Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। রথীনের পড়া ।। শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী

রথীনের পড়া

 শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী


প্রি-টেস্টের পরই পুজো এসে পড়ায় মনেই হয়নি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকটা মাস বাকি। তখনকার কালে, মানে পঞ্চাশের দশকে প্রি-টেস্ট আর টেস্ট নিজেদের স্কুলেই হত। তাই মোটামুটি ভাল ছেলে বলে পরিচিত ছাত্রদের তেমন কোনও অসুবিধে হত না এ সব পরীক্ষার বাধা টপকাতে। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার খাতাগুলো তো আর নিজেদের স্কুলের শিক্ষকমশায়রা দেখবেন না। যাঁরা দেখবেন তাঁরা কী করেই বা জানবেন কে কেমন ছাত্র! তাই ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তরগুলোর মোটামুটি সঠিক না দিতে পারলে ভাল ডিভিশন পাওয়া তো দূরের কথা, পাশ করাটাই প্রশ্নচিহ্নে আটকে যাবে।

     প্রি-টেস্টের সময় কথাগুলো মনে এলেও পুজোর ক'টা দিন হই হই করেই কেটে গেল। ও সব নিয়ে তেমন মাথা ঘামালাম না। পুজো কাটতেই বইপত্র নিয়ে বসতে হল। কিন্তু লক্ষ্মীপুজো কাটা না পর্যন্ত মন বসল না। তারপর সত্যিই পড়াশুনায় মন দিলাম। পড়লাম অথৈ সাগরে। এত পড়া বাকি! ক'টা মাসের মধ্যে শেষ করতে পারব তো! স্কুলে নিয়মিত গেছি ঠিকই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাকি সময়টা ফুটবল ক্রিকেট খেলে আর আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিয়েছি। রবিবার আর ছুটির দিনগুলোতে বই-এর সঙ্গে কোন সম্পর্কই থাকত না। তখন কিন্তু একবারও মনে আসেনি, পরীক্ষায় পাশ করতে হলে বইগুলো পড়তে হবে। আর ভাল রেজাল্ট করতে হলে সেগুলো গুলে খেতে হবে।

    আমাদের পাড়ার বন্ধু রথীন কিন্তু তেমনই গুলে খেত বইপত্র। ভীষণ পড়ুয়া ছেলে বলে তার নাম ডাক ছিল পাড়ায়। আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতেই থাকত। সকালে উঠেই রথীনের পড়ার শব্দ কানে আসত। সন্ধেতে খেলে টেলে ফিরে শুনতে পেতাম রথীন পড়ছে। আবার ঘুমোতেও যেতাম রথীনের পড়ার গুনগুন আওয়াজে। দিনরাত পড়ত রথীন। আমার মাতৃদেবী রথীনের এই হেন ক্লান্তিহীন পড়া দেখে প্রায়ই আক্ষেপ করতেন, 'দেখ তো, কী প্রচণ্ড খাটছে ছেলেটা। আর তুই দ্যাখ, সারাক্ষণ খেলে আর বন্ধুদের সঙ্গে হই হই করে সময় কাটাচ্ছিস। না পড়লে পাশ করবি কী করে রে!' 

   এমনিতে মায়ের এ সব কথায় তেমন গা দিতাম না। তবে মা যখন বেশি ঘ্যান ঘ্যান করত, আমি রেগে যেতাম আর বলতাম, 'তুমি এ নিয়ে এত ঘ্যান ঘ্যান করো না তো! পাশ করাটা আমার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। ও নিয়ে তুমি কিছু ভেব না।' মা চুপ করে যেতেন।

    তখনকার বাবা-মায়েরা আজকালকার বাবা-মায়েদের মতো কোনও টেনশনে ভুগতেন না ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা নিয়ে। এখন তো প্রায়ই দেখি, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় সময় তাদের মায়েরা সংসার করতেই ভুলে যায়। যেন তাদেরই পরীক্ষায় বসতে হবে। আমার মা কিন্তু আমার পরীক্ষায় সময় সংসারের কাজে এতটুকু এদিক ওদিক করতেন না। পরীক্ষার হলে ছেলেকে পৌঁছে দেওয়ার কথা কখনও তাঁর কল্পনাতেও এসেছে বলে মনে হয় না আমার। শুধু পরীক্ষা দিয়ে আসার পর জলখাবার দিতে দিতে ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করতেন, পরীক্ষা কেমন হল! বলতাম, ভালই হয়েছে। আশ্বস্ত হতেন মা। কিন্তু এবার আমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসব। তাই মা বোধহয় একটু চিন্তায় পড়েছিলেন। কারণটা অবশ্য আমার বেপরোয়া ফাঁকিবাজি। সঙ্গে রথীনের জান লড়িয়ে দেওয়া প্রস্তুতি যা হয়তো তাঁর চিন্তার আগুনে অনবরত ইন্ধন জোগাচ্ছিল।

    লক্ষ্মীপুজোর পর বইপত্র নিয়ে বসতেই হাড়ে হাড়ে টের পেলাম মা কেন বারবার রথীনের কথা তুলে আমাকে সাবধান করতেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া কথাটা শুধু এতদিন শুনেই এসেছিলাম, মর্ম বুঝিনি। এবার তার মর্ম শরীরের সব ক'টা হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। পুরো এক বছরের পড়া এই ক'মাসে হজম করে পরীক্ষায় বসতে হবে। রথীনের যে প্রাণপাত পড়া আমার ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না, যে পড়া নিয়ে মা কিছু বললেই হেসে উড়িয়ে দিতাম, যে পড়া আমাদের বন্ধু মহলে ঠাট্টাতামাশার লাগাতার রসদ জোগাত, রথীনের সেই পড়াই যেন ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো তাড়া করতে লাগল আমায়। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সারা বছর এতটা ফাঁকিবাজি না করলে এমন অথৈ জলে পড়তাম না। একটু একটু করে কেমন নার্ভাস হয়ে পড়লাম। রথীনের সকাল সন্ধে পড়ার কিন্তু কোনও ক্ষান্তি ছিল না। এবার সেই পড়ার আওয়াজ যেন বোম ফাটাতে লাগল আমার ভাবনাচিন্তার চারিদিকে। যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাকে প্রায়ই বলতাম পাশ করাটা আমার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়, সেই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল। পাশ করব তো শেষপর্যন্ত!

    খেলাধূলো, আড্ডা মারা সব শিকেয় উঠল। মুখ গুঁজে পড়তে লাগলাম দিনরাত। চোখমুখ বসে গেল। একেই রোগাপ্যাংলা ছিলাম। পড়ার প্রচণ্ড চাপে হাড্ডিসার হলাম এক মাসের মধ্যেই। আমি যে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছি, সে কথা মা বুঝতে পারতেন। তাই মাঝে মাঝে সাহস দিতেই হয়তো বলতেন, 'দেখছিস তো, কেন আমি রথীনের কথা এত বলতাম। সারা বছর একটু একটু করে পড়াশুনা করে রাখলে এমন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হত না। খুব রোগা হয়ে গেছিস বাবা। দেখিস, পরীক্ষার আগে অসুখ বিসুখে পড়ে যাস না যেন!' মায়ের কথায় সাহস পাওয়ার চেয়ে ভয় হত বেশি। বিশেষ করে রথীনের নামটা এসে যাওয়ায়। রথীনের পড়া যেন ছায়ার যেন আমায় তাড়া করে বেড়াতে লাগল।

    শেষপর্যন্ত পরীক্ষা এসে গেল। এপ্রিলের প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে পরীক্ষা দিলাম। সিলেবাসের বাইরে কিছু প্রশ্ন আসায় ইতিহাসে খাতা ছেঁড়াছেঁড়ি করল কিছু বাইরের ছেলে আমাদের সেন্টারে জোরজবরদস্তি ঢুকে পড়ে। পরে শুনলাম, বেশির ভাগ সেন্টারেই খাতা ছেঁড়াছেঁড়ি হয়েছে। অন্যান্য পরীক্ষাগুলো নির্বিঘ্নে কাটলেও, ইতিহাস নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লাম। কিছুদিনের মধ্যে বোর্ড জানাল, আবার ইতিহাস পরীক্ষা হবে। তবে যারা পরীক্ষায় বসতে চায় না, তারা অন্য বিষয়গুলোর গড়ে ইতিহাসে মার্কস পাবে। ইতিহাস ছিল আমার কাছে স্কুলে জীবনের সব থেকে বড় বিভীষিকা। সেই ইতিহাস পরীক্ষায় আর বসতে হবে না জেনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। জানতাম, অঙ্ক আর সংস্কৃতের দৌলতে যে গড়পড়তা মার্কস পাব ইতিহাসে, পরীক্ষার বসে সেই মার্কস সারা জীবন চেষ্টা করেও পাব না। রথীন অবশ্য আমার মতো তার সারা বছরের প্রস্তুতি হেলায় হারাতে চায়নি। তাই ইতিহাসের রী-এগজ্যামিনেশনে বসেছিল।

    পরীক্ষা শেষ হতে এক রাতেই সব টেনশন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়লাম আড্ডার স্বর্গে আমরা সব বন্ধুরা। সবে তখন ব্রীজ শিখেছি। দিনরাত চলল তাস পেটা। সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়তাম। মা বলতেন, চড়তে। শুধু ভাত খাওয়ার সময় ফিরে আসতাম বাড়িতে। আর রাতে শুতে।

    ব্যস, এমন করেই কেটে গেল আরও ক'টা মাস। কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না আমাদের। তবে রথীনের পড়ার স্মৃতি আমাকে খোঁচা মারত থেকে থেকেই। পুরনো ভয় ফিরে আসত। বন্ধুরা অবশ্য সে সব বুঝতে পারত না।

    পরীক্ষায় ফল বেরনোর সময় হয়ে গেল। প্রতিদিনই অপেক্ষা করে থাকতাম কখন কোন খবরের কাগজ পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে বলে, যাকে বলা হত টেলিগ্রাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা ভাবতেই পারবে না, তখনকার দিনে প্রায় পরীক্ষার ফল কাগজে বেরত গেজেট আসার আগেই। তবু গেজেট বেরবে সেই আশায় আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রতিদিনই চক্কর লাগাত কলেজ স্ট্রীটের বই পাড়ায়। তেমনই কোনও এক অপেক্ষার দিনে যথারীতি আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু দুপুরের খাওয়ার পর তাস পেটাচ্ছিলাম। জানতেও পারিনি আমাদের রেজাল্ট দুপুরেই বেরিয়েছে। যখন জানলাম, তখন প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে আর আমরা তাস খেলতে খেলতে তেলেভাজা মুড়ি চেবাচ্ছি। যে বন্ধু সেদিন কলেজ স্ট্রীটে চক্কর মারতে গিয়েছিল, সে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা ছেঁড়াখোঁড়া গেজেট হাতে হাজির হল। গেজেটটার বেশির ভাগ পাতাই প্রায় খাবলে খাবলে ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ বা কারা। শুধু আমাদের স্কুলের রেজাল্টটা বাঁচিয়ে আনতে পেরেছে আমাদের বন্ধু। বুক দুরদুর করে উঠল আমার। তাসগুলো হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা গেজেটটার ওপর। উত্তেজনায় নিজের রোল নম্বারটাই ভুলে গেলাম আমি। এক বন্ধু বলল, আমি পাশ করেছি। ইনফ্যাক্ট, আমরা সবাই পাশ করেছি।

   উত্তেজনা কমে এল। রোল নম্বার মনে পড়ল। ভাল করে দেখলাম গেজেটের ছেঁড়া পাতাটা। রথীন যে প্রস্তুতি জান লড়িয়ে এক বছর ধরে করে গেছে, কয়েক মাসের চেষ্টায় আমার সেই প্রস্তুতিতে যেমন রেজাল্ট হওয়া উচিত, তাই হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অবশেষে রথীনের পড়ার ভয়াবহ ছায়াটা আমার পিছু ছাড়ল। যেন আমার আত্মবিশ্বাসের টুটি চেপে রেখেছিল অ্যাদ্দিন!

    আমরা সবাই ছুটলাম যে যার বাড়ির দিকে। এক নিঃশ্বাসে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠলাম আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটে। মা দরজা খুলতেই হেসে বললাম, 'মা, আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে।'

    'জানি' কোনও উত্তেজনার চিহ্ন নেই মায়ের উত্তরে।

    'আমি পাশ করে গেছি, মা' ঢক করে প্রণাম করলাম মাকে। তারপর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিন্তু তুমি কী করে জানলে, আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে?'

    'রথীনের মা বিকেল থেকে কান্নাকাটি করছেন। রথীনটা পাশ করতে পারেনি' বিমর্ষ গলায় মা জানালেন। আমার মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল।
                               ***

Subhrendu Ray Chaudhuri 
C1/202 Mangalam Park
14 Ho Chi Minh Sarani
Kolkata - 700 034


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.