বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

শ্রুতি নাটক ।। পুপুর কান্না ।। সুদামকৃষ্ণ মন্ডল

 

  ছবি - সংগৃহীত ।

 

             পুপুর কান্না    ( শ্রুতি নাটক )

সুদামকৃষ্ণ মন্ডল 


(ফোনে রিংটোন বাজছে দেখেও ফোনটা রেখে দিল,  বারবার ফোনটা বাজছে। )

রেবতী //  উফ্ !  কি যে করি -- হ্যালো--
হেমন্ত //  হ্যালো- হ্যালো- কতক্ষণ ফোনটা করছি ।       
রেবতী // হ্যালো -- আচ্ছা তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ,  নাঃ পাগল করে ছাড়বে?  বারবার ফোন করছ ? তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ---        
হেমন্ত //  পুপু তোমাকে দেখতে চাইছে  ;  কাঁদছে--  একটু আসবে  ? তুমি--
রেবতী //  কোথায় ? নরকে ?
হেমন্ত  // নরক !! আচ্ছা তুমি কি ধীর-স্থির ভাবে কথা বলতে পারো না ? শ্বশুরের ভিটেকে নরক বলছ ?
রেবতী //  কেন ? তোমার সঙ্গে আমার  আর কি সম্পর্ক ? ওগো হ্যাঁগো বলতে আমার বয়েই গেছে ।  কেন যে মরতে অন্ধ আবেগে তোমার মত কালপ্রীটের হাত ধরেছিলাম । এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভিটেটা নরক নয় তো কি নরককুন্ড ?
হেমন্ত //  সব জেনে শুনে আমি তো তোমাকে আগে প্রপোজ করিনি, করেছিলে তুমি ।
রেবতী //  সেই জন্য তো বাপ-মায়ের দাসী বাঁদী হয়ে কাটাতে হল । আর আমার ফুলের মত জীবনটার কদর নেই  বিসর্জনের বাসি ফুলের মতো নদী খালে ।
হেমন্ত //  আমার বাবা মা তোমাকে কোনওদিন অন্যধন্য  করেছে  ? না তোমাকে মেনে নিতে পারেনি?
রেবতী //  আহারে !! মরি মরি । সোনায় সোহাগা করে রেখেছিলে । কেন , রান্না করতে হয়নি ?  জল আনতে হয়নি ? ঘর মুছতে  হয়নি  ? জামা কাপড় পরিষ্কার করতে হয়নি ? না , পাটরানীর মতো বসে বসে খাইয়েছিলে আমাকে ?
হেমন্ত // মফঃস্বলে বেকার স্বামীর ঘরে কোন মেয়ে  এসব না করে ?  বিয়ের আগে তুমি তো এসব করবে বলে রাজি ছিলে ? এ তো আমি বলিনি, তুমি নিজের মুখে আগ বাড়িয়ে বলোনি ? 
রেবতী //  বলেছিলাম তো অনেক কিছু । তাহলে ডিভোর্সটা হল কেন ? উম্ --  গাছ উপড়ে গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছে ।
হেমন্ত // না রেবতী।  না -না -তুমি যা যা চেয়েছিলে সব সব দিয়েছি  । কেবল --
রেবতী //  কেবল সঙ্গ দিতে পারোনি  ;  এই তো ?         
হেমন্ত //  হ্যাঁ । সেকি  ইচ্ছে করেই তোমাকে মা-বাবার কাছে ফেলে বেসরকারি চাকরি নিয়ে ভিন রাজ্যে পড়ে আছি ?  তুমি কি জানো না ঘুষ না দিয়েও চাকরিটা যখন বিচারাধীন বাধ্য হয়ে সামান্য বেতনে তোমার জন্য , বাবা -মার জন্য ,  পুপুর জন্য রোজগার করতে এসেছি । এম. এ. বি. এড. করেও রাজমিস্ত্রী জোগাড়ে কাজ নিয়ে কত প্রতিকূলতার মধ্যে আছি। তুমি কি একবার ভেবেছ ?  তুমি  আরো সবাইকে ভাবিয়েছো, একবারও ভাবলে না --
রেবতী //  ভাবতে হয় তুমি ভাবো,  সেই দায় কি আমার ?
হেমন্ত // দায়  তোমার নয় ? নিজের পেটের সন্তান দশ মাস দশ দিন পেটে রাখলে তাকে তুমি সঙ্গেই নিলে না!  ওর ভবিষ্যৎ ?
রেবতী // কেন,  সন্তান কী শুধু আমার ?
হেমন্ত //  আমারও ।  সে কথা বলছি না তো । মায়ের স্নেহ আদর পেলে  সুসন্তান হয় । বড় হয় হৃদয়ের স্পর্শ --
রেবতী // তাহলে কাকের বাঁসায় কোকিল ডিম পাড়লেই হলো ? দায়ভার  নিতে হবে না ?
হেমন্ত // অনেক  নিয়েছি রেবতী।  প্লিজ ! তুমি পুপুর কথা ভেবে আর একবার ভেবে দেখো।  তুমি মেয়ে- মা হয়ে জগতে --
রেবতী //  ভেবে দেখব ? হা-হা-হা মন্দ বলোনি তো ?  কোর্টে বল ঠেলতে পারো বেশ , তাইতো ?
হেমন্ত //  মা অসুস্থ - অন্ধ -ব্রোঙ্কিও অ্যাজমা !  কোনো কিছু করতে পারেন না । বাবারও তাই । পড়াশোনা করাতে আর চাকরির জন্য টাকা খুইয়ে  দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন । যাবেন কোথায় ? ছেলের কথা ভেবে ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে ফেলো ।  আর একবার নতুন করে ভেবে দেখো । খুব টেনশনে আছি ।
রেবতী // না হেমন্ত কুমার দত্ত ।  অঞ্জন আমাকে তোমার চেয়েও ভালো রাখবে ; সে কথা দিয়েছে ।  তার বাবা-মা নেতা-নেত্রী উচ্চবিত্ত।
হেমন্ত //  শরীরী সুখ ঐশ্বর্য বড় হল ? বিবেক-  মান-  মনুষ্যত্ব - দায়বদ্ধতা - কর্তব্যবোধ থেকে সরে এসব করে কি ঠিক কাজ করেছ ?
রেবতী  //  নতুন করে তুমি আমাকে বোঝাতে এসো না  ।
হেমন্ত // তোমার অঞ্জন ঘুষ দিয়ে চাকরি করছে । ও ধরা পড়বেই । তারপর, তারপর  কোথায় দেখা করতে যাবে ? পার্ক ছেড়ে কি জেলে ?
রেবতী  // কেন ? সরকারি চাকরি থেকে কেউ কোনওদিন ছাঁটাই করতে পেরেছে না পারবে ?
হেমন্ত //  তোমার ওই অঞ্জন কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে । ওর বাবা সরকারি অফিসার আবার একটা স্বার্থান্বেষী দলের নেতা । ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছে মামলা হাইকোর্টে ঝুলছে। উনি এবার জেলে যাবেনই।  গোটা দলের পায়ের নখ থেকে মাথা টিকি অবধি কেষ্ট বিষ্টুরা জেলে ঢুকবে । তুমি যা করছ মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছ।  পরে পস্তাতে হবে  ;.সাময়িক সুখের জন্য--  রেবতী // দেখো বেশি জ্ঞান দিও না তো । আছে কি তোমার ?  অ্যাঁ? তুমি তো বলেছিলে বিয়ের পর সোনার বালা কঙ্কন  মতিহার দেবে  ; দিয়েছ ?  আজও একটা ভালো শাড়ি দিতে পারলে না ।
হেমন্ত //  বলেছিলাম--  কিন্তু সরকারি চাকরি হলে নিশ্চয়ই দিতাম । এখানে রাত দিন শুধু তোমাদের জন্য গলদকর্ম হচ্ছি। তুমি যদি দেখতে যে আমি কত কষ্ট করি -- কত পরিশ্রম হয় -- সারারাত ক্লান্তিতে ঘুমোতে পারি না তোমার চিন্তায় ।  এমন সিদ্ধান্ত কোনও রক্ত মাংসের মানুষ নিতে পারে কিনা আমার সন্দেহ ।  এ তো  নির্মমতা ।
রেবতী//  তুমি জানলে কি করে অঞ্জন কোনো মেয়ের সঙ্গে জুটে আছে ? আমি এখানে আছি জানতে পারলাম না-- তুমি ওখানে এত দূরে থেকে জানতে পারলে ? আসলে তুমি আমাকে সরাবার জন্য চাইছো--  
  হেমন্ত // তোমার দেখার মতো চোখ নেই ।  যাকে বলে অন্তর্দৃষ্টি । আমি কি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবো অঞ্জন কোন কোন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ?  কিন্তু তোমার চোখে পড়েনি ! যে ভালো ছেলে সে কি আনকোরা  অবিবাহিত সোমত্ত  শিক্ষিত মেয়ে পায় না ?  কারণ ও জানে ওর কপালে কেন শত চেষ্টা করেও সেরকম পাবে না । আর তুমি কিনা এক ছেলের মা হয়েও --  একটা অসৎ চরিত্রের ছেলের প্রতি আসক্তি দেখাচ্ছ ! মোহ ভাঙো । বাস্তবের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের আয়নায় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখো।
রেবতী // তুমি অঞ্জনকে চেনো না । এসব শুনলে তোমার আস্ত রাখবে না । সে আমায় বলেছে কোনো মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই । হি ইজ অ্যালোন।         
  হেমন্ত //  বেশ ;  তাহলে আমিই তোমাকে ছবিগুলো পাঠাচ্ছি ।
রেবতী  // ছবিগুলো পেলে কোথায় ?
হেমন্ত//  তোমার মা- বাবা- দাদা পাঠিয়েছে । আমার  নিয়মিত কথা হয় ওদের সঙ্গে ।  ওরাও চায় না তুমি অঞ্জনের হাত ধরে জীবনটা বরবাদ অথবা নষ্ট করো।  যখন দই খেয়ে  ভাঁড় ফেলবে তুমি তখন যাবে কোথায়? রেবতী//  বেশ পাঠাও দেখি । তবে হ্যাঁ, যদি আমি চিনতে পারি তাহলে --
হেমন্ত //  হোয়াটসঅ্যাপে দেখার পর তুমি ভেবে দেখো । পুপু আমার শুধু নয় -- আমাদের--  দু'জনের -- সেও  কষ্ট পাচ্ছে  শুধু শুধু । মানসিক যন্ত্রণা -- একাকীত্ব -- বড় হওয়ার স্বপ্নে হাসিখুশিহীন ।
রেবতী//  ঠিক আছে পাঠাও ।

                বিরতি

হেমন্ত // গেছে ?
রেবতী//  হুম ।  সেকি !!  এ এ তো সেই প্রতিমা ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা !  সনকা!  এ তো সেই  বস্তির মেয়েটা  ! এটা কে দেখি  ?  উরিবাবা !! এ তো সেই টুম্পা বৌদি ! পাশের বাড়ির বউ । এটা কে ? এ তো সেই শাকিলা !  যাকে তালাক দিয়ে স্বামী মুর্শিদাবাদে চলে গেছে। এটা কে দেখি  ? শরমা বলে মনে হয় ? এর বর তো গত বছর ফিশিং ট্রলারে ডুবে মরেছে  !! বাব্বা এতগুলো মেয়ের সাথে !!
হেমন্ত // হ্যাঁ । যে ভালো তার কত ভালো দিক দেখো রেবতী।
রেবতী // আমাকে ক্ষমা করো তুমি । আমার ভুল --
হেমন্ত //  ক্ষমা ! ক্ষমা না করলে তোমাকে বারবার ফোন করি ? তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমার ক্ষতি চাই না । তোমার পরকীয়া মনোভাবের জন্য সংসার ভেসে যেতে বসেছে ।
রেবতী // পুপু  কোথায় ?  আমার পুপু --
হেমন্ত // সে এক্ষুণি কাঁদছিল।  মাকে এনে দাও -মাকে এনে দাও বলে --
রেবতী // তুমি কি বললে ?
হেমন্ত // সে বলেছে ও মা যদি না আসে অন্য মা এক্ষুণি আনাও আমি মায়ের সাথে থাকবো ।
রেবতী //  ওহো তাই ! তুমি কি --
হেমন্ত // মান সম্মান হাটে বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না । তোমার -আমার -আমাদের -মানুষের সম্মানের মূল্য বহু মূল্যবান।  আমরা কতজন বুঝি । জীবনসঙ্গী বদলানো যায় মুহুর্মূহু  কিন্তু মান সম্মান একবার গেলে সে আর ফিরে আসে না। আমাদের  জীবনে বাঁচার পথ-- মসৃণতার বড় অভাব । ভালো-মন্দ সব দিক আছে । সবটা মেনে নেওয়াই জ্ঞানী মানুষের কাজ ।  সকলেই  সুখের হদিস পেতে সুখে থাকতে মাঝে মাঝে হঠকারিতা দেখাই।  কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে দেখি না ভবিষ্যতের । পরস্পরে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে চলাই জীবন । তাতেই  সুখ সমৃদ্ধি পাওয়া যায় ।  সমাজে সবাই ভদ্র সৎ রুচিবান নেই ।
রেবতী //  তুমি কি পুপুকে নিয়ে গেছ ?
হেমন্ত // ও যে আসতে চাইল ।  অনেক অনেক খেলনা কিনে দিয়েছি । আমাদের মেসে যে মাসিমা রান্না করে দেন তাঁরই নাতির সঙ্গে খেলা করে আর আমি সারাদিন কাজে চলে যাই । কখনো ওভারটাইম করে রাতে ফিরি ;  ও তখন ঘুমিয়ে পড়ে।  ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি স্নেহ আদরের অভাব যেন গ্রাস করেছে।  আমিও তখন ভেঙে পড়ি  রেবতী । তুমি বুঝলেনা -- যে রক্তে শিশুর জন্ম দিলে শিশু মনের গভীরে গেলে না এটাই আমার সবথেকে বড় আফসোস ।
রেবত//  আর শাশুড়ি -মা শ্বশুর -বাবা ?
হেমন্ত // দেখবে যাও রেবতী  মা অন্ধ হয়েও ঠাউরে  ঠাউরে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কত কষ্টে দিন যাপন করছেন । একদিন তুমি আমি সকলেই ওই পথের পান্থশালায় এসে থাকব।  একবার ভেবেছ তখন কি হবে ?
রেবতী //  ভেবেছি । খুউব ভেবেছি।  তুমি নিশ্চিন্তে থাকো । আমি সকাল না হতেই ভোরের ট্রেনে বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি না -- ছুটি নিয়ে পুপুকে নিয়ে এসো । ওকে রেখে যাবে । আর ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে আদালতে আইনি জটিলতা কাটাব । তোমাকে কতবার বলেছি তোমাকে ছাড়া আমি  একদন্ড থাকতে পারি না ।          
হেমন্ত // বলেছ।  কিন্তু অর্থ না হলে যে কিছুই হয় না ।  অর্থ রোজগার করতে তো বিভূঁইয়ে আসা ।
রেবতী //  রাখছি । তাহলে ওই কথা --থাকল ।
হেমন্ত//  একটা কথা মনে রেখো রেবতী।  আমরা শিক্ষিত । সমাজ আমাদের থেকে অনেক কিছু পেতে চায় --  আশা করে । তা বলে খারাপ অরুচি ঘৃণ্য কিছু তো নয় ।
রেবতী //  রাখছি । তুমি ঘুমাও । আমি আসছি ।
================================

সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.