
বড়গল্প ।। নিশিথের অন্ধকার ।। শংকর ব্রহ্ম
নিশিথের অন্ধকার
শংকর ব্রহ্ম
মাঝরাতে মলয়ের ঘুম ভেঙে গেল বাথরুমের চাপে। বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় পাশে তাকিয়ে দেখল, নীলিমা অকাতরে ঘুমাছে ওপশে কাৎ হয়ে। খাট থেকে নীচে নেমে যাওয়ার সময় দেখল, নীলিমার মুখে একটা আলগা হাসি লেগে আছে। হযতো কোন মধুর স্বপ্ন দেখছে সে। এসময় তাকে জাগিয়ে দিলে কেমন হয়? স্বপ্ন অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে, ঘুম ভাঙায় সে কি খুব বিরক্ত হবে? দেখাই যাক না, একবার তার ঘুম ভাঙিয়ে। আচ্ছা আগে বাথরুম থেকে ঘুরে আসা যাক। খুব পেচ্ছাবের বেগ পেয়েছে তার। পেচ্ছাব চেপে রাখা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে কিডনির উপর চাপ পরে। মলয় তাই আগে বাথরুমে চলে গেল।
বাথরুমের কাজ শেষ করে, ঘরে ফিরে তার চোখ গেল খোলা জানলাটার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখে সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল।
কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে। নির্মল আকাশ। জোৎস্নায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ পরিবেশ। এ রকম চাঁদ জীবনে একবারই দেখার সৃযোগ হয়, মনেহল মলয়ের। পেচ্ছাবের বেগ না পেলে এসময়টা সে ঘুমিয়েই থাকত। এমন মনোরম দৃশ্য তার দেখা হত না। এমন বিরল দৃশ্য দেখলে মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। মলয় কতক্ষণ বিভোের হয়ে তাকিয়ে ছিল জানে না। নীলিমার কথায় তন্ময় ঘোর কাটল। সে ফিরে দেখল, কখন ঘুম ভেঙে উঠে এসে নীলিমা তার পাশে দাঁড়িয়ছে। নীলিমা বলল, কী সুন্দর লাগছে বাইরেটা দেখতে।
মলয় বলল, যাবে বাইরে?
- না বাবা, এত রাতে বাইরে গিয়ে কোন কাজ নেই।
শুনে, মলয় তার কাঁধে হাত রাখল। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, আমি তো আছি, ভয় কি?
নীলিমা একটু হেসে এবার বলল, তবে চল।
এমন সময় মলয়ের চন্দ্রানীর কথা মনে পড়ল। চন্দ্রানী এখন কি করছে? হয়তো গভীর ঘুমে, কিংবা স্বামী সোহাগে। নিমগ্ন।
এত মেয়ে চন্দ্রানীকে মনে পড়ল কেন? নামের মিল আছে বলে? নাকি অন্যকিছু?
অন্যকিছু তো বটেই। এমন এক চাঁদনী রাতে জীবনে প্রথম চুমু খেয়ে ছিল চন্দ্রানীকে। সে এক অনন্য অনুভূতি। সে কথা আজও ভুলতে পারেনি মলয়।
নীলিমা হেসে বলল, এই নাইট-ড্রেসে বেরবো? নাকি পোষাক বদলে নেবো?
মলয় বলল, পোষাক বদলাবার কি আছে, এই নাইট-ড্রেসেই চলো।
- বেশ, তবে চলো।
ওরা দু'জনেই নাইট-ড্রেসে পরেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।
উজ্জ্বল বিকশিত পূর্ণ-চাঁদকে লক্ষ্য করে ওরা হাঁটতে শুরু করল। গ্রাম পেরিয়ে শহর।মাঠ পেরিয়ে বন। জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়। পাহাড় ডিঙিয়ে ওরা একসময় দেখল ওরা চাঁদে পৌঁছে গেছে। ওদের মনে নিবিড় আনন্দ হল। ওরা এক আর একজনকে জড়িয়ে ধরল, নিজেদের চাঁদ জয় করার সার্থকতার আবেগে। পরস্পর পরস্পরকে চুমু খেল। মলয়ের মনে পড়ল প্রথম চুম্বনের কথা। যেন সে নীলিমাকে নয় চন্দ্রানীকে চুমু খাচ্ছে। এ'কথা অনুভব করে, সে কিছুটা বিস্মিয় বোধ করল।
চাঁদে এসে প্রথম কিছুদিন তাদের বেশ আনন্দেই কাটল। এদিক সেদিকে ঘুরে বেড়াল। যে দিকেই তাকায়, দেখে সমুদ্রের মতো বড় বড় নির্জলা শুকনো খাঁদ। ছোট ছোট নেড়া পাহাড়, গাছ-পালা হীন। আর চারিদিকে ধূ ধূ করছে শুধু বালি আর পাথর। রঙ-বেঙের সব পাথর। সূর্যের সাত রঙের পাথরই বোধহয় এখানে পাওযা যায়। পাথরগুলি দেখে তাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। এমন সুন্দর পাথর পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। বালি পাথর ছাড়া আর এখানে কিছুই নেই দেখার। জল নেই, গাছপালা নেই, পশু নেই, পাখি নেই, কীট-পতঙ্গ নেই, কোন প্রাণী নেই। এখানে খিদে তৃষ্ণা পায় না। তবে ঘুম আসে।
ওরা সারাদিন নানা রকমের পাথর কুড়িয়ে জড়ো করে। তারপর ঘুম পেলে, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে বালির উপরে। বিছানা বালিশ লাগে না। চলাফেরা করার সময় কোন পোষাকের প্রয়োজন হয় না। কারণ, দেখার কেউ নেই এখানে। তারা দু'জন ছাড়া, আপন পর নেই। আদিম রূপে দেখে কোন কামনা জাগে না পরস্পরের মনে। ভালবাসার বোধ আসে না। যেন আদম ইভের জ্ঞানবৃক্ষের আপেল খাওযার আগের অবস্থা হয়েছে তাদের।
এইভাবে দিন কাটতে থাকে তাদের। মলয়ের একদিন মনেহয়, পৃথিবী থেকে কিছু গাছ এনে এখানে লাগিয়ে দিলে এটা স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠতে পারে অচিরেই। তাই সে কথা নীলিমাকে জানতেই সে রাজী হয়ে যায়। তারপর তাার মনেহয়, গাছ এনে লাগালে কি হবে? গাছগুলি তো জল ছাড়া বেশিদিন বাঁচবে না। সেকথা মলয়কে জানায়। মলয় শুনে বলে, তাইতো। সেকথা তো আমি ভেবে দেখিনি। তবে উপায় কি? নিলীমার কাছ জানতে চায়।
একটু ভেবে নীলিমা বলল, তবে পৃথিবী থেকে একখন্ড মেঘও তাড়িয়ে এখানে আমাদের নিয়ে আসতে হবে।
- সেটা কি করে সম্ভব?
- তাই তো ভাবছি। বরুণদেবের তপস্যা করে বরুণ দেবকে তুষ্ট করতে পারলে, হয়তো বরুণদেব মেঘ পাঠিয়ে দিতে পারে।
- পৃথিবী হলে বরুণদেব মেঘ পাঠাতে পারত। চাঁদে সে কি করে পাঠাবে?
- তবে?
- মহাদের জটা থেকে যদি গঙ্গাকে এনে এখানে ছেড়ে দেওয়া যায়?
- তা কি করে সম্ভব?
- যদি তপস্যা করে মহাদেবকে তুষ্ট করা যায় তবে সেটা সম্ভম?
- এসো তবে আমরা একসঙ্গে বসে তার তপস্যা শুরু করি।
- বেশ চলো, তবে তাঁর তপস্যা শুরু করি।
এইভাবে তপস্যায় দিন কাটতে লাগল তাদের। অনেক দিন তপস্যা করেও যখন কোন ফল পাওয়া গেল না, তখন তারা চাঁদ ছেড়ে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা ভাবল। কিন্তু মুশকিল হল পৃথিবীতে ফিরে আসার সময়, তারা পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য কোন পথ খুঁজে পেল না। তখন তারা চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ঝাঁপ দিয়ে নামার কথা ভাবল। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না, চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি না থাকার ফলে।
এমন সময় কোথা থেকে এক বুড়ি এসে হাজির তাদের কাছে। এতদিন তারা এই চাঁদে আছে, কোনদিন এই বুড়িকে তারা কোথাযও দেখেনি। কোথা থেকে এল এই বুড়ি।
কী চায় তাদের কাছে। বুড়ির গায়ের রঙটা অনেকটা ছানার জলের মতো নীলাভ।
বুড়িটা তাদের কাছে এসে সুরেলা মিষ্টি সুরে বলল, তোমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাও?
নীলিমা মাথা কাৎ করে নীরবে তাকে সন্মতি জানল।
বুড়ি তখন তাদের দু'জনের দু'হাতে দু-গাছা করে সূতো ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা ধরে তোমরা নেমে যেতে পারবে।
ওরা তাই ধরল।
মলয় তখন বলল, আপনি কে? আমরা এতদিন এখানে আছি, আপনাকে তো কোনদিন দেখিনি।
বুড়ি তখন সারা মুখে একরাশ আন্তরিক হাসি ছড়িয়ে বলল, আমি চাঁদের বুড়ি।
বলেই সে কোথায় মিলয়ে গেল।
নীলিমার ডাকে মলয়ের ঘুম ভাঙল। কি গো আজ অফিস যাবে না?
মলয় চোখ খুলে দেখল, দেওয়াল ঘড়িতে প্রায় আটটা বাজে। দশটায় অফিস। আর দেরি করা যাবে না। সে বিছানায় উঠে বসল। নীলিমাকে বলল, চা হয়েছে?
- হচ্ছে। তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো।
মলয় বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমের দিকে গেল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে দেখে, চা রেডি।
চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েই মলয় ভাবল, নীলিমাকে স্বপ্নের কথাটা এখন বলবে কিনা? তারপর আবার ভাবল, না থাক এখন, অফিস থেকে ফিরে এসে, সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে নীলিমাকে রসিয়ে রসিয়ে বলবে গল্পটা। মলয় চা শেষ করে, আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ল, মল ত্যাগ ও স্নান সেরে অফিসের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হবার জন্য।
২).
চন্দ্রানীর বাবা ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। শখ করে কবিতা লিখতেন। তিনি তার নাম রেখে ছিলেন চন্দ্রাননী। চন্দ্রাননী মানে চাঁদ মুখ। মায়ের মুখে শুনেছে। ছোট বেলায় তার মুখখানা নাকি চাঁদের মতো দেখতে লাগত। চাঁদের জ্যোৎনার মতো হাসি মুখে লেগে থাকত সারা সময়। সে নাকি কাঁদত খুব কম। বন্ধুরা তাকে ডাকত চন্দ্রানী বলে। মা ডাকতেন চানু বলে। বন্ধুদের সামনে মার এই ডাকটা শুনে চন্দ্রানী একটু বিব্রত বোধ করত।
চন্দ্রানী যখন মাধ্যমিক পাশ করল। বাবা তার জন্য এক এক পাত্র জোগাড় করলেন। ছেলেটির বয়স একটু বেশি হলেও, বাবার এক বন্ধুর মুখে শুনেছে সে নাকি ভাল চাকরি করে। কী চাকরি করে, কোথায় চাকরি করে, তার কোন খোঁজ খবর ভাল করে না নিয়ে বাবা তার সাথে চন্দ্রানীর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন। ফলে, ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের মতো করে, ভাল করে কিছু বোঝার আগেই চন্দ্রানীর বিয়ে হয়ে গেল।
যদিও চন্দ্রানী বিয়ের পর জেনে ছিল, তার বর নিশীথ গেঞ্জীর কারখানায় দৈনিক বেতনে কাজ করে। কাজে গেলে, কাজ করলে সেই অনুযায়ী টাকা পায়। না গেলে কোন টাকা নেই। এই ভাবে একটা সংসার চালান যায়? বাবার সংসারে একটা মাসিক আয় ছিল। মাসের প্রথমে মাইনে পেলে, সারা মাসের চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা কিনে রাখা হত। সপ্তাহে দু'দিন বাবা সবজী মাছ বাজার করতে বাজারে যেতেন।
তাছাড়া লোকটা ছিল উদ্ধত স্বভাবের। খাম-খেয়ালী। ইচ্ছে হলে কারখানায় যেত, না হলে যেত না। চন্দ্রানীর প্রতি তার কোন মায়া মমতা ছিল না। চন্দ্রানী যেন বাড়ির কাজের মেয়ে, এমন ভাবে তার সঙ্গে ব্যবহার করত হিমাংশু। সে কারণে চন্দ্রানীর সঙ্গে তার কোন মনের মিল ছিল না। মনের ব্যথা মনের ভিতর চেপে রেখে সে তার সংসার করতে লাগল।
চন্দ্রানীর বিয়ের কিছুদিন পর তার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। চন্দ্রানীর মনের চাপা কষ্টের কথা তিনি জেনে যেতে পারেননি। না জেনে খুব ভালই হয়েছে। জানলে খুব কষ্ট পেতেন।
অনেকদিন পর চন্দ্রানীর হঠাৎ মলয়ের কথা মনে পড়ল। কিশোরী বয়সের শেষ লগ্নে, বয়সের সন্ধিক্ষণে মলয় সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। ঘনিষ্টতাও গড়ে উঠেছিল। সে সম্পর্ক শাখা-পল্লবে পল্লবিত হতে পারনি তার মনের জোরের অভাবে। সে সময় সে খুব ভীতু ছিল এসব ব্যাপারে। মলয় অনেকটা সাহসী ছিল।
একদিন চাঁদনি রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে সে বলল, জান এখন আমি চাঁদকে চুমু খেতে পারি।
- কি ভাবে?
- দেখবে?
- দেখি।
বলার সঙ্গে সঙ্গে আলটপকা আমার গালে একটা চুমু দিয়ে ফেলল।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, এটা কি হল?
- চন্দ্রাননী মানে চাঁদপনা মুখ। আমি তো সেখানেই চুমু দিলাম, সেটা চাঁদে গিয়ে পড়ল না? বলেই সে হো হো করে হাসতে শুরু করল। তার হাসি দেখে তখন আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। সে রাগ হলেও আজ সে কথা ভেবে খুব মজা লাগছে। আজ তারও হাসি পাচ্ছে। মনে পড়ছে বাবার কাছে থাকা একটা ম্যাগাজিনে, সে একটা কবিতা পড়েছিল। কবিতাটার নাম - চিরন্তন। তাতে লেখা ছিল -
"যদি প্রকাশ করতে হয়
সেই ক্ষুদ্র চিরন্তন মুহূর্তটি
সারাজীবনেও কুলোবে না
এ' কথা নিশ্চিত।
জীবনেরর প্রথম চুম্বনস্বাদ
মৃদু আলিঙ্গন
এই পৃথিবীর বুকে যেন
অন্যকোন গ্রহের সন্মোহন।"
চন্দ্রানী যদি সেদিন রাগ না করে, তার মতো সাহসী হয়ে উঠতে পারত, তাহলে আজ কি হত বলা যায় না।
চন্দ্রানী শুনেছে, মলয়ের বিয়ে হয়েছে।
এখন কেমন আছে মলয়? চন্দ্রানীর কথা কি এখন তার একবারও মনে পড়ে না?
চন্দ্রানী বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব কথা ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ছে টের পায়নি।
নিশীথের ডাকে সে ধড়মড় করে উঠে বিছানায় বসল। নিশীথ তাকে একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে বলল, এটা ঘুমোবার সময় হল মাগী। জানিস না তুই, আমি এখন কারখানা থেকে ফিরব। নিশীথ প্রায়ই তার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করত। তুই-তোকারি করে কথা বলত। খিস্তি করত হামেশাই।
যার কাছ থেকে কেউ সব সময় খারাপ ব্যবহার পায়, তার রুক্ষ ব্যবহার তাকে আর ততটা আহত করতে পারে না।
চন্দ্রানী বিছানা থেকে উঠে পড়ে, পরনের কাপড় ঠিক করে, স্বাভাবিক ভঙ্গীতে রান্না ঘরের দিকে গেল। নিশীথের জন্য চা-জল খাবার তৈরী করতে। রুটি আর আলু চচ্চরি। সঙ্গে চা।
নিশীথ জামা প্যান্ট ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। নিশীথের ব্যবহারের গ্লানি তার হৃদয় স্পর্শ করল না। স্বপ্নের আবেশ তখনও তার মন জুড়ে আছে।
সে ভাবতে লাগল, এতদিন পরে কেন সে মলয়কে স্বপ্ন দেখল। এর কারণ কি?
অনেকদিন আগে মলয়কে নিয়ে সে আর একটা আজগুপি স্বপ্ন দেখেছিল, যার কোন মানে হয় না। মনে পড়ে গেল। সে দেখেছিল, মলয় ও সে কোন একটা পাহাড়ে উঠছে। খুব উঁচু পাহাড়টা। পাহাড় কেটে পথ করা বলে, পথটা খুব এবড়ো-খেবড়ো, উঁচু-নীচু। চন্দ্রানীর উঠতে কষ্ট হচ্ছে দেখে, মলয় তাকে পাঁজা কোলে ধরে তুলে নিয়ে, পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। সে ভয়ে চিৎকার করে তাকে নীচে নামাতে বলছে। আর মলয় তা শুনে হো হো করে বিভৎস ভাবে হাসছে।
চন্দ্রানীর খুব রাগ হয়ে ছিল মলয়ের হাসি শুনে।
সে মলয়ের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে নীচে নেমে, টাল সামলাতে না পেরে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে একটা পাইন গাছের গোড়ায় এসে আটকে গেছিল। তৎক্ষণাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গিয়ে বুকের ভিতরটা ধরাস ধরাস করছিল।
এই সব ভাবতে ভাবতে রুটি চাটুতে সেঁকবার সময়, তার অন্যমনস্কতায় ডান হাতটা পুড়ে গেল। সে হাত উলটে দেখল, মধ্যমা আর অনামিকা গরমে পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। জ্বালা করছে। সে গ্যাস ওভেনটা বন্ধ করে, ঘরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রায়ার থেকে বের করে পোড়ার মলম লাগাল।
নিশীথ বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে, তা দেখে বলে, কি হয়েছে?
চন্দ্রানী মুখে কোন উত্তর না দিয়ে, মলমটা তার আঙুল দুটোয় লাগাতে থাকে।
- হাত পুড়বে না মাগি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করলে এই হয়। বলে নিশীথ আয়নার সমনে দাঁড়িয়ে পরিপাট করে চুল আঁচড়াতে লাগল।
সামান্য একটু সহানুভূতি দেখিয়ে তার হাতটা একবার দেখতে চাইল না। বরং তাকে শ্লেষ করে বলল, কার কথা ভাবছিলিস মনে মনে? আগে এসব ভাবলে চন্দ্রানীর খুব দুঃখ হত। মনে খুব কষ্ট পেতো।আজকাল আর তা হয় না।
৩).
চন্দ্রানীর বাবা দীননাথ বাবু বাড়িতে দু'এক জন ছাত্র পড়াতেন। মলয় সেখানে পড়ত। সেই সূত্রেই চন্দ্রানীর সঙ্গে তার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা। মলয়ের বয়স তখন ষোল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সে কারণেই দীননাথ বাবুর কাছে তার অঙ্ক শিখতে যাওয়া। চন্দ্রানীর বয়স তখন চোদ্দ, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মুখখানা সুন্দর, কথাবার্তাও মিষ্টি।
সেকারণেই চন্দ্রানীকে মলয়ের ভাল লেগে যায়। তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।
তাদের বাড়িতে পড়তে গিয়ে মাঝেমাঝেই চন্দ্রনীর সঙ্গে তার কথা হয়, গল্প করে। চন্দ্রানীর হাসিটা খুব সুন্দর। গল্প শুনে, হাসলে পরে উপরের গজ দাঁতটা তার আপনা আপনি বেরিয়ে পড়ে। সেটা হাসিতে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করে, যা চোখের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তারপর তখন আর অন্য দিকে চোখ ফেরানো যায় না।
মলয়ের বাবা টালা পোষ্ট অফিসে ক্লার্কের কাজ করতেন। হেড অপিসে চিঠিপত্র লেখা, কর্মচারীদে মাইনর বিল করা, তাদের
ছুটির হিসাব রাখা। এইসব লেখালেখির কাজ।মলয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার পর, তার বাবা যাদবপুর পোষ্ট অফিসে ট্রাস্মফার হয়ে যায়। বাবা টালা পোষ্ট অফিসে কাজ করার সময় তারা ওলাইচন্ডী লেনের একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত।
যাদবপুর পোষ্ট অফিসে ট্রাস্মফার হয়ে আসার পর, তারা চিত্তরঞ্জন কলোনিতে চলে আসেন ভাড়া বাড়িতে। সেখান থেকেই মলয় সাউথ-সিটি কলেজে পড়াশুনা শেষ করে, কলকাতা কর্পোরেশনে একটা ক্লার্কের কাজ পেযে যায়।
তারপর দু-তিন বছর পেরোতে না পেরোতেই, বাবার অফিস কলিগের এক বন্ধুর মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। মলয়ের তখন বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। কিছুদিন স্বাধীনভাবে ওড়ার ইচ্ছে ছিল তার। নাইট শো সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরা। বন্ধুদের সঙ্গে কোনদিন বারে যাওয়া। অফিস ছুটি নিয়ে, কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দু'তিন দিনের জন্য বাইরে ঘুরতে যাওয়া। দিঘা পুরী নয়। কেদলী মেলা, দুবরাজপুর, ধলভূমগড়, জঙ্গলমহল। এরকম সব জায়গায়। বাবা সেটা কিভাবে যেন টের পেয়ে যান। তাই মলয়কে আর বেশি উড়তে না দিয়ে, তাকে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ করে, মলযের বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলেন, বন্ধুর মেয়ে নীলিমার সঙ্গে। নীলিমা একটু উচ্ছল, বহির্মুখ স্বভাবের। মলয় ঠিক তার বিপরীত অন্তর্মুখী স্বভাবের। তাই প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত লাগলেও, এখন মানিয়ে নিয়েছে মলয়। নীলিমা খানিকটা আগ্রাসী। মলয়কে গ্রাস করে ফেলতে চায় মনে মনে, পুরোপুরি করতে পারে না বলে মনোকষ্ট রোগে মাঝে মাঝেই ভোগে।
নীলিমার আবদার, অফিস থেকে ফিরে চা খেতে খেতে মলয়কে বলতে হবে, অফিসে আজ কি কি ঘটেছে? কার সঙ্গে দেখা হয়েছে? কার সঙ্গে কথা হয়েছে? কি কি কথা হয়েছে। প্রথম প্রথম এইসব উত্তর দিতে বিরক্ত বোধ করত সে। মাঝে মাঝে রেগেও যেত।
আজকাল তার প্রশ্ন শুনে আর রাগে না। মানিয়ে নিয়েছে। যা মনে আসে তাই উত্তর দিয়ে দেয়। উত্তর শুনেই নীলিমা খুশি। কখনও ক্রসচেক করে দেখে না সেটা সত্যি কিনা। নীলিমা মনে খুব স্ফূর্তিবাজ। আনন্দ অনুষ্ঠান বা উৎসব বাড়িতে যেতে সে খুব আনন্দ পায়। তাকে সেখানে নিয়ে যেতেই হয় মলয়কে। না নিয়ে গেলে সে রাগারাগি করে, কান্নাকাটি করে বাচ্চাদর মতোই। তাই মলয়কে শেষপর্যন্ত নিয়ে যেতেই হয়।
মলয়ের এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়ে ১৭ই জৈষ্ঠ। বিয়ে বাড়ি শ্যামবাজার। মেয়ের বাড়ি আহিড়িটোলা। বিয়ে বাড়িতে তাদের দুজনকে যাওযার জন্য নিমন্ত্রণ করে তাদের দু'জনের নাম লিখে কার্ড দিয়েছে সে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে, নীলিমার হাতে সে কার্ড দিতেই, নীলিমা আনন্দে লাফাতে শুরু করে।
৪).
নিশীথ যে গেঞ্জির কারখানা কাজ করে তার মালিকের বড় মেয়ের বিয়ে ১৭ই জৈষ্ঠ। বিয়ে বাড়ি শ্যামবাজার। মালিকের বাড়ি আহিড়িটোলা। বিয়ে বাড়িতে তাদের দুজনকে
নিমন্ত্রণ করেছে যাওয়ার জন্য।
১৭ই জৈষ্ঠ দামী একটা শাড়ি কিনে নিয়ে, নিশীথ চন্দ্রনীকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। চন্দ্রানীর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না মোটেও। সে বলেছিল, তুমি একাই যাও না। আমাকে আবার কেন নিয়ে যাচ্ছো?
- তোমার রূপ দেখাতে। বলে হিমাংশু তাকে বিদ্রুপ করে চোখ রাঙিয়ে ছিল।
চন্দ্রানী তার চোখ মুখ দেখে বুঝেছিল, এরপরও সে না যেতে চাইলে নিশীথ রুদ্র মূর্তি ধরবে। তাই সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে, সেজেগুজে তার সঙ্গে বেরিয়ে ছিল শ্যামবাজার যাওয়ার জন্য।
সেখানে পৌঁছে দেখে বিরাট আয়োজন।
নিশীথ সেখানে পৌঁছে মালিকের সঙ্গে চন্দ্রানীর পরিচয় করিয়ে দিল। চন্দ্রানী হাতজোড় করে তাকে নমস্কার করল। তিনিও প্রতি নমস্কার করে, একটা দিকে নির্দেশ করে, তাদের সেখানে গিয়ে বসতে বললেন।
সেটা একটা হল ঘরের মতো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরে টেবিল চেয়ার পাতা। একটা টেবিল ঘিরে চারটে করে চেয়ার। নিশীথ আর চন্দ্রানী একটা টেবিলে গিয়ে দু'টোে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। একটু পরে নিশীথ বলল, তুমি একটু বসো, আমি গিয়ে শাড়িটা দিয়ে আসি বিয়ের কনেকে।
চন্দ্রানী বলল, বেশ।
নিশীথ চলে যেতে, চন্দ্রানী ঘাড় ঘুরিয়ে, অন্য সব দিকে বসে থাকা লোকদের দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে হঠাৎ একজনের দিকে চোখ পড়তেই চন্দ্রানী চমকে উঠল। আরে মলয়দা না !
সে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মলয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মলয়ও তাকে দেখে চমকে উঠে বলল, চন্দ্রানী তুমি এখানে?
চন্দ্রানী হেসে বলল, আমারও তো একই প্রশ্ন।
নীলিমা তখন অন্দরে গেছে। ভিতরে গিয়ে মেয়ে মহলের সকলের সঙ্গে মেতে উঠেছে, মলয়কে এখানে একা বসিয়ে রেখে।
মলয় বলল, ইস কতদিন পরে দেখা তোমার সঙ্গে। চলো আমরা এই কোলাহল ছেড়ে একটু বাইরে কোথাযও গিয়ে কথা বলি।
চন্দ্রানী বলল, বেশ তাই চলো তবে।
ওরা দু'জনে বাইরে বেরিয়ে এলো। কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগোল। হাঁটতে হাঁটতে তাদের এতদিনকার জমানো কথা আর ফুরায় না। পথও ফুরায় না। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলে তারা পৃথিবীর পথে, নিশিথের অন্ধকার নীলিমা পেরিয়ে।
=========================
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.