ছবি - সংগৃহীত ।
জীবন এইরকম
কাকলী দেব
সুজন বাবু একসময় প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চ পদস্থ অফিসার ছিলেন। তখন তার ঠাঁটবাঁটই ছিল অন্য রকম। বালীগন্জের পৈতৃক বাড়ীতেই আজ জন্মাবধি তিনি আছেন। বাড়ীর বয়স নয় নয় করেও একশো হতে চলল। মজবুত ভিতের শক্ত পোক্ত বাড়ী এখনও দিব্যি টিকে আছে। যদিও বাবা কাকারা সবাই একে একে চলে গেছেন। বাবার বাবা ছিলেন বাংলাদেশের রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়া জমিদার। দেশ ভাগের আগেই বুদ্ধি করে দেশের সব সম্পত্তি বেচে কলকাতার এই বিশাল বাড়ী বানিয়ে ছিলেন। তার বাবারা দুই ভাই। দাদুর মৃত্যুর পরে , কাকা সম্পত্তি আর বাড়ী ভাগাভাগি করে নেন। বাবার একমাত্র ছেলে হিসেবে তিনি যা পেলেন সেও অনেক। একটা সময়ে অবস্হাপন্ন বাবার এক ছেলে হিসেবে যৌবনে বখে যাওয়ার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। সেই সময়ই তার রাশভারী বাবা প্রায় জোর করেই একটি সুশীল সুন্দর নম্র শান্ত গরীব ঘরের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেন। সত্যিই সেই গভীর চোখের মেয়েটি কিভাবে যেন তাকে খুব সহজেই সংসার মুখী করে তোলে। ভাল চাকরী করতেন, শিগগিরই সেখানে পদন্নোতি আর তাদের জীবন আলো করে এল এক নতুন প্রাণ। তাদের একমাত্র সন্তান '' সুসময়"। ছেলে কেন্দ্রিক সেই জীবনে বৃদ্ধ বাবা মা কে ও তেমন দেখলেন না। মা যেন কিছুটা অবহেলিতই হয়ে রইল। তার স্ত্রী অবশ্য সবসময় ওদের প্রতি কর্তব্য করে গেছে। কিন্ত তিনি তো তখন ছেলে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননা। ছেলেকে কলকাতার বেস্ট স্কুলে পড়ানোর থেকে, সাঁতারে , টেনিসে, চৌখশ বানানোর প্রচেষ্টায় তার দিন রাত এক হয়ে যেতে লাগল। ছেলেকে মানুষ করলেন না , জীবন বিমুখ করলেন। আত্মসর্বস্ব, সেই ছেলে বুঝে গেল, সবাই তাকে শুধু দেবে আর সে ভোগ করবে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে " সুসময় " প্রথম জীবনের কুড়ি বছর কলকাতায় কাটিয়ে অ্যামেরিকায় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গেল। তারপর আরও বছর দশেক কেটে গেল। সে আর ফিরলনা। বিয়ে করল ওখানকার মেয়েকে। যাতে সে দেশের নাগরিকত্ব সহজলভ্য হয়। বাবা মা কে ও ডাকলনা একবারও, নিজেও আর এলনা । কালে ভদ্রে ফোন করে।
ছেলে অন্ত প্রাণ সুজন বাবুর ঘোর কেটে যেতে লাগল । বুঝতে পারলেন, যে ছেলের ভরসায় কাটালেন, সেই ছেলে তাকে আর দেখবে না, তাদের কোনও দায়িত্ব ও নেবেনা।
সেই সময় রিটায়ারড প্রায় বৃদ্ধ সুজন বাবু আর তার স্ত্রী নমিতার মাঝেমাঝে এমনকি আত্মহত্যার কথাও মাথায় আসত। কখনও আবার ভাবতেন,এতবড় বাড়ী বিক্রি করে কোনও ওল্ড এজ হোমে চলে যাবেন। একাকীত্ব তাদের গ্রাস করেছিল। তেমন বন্ধু বান্ধব কোনও দিন হয়নি। আত্মীয়দের সঙ্গেও যোগাযোগ ক্ষীন।
সেই সময়কার এক শীতের রাতে তাদের নির্ঘুম চোখে দেখতে পেলেন বাড়ীর ঠিক সামনের ফুটপাতে একটি মহিলা তার ছোট শিশুকে নিয়ে কোনমতে একটুখানি জায়গায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে দুজনেই দৌড়ে গেলেন। বাচ্চাটির মনে হল কাঁদারও শক্তি নেই। নির্জীব একটি দুধের শিশু আর তার মাকে বাড়ীর ভেতর নিয়ে এলেন। নমিতা দুজনের জন্য গরম দুধ আর কম্বল নিয়ে এলেন। পরদিন সকালে মহিলার মুখে শুনলেন তার করুণ জীবন কাহিনী। তার মদ্যপ স্বামী আর একটা বিয়ে করে বউ নিয়ে এসে মা মেয়েকে মাঝরাতে বাড়ীর থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনা খুবই কমন। আমাদের সমাজে আকছার ঘটছে। কিন্ত এই ঘটনার অভিঘাতে তাদের দুজনের জীবনের মোড় ঘুরে গেল।
তাদের জীবনে যেন নতুন জোয়ার এল। একটি ছোট শিশু কন্যার কল্যাণে তাদের একঘেয়ে বৈচিত্রহীন জীবন আনন্দে ভরে উঠতে লাগল। সেই মহিলা যার বয়স বেশী না অথচ অপুষ্টি আর অবহেলায় যাকে দেখাত কত বয়স্ক, সেই প্রতিমা তাদের হাল ধরল আর তারা আবার একটা নতুন প্রাণ কে বুকে করে বড় করতে লাগলেন। ভুলে যেতে লাগলেন সব ব্যথা, প্রবাসী ছেলের কথা।
সুজন বাবুর শেষ পর্যায়ের জীবন যাপনে প্রথমবার নিঃস্বার্থ ভালবাসার আবেগ ফুটে উঠল। এতদিন যে জাত্যাভিমান, যে বনেদীয়ানার চালে নিজেদের ঘিরে রেখেছিলেন সব কিছু আবর্জনার মত ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। একবারও ভাবলেন না এই মা মেয়ের জাত কি, ধর্ম কি ? কোন দিন সেকথা জানতেও চাইলেন না। বাচ্চা মেয়েটির দৌলতে তাদের জীবন এখন আলোময়, সে আধো আধো বুলি বলে, এসে জড়িয়ে ধরে। রোজ ঘুম থেকে উঠে ঐ শিশুর মুখ খানা দেখে যে তৃপ্তির স্বাদ পেলেন তা যেন আগে কখনও পাননি।
তবে শুধুমাত্র এখানে থামলেন না। বছর দুই যেতে যেতে আরও দু চারজন এরকম অসহায় দুস্হ মহিলার সন্তান সহ দায়িত্ব নিলেন। তারাও যেন কোথা থেকে খবর পেয়ে তাদের দরজায় এসে দাঁড়াল। ফেলতে পারলেননা।
তার বিপুল সম্পত্তির জন্য একটা ট্রাস্ট তৈরী করলেন, এমনকি তার অবর্তমানেও যাতে এদের দেখাশোনার কাজ হয়, তারা যেন এই আশ্রয় থেকে কখনও বঞ্চিত না হয়, তাদের সন্তানদের কলেজের শিক্ষা যাতে সমাপ্ত হয় সেই ব্যবস্থাও করে দিলেন। সরকারী অনুদান ও যাতে পাওয়া যায়, সেই চেষ্টাও করতে লাগলেন। একে একটি সাহায্যকারী সংস্থা হিসেবে গড়ে তুললেন। নিজের মায়ের নামে নাম রাখলেন। ' গীতা সেবা সংঘ ' ।
এখানে থাকা মোট এইরকম মহিলার সংখ্যা একে একে এখন দশজন । সবাই নিজেদের কন্যাসন্তানকে নিয়ে এদের কাছে থাকে। সমাজে এদের সংখ্যা বিপুল। তাদের মধ্যে কম জনকেই তার সীমিত ক্ষমতায় তিনি সাহায্য করতে পারেন। তাই সুজন বাবু কিছু শর্ত রেখেছিলেন প্রথম থেকেই। মহিলাটিকে একেবারে আশ্রয়হীন, বা প্রকৃতই অনাথ হতে হবে আর তার সন্তান মেয়ে হলে সে প্রাধান্য পাবে।
নমিতা দেবী আর সুজন বাবু এখন বড্ড ভাল আছেন। বাড়ী ভর্তি লোক। মহিলারা তাদের মাসীমা আর মেসোমশাই বলে ডাকে। প্রতিমা সবাইকে আগলে রাখছে । প্রতিমার অশেষ গুণ। তার ধৈর্য, আন্তরিকতা, সততা দেখে তাকেই অনেক কিছুর দায়িত্ব দিয়েছেন।
প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্য মত কিছু না কিছু কাজ করে। এদের যাতে অর্থকরী শিক্ষা দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাও করেছেন। কেউ সেলাই শিখছে, কেউ নানারকম হাতের কাজ শিখছে। এরমধ্যে দুজন পড়াশোনা করতে চাইল তাই তাদের প্রাইভেটে পড়াচ্ছেন, তারা এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। দু একজন তেমন কিছুই শিখতে চায় না । তারা আবার খুব গুছিয়ে সংসার করতে চায় তাই তাদের ওপর ভার দিয়েছেন সব বাচ্চাদের সামলানোর, স্কুলে দেওয়া নেয়া করা ।
সুজন বাবু আর নমিতা দেবীর এখন ভরা সংসার। বাচ্চারা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। তারা যাতে স্বার্থহীন, সৎ পরোপকারী, নির্লোভ হতে পারে, সুজন বাবু আর নমিতা দেবী সেই চেষ্টাই করছেন।
-------------------------------------------