(ফোনে রিংটোন বাজছে দেখেও ফোনটা রেখে দিল, বারবার ফোনটা বাজছে। )
রেবতী // উফ্ ! কি যে করি -- হ্যালো--
হেমন্ত // হ্যালো- হ্যালো- কতক্ষণ ফোনটা করছি ।
রেবতী // হ্যালো -- আচ্ছা তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে , নাঃ পাগল করে ছাড়বে? বারবার ফোন করছ ? তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ---
হেমন্ত // পুপু তোমাকে দেখতে চাইছে ; কাঁদছে-- একটু আসবে ? তুমি--
রেবতী // কোথায় ? নরকে ?
হেমন্ত // নরক !! আচ্ছা তুমি কি ধীর-স্থির ভাবে কথা বলতে পারো না ? শ্বশুরের ভিটেকে নরক বলছ ?
রেবতী // কেন ? তোমার সঙ্গে আমার আর কি সম্পর্ক ? ওগো হ্যাঁগো বলতে আমার বয়েই গেছে । কেন যে মরতে অন্ধ আবেগে তোমার মত কালপ্রীটের হাত ধরেছিলাম । এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভিটেটা নরক নয় তো কি নরককুন্ড ?
হেমন্ত // সব জেনে শুনে আমি তো তোমাকে আগে প্রপোজ করিনি, করেছিলে তুমি ।
রেবতী // সেই জন্য তো বাপ-মায়ের দাসী বাঁদী হয়ে কাটাতে হল । আর আমার ফুলের মত জীবনটার কদর নেই বিসর্জনের বাসি ফুলের মতো নদী খালে ।
হেমন্ত // আমার বাবা মা তোমাকে কোনওদিন অন্যধন্য করেছে ? না তোমাকে মেনে নিতে পারেনি?
রেবতী // আহারে !! মরি মরি । সোনায় সোহাগা করে রেখেছিলে । কেন , রান্না করতে হয়নি ? জল আনতে হয়নি ? ঘর মুছতে হয়নি ? জামা কাপড় পরিষ্কার করতে হয়নি ? না , পাটরানীর মতো বসে বসে খাইয়েছিলে আমাকে ?
হেমন্ত // মফঃস্বলে বেকার স্বামীর ঘরে কোন মেয়ে এসব না করে ? বিয়ের আগে তুমি তো এসব করবে বলে রাজি ছিলে ? এ তো আমি বলিনি, তুমি নিজের মুখে আগ বাড়িয়ে বলোনি ?
রেবতী // বলেছিলাম তো অনেক কিছু । তাহলে ডিভোর্সটা হল কেন ? উম্ -- গাছ উপড়ে গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছে ।
হেমন্ত // না রেবতী। না -না -তুমি যা যা চেয়েছিলে সব সব দিয়েছি । কেবল --
রেবতী // কেবল সঙ্গ দিতে পারোনি ; এই তো ?
হেমন্ত // হ্যাঁ । সেকি ইচ্ছে করেই তোমাকে মা-বাবার কাছে ফেলে বেসরকারি চাকরি নিয়ে ভিন রাজ্যে পড়ে আছি ? তুমি কি জানো না ঘুষ না দিয়েও চাকরিটা যখন বিচারাধীন বাধ্য হয়ে সামান্য বেতনে তোমার জন্য , বাবা -মার জন্য , পুপুর জন্য রোজগার করতে এসেছি । এম. এ. বি. এড. করেও রাজমিস্ত্রী জোগাড়ে কাজ নিয়ে কত প্রতিকূলতার মধ্যে আছি। তুমি কি একবার ভেবেছ ? তুমি আরো সবাইকে ভাবিয়েছো, একবারও ভাবলে না --
রেবতী // ভাবতে হয় তুমি ভাবো, সেই দায় কি আমার ?
হেমন্ত // দায় তোমার নয় ? নিজের পেটের সন্তান দশ মাস দশ দিন পেটে রাখলে তাকে তুমি সঙ্গেই নিলে না! ওর ভবিষ্যৎ ?
রেবতী // কেন, সন্তান কী শুধু আমার ?
হেমন্ত // আমারও । সে কথা বলছি না তো । মায়ের স্নেহ আদর পেলে সুসন্তান হয় । বড় হয় হৃদয়ের স্পর্শ --
রেবতী // তাহলে কাকের বাঁসায় কোকিল ডিম পাড়লেই হলো ? দায়ভার নিতে হবে না ?
হেমন্ত // অনেক নিয়েছি রেবতী। প্লিজ ! তুমি পুপুর কথা ভেবে আর একবার ভেবে দেখো। তুমি মেয়ে- মা হয়ে জগতে --
রেবতী // ভেবে দেখব ? হা-হা-হা মন্দ বলোনি তো ? কোর্টে বল ঠেলতে পারো বেশ , তাইতো ?
হেমন্ত // মা অসুস্থ - অন্ধ -ব্রোঙ্কিও অ্যাজমা ! কোনো কিছু করতে পারেন না । বাবারও তাই । পড়াশোনা করাতে আর চাকরির জন্য টাকা খুইয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন । যাবেন কোথায় ? ছেলের কথা ভেবে ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে ফেলো । আর একবার নতুন করে ভেবে দেখো । খুব টেনশনে আছি ।
রেবতী // না হেমন্ত কুমার দত্ত । অঞ্জন আমাকে তোমার চেয়েও ভালো রাখবে ; সে কথা দিয়েছে । তার বাবা-মা নেতা-নেত্রী উচ্চবিত্ত।
হেমন্ত // শরীরী সুখ ঐশ্বর্য বড় হল ? বিবেক- মান- মনুষ্যত্ব - দায়বদ্ধতা - কর্তব্যবোধ থেকে সরে এসব করে কি ঠিক কাজ করেছ ?
রেবতী // নতুন করে তুমি আমাকে বোঝাতে এসো না ।
হেমন্ত // তোমার অঞ্জন ঘুষ দিয়ে চাকরি করছে । ও ধরা পড়বেই । তারপর, তারপর কোথায় দেখা করতে যাবে ? পার্ক ছেড়ে কি জেলে ?
রেবতী // কেন ? সরকারি চাকরি থেকে কেউ কোনওদিন ছাঁটাই করতে পেরেছে না পারবে ?
হেমন্ত // তোমার ওই অঞ্জন কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে । ওর বাবা সরকারি অফিসার আবার একটা স্বার্থান্বেষী দলের নেতা । ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছে মামলা হাইকোর্টে ঝুলছে। উনি এবার জেলে যাবেনই। গোটা দলের পায়ের নখ থেকে মাথা টিকি অবধি কেষ্ট বিষ্টুরা জেলে ঢুকবে । তুমি যা করছ মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছ। পরে পস্তাতে হবে ;.সাময়িক সুখের জন্য-- রেবতী // দেখো বেশি জ্ঞান দিও না তো । আছে কি তোমার ? অ্যাঁ? তুমি তো বলেছিলে বিয়ের পর সোনার বালা কঙ্কন মতিহার দেবে ; দিয়েছ ? আজও একটা ভালো শাড়ি দিতে পারলে না ।
হেমন্ত // বলেছিলাম-- কিন্তু সরকারি চাকরি হলে নিশ্চয়ই দিতাম । এখানে রাত দিন শুধু তোমাদের জন্য গলদকর্ম হচ্ছি। তুমি যদি দেখতে যে আমি কত কষ্ট করি -- কত পরিশ্রম হয় -- সারারাত ক্লান্তিতে ঘুমোতে পারি না তোমার চিন্তায় । এমন সিদ্ধান্ত কোনও রক্ত মাংসের মানুষ নিতে পারে কিনা আমার সন্দেহ । এ তো নির্মমতা ।
রেবতী// তুমি জানলে কি করে অঞ্জন কোনো মেয়ের সঙ্গে জুটে আছে ? আমি এখানে আছি জানতে পারলাম না-- তুমি ওখানে এত দূরে থেকে জানতে পারলে ? আসলে তুমি আমাকে সরাবার জন্য চাইছো--
হেমন্ত // তোমার দেখার মতো চোখ নেই । যাকে বলে অন্তর্দৃষ্টি । আমি কি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবো অঞ্জন কোন কোন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ? কিন্তু তোমার চোখে পড়েনি ! যে ভালো ছেলে সে কি আনকোরা অবিবাহিত সোমত্ত শিক্ষিত মেয়ে পায় না ? কারণ ও জানে ওর কপালে কেন শত চেষ্টা করেও সেরকম পাবে না । আর তুমি কিনা এক ছেলের মা হয়েও -- একটা অসৎ চরিত্রের ছেলের প্রতি আসক্তি দেখাচ্ছ ! মোহ ভাঙো । বাস্তবের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের আয়নায় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখো।
রেবতী // তুমি অঞ্জনকে চেনো না । এসব শুনলে তোমার আস্ত রাখবে না । সে আমায় বলেছে কোনো মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই । হি ইজ অ্যালোন।
হেমন্ত // বেশ ; তাহলে আমিই তোমাকে ছবিগুলো পাঠাচ্ছি ।
রেবতী // ছবিগুলো পেলে কোথায় ?
হেমন্ত// তোমার মা- বাবা- দাদা পাঠিয়েছে । আমার নিয়মিত কথা হয় ওদের সঙ্গে । ওরাও চায় না তুমি অঞ্জনের হাত ধরে জীবনটা বরবাদ অথবা নষ্ট করো। যখন দই খেয়ে ভাঁড় ফেলবে তুমি তখন যাবে কোথায়? রেবতী// বেশ পাঠাও দেখি । তবে হ্যাঁ, যদি আমি চিনতে পারি তাহলে --
হেমন্ত // হোয়াটসঅ্যাপে দেখার পর তুমি ভেবে দেখো । পুপু আমার শুধু নয় -- আমাদের-- দু'জনের -- সেও কষ্ট পাচ্ছে শুধু শুধু । মানসিক যন্ত্রণা -- একাকীত্ব -- বড় হওয়ার স্বপ্নে হাসিখুশিহীন ।
রেবতী// ঠিক আছে পাঠাও ।
বিরতি
হেমন্ত // গেছে ?
রেবতী// হুম । সেকি !! এ এ তো সেই প্রতিমা ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা ! সনকা! এ তো সেই বস্তির মেয়েটা ! এটা কে দেখি ? উরিবাবা !! এ তো সেই টুম্পা বৌদি ! পাশের বাড়ির বউ । এটা কে ? এ তো সেই শাকিলা ! যাকে তালাক দিয়ে স্বামী মুর্শিদাবাদে চলে গেছে। এটা কে দেখি ? শরমা বলে মনে হয় ? এর বর তো গত বছর ফিশিং ট্রলারে ডুবে মরেছে !! বাব্বা এতগুলো মেয়ের সাথে !!
হেমন্ত // হ্যাঁ । যে ভালো তার কত ভালো দিক দেখো রেবতী।
রেবতী // আমাকে ক্ষমা করো তুমি । আমার ভুল --
হেমন্ত // ক্ষমা ! ক্ষমা না করলে তোমাকে বারবার ফোন করি ? তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমার ক্ষতি চাই না । তোমার পরকীয়া মনোভাবের জন্য সংসার ভেসে যেতে বসেছে ।
রেবতী // পুপু কোথায় ? আমার পুপু --
হেমন্ত // সে এক্ষুণি কাঁদছিল। মাকে এনে দাও -মাকে এনে দাও বলে --
রেবতী // তুমি কি বললে ?
হেমন্ত // সে বলেছে ও মা যদি না আসে অন্য মা এক্ষুণি আনাও আমি মায়ের সাথে থাকবো ।
রেবতী // ওহো তাই ! তুমি কি --
হেমন্ত // মান সম্মান হাটে বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না । তোমার -আমার -আমাদের -মানুষের সম্মানের মূল্য বহু মূল্যবান। আমরা কতজন বুঝি । জীবনসঙ্গী বদলানো যায় মুহুর্মূহু কিন্তু মান সম্মান একবার গেলে সে আর ফিরে আসে না। আমাদের জীবনে বাঁচার পথ-- মসৃণতার বড় অভাব । ভালো-মন্দ সব দিক আছে । সবটা মেনে নেওয়াই জ্ঞানী মানুষের কাজ । সকলেই সুখের হদিস পেতে সুখে থাকতে মাঝে মাঝে হঠকারিতা দেখাই। কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে দেখি না ভবিষ্যতের । পরস্পরে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে চলাই জীবন । তাতেই সুখ সমৃদ্ধি পাওয়া যায় । সমাজে সবাই ভদ্র সৎ রুচিবান নেই ।
রেবতী // তুমি কি পুপুকে নিয়ে গেছ ?
হেমন্ত // ও যে আসতে চাইল । অনেক অনেক খেলনা কিনে দিয়েছি । আমাদের মেসে যে মাসিমা রান্না করে দেন তাঁরই নাতির সঙ্গে খেলা করে আর আমি সারাদিন কাজে চলে যাই । কখনো ওভারটাইম করে রাতে ফিরি ; ও তখন ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি স্নেহ আদরের অভাব যেন গ্রাস করেছে। আমিও তখন ভেঙে পড়ি রেবতী । তুমি বুঝলেনা -- যে রক্তে শিশুর জন্ম দিলে শিশু মনের গভীরে গেলে না এটাই আমার সবথেকে বড় আফসোস ।
রেবত// আর শাশুড়ি -মা শ্বশুর -বাবা ?
হেমন্ত // দেখবে যাও রেবতী মা অন্ধ হয়েও ঠাউরে ঠাউরে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কত কষ্টে দিন যাপন করছেন । একদিন তুমি আমি সকলেই ওই পথের পান্থশালায় এসে থাকব। একবার ভেবেছ তখন কি হবে ?
রেবতী // ভেবেছি । খুউব ভেবেছি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো । আমি সকাল না হতেই ভোরের ট্রেনে বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি না -- ছুটি নিয়ে পুপুকে নিয়ে এসো । ওকে রেখে যাবে । আর ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে আদালতে আইনি জটিলতা কাটাব । তোমাকে কতবার বলেছি তোমাকে ছাড়া আমি একদন্ড থাকতে পারি না ।
হেমন্ত // বলেছ। কিন্তু অর্থ না হলে যে কিছুই হয় না । অর্থ রোজগার করতে তো বিভূঁইয়ে আসা ।
রেবতী // রাখছি । তাহলে ওই কথা --থাকল ।
হেমন্ত// একটা কথা মনে রেখো রেবতী। আমরা শিক্ষিত । সমাজ আমাদের থেকে অনেক কিছু পেতে চায় -- আশা করে । তা বলে খারাপ অরুচি ঘৃণ্য কিছু তো নয় ।
রেবতী // রাখছি । তুমি ঘুমাও । আমি আসছি ।
================================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা