ছোটগল্প ।। দক্ষিণের বারান্দা ।। দীনেশ সরকার
ছবি - সংগৃহীত ।
দক্ষিণের বারান্দা
দীনেশ সরকার
কর্মজীবনের শেষ ভাগে এসে ভাবলেন, আর কতদিন এই ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকবো, ছেলে-মেয়েও অনেকটা বড় হয়েছে । এবার একটা বাড়ি বানানোর কথা ভাবতে হবে । ফ্লাটবাড়ি তার এক্কেবারেই পছন্দ নয় । তার বাড়ির চাই একটা দক্ষিণমুখি বারান্দা, যেখানে তিনি সন্ধ্যা বেলা ইজি চেয়ারে বসে দক্ষিণের হাওয়া খাবেন আর বইয়ের পাতা ওল্টাবেন । এটাই তার স্বপ্ন, এটাই তার চাওয়া ।
জমির খোঁজাখুঁজি শুরু হলো । দালালরা যে সব প্লট দেখায় কোনোটাই তার মনঃপুত হয় না । খোলামেলা না হলে তিনি বাড়ি করবেন না । শেষে তার সহকর্মী তারিণীবাবু তার আসা- যাওয়ার পথে তারই গ্রামে ঢোকার মুখে একটা জমির সন্ধান দিলেন । গ্রাম্য পরিবেশ সেটাও বলে দিলেন । তবে আজ গ্রাম কাল কি আর গ্রাম থাকবে ? যেভাবে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যে আর গ্রামকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
যাই হোক, জমি দেখে সুরেশবাবুর পছন্দ হলো । বাস রাস্তার দক্ষিণ ধারে প্লটটা । তারপরে কিছুটা সরকারী খাস জমি, তারপর বিশাল খেলার মাঠ । খেলার মাঠের ওপাশে আবার রাস্তা । খেলার মাঠের ওপর দিয়ে সন্ধ্যাবেলা হু-হু করে দখিনা হাওয়া বইছে তার বাড়িতে আর তিনি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসে বই পড়ছেন ---- তিনি যেন মানস চোখে দেখতে পেলেন । তার স্কুল, ছেলে-মেয়ের কলেজ, দোকান-বাজার কোনটাই খুব একটা দূরে নয় । সময় বেশী লাগলেও সাইকেলে কভার করা যাবে । তারিনীবাবু তো এখান থেকেই স্কুলে যান । তবে পরিবেশটা গ্রাম্য, ছেলে-মেয়েদের মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে ।
জমির মালিক যে দাম চেয়েছিল তিনি সেই দামেই জমিটা কিনে ফেললেন । যোগমায়াকে একদিন দেখিয়েও নিয়ে গেলেন জমিটা ---- সহধর্মিনী বলে কথা । তারপর কিছুটা নিজের সঞ্চয় আর কিছুটা ব্যাঙ্কলোন নিয়ে তিন কামরার একটা একতলা বাড়ি বানালেন । ভিত বেশ কিছুটা উচু করলেন যাতে পাঁচিল টপকে দখিনা বাতাস অনায়াসে তার ঘরে ঢুকতে পারে । ঘরের তিন পাশ দিয়ে বারান্দা, তবে দক্ষিণের বারান্দাটা বেশ চওড়াই করলেন । বারান্দায় বসে দেখা যায় সামনের বিশাল খেলার মাঠ । বিকেল হলেই ছেলের দল খেলে, সন্ধ্যা হতেই ঘরে ফিরে যায় । সন্ধ্যাবেলায় হু-হু করে দখিনা হাওয়া তার ঘরে ঢোকে । তিনি দক্ষিণের বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা-এলিয়ে সেই হাওয়া উপভোগ করেন আর বই পড়েন । মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় । সংসারের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ কিছুই আর তখন স্পর্শ করে না । তিনি তো এমনটাই চেয়েচিলেন । এটাই তার স্বপ্ন ছিল ।
দেখতে দেখতে দিন গড়িয়ে গেল । সুরেশবাবু অবসর নিয়েছেন প্রায় বছর দশেক হলো । ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কলেজে পড়ায় । আগে উত্তরবঙ্গের এক কলেজে ছিল, বছর খানেক হ'লো নিজের কলেজে এসেছে । মেয়ে শিক্ষিকা, সৎপাত্রে বিয়ে দিয়েছেন । জামাইও শিক্ষক । ফুটফুটে এক নাতনি । মাঝে মাঝে আসে, থাকে আবার নিজের বাড়ি ফিরে যায় । ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, লক্ষীমন্ত বউমা এনেছেন । দুটি নয়নের মণি নাতি সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখে । বড়টি স্কুলবাসে স্কুল যায়, টু-তে পড়ে । ছোটটি এখনও স্কুলমুখো হয় নি । বউমা এখন সংসার সামলায় । যোগমায়াকে এখন কার্যত কিছুই করতে হয় না, কিন্তু সংসারের হাল ছাড়ে নি ---গৃহকর্তৃ বলে কথা । খুবই সচ্ছ্বল অবস্থা এখন । ছেলে একতলার উপর দোতলা তুলেছে । ছেলে বউমারা দোতলায় থাকে । এ সি লাগিয়েছে । সুরেশবাবুর ঘরেও এ সি লাগাতে চেয়েছিল, সুরেশবাবু রাজি হননি । তার মন যে পড়ে আছে দখিনা বাতাসে । সুরেশবাবুর ঘরে সুখ উচ্ছ্লে পড়ছে । এখন তার চাঁদের হাট ।
সুরেশবাবু রোজ সকাল বিকেল হাঁটেন । সঙ্গীও বেশ কয়েকজন । সন্ধ্যায় দক্ষিণের বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে হাওয়া খান, চা খান, বই পড়েন । যোগমায়াও মাঝে মাঝে পাশে এসে বসেন, তবে রোজ নয় ।
এত সুখ সুরেশবাবুর বেশী দিন সইলো না । সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর হঠাৎ বুকে ব্যথা । শুয়ে পড়লেন । ছেলে কলেজে । যোগমায়া বললেন, বাবুকে (ছেলে) ডাকি, ডাক্তারবাবুকে খবর দিই ।
সুরেশবাবু মাথা নেড়ে বললেন, 'তার কোনো দরকার নেই । একটু বিশ্রাম নিই, ঠিক হয়ে যাবে ।'
বিকেল হতেই সুরেশবাবু যোগমায়াকে বললেন, 'আমাকে ধরে একটু দক্ষিণের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসিয়ে দাও । দক্ষিণের হাওয়া খেলেই ঠিক হয়ে যাব ।'
যোগমায়া তাই করলেন । সুরেশবাবু 'শ্রীরাম্কৃষ্ণ কথামৃত' বইখানি চাইলেন । যোগমায়া এনে দিলেন । সুরেশবাবু দখিনা বাতাসে গা এলিয়ে পড়তে লাগলেন । অনেকক্ষণ যোগমায়া তার পাশে ছিলেন । তারপর ঘরের কাজে ভিতরে গেলেন । সন্ধ্যা হয় হয় । ছেলে কলেজ থেকে ফিরতেই যোগমায়া বললেন, 'তোর বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে , একটু দেখ না যদি ডাক্তার ডাকতে হয় ।' ছেলে 'বাবা-বাবা' করে ডাকতে ডাকতে সুরেশবাবুর কাছে গিয়ে দেখে, সুরেশবাবু ইজি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে আছেন । বইটা বুকের উপরে চেপে ধরে আছেন । দক্ষিণের হাওয়ায় ফুরফুর করে তার চুলগুলো উড়ছে । ছেলে 'বাবা-বাবা' করে বার কয়েক ঝাঁকিয়েও কোনো সাড়া পেল না ।
ডাক্তারবাবু এলেন, হাত ধরে নাড়ী দেখলেন, চোখ টেনে দেখলেন । তারপর বললেন, 'উনি আর সাড়া দেবেন না । উনি চির-ঘুমের দেশে চলে গেছেন ।'
দক্ষিণের হাওয়ায় সুরেশবাবুর চুলগুলো তখনও ফুরফুর করে উড়ছে ।
**************************
,দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর --- ৭২১৩০৬