খবরটা শুনে আনন্দে মেতে উঠেছে পরিবারের সকলে। রাত দশটার সময়ে রজত ফোন করে জানায় যে সে দেড় মাসের ছুটি পেয়েছে। আগামী মাসেই দেশে ফিরছে। ফোনটা ধরেন রজতের মা। সুখবরটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন। মায়ের চিৎকার শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে দোতলা থেকে ছুটে আসে রজতের দুই দাদা অশোক, অমর। তাদের পেছনে পেছনে তার দুই বৌদিও নিচে নেমে আসে। দোতলা বাড়িটার, দোতলাতে থাকে রজতের দুই দাদা বৌদি। সিঁড়ি ভেঙে ওঠা নামা করতে অসুবিধা হয় বলে একতলাতে থাকেন রজতের বাবা মা। কয়েক বছর ধরে হার্টের সমস্যায় ভুগছেন রজতের বাবা। সেই নিয়ে উৎকন্ঠায় থাকে রজতের দুই দাদা। রজতও আমেরিকা থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নেয় তার বাবা মায়ের। উৎকন্ঠিত অশোক, অমর নিচে নেমে, আনন্দের খবরটা শুনে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দেয়।
রজতের বড় বৌদি স্বপ্না তার শাশুড়িকে বলে, "আর দেরি করা ঠিক হবে না মা। রজতের বিয়েটা এবারে দিয়ে দিন। রজতের বাড়ি ফিরতে এখনও কুড়ি দিন দেরি আছে। এরমধ্যে দেখাশোনাটা সেরে ফেলুন।"
- "ঠিক বলেছ বৌমা, আর দেরি করব না। এরমধ্যে তোমরা সকলে মিলে দেখে শুনে রাখো। রজত ফিরলেই বিয়েটা দিয়ে দেব। তারপর একেবারে বৌ নিয়ে আমেরিকায় যাবে।"
- "পাত্রীতো আমার দেখাই আছে মা। আমার ছোট বোনের ননদ। দেখতে শুনতে খুবই সুন্দরী। লেখা পড়া জানা, উচ্চ শিক্ষিত। বনেদী বাড়ি। ওদেশে গিয়ে কোনও অসুবিধা হবে না। ভালোভাবেই মানিয়ে নিতে পারবে। তাছাড়া যেখানে সেখানেতো আমাদের রজতের বিয়ে দেওয়া যায় না। রজতের একটা স্ট্যাটাস আছে।" কথা বলতে বলতে রজতের বড় বৌদি একবার আড়চোখে দেখে নেয় রজতের মেজ বৌদি তনুশ্রীকে।
মুখে বিরক্তির ভাব এনে রজতের মেজ বৌদি তনুশ্রী বলে, "ভালো করে দেখে শুনে রজতের বিয়ে দিতে হবে মা। বিদেশ বিভুঁইতে থাকে। দরকার যোগ্য সহধর্মিনী। যাকে সবসময়ই রজত পাশে পাবে। সে যেমন বিদেশী আদব কায়দা জানবে, তেমন গৃহকর্মেও দক্ষ হবে। ছেলেটা একা থাকে, হাত পুড়িয়ে খায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মাইনে বেশ ভালোই পায়। কিন্তু সেটাতো কষ্ট করেই উপার্জন করতে হয়। ওদেশে রান্নার লোক রাখা বা হোটেল থেকে নিয়মিত কিনে খেতে গেলে হাতে আর কিছুই থাকবে না। তাই এমন বৌ আনতে হবে যে রান্নাবান্না, ঘর গুছানোতেও পারদর্শী হবে।"
- "তুই কি বলতে চাইছিস মেজ? আমাদের শেলী রান্নাবান্না জানে না বলেই একথা বলছিসতো। আজ রান্না জানে না, কাল শিখে নেবে। কিন্তু রূপ? সেতো সবাইয়ের থাকে না। তাই যাকে তাকে ঘরে আনা যাবে না। তুই যদি কোনও সাধারণ দেখতে মেয়ের কথা বলিস, তাকে কি আনা যাবে? রজতের সে দেশে একটা স্ট্যাটাস তৈরী হয়েছে। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত একটা মেয়েকে তার বৌ হিসেবে ওদেশে পাঠাতে হবে।"
- "আমি কিছুই বলছি না দিদি। বাবা মা যা ভালো মনে করবেন তাই হবে। রজত বিয়ে করে রূপের পুটুলি নিয়ে যাবে নাকি কাজে কর্মে দক্ষ কোনও মেয়েকে নিয়ে যাবে, যে রজতের কষ্ট পরিশ্রম লাঘব করতে পারবে, সেটা বাবা মাকেই ঠিক করতে দাও।"
- "বুঝেছি বুঝেছি, তুই তোর দাদার শালীকে রজতের ঘাড়ে চাপাতে চাইছিস। সব বুঝি আমি।"
- "কি আশ্চর্য, আমি কি কারও নাম করেছি? তুমি কেন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চাইছ দিদি?"
- "দেখো দেখো, তোমার সামনেই মেজ আমাকে ঝগড়ুটে বলে অপমান করছে।" কথা বলতে বলতে রজতের বড় বৌদি স্বপ্না ঘুরে তাকায় রজতের বড়দা অশোকের দিকে।
- "থামো, বৌমারা থামো।" বৌমাদের থামিয়ে রজতের বাবা বলতে থাকেন, "রজত বাড়ি ফিরছে। সেই আনন্দে কাল একটা পার্টি হয়ে যাক। কাল সকাল থেকেই বৌমারা সব কাজে লেগে পড়বে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি পনির, চিলি চিকেন আর যত খুশি রসগোল্লা...।"
- "না একটাও নয়।" ধমকে ওঠেন রজতের মা, "দিনে দিনে যত সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল বাড়ছে, তত লাফিয়ে লাফিয়ে নোলাও বাড়ছে! কোনও বাড়াবাড়ি নয়। যেমন মাছের ঝোল ভাত হয়, তেমন হবে।"
- "আরে বাবা চিকেনে কোলেস্টেরল বাড়ে না।"
- "ঠিক আছে। চিকেন হতে পারে। তবে চিকেন স্ট্যু। চিলি চিকেন নয়।"
- "বড় আসা করে বলেছিলাম গো! ঠিক আছে, যা দেবে, তাই খাব।" পুরোপুরি রণে ভঙ্গ দেন রজতের বাবা।
বাবাকে গুটিয়ে যেতে দেখে অশোক বলে, "ঠিক আছে, ঠিক আছে, অত কিছু না হোক, সকালে জলখাবারের সঙ্গে দুটো করে ফিস ফ্রাইয়ের ব্যবস্থা করা হবে।"
- "দুটো নয়। একটা করে।" আবার দাবড়ানি দেন রজতের মা।
পাঁচ বছর পর দেশে ফিরছে রজত। কতদিন সে বাবা মাকে দেখেনি। পায়নি মায়ের আদর, বাবার স্নেহ, দাদাদের ভালোবাসা। বৌদিদের কাছে এটা ওটা খেতে চাওয়ার আবদার বায়নাক্কা বন্ধ হয়ে গেছে পাঁচ বছর। গত পাঁচ বছর সে দেখতে পায়নি পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনদের মুখ। গত পাঁচ বছরে যা কিছু থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে, সবকিছু সে কড়ায় গন্ডায় উসুল করবে আগামী দেড় মাসে। বাড়ি ফিরে কি কি করবে, কোথায় কোথায় যাবে তার একটা খসড়া সে তৈরি করতে থাকে মনে মনে।
পাঁচ বছর আগে আই আই টি খড়্গপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে আমেরিকার মিশিগানে এক বহুজাতিক গাড়ি কোম্পানির লোভনীয় চাকরিটা পেয়ে যায়। তারপর লোটা কম্বল গুটিয়ে আমেরিকা পাড়ি। দেখতে দেখতে কেটে যায় পাঁচ বছর। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে রজতের মনের মাঝে। কত সুখ স্মৃতি। সবকিছু ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে ক্যারিয়ার গড়ার আসায়। গত পাঁচ বছর সে কাটিয়েছে চাতকের তৃষ্ণা নিয়ে। মাত্র দেড় মাসের জন্য সে বাড়ি ফিরছে। এই কদিনে কি সে পারবে তার তৃষ্ণা মেটাতে? দর্শনের তৃষ্ণা। আরতো বেশি কিছু তার কাছ থেকে চাওয়ার নেই রজতের। কতদিন দেখা হয়নি! কথা হয়নি। শীতল হয়ে যাওয়া সম্পর্কটা কি আবার উষ্ণ হয়ে উঠবে? নাকি পাঁচ বছরের অদর্শন পুরোপুরি শীতল করে দিয়েছে সেই সম্পর্ককে? জানে না, জানে না। কিছুই জানেনা রজত। বাড়ি ফেরার পর সে বুঝতে পারবে তাদের সম্পর্কের সমীকরণকে। কিন্তু সে এখন আছে কোথায়? কোথায় গেলে খুঁজে পাবে তাকে? বারে বারে রজত তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছে তার কথা। তার পরিবারের কথা। কিন্তু কোনও সদুত্তর পায়নি। সেও কোনও রকম যোগাযোগ করেনি। তার মোবাইল নম্বরটাও অকেজো হয়ে গেছে কোনও অজ্ঞাত কারণে।
অনেক কথাই আজ মনে পড়ে রজতের। মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। যেদিন সে বাড়ি ছেড়েছিল। পাড়ি দিয়েছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর অপর পারে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা এসেছে তাকে বিদায় জানাতে। কিন্তু তার চোখ খুঁজে চলেছে অন্য একজনকে। কোথায় সে? রজততো তাকে দেখতে পাচ্ছে না! কিছু পরে তার চোখে পড়ে সেই দুচোখ। জলে ভরা। কাজল মুছে গেছে ভিজে পাতা থেকে। কিন্তু সে কি হাসছে? রজত বুঝতে পারে না। রজতের চোখও যে ঝাপসা! আলতো ভাবে সে হাত নাড়ছে। রজত কি হাত নেড়েছিল? মনে পড়ে না!
ভাবতে থাকে রজত। ভাবতে ভাবতে ডাউন মেমরি লেন ধরে এগিয়ে চলে সে। নাকি পিছিয়ে যায়? মনে পড়ছে। আজ কাজের অবসরে কত কিছুই না তার মনে পড়ছে! কত কথা, কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে তার মনের অলিন্দে। মনে পড়ছে তার স্কুলের কথা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার কথা।
- "রজতদা, আমাকে তোমার সাইকেলে করে নিয়ে যাবে? স্কুলে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছি। পায়ে ব্যথা করছে। হাঁটতে পারছি না। নিয়ে চলোনা।"
রজত ঘুরে দেখে সবুজ ফিতেয় বাঁধা দুটো বেণী। রজত থামতেই সে ছুটে এসে উঠে পড়ে রজতের সাইকেলে।
- "এইতো বললি তোর পায়ে ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তাহলে ছুটে এলি কি করে?"
- "হি হি হি। পায়ে ব্যাথা না বললে তুমি সাইকেল থামাতে না। আমিও উঠতে পারতাম না।"
- "সারাদিনতো ছুটে বেড়াস। এইটুকু রাস্তা হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হয়?"
- "সেতো যেতেই পারি। কিন্তু আমারতো তোমার সঙ্গে যেতে ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। তোমার ভালো লাগেনা আমাকে নিয়ে যেতে? বলোনা ভালো লাগেনা?"
- "সেতো নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু তুই এত কিচির মিচির করিস যে সাইকেলের ব্যালেন্স রাখা মুশকিল হয়।"
পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে রজতের দিকে তাকিয়ে সে বলে, "আমি কিচির মিচির করি! আমি কি পাখি?"
- "না তুই পাখি নয়, তুই বক। যেভাবে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে দেখছিস, তোকে মেছো বক মনে হচ্ছে।"
- "আমি বক! তুমি হুতুম প্যাঁচা।"
সাইকেল থামিয়ে দেয় রজত। রাগত স্বরে বলে, "যা, নেমে যা আমার সাইকেল থেকে।"
- "নামব না, কি করবে?"
- "না রে, তুই মেছো বক নয়। তুই খুব ভালো মেয়ে। চল আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি যাই। তোর সঙ্গে হেঁটে যেতে আমার খুব ভালো লাগে।"
- "তাই চলো। আমারও খুব ভালো লাগে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরতে। তুমি হুতুম প্যাঁচা নও। তুমিও খুব ভালো।"
দোতলাতে নিজের ঘরে এসে স্বপ্না ফোন করে তার বোন রত্নাকে, "একটা ভালো খবর আছে। রজত আগামী মাসে বাড়ি ফিরছে।"
- "রজত বাড়ি ফিরছে। বাঃ খুব ভালো খবর। তোমার জন্য নিশ্চয়ই অনেক কিছু আনছে। ফোন করে বলে দাও না আমার জন্য অন্তত একটা লিপস্টিক আনতে।"
- "ওসব কথা এখন ছাড়। কাজের কথা শোন, বিয়েটা লাগাতে পারলে ওরকম অনেক লিপস্টিক পাবি।"
- "বিয়ে, মানে রজতের সঙ্গে শেলীর বিয়ের কথা বলছতো। সেতো তুমি আগেই ঠিক করে রেখেছ। রজত কি এবারে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় থাকবে? নাকি কয়েকদিন থেকে আমেরিকায় ফিরে যাবে। আবার পাঁচ বছর পর আসবে। এই করতে করতে আমাদের শেলী বুড়ি হয়ে যাবে।"
- "রজতের যা মতি গতি দেখছি, ও কোনও দিন আর পাকাপাকিভাবে কোলকাতায় থাকবে না। আরে বাবা, অত টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে, আমেরিকার লাক্সারি জীবন যাপন ছেড়ে কেউ এই ঘিঞ্জি, নোংরা কলকাতায় থাকতে চায়? ও আমেরিকায় থাকবে। পাঁচ সাত বছর অন্তর একবার করে এখানে ঘুরতে আসবে।"
- "তাহলে বিয়ের কি হবে?"
- "আমার শাশুড়ি বলেছে, এবার রজতের বিয়ে দিয়ে আমেরিকায় পাঠাবে।"
- "তারমানে আমাদের শেলী আমেরিকায় যাবে! আমাদের শেলী স্যান্ডো গেঞ্জি, জাঙিয়া পরে, বিড়ি সিগারেট টানতে টানতে আমেরিকার রাস্তায় মেম সাহেবদের মত ঘুরে বেড়াবে! উরি বাবা, আমারতো ভাবতে গেলেই মাথা ঘুরছে!"
- "দাঁড়া দাঁড়া, এখনই এত লাফাস না। এরমধ্যে কম্পিটিটর এসে গেছে। মেজ চেষ্টা চালাচ্ছে তার দাদার শালীকে রজতের গলায় ঝোলাতে। মেয়েটাকে আমি দেখেছি, শেলীর মত অত সুন্দরী না হলেও, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, ফড়ফড়িয়ে ইংরাজি বলে। রান্নাবান্নাও জানে। মেজ সব সময়ে মায়ের আসে পাশে ঘুরঘুর করছে, আর ফিসফিস করে কি সব বোঝাচ্ছে! তবে আমিও ছোড়নেওয়ালী নেহি। রজতের সঙ্গে শেলীর বিয়েটা দিতে পারলে তোর আমার আমেরিকায় ঘুরতে যাওয়া একদম পাকা। তোর অশোকদারতো অত টাকা নেই যে আমাকে আমেরিকায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। দীঘায় যেতে বললেই সাত বার ভাবে, সে যাবে আমেরিকা! তুই একটা কাজ কর এই পনেরো কুড়ি দিনে শেলীকে কিছু ডাল, ঝোল রান্না করা শিখিয়ে দে। তারপর আমি লড়ে যাব।"
- "বিয়ের পর রজত শেলীকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে। কিন্তু তোমাকে কেন নিয়ে যাবে?"
- আরে বাবা, ওদের সংসারটা গুছিয়ে দিতে হবেতো। আর আমি গেলে তোকেও সঙ্গে নেব। তুই এখন শেলীকে আমেরিকার লোভ দেখা আর রান্না শেখা।"
- "তুমি আমি দুজনে একসঙ্গে আমেরিকায় ঘুরতে যাব!" উচ্ছসিত রত্না বলতে থাকে, "ঠিক আছে দিদি, কাল থেকেই আমি মাকে বলে শেলীর উড়ে বেড়ানো বন্ধ করে, রান্না শেখানোর ব্যবস্থা করছি। তুমি চিন্তা কোরো না।"
ফোনটা ছেড়ে স্বপ্না ভাবতে থাকে - আমেরিকা যাওয়ার টোপ রত্না ভালোই গিলেছে। এবার সে আমার কাজটা অনেক সহজ করে দেবে। গীতায় বলেছে 'ফলের কথা চিন্তা না করে কাজ করে যাও।' অতয়েব রত্নাবলী, তুইও ফলের কথা চিন্তা না করে, কাজ করে যা। ফলটা আমি খাব। মানে আমেরিকায় আমি যাব। বাড়তি লোকজনকে নিয়ে যাওয়া মানে বাড়তি খরচ। রজতের আর্থিক দিকটাওতো বড় বৌদি হিসেবে আমার দেখা দরকার। ভাবতে থাকে স্বপ্না। ভাবতে ভাবতে হাসতে থাকে।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর প্রথম বিড়ি খাওয়ার স্মৃতিটাও ভেসে ওঠে রজতের চোখের সামনে। বিচ্ছু মেয়েটা তাকে বিড়ি খেতে দেখে খুব হেসেছিল।
- "কিগো রজতদা, ডেকেছ কেন?"
- "একটা জিনিষ কিনেছি, দেখবি?"
- "কিগো?"
- "এই দেখ।" পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দেখায় রজত, বলে, "সবাই খায়। আমিও খেয়ে দেখি কেমন লাগে।"
- "তুমি বিড়ি খাবে?"
- "রোজ খাব না। শুধু আজ খেয়ে দেখি।"
- "সবাই ওরকম বলে তারপর বিড়ি খোর হয়ে যায়। তুমিও হয়ে যাবে। বিড়ি খোর, বিড়ি খোর। হি হি হি।"
বিড়ি খোর তকমাটা পেয়ে মাথা গরম হয়ে যায় রজতের। একটা চাঁটি মারে তার মাথায়। সে তার মাথাটা রজতের মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, "আর একটা চাঁটি মারো। না হলে সিং গজাবে।"
- "তোর মাথায় সিং গজাবে না।"
- "কেনগো?"
- "তোর যা লেজ গজিয়ে গেছে, আর সিং গজাবে না।"
রজতের মেজ বৌদি তনুশ্রীর দাদা মাঝে মাঝে তনুশ্রীকে ফোন করে। গল্প গুজব করে। তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়। বিশেষ করে রজতের খোঁজ নেয়। তার ইচ্ছা রজতকে ধরে যদি তার ছেলেকে আমেরিকায় পাঠানো যায়। সে শুনেছে আমেরিকায় চাকরির অভাব নেই। মাইনে প্রচুর। কাজ জানা লোক আমেরিকায় গেলে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি পেয়ে যায়। আর আনকোরাদের মাসখানেক সময় লাগে।
- "কি খবর তনুশ্রী? তোর শ্বশুর শাশুড়ি কেমন আছেন? রজতের খবর কি?"
- "রজতের খুব ভালো খবর। সামনের মাসে বাড়ি আসছে। আমার শাশুড়ি বলেছে, রজত বাড়ি ফিরলেই বিয়ে দেবে। আমাদের দুই জাকে দেখাশোনা করতে বলেছে। এখন তুমি বলো তোমার শালী পারমিতার কি খবর?"
- "পারমিতা আগের চাকরিটা ছেড়ে একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করছে। সেই সঙ্গে চুটিয়ে টিউশনি করছে। ভালোই কামাচ্ছে।"
- "ওসব ছাড়ো, পারমিতাকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে এস।"
- "হ্যাঁ, যাব খুব তাড়াতাড়ি যাব। তুই দেখ যাতে পারমিতার সাথে রজতের বিয়েটা দেওয়া যায়। তাহলে আমার ছেলেটাকে আমেরিকায় পাঠানো সহজ হবে। মাসির বাড়িতে কিছুদিন থেকে সে সেটেল করে নিতে পারবে। এইটুকু কর তোর ভাইপোর জন্য।"
- "আমিতো চেষ্টা করছি। তবে আমার জা তার বোনের ননদকে গছানোর ধান্দা করছে। কাজটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছি, তোমরা মাঝে মাঝে এসে আমার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে কথা বলো, গল্প গুজব করো। যাতে তোমাদের কথা ফেলতে না পারে।"
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর মায়াপুর ঘুরতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে রজতের। সেদিন সে মনে মনে খুব রেগে গিয়েছিল। আজ অবশ্য রাগ নেই। তার বদলে সেই দিনটার কথা মনে পড়লে তার হাসি পায়।
পাড়ার কয়েকজন ছেলে মায়াপুর ট্যুরের ব্যবস্থা করেছে। বড় একটা বাস ভাড়া করা হয়েছে। রজতও যাচ্ছে তার বাবা মায়ের সঙ্গে। বাসের একদিকে দুটো, অন্যদিকে তিনটে করে সীট। রজত বসে একটা সীট রেখেছে। পাশাপাশি অন্যদিকে বসেছেন তার বাবা মা। কিন্তু সেতো আসছে না! কতক্ষণ এভাবে সীট রাখা যায়! বারে বারে রজত জানালা দিয়ে দেখছে, কোথায় সে? ঐতো আসছে। এখন আর সবুজ ফিতেয় বাঁধা দুই বেণী নেই। তার বদলে জড়িয়ে নিয়েছে লাল ওড়না। শরীরে আসন্ন যৌবনের পেলব ছোঁয়া। সুন্দরী না হলেও দিনে দিনে আকর্ষণীয়া হয়ে উঠছে সে। রজত দেখছে, বাসে উঠছে। এগিয়ে আসছে রজতের দিকে।
কিন্তু একি! রজতের রাখা সীটে না বসে, সে বসে পড়ে রজতের মায়ের পাশে! খুব রাগ হচ্ছে রজতের। মনে হচ্ছে বাস থেকে নেমে যায়। অবশ্য মায়াপুরে পৌঁছে, সে রজতের সঙ্গেই ঘুরেছে, দেখেছে বিভিন্ন মন্দির। কখনও নিজের অজান্তে ধরেছে রজতের হাত। হাত ধরেই তারা ঘুরে বেড়িয়েছে। পাশাপাশি বসে প্রসাদ গ্রহন করেছে।
সন্ধ্যায় ফেরার সময়ে অবশ্য রজতের পাশেই বসেছে। রজতের সকালের রাগ কখন যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় ছুটে চলেছে বাস। জানালার ধারে বসে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলে, "দেখ রজতদা, ঐ তারাটাকে দেখ। মিট মিট করে জ্বলছে, কিন্তু কি উজ্জ্বল!"
- "সন্ধ্যা তারা। শান্ত স্নিগ্ধ কিন্তু ভিড়ের মাঝেও চোখে পড়ে। ঠিক তোর মত।"
সকাল হতেই তনুশ্রীর দাদা বৌদি এসে হাজির হয়েছে তনুশ্রীর শ্বশুর বাড়িতে। তাদের ছেলের আঠারো বছরের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ করতে।
- "মেজ তোর কি কোনও কান্ডজ্ঞান নেই? তোর বাপের বাড়ির লোকেরা আসছে সে কথা আগে বলিসনি কেন? ঘর দোর সব আগছালো হয়ে রয়েছে।"
- "আমি কি করে জানব ওরা আজ সকালেই চলে আসবে। বলেছিল একদিন আসবে। সেটা যে আজ, কি করে জানব?"
- বেশ বুঝেছি তোর দাদা বৌদি কোন ধান্দায় এসেছে। সব জানি আমি। তবে তোদের ঐ খেঁদি, কি যেন নাম, পারমিতা না কি! ও শেলীর রূপের সামনে দাঁড়াতে পারবে?"
- "রজত কি রূপ ধুয়ে জল খাবে? তোমাদের শেলীতো কাজের অষ্টরম্ভা! ওকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে রজতের বোঝা বাড়বে। রজতকে হাত পুড়িয়ে দুবেলা রান্না করে খাওয়াতে হবে।"
- "তুই থাম মেজ। রজতের ব্যাপার রজতের বাবা মাকে বুঝতে দে। আর তোর দাদা বৌদিকে বেশি হ্যাংলামো করতে বারণ কর। ওদের বলে দিবি যেন ঘনঘন এ বাড়িতে না আসে।"
- "একদম বাজে কথা বলবে না। এ বাড়িটা তুমি তোমার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছ? নাকি আমাকে তোমার ঝি চাকর ভাবছ, যা বলবে তাই শুনব।"
- "এই খবরদার, একদম বাপের বাড়ি তুলে কথা বলবি না। তাহলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেব।"
- "তোমার যা খুশি করো। যত খুশি বাঁদরামো করো। আমার কিছু যায় আসে না।"
- "এই মুখ সামলে কথা বল। তোর এত সাহস যে আমাকে বাঁদর বলিস! আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।"
- "যা খুশি করো। আমার কিছু যায় আসে না। তার আগে একটা ভুল শুধরে নাও, তুমি বাঁদর নও, বাঁদরী, বুঝেছ।"
- "ওগো শুনছ, মেজ আমাকে বাঁদরী বলছে। আমার বাবা মাকে গালাগাল দিচ্ছে।" চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় স্বপ্না। পাল্লা দিয়ে চিৎকার করতে থাকে তনুশ্রী। দুই জায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়া মাথায় ওঠে।"
আই আই টিতে সুযোগ পেয়েছে রজত। পড়া শেষ হলেই দামী চাকরি, মোটা মাইনে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। মনটা খুশিতে ভরে আছে। তার মধ্যেও যেন একটা বিষাদের কাঁটা বিঁধে রয়েছে। অনেক দিন বাড়ি ছেড়ে থাকতে হবে। দেখা হবে না তার সঙ্গে। তাকে না দেখলে যে একটা দিনও কাটতে চায় না রজতের! সেই জায়গায় মাসের পর মাস তাকে না দেখে থাকতে হবে! মনটা ভারি হয়ে আসে রজতের।
- "রজতদা তুমি চলে যাচ্ছ? আবার কবে আসবে?"
- "বেশি দুরেতো যাচ্ছি না। খড়্গপুর আর কতদুর! মাঝে মাঝে আসব। তোর সঙ্গে দেখা করব।" গলাটা কেঁপে ওঠে রজতের।
- "তুমি কাঁদছ রজতদা? এমা বুড়ো ছেলে কেমন কাঁদে!"
- "তোর চোখেওতো জল।" সজোরে কেঁদে ওঠে রজত, "আমি পারছি নারে! একদম পারছি না! তোকে ছেড়ে যেতে একদম মন চাইছে না! তোকে যে আমি ভালোবাসিরে, খুব ভালোবাসি। এতদিন কি করে থাকব তোকে ছেড়ে? বল, তুই বল?"
- "জানিনা রজতদা। আমিও যে তোমাকে খুব ভালোবাসি। তবে আমি পারব। মেয়েরা যে অনেক কিছু পারে রজতদা। মেয়েদের যে অনেক কিছু পারতে হয়। মেয়েদের যে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। কিন্তু তুমি কি করে পারবে রজতদা? বলো, তুমি কি করে পারবে?"
ঝরে পড়া দুজনের চোখের জল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরেছে রজত। সবাই আনন্দ করছে, হাসছে। কিন্তু রজতের মনে হচ্ছে কোথাও যেন তাল কেটে যাচ্ছে! সুরধ্বনি যেন ঠিক সুরে বাজছে না! কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। দুই বৌদিকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না! দুই দাদার মধ্যেও যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল এসে দাঁড়িয়েছে!
প্রতিদিন সকালে রজত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, কেন যায়, কেউ জানে না। বাড়ি ফিরতে কোনও দিন দুপুর হয়ে যায়। কোনও দিন আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। রজতের মা একদিন স্বপ্নার বোনকে ফোন করে বললেন যে তারা শেলীকে দেখতে যাবেন। আবার একদিন তনুশ্রীর দাদাকে ফোন করে বললেন যে পারমিতাকে দেখতে যাবেন। কিন্তু রজত সময় দিতে পারছে না।
দেখতে দেখতে কুড়ি দিন কেটে যায়। বিয়ের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই রজতের। একদিন তার মা তাকে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বললেন। মা ছেলের মধ্যে বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে শুনতে পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে রজতের দুই বৌদি।
বৌদিদের সামনে রজত তার মাকে বলে, "আমার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি যাকে বিয়ে করব, তার দেখা পেয়েছি। এবারে আমেরিকায় গিয়ে সব ব্যবস্থা করে, সামনের বছরে এসে তাকে নিয়ে যাব।"
শুনে রজতের মা বললেন, "দেখা পেয়েছিস! কোথায় পেলি? তারা অনেক দিন আগে এপাড়া ছেড়ে চলে গেছে। সেটাই ভালো, নিজের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে কর। তাহলে তোর বৌদিদের মধ্যে আর কোনও সমস্যা থাকবে না।"
- "কাকে বিয়ে করবে রজত?" স্বপ্না প্রশ্ন করে, "ঐ কেলে কুৎসিত মেয়েটাকে?"
- "হ্যাঁ বড় বৌদি, ঐ কালো মেয়েটাইতো আমার মনের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।"
- "শেলীর মত ডানা কাটা পরীকে ছেড়ে তোমার ঐ রক্ষেকালীকে মনে ধরল? তোমার কি গলায় দড়ি জোটেনি?"
- "দড়িইতো জুটল বড় বৌদি। মালা আর পেলাম কোথায়!"
ফিরে যাচ্ছে রজত। আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছে। সত্যিই কি রজত তার দেখা পেয়েছে? নাকি গৃহ বিবাদ আটকাতে সে সামান্য মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে? সত্যিই কি সে এক বছর পর আবার ফিরে আসবে? নাকি বাকি জীবনটা আমেরিকায় কাটিয়ে দেবে? হয়ত আমেরিকার চোখ ধাঁধানো, উজ্জ্বল আলোকছটার মাঝে সে খুঁজতে থাকবে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা কোনও এক সন্ধ্যা তারাকে!
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার,
মোবাইল নং - 8902737584
ঠিকানা - 34/10/A,
M.G.ROAD BUDGE BUDGE
KOLKATA - 700137