহয় শুনতে পায়।
___________
এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
মোবাইল : ৯৪৭৫৯৭৬৫৭৬
শিবপুর দীঘিরপাড়, পোস্ট - রাজবাটী,
জেলা - পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ৭১৩১০৪